সামিট-ইউনাইটেডসহ ১৫৮ বিদ্যুৎকেন্দ্রের নথি নিল দুদক, ক্যাপাসিটি চার্জের নামে লুটপাট ১ লাখ কোটি

পতিত সরকারের আমলে বিদ্যুৎখাতে হঠাৎ ফুলে ফেঁপে ওঠা ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড বা ইউপিজিডিসিএল, সামিট পাওয়ার লিমিটেডসহ ১৫৮টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যাবতীয় নথি নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন—দুদক। এসব নথিতে দেখা গেছে, গত ১৫ বছরে বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে চলেছে হরিলুট। এসময় বিদ্যুৎখাতে মোট ব্যয় হয়েছে পৌনে ৪ লাখ কোটি টাকা (২ হাজার ৮৩০ কোটি ডলার)। যার মধ্যে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জের নামে আত্মসাৎ হয়েছে এক লাখ কোটি টাকা। এছাড়া এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা দেখানো হয়েছে ২৩ হাজার ৫৮৪ মেগাওয়াট।
দুদক সূত্র বলছে, সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ঘুষ গ্রহণ, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে প্রকল্প পাস করানো, সরকারি জমি দখল এবং ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। দুদক অনুসন্ধানের স্বার্থে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড—বিউবোর কাছে এসব নথি তলব করেছিল।
একইসঙ্গে বিউবোতে দুদকের পাঠানো চিঠিতে ভারতের বাহারামপুর থেকে ১ হাজার মেগাওয়াট ও ত্রিপুরা থেকে ১৬০ মেগাওয়াট ও ঝাড়খণ্ডে আদানি পাওয়ার থেকে ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির নথিও সংগ্রহ করা হয়েছে।
দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম জানিয়েছেন, দুদক যেসব নথি চেয়েছিল বিউবো সেগুলো সরবরাহ করেছে। বিদ্যুৎ খাতের অনিয়ম এবং অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি তদন্তের জন্য এসব নথি নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে বিদ্যুৎ খাতের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ক্রয়, ভূমি অধিগ্রহণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে ভয়াবহ অনিয়ম ও লুটপাট হয়েছে। বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ সক্ষমতায় ব্যবহার করা হবে- এমন শর্তে লাইসেন্স দেওয়া হয়। কিন্তু এসব কেন্দ্র চলেছে গড়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ সক্ষমতা নিয়ে। কেন্দ্রগুলো বছরের ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে অলস বসে ছিল। প্রয়োজন না থাকলেও অতিরিক্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়। উচ্চমূল্যের এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে বছরের পর বছর ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীগোষ্ঠীর পকেটে ঢোকে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের আগে দরপত্রের মাধ্যমে আটটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। পরে বিনা দরপত্রে ৩২টি কুইক রেন্টাল কেন্দ্র নির্মাণ করে। দরপত্র এড়াতে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে দুই বছরের জন্য পাস করা হয় জরুরি বিশেষ আইন। আইনটির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে সর্বশেষ ২০২৬ সাল পর্যন্ত করা হয়।
এই আইনের অধীনে ৭২টি রেন্টাল ও ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) কেন্দ্রের অনুমতি দেওয়া হয়। বিনা দরপত্রে প্রতিযোগিতা ছাড়াই এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বড় অংশই পেয়েছেন তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে রয়েছে- সামিট, ওরিয়ন, ইউনাইটেড, দেশ এনার্জি, ডরিন পাওয়ার এবং এনার্জিপ্যাক।
সামিট ও ইউনাইটেড পাওয়ার বেশি ক্ষমতা দেখিয়েছে:
বিনা দরপত্রে বিদ্যুৎ কেন্দ্র পাওয়ার শীর্ষে রয়েছে সামিট গ্রুপ। সামিটের সাতটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভাড়া পেয়েছে ১ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। আর দ্বিতীয় স্থানে আছে ইউনাইটেড গ্রুপের পাঁচটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। তারা পেয়েছে ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা।
বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড পাওয়ার নিয়মবহির্ভূত সুবিধা নিয়ে বিদ্যুৎখাতে লুটপাট চালিয়েছে। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের আপত্তি ও আদালতে আবেদন নাকচ হওয়ার পরও বিশেষ সুবিধায় কম দামে গ্যাস কেনা এবং বেআইনিভাবে ইপিজেডের বিভিন্ন কারখানায় বিদ্যুৎ বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। অনেক ক্ষেত্রে তারা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে ব্যবহার করে। এছাড়া সাবেক সেনাপ্রধান আব্দুল মুবিনও এসব কাজে ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। ইউনাইটেড পাওয়ার শুধু তাদের ঢাকার ইপিজেড এলাকায় ৮৬ মেগাওয়াট ও চট্টগ্রাম ইপিজেডে ৭২ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে হাজার কোটি টাকা মুনাফা লুটেছে। তারা প্রতি ঘনমিটারে গ্যাস কিনছে ১৬.৭৫ টাকা দরে কিন্তু একই গ্যাস অন্যান্য বিদ্যুৎ কোম্পানির কিনতে হচ্ছে ৩০.৭৫ টাকায়।
তথ্য বলছে, গ্যাস দিয়ে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ৪.১৭ টাকা, সেই বিদ্যুৎ ইউনাইটেড ১০.৮৮ টাকা দরে বিক্রি করছে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে।
সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীকে জমি ঘুষ:
সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি-এপিএসসিএলের তৎকালীন চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আলম মিলে ইউনাইটেড পাওয়ারকে নানান অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ করে দেয়। যার নেপথ্যে থেকে সবাইকে সহায়তা করেন সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ। যিনি আওয়ামী লীগ আমলের বিদ্যুৎ খাত নিয়ন্ত্রণ করতেন। প্রতিমন্ত্রী বিপুকে ঘুষ হিসেবে রাজধানীর মাদানি অ্যাভিনিউর ১০০ ফিট সড়কের পাশে অবস্থিত ৮০ কাঠা জমি দেওয়া হয়। যার বর্তমান মূল্য দেড়শ কোটি টাকার বেশি।
(ঢাকাটাইমস/১৩মে/এসএস/এমআর)

মন্তব্য করুন