কেন টাকা দিলেই সব করতে রাজি ওরা?

পুলক রাজ, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ১৭ জুন ২০২২, ১৩:৫৩
অ- অ+

নেই বাপ, নেই মা, থাকি ফুটপাতে, পেট চালাই বোতল কুড়িয়ে বিক্রি করে। আমার বয়স কতো জানি না, কেউ বলে ১০ বছর, কেউ বলে আট বছর। আমাকে মানুষ বিভিন্ন নাম ধরে ডাকে। যেমন টোকাই, পিচ্চি- আরও অনেক নাম আছে আমার। আমি প্রায় এক বছর আগে মগবাজারের একটা মোটরসাইকেলের দোকানে চাকরি করতাম। মালিক আমাকে মা-বাপ তুলে গালাগালি, মারধর করতো।

পথশিশু মুসাফির কান্না করে ঢাকা টাইমসকে এসব কথা বলেন।

মুসাফির বলেন, ‘মটরসাইকেলের ভারী ভারী যন্ত্রপাতি আমার মাধ্যমে দোকানে তুলতো মালিক। আমার খুব কষ্ট লাগতো। দোকানের মালিক একদিন দুপুরে আমাকে মারধর করেছে। মারধর করার কারণ, মালিকের অন্য দোকানের যন্ত্রপাতি নিয়ে আসতে দেরি হয়েছিলে।’

মুসাফির বলেন, ‘মালিকের পা ধরে মাপ চেয়েছি যে আমার কোনো দোষ নেই। মালিক কোনোভাবেই মানতে রাজি না। মগবাজার এলাকার মানুষ দাঁড়িয়ে মারধর দেখেছে। ওইদিনই মোটরসাইকেলের দোকান ছেড়ে এসেছি। পেটের ক্ষুধা মেটাতে রিকশা চালিয়েছি প্রায় একমাস। শরীরে মানেনা রিকশা চালাতে। শেষ পর্যন্ত দেখলাম আমার আর এসব করলে চলবে না। এখন রিকশাও চালাইনা, কারো কাজও করিনা। ডাস্টবিন, ময়লার ভাগার, ফুটপাতে থাকা বোতলসহ প্লাস্টিকের জিনিসপত্র টোকাই এবং বিক্রি করে পেটের ক্ষুধা মেটাই।’

পথশিশুরা অন্য সাধারণ শিশুদের মতো নয়। এ বয়সে শিশুরা মায়ের আদরে, স্কুলে পড়াশোনায় মেতে থাকে। অন্যসব শিশর মতো পথশিশুদেরও পেটের ক্ষুধা মেটাতে পাশে কেউ থাকতে পারত। পরিবার পরিজনের সঙ্গে অটুট বন্ধনে থাকতে পারত এই শিশুরা। কিন্তু নিয়তির ফেরে এসব কিছুই পাওয়া হয় না তাদের।

ওরা হাটে ঘাটে মাঠে, রেলস্টেশনে, বাসস্টেশনে, পথে পথে ঘোরে। ওরা রাত হলে ফুটপাতে বা ফুটওভার ব্রিজে ঘুমায়। ঝড় বৃষ্টি দিনেও পথে থাকতে হয়। যে কাপড় ভিজে সেই কাপড় শরীরে থাকা অবস্থায় শুকায়। জীবিকার পথ রাস্তায়ই বেছে নেয় ওরা। ওরা ছিন্নমূল পথশিশু, ওরাই টোকাই।

কিন্তু ওরা কেন পথশিশু? ওদের জন্য রাষ্ট্র বা সমাজের কি কোনো দায় নেই?

রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলি ও মোড় ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, বিমানবন্দর রেলস্টেশন, পলাশী মোড়, কমলাপুর রেলস্টেশন, টঙ্গি রেলস্টেশন, হাইকোর্ট মাজার, চাঁনখারপুল, দোয়েল চত্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ঢাকা মেডিক্যাল, গাবতলী, শহীদ মিনার, সদরঘাট ও বিভিন্ন ফুটওভার ব্রিজ এলাকায় পথশিশুদের দেখা মেলে বেশি।

রাত যত গভীর হয় ওরা নেশায় মগ্ন হয়। এই ছোট ছোট পথশিশুদের এক হাতে ভাঙারির বস্তা অন্য হাতে পলিথিন, সেই পলিথিনে জুতার আঠা ভরে গন্ধ শুঁকে নেশা করে। এসব নেশার নাম দিয়েছে ড্যান্ডি।

কারওয়ান বাজার পেট্রোবাংলার সামনে দুই পথশিশুর সঙ্গে আলাপ জমিয়ে জানা গেল, রাজধানীর যেকোনো এলাকায় রাত হলেই তারা ফুটওভার ব্রিজ বা ফুটপাতে ঘুমিয়ে রাত পার করে। দিনে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে বোতল, প্লাস্টিকের জিনিস, লোহা- এসব প্রতিদিন সংগ্রহ করে ভাঙারি দোকানে বিক্রি করে। তবে রাত যত গভীর হয় ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে ড্যান্ডিতে আসক্ত হয়ে পড়ে এইসব পথশিশু।

প্রায় ১২ বছর বয়সের পথশিশু দোয়েল মিয়া ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের পড়াশোনার কোনো ব্যবস্থা নেই। আমরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছি। আমাদের থাকার কোনো ঠিকানা নেই। আমাদের থাকার জায়গা ফুটপাত, ফেরিঘাট লঞ্চটার্মিনাল, রেলস্টেশন, বাসস্টেশন। আমাদের জন্য সরকার থেকে নির্দিষ্ট জায়গার ব্যবস্থা করা হোক। তাহলে আমার মতো হাজার হাজার পথশিশু একটু শান্তিতে থাকতে পারবে।’

পথশিশু অনিক মিয়া ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমি দিনে বোতলসহ ভাঙারির জিনিসপত্র সংগ্রহ করে বিক্রি করি। প্রতিদিন প্রায় দেড়শ বা দুইশ টাকা রুজি করি। ঘুমাই খোলা আকাশের নিচে যেখানে রাত সেখানেই ঘুম। আমার মতো অনেক পথশিশু বিভিন্ন ধরনের খারাপ কাজে জড়িত। কিছু করার নাই রাস্তায় থাকলে এর চেয়ে ভালো আর কী কাজ করা যায়।’

পথশিশু পারভীন আক্তার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমার কেউ নাই। আমি থাকি রেলস্টেশনে। রেলস্টেশনে বিভিন্ন ধরনের কাজ করি। যেমন মানুষের জিনিসপত্র তুলে দেই ট্রেনে, এর পাশাপাশি আমাকে দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খারাপ কাজ করাতে চায় মানুষ। আমাদের কোনো ধরনের নিজস্বতা নেই। মানুষ আমাদের খারাপ বানায়। আমরা মানুষের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে চাই না। মানুষই আমাদের খারাপ খারাপ কথা বলে। তখন আমরাও বসে থাকি না। আমার মতো হাজার হাজার পথশিশুর থাকার ঠিকানা নেই। সরকার থেকে আমাদের জন্য যদি একটু থাকার ব্যবস্থা করে দিতো। তাহলে আমার মতো মেয়েদের এই পথে আর চলতে হতো না।’

পথশিশু বাবুল মিয়া ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘পথশিশুরা প্রতিদিন ক্রাইমের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। আমি নিজেই টাকা দিলে সব করতে রাজি, কারণ হলো আমার পেটে ক্ষুধা। আমার নেই থাকার জায়গা। কেউ যদি বলে তোর বাপ-মার নাম কী? এর উত্তর দিতে পারি না। তখন কান্না আসে।’

(ঢাকাটাইমস/১৭জুন/পিআর/এফএ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
যশোরে ঢালাইয়ের সময় ছাদ ভেঙে দুই প্রকৌশলীসহ নিহত ৩
এক ডিআইজি ও তিন এসপিকে চাকরি থেকে বরখাস্ত
জুলাইকে সবার গণজাগরণ ও ঐক্যের মাসে পরিণত করার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কার্টুন প্রকাশের অভিযোগে তুরস্কে সংঘর্ষ, গ্রেপ্তার ৪ জন
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা