মৃত্যুঞ্জয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল

কানিস রহমান
  প্রকাশিত : ০৪ আগস্ট ২০২২, ২৩:৩৪
অ- অ+

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল। ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।তিনি ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাঁচ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। আজ বীর মুক্তিযোদ্ধা কেপ্টেন শেখ কামালের ৭৪তম শুভ জন্মদিন।

বিচিত্র এ জগতের লীলাখেলা যে মাসে জন্ম সে মাসেই মৃত্যু। আজ তার জন্মদিনে বিজয় উৎসব করব না নির্মম হত্যাকাণ্ডের শোক পালন করব। জন্মদিনের কথা মনে হলে হৃদয়ে বাজে আনন্দের হিল্লোল। ঠিক তাৎক্ষণিক হৃদয়ের গভীরে রক্তক্ষরণ বয়ে চলার শব্দ শোনা যায়।

তারপরও এ মানুষটি নিয়ে আজ লিখতে হবে। না লিখলে অনেক অজানা অজানাই থেকে যাবে। শেখ কামাল একটি নাম। জাতির জনকের পুত্র। শেষ হয়ে গেল তাঁর পরিচয়! না শেখ কামাল একটি প্রতিষ্ঠান। যে নাকি পিতার পরিচয়ে পরিচিত হবার পাশাপাশি নিজের একটি জায়গা তৈরি করেছিল এদেশের মানুষের মনের মনিকোঠায়।

তিনি যেমন মেধাবী ছাত্র ছিলেন ঠিক তেমনি মেধাবী একজন সংগঠকও ছিলেন। রাজনীতি, সমাজনীতি, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলেও তাঁর বিচরণ ছিল অবারিত। এই মানুষটির জন্ম ১৯৪৯ সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় হলেও পড়ালেখা করেছেন ঢাকায়। ঢাকার সেগুনবাগিচার ডন্স স্কুলে পড়ালেখা করেছেন, পরে শাহীন স্কুল থেকে ১৯৬৭ সালে এসএসসি এবং ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে এইচএসসি পাস করেন। আর একই বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। তিনি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে বাংলার আপামর জনতার মুক্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীর এডিসি (এইড-দ্য-ক্যাম্প) হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে সামরিক বাহিনী থেকে অব্যহতি দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে লেখাপড়া ও দেশ গঠনে মনোনিবেশ করেন। রাজনীতি, সমাজিক কর্মকান্ড, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড সর্বক্ষেত্রে বিচরন করেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা অব্যাহত রাখেন। ইতিমধ্যে তাঁর খ্যাতি ও কর্মপরিসর বিস্তৃতি লাভ করে আর তাঁর মাথায় নানাবিধ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও দেশগঠনমূলক চিন্তা প্রসার লাভ করে। ১৯৭৪ সালে তিনি সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক(সম্মান) পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান অর্জন করেন। আর ১৯৭৫ সালে এমএসএস(সমাজবিজ্ঞান) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং মৃত্যুর মাত্র কয়েক দিন আগে মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেন। শেখ কামালের মৃত্যুর পর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয় এবং তাঁর নব পরিণীতা স্ত্রী সুলতানা কামাল খুকীও কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন।

একদম সাদামাটাভাবে জীবন যাপনে অভ্যস্ত শেখ কামাল ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। তিনি ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ কর্মী ও সংগঠক হিসেবে ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন।

তাইতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জনাব তোফায়েল আহমেদ এমপি বলেন "ঊনসত্তরে পাকিস্তান সামরিক জান্তা সরকার ধর্মীয় উগ্রতার পরিচয় দিয়ে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করে। শেখ কামাল তখন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের সংগঠিত করেন এবং রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি খ্যাতিমান শিল্পী জাহিদুর রহিমকে দিয়ে বিভিন্ন সভা ও অনুষ্ঠানে গাওয়ানোর উদ্যোগ নেন।

বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতার সন্তান তিনি, জন্ম থেকেই তার ধমনীতে নেতৃত্বগুণ আর বাঙালি জাতীয়তাবোধের চেতনা। সংস্কৃতিবান শেখ কামালের প্রতিবাদের ভাষা ছিল রবীন্দ্রসংগীত। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে যখন যেখানে সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেই বিশ্বকবির গান গেয়ে অহিংস প্রতিবাদের অসাধারণ উদাহরণ রেখেছেন।"

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে শেখ কামালের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল নিরন্তর। তিনি ছায়ানট থেকে সেতারের উপর তালিম গ্রহণ করেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি সংগীতচর্চা, অভিনয়, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও উপস্থিত বক্তৃতাসহ বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতিকে বিশ্ববাসির কাছে উপস্থাপন করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন শেখ কামাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যাঙ্গনে শেখ কামাল ছিলেন সুপরিচিত সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সংগঠক এবং অভিনেতা। আবাহনী ক্রীড়াচক্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি দেশের ক্রীড়াঙ্গনে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ‘স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী’র প্রতিষ্ঠাও তাঁকে অমরত্ব দান করেছে। প্রকৃতপক্ষে শেখ কামাল ছিলেন একজন ক্রীড়া ও সংস্কৃতিমনস্ক সুকুমার মনোবৃত্তির বৃহৎ হৃদয়ের মানুষ। শেখ কামাল কখনো কোন বানিজ্যিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়াননি। সাধারণ জীবন যাপন করার ফলে অর্থের পিছনে কখনো ছুটেননি। ছাত্র থাকাকালে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের খেলাধুলায় শেখ কামাল ছিলেন অপরিহার্য অংশ। তার মধ্যে ক্রিকেট ছিল তাঁর প্রিয় খেলা। তৎকালিন সময়ে অন্যতম উদীয়মান পেসার ছিলেন তিনি। তখন শেখ কামালদের মতো উঠতি প্রতিভাবানদের আশ্রয়স্থল ‘আজাদ বয়েজ ক্লাব’। এখানেই শেখ কামাল প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন দীর্ঘদিন। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ‘আবাহনী সমাজকল্যাণ সংস্থা’ প্রতিষ্ঠা করেন। ফুটবল দল ‘ইকবাল স্পোর্টিং’, আর ক্রিকেট, হকির দল ‘ইস্পাহানী স্পোর্টিং’আবাহনী সমাজকল্যাণ সংস্থার নামে সংগঠিত করেন। পরে এসব দলের সমন্বয়ে যাত্রা শুরু হয় ‘আবাহনী ক্রীড়া চক্র’। যা আজ বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের একটি অপরিহার্য অংশ।

তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন ভালো মানুষ। রাষ্টপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পুত্র হওয়া সত্বেও তাঁর মধ্যে কোন প্রকার অহংবোধ কাজ করেনি। সাধারণ মানুষের মত জনসাধারণের সাথে মিশে থাকার পথচলার সহজাত প্রবৃত্তি তার মধ্যে ছিল। তাইতো শেখ কামাল এর আচরণ সম্পর্কে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবুল ফজল তাঁর রচিত 'শেখ মুজিব: তাঁকে যেমন দেখেছি' গ্রন্থে লিখেছেন, “১৭ই মার্চ শেখ সাহেবের জন্মদিন। স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগ প্রতি বছর এ দিনটি পালন করে থাকে। ১৯৭৪-এর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হওয়ার জন্য ঢাকার ছাত্রলীগ আমাকে অনুরোধ জানায়। আমি রাজি হলাম, তবে দিনে দিনে ফিরে আসতে চাই এ শর্তে। তারা সেভাবে বিমানের টিকেট পাঠিয়ে দিয়েছিল।

১৭ তারিখ ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে আমি চিন্তা করতে লাগলাম, ওরা আমাকে নিতে আসবে কি না। এলেও আমি চিনতে পারব কি না। ওদের কারও সঙ্গে তো আমার দেখা নেই। ... একধারে দেখলাম একটা ছিপছিপে গোঁফওয়ালা ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বেশ লম্বা বলে সহজে চোখে পড়ে। ছেলেটাকে আমি চিনতে পারলাম না। লাউঞ্জের প্রবেশপথে ছেলেটি এগিয়ে এসে বলে, ‘আপনাকে নিতে এসেছি।’ বলেই আমার হাত থেকে ব্যাগটি আমার আপত্তি অগ্রাহ্য করে নিজের হাতে নিয়ে নিল। নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এসেছ?’ ‘জ্বি হ্যাঁ।’ জবাব দিলো ছেলেটি।

ওর পেছনে পেছনে হেঁটে এসে একটা গাড়িতে উঠে বসলাম। ড্রাইভারের সিটে গিয়ে বসল ও নিজে এবং শুরু করলো ড্রাইভ করতে। তার আগে ও জেনে নিয়েছে আমি কোথায় উঠব। গাড়িতে তৃতীয় ব্যক্তি নেই। কিছুদূর যাওয়ার পর আমার মনে হঠাৎ কৌতূহল হলো। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি কী করো?’ বললো, ‘অনার্স পরীক্ষা দিয়েছি সোসিয়োলজিতে।’ ‘ঢাকা থেকে?’ ‘জ্বী হ্যাঁ।’ শেখ সাহেবের সঙ্গে ছেলেটির দৈহিক সাদৃশ্য আমার মনে ধীরে ধীরে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছিল। জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার নাম? ‘শেখ কামাল।’ ও! তুমি আমাদের শেখ সাহেবের ছেলে!”

এ-থেকেই বুঝা যায় শেখ কামালকে কোন ভাবে দাম্ভিকতা ও অহংবোধ কখনো স্পর্শ করতে পারেনি।

জন্ম মৃত্যু বিয়ে এ তিন সত্য নিয়ে আমাদের পথ চলা। আর এ তিনটির দুটি পথই তাকে পারি দিতে হল এ আগস্ট মাসে। তার মধ্যে বিয়ের একমাস পেরুতে না পেরুতেই (১৪ জুলাই ১৯৭৫) ১৫ আগস্ট ঘাতের নির্মম বুলেটের আঘাতে প্রথম শহিদ হতে হল শেখ কামালকে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সহ সপরিবারে হত্যা করা হল। রেহায় পেল না শিশু রাসেলও। কি জঘন্য বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড।

আজ আগস্টের শোকাবহ মাসে ১৫ আগস্টে শহীদ সকলের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।

কেমন সুন্দর জীবন প্রবাহিত হচ্ছিল। উচ্ছল জীবনের নতুন অধ্যায় রচিত হওয়ার ২৩ দিন পর জন্মদিন। নবপরিণীতা স্ত্রীর সাথে প্রথম জন্মদিন পালন করে হাতের মেহেদীর রং না শুকাতেই জীবন সাথিকে সাথে করে জন্মদিনের দশদিন পর বিদায় নিতে হল ইতিহাসের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে।

আজ তাঁর জন্মদিনে আমরা তাঁর সল্প পরিসরে ২৬ বছরের যাপিত জীবনের যে চিত্র পাই তাতে নির্দিধায় বলতে পারি শেখ কামাল মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে থাকবেন তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। আজকের দিনে আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।

লেখক: উপ রেজিস্ট্রার, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
আলোচিত দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনের চাকরি ফেরত দেয়ার নির্দেশ
বগুড়ায় শ্বশুর ও পুত্রবধূকে হাত-পা বেঁধে গলা কেটে হত্যা  
পাকিস্তানি অভিনেত্রী হুমাইরা আসগরের রহস্যজনক মৃত্যু
জুরাইনে অস্ত্রসহ তিন মাদক কারবারি গ্রেপ্তার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা