মানুষের কথা

সিন্ডিকেটের কারণে আমরার খাওয়া-খাদ্যে টান পড়ছে

পুলক রাজ, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:৫৪

লোকটা কৌটা থেকে আঙুলে কালি নিয়ে জুতার এখানে-সেখানে ছোপ-ছোপ করে লাগান। এরপর একটা ব্রাশ দিয়ে ছন্দে ছন্দে জুতা পলিশ করতে থাকেন। ব্রাশের ছন্দে তার শরীরটাও দোলে। একমনে কালি করে জুতাটা পাশে রাখেন। এরপর হাতে তুলে নেন অন্য একটি জুতা, সেলাইয়ের জন্য।

লোকটার মাথায় বড় গামছা পাকিয়ে পাগড়ি বাঁধা। এত বড় পাগড়ি কেন? তিনি হাসেন। নাম রাখাল চন্দ্র দাস। বয়স নাকি ৪৫ বছরের বেশি। দেশের বাড়ি কুমিল্লার তিতাসে। ছোটবেলা থেকে আছেন রাজধানীতে।

দুই যুগের বেশি সময় ধরে জুতা সেলাই আর পলিশ করে সংসার চালাচ্ছেন রাখাল চন্দ্র। রাজধানীর নানা জায়গা ঘুরে বর্তমানে কারওয়ান বাজার সড়কের পাশে পাটি বিছিয়ে তার ব্যবসার আয়োজন। এখানে আছেন বেশ কিছু দিন ধরে।

সারা দিন কাজ শেষে কারওয়ান বাজারেই রাতযাপন করেন। একটি ভবনের বারান্দায়। তার মা, স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে থাকে দেশের বাড়ি। বংশপরম্পরায় এই মুচির পেশায় আছেন রাখাল চন্দ্র। আলাপকালে ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘আমি মুচির পেশায় কাজ করছি বহু বছর ধরে। আমার বাপে মুচি ছিলেন। আমার দাদাও। দাদায় জুতা সেলাই করত গ্রামে বসে। আমি রাজধানীতে জুতা সেলাই করি। আগে কত মানুষের চড়-থাবড়া, লাথি খাইছি!’

রাখাল চন্দ্র দাস যখন ঢাকায় আসেন, তখন আশপাশে অনেক জায়গায় জঙ্গলের মতো ছিল। তার ভাষায়, ‘চোখের সামনে সেসব জায়গায় শহর হয়ছে, বড় বড় দালান-কোটা হয়ছে। আমার তকদিরে কিছু জুটে নাই। কেমনে জুটবে, অর্থ নাই, সম্পদ নাই। একেক দিন একেক রকম রুজি। একটু রুজি বাড়লে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। এক টাকাও জমে না।’ এই পেশায় কাজ করে সাত সদস্যের পরিবার চালান রাখাল চন্দ্র। আগে কোনো রকমে চললেও এখন কষ্ট হচ্ছে তার। বলেন, ‘সব জিনিসপত্রের দাম অতিরিক্ত বাইড়া গেছে। সামনে যে কেমনে সংসার চালাব, চিন্তায় আছি।’

জিনিসপত্রের এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সিন্ডিকেট কাজ করছে- এ কথাও বোঝেন মুচি মানুষটি। বলেন, ‘কোথাও কোনো জিনিসের কমতি দেখি না। তাইলে দাম বাড়ে কেন! বাড়লেও এত বাড়ব? সিন্ডিকেটের কারণে আমরার খাওয়া-খাদ্যে টান পড়ছে।’

রাখাল চন্দ্র দাস বলেন, ‘এখন নিজেও ভালোমন্দ খেতে পারি না। রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়ার টাকা নেই। রাস্তার পাশে ভাত-ডাল দিয়ে খাই। যেদিন একদম কম রুজি হয়, সেদিন তো না খেয়ে দিন রাত পার করি। এই ঢাকা শহরে কত দিন যে না খেয়ে পার করেছি!’

সংসার চালানোর টাকা জোগাতে নিজে কোনো ঘর ভাড়া করেন না। বলেন, ‘আমার নাই ঘর, আমি থাকি রাস্তার পাশে, কোনো অফিসের বারান্দা বা দোকানের দরজার সামনে। বৃষ্টি নামলে কোনো ঝুপ-ঝাপে বসে থাকতে হয়। যে কাপড় বৃষ্টিতে ভিজে, সেই কাপড় শরীরে শুকায়।’

রাখাল চন্দ্র দাস বলেন, ‘আমি রাজধানীতে ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে পথে-ঘাটে থাকি। জুতা সেলাই করা শিখেছি বলে আজকে এই কাম করে সংসার চালাই। আর কোনো কাম জানি না।’

‘আমার স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করব।’ বলতে থাকেন রাখাল চন্দ্র, ‘কিন্তু দুঃখের বিষয়, সংসারের চাপ ও বাবা মারা যাওয়ার কারণে আমার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। বাধ্য হয়ে বাপ-দাদার মুচির পেশায় আসতে হয়েছে।’

তবে নিজে পড়াশোনা করতে না পারলেও সন্তানদের মাধ্যমে তার স্বপ্ন পূরণ করতে চান রাখাল চন্দ্র, ‘আমি বেঁচে থাকলে কষ্ট করে হলেও আমার ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনা করাব। আমার বড় ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে, আর মেজ মেয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। আমার ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে বড় অফিসার বানাতে চাই। এখন আমার এটাই স্বপ্ন।’

(ঢাকাটাইমস/১৬সেপ্টেম্বর/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :