প্রতিযোগিতা কমিশনের শুনানি

পাঁচ হাত ঘুরে ডিম যায় ভোক্তার কাছে

আশিক আহমেদ, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২২:০১

সারাদেশে মিনিকেট নামে পরিচিত চিকন চাল নিয়ে বছরের পর বছর ধরে কারসাজি চলছে। মিনিকেট জাতের কোন ধান বা চাল না থাকলেও চক্রটি চালের প্যাকেটে মিনিকেট লিখে উচ্চ দামে বিক্রি করছে। এ নিয়ে ঢাকা টাইমসসহ একাধিক মিডিয়ায় প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।

সূত্র জানায়, তার সূত্র ধরে প্রতিযোগিতা কমিশন মিনিকেট চালের রহস্য উন্মোচনে নমুনা সংগ্রহের জন্য মিনিকেট রশিদকে নির্দেশ দিয়েছেন। মঙ্গলবার বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের ইস্কাটন গার্ডেনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক শুনানি শেষে এ নির্দেশ দেওয়া হয়।

শুনানিতে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন মো. মফিজুল ইসলামসহ চারজন উপস্থিত ছিলেন। এই শুনানিতে রশিদ এগ্রো ফুডের মালিক আব্দুর রশিদ (চাল), বেলকন গ্রুপের বেলাল হোসেন, (চাল করপোরেট), সিটি গ্রুপের বিশ্বজিৎ দত্ত (প্যাকেটাজাত চাল) শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন।

শুনানিতে প্রতিযোগিতা কমিশন এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছে জানতে চায় কত জাতের চাল আছে? চালের দাম অস্বাভাবিক হারে কেন বেড়েছে? উত্তরে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা বলেন, উৎপাদন, পরিবহনে খরচ অনেক বেড়েছে। ফলে চালের দাম বেড়েছে। তখন কত জাতের চাল আছে তার নমুনা দাখিলের নির্দেশ দেয়। আগামী ৬ অক্টোবর থেকে ১৩ অক্টোবরের মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে এসব চালের নমুনা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

এদিকে বাজারে ডিমের দাম নির্ধারণ করে কাজী ফার্মস। প্রতিদিন সকাল আটটা মধ্যে তাদের সব ডিলারের কাছে ওইদিন বাজারে কতদামে ডিম বিক্রি হবে সেটা পৌছে যায়।

প্রতিযোগিতা কমিশনের শুনানিতে এক প্রশ্নের জবাবে এসব তথ্য তুলে ধরেন ডিম ব্যবসায়ী আড়দার সমাবয় সমিতির সভাপতি মো. আমান উল্লাহ। প্রতিযোগিতা কমিশন তার বিরুদ্ধে ডিমের দাম বাড়ানোর অভিযোগে একটি মামলা করেন। শুনানিতে তার আইনজীবী বলেন, সমাবায় সমিতি ডিমের ব্যবসা করে না। ডিমের ব্যবসা করেন আমান উল্লাহ। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ডিমের ব্যবসা করেন।

বাজারে ডিমের দাম বৃদ্ধিতে ডিম ব্যবসায়ী মালিক সমিতির দায় কতটুকু প্রতিযোগিতা কমিশনের এমন প্রশ্নের জবাবে আমান উল্লাহ বলেন, ‘ডিমের দাম নির্ধারণ করে কাজী ফার্মস এবং প্যারাগন লিমিটেড।’

একটি ডিম উৎপাদনের খরচ হয়েছে পাঁচ টাকা, আর সেই ডিমের দাম কাজী ফার্মস নির্ধারণ করে ১০ টাকা, আপনারা সেই দাম মেনে নেবেন? প্রতিযোগিতা কমিশনের এমন প্রশ্নের জবাবে আমান উল্লাহ বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল আটটার মধ্যে কাজী ফার্মস তাদের সব ডিলারদের কাছে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দেন ডিমের দাম কত হবে। ওইদিন বাজারে সেইভাবেই ডিম বিক্রি হয়ে থাকে।’

মুরগি থেকে ভোক্তার কাছে ডিম পৌছাতে কয়টি হাত ঘোরে প্রতিযোগিতা কমিশনের এমন প্রশ্নের জবাবে আমান উল্লাহ বলেন, ‘পাঁচটি হাত ঘুরে একটি ডিম ভোক্তার কাছে যায়।’

শুনানির মাঝে প্রতিযোগিতা কমিশন আমান উল্লাহর বক্তব্য রেকর্ড হচ্ছে বলেও জানায়। তখন আমান উল্লাহ বলেন, ‘রেকর্ড হলে অসুবিধা নেই। পরে শুনানি শেষে যখন প্রতিযোগিতা কমিশন আমান উল্লাহর বক্তব্য লিখে তাতে আমান উল্লাহকে তার স্বাক্ষর দিতে বলেন।

এসময় আমান উল্লাহ তাতে স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে প্রতিযোগিতা কমিশন নথিতে লিখে রাখেন যে আমান উল্লাহ স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

কাজী ফার্মসের ডিম ‘নিলাম’ পদ্ধতি দেখে প্রতিযোগিতা কমিশনের ‘বিস্ময়’: ডিম ও মুরগি উৎপাদনকারী কোম্পানি কাজী ফার্মসের ডিমের দর নির্ধারণে নিলাম পদ্ধতি, বাজারজাতের কার্যক্রম ও মুরগি ব্যবসার বিভিন্ন দিক আলোচনা করতে গিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। গত সোমবার ছিল ডিম ও মুরগির বাজারে অস্বাভাবিক মূল্য বাড়ানোর অভিযোগে কাজী ফার্মসের বিরুদ্ধে করা দুই মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

রাজধানীর ইস্কাটনে প্রতিযোগিতা কমিশনের কার্যালয়ে শুনানির এক পর্যায়ে সরকারি সংস্থার চেয়ারপারসন মো. মফিজুল ইসলাম কাজী ফার্মসের প্রতিদিন ডিমের দাম ঠিক করার জন্য চালু নিলাম পদ্ধতিকে ‘অদ্ভুত’ মন্তব্য করে বলেন, ‘আপনাদের বিজনেস পলিসি আমার পক্ষে বোঝা কঠিন। আমরা আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি।’

পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে বাজার ‘অস্থিতিশীল’ করার অভিযোগে নিত্যপণ্য প্রস্তুতকারক ও সরবরাহকারী ৪৪টি কোম্পানি ও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে গত বৃহস্পতিবার মামলা করে প্রতিযোগিতা কমিশন।

সংস্থাটির প্রচলিত আইনে চাল, তেল, সাবান, আটা, ডিম ও মুরগি উৎপাদন ও সরবরাহ খাতের এসব কোম্পানি ও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে দাম বাড়ানোসহ আরও কিছু অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ায় পৃথকভাবে এসব মামলা করে প্রতিযোগিতা কমিশন।

পর্যায়ক্রমে এসব মামলার শুনানি হবে কমিশনে, যা শুরু হল কাজী ফার্মসের শুনানীর দিয়ে। মঙ্গলবার নয়টি কোম্পানির বিরুদ্ধে করা অভিযোগের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

এদিন শুনানিতে কাজী ফার্মস কমিশনের চাওয়া অনুযায়ী প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করতে পারেনি। এজন্য আরও দুই সপ্তাহ সময় চেয়ে আবেদন করেন কোম্পানির আইনজীবী বিশ্বজিৎ দেব। পরে কমিশন আগামী ৬ অক্টোবর প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক করে।

গত জুলাইতে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ার ফলে পণ্য বাজারে অস্থিরতার মধ্যে কাজী ফার্মস নিজস্ব নিলাম পদ্ধতির মাধ্যমে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রতিটি ডিমের দাম ২ টাকা ৭০ পয়সা করে বাড়িয়ে দেয়। একইভাবে ব্রয়লার মুরগির দামও কেজিতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা করে বাড়িয়ে দেয় বলে সেসময় অভিযোগ ওঠে।

ওই সময় আরও কিছু ডিম ও মুরগি উৎপাদনকারী কোম্পানি প্রায় একইভাবে দাম বাড়ায়। এমন মূল্য বাড়ানোকে ‘অস্বাভাবিক’ হিসেবে চিহ্নিত করে কাজী ফার্মস, প্যারাগন, সিপি, ডায়মন্ড এগ, পিপলস ফিডসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলা করে প্রতিযোগিতা কমিশন।

বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেছেন, ‘কয়েকদিন ধরেই বাজারে ব্রয়লার মুরগির পাশাপাশি ডিমের দামে বেশ অস্থিরতা চলছে। একটি মাফিয়া চক্র গত ১৫ দিনে ডিম ও মুরগির বাজার থেকে ৫১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। চক্রটি পরিকল্পিতভাবে ডিম, মুরগি ও বাচ্চার দাম বাড়িয়ে বিপুল অংকের টাকা মুনাফা করেছে।’

সুমন হাওলাদার বলেন, ‘দেশের পোলট্রি খাত মাফিয়া চক্রের হাতে চলে গিয়েছে। ১০-১২টি কোম্পানি যৌথভাবে এ চক্র তৈরি করেছে। চক্রটি সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে সারা দেশে প্রান্তিক খামারিদের ধ্বংস করতে চায়। এরই মধ্যে পরিকল্পিত চক্রান্তে দেশের প্রায় অর্ধেক প্রান্তিক খামার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যারা এখনো টিকে আছে, তারা ডিম ও মুরগি উৎপাদন করলেও দাম নির্ধারণ করতে পারে না। এ দাম নির্ধারণ করে দেয় বড় কোম্পানিগুলো।’

‘যখন প্রান্তিক খামারিদের হাতে ডিম ও মুরগি মজুদ থাকে, তখন তারা দাম বাড়াতে চায় না। কিন্তু কোনো কারণে দাম কমে এলে বড় কোম্পানিগুলো বাজারে ডিম ও মুরগি ছাড়া বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে দেশে ডিম ও মুরগির বাজারে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে এটি বড় কোম্পানিগুলো জেনেশুনে করছে।’

একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে এক বস্তা ফিড প্রান্তিক খামারিকে কিনতে হয় ৩ হাজার ৩০০ টাকায়। কিন্তু কোনো খামারি বড় কোম্পানির সঙ্গে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং করলে ওই বস্তা পাওয়া যায় আড়াই হাজার টাকায়। অর্থাৎ কোম্পানিগুলো বস্তাপ্রতি ফিডে ৮০০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা করেছে। তারা প্রতিটি ডিমে বাড়তি লাভ করছে তিন টাকা। প্রতিটি ব্রয়লারের বাচ্চা বিক্রি করে বাড়তি লাভ করছে ২০-২২ টাকা।

ওই সূত্রটি বলছে, দেশে প্রতিদিন ডিমের চাহিদা সাড়ে চার কোটি পিস। এর মধ্যে বড় কোম্পানিগুলোই জোগান দেয় আড়াই কোটি। প্রতি ডিমে ৩ টাকা করে বেশি নিয়ে প্রতিদিন সাত কোটিরও বেশি টাকা তারা অবৈধভাবে লাভ করেছে। এভাবে ১৫ দিনে বড় কোম্পানিগুলো ডিমের বাজার থেকে ১১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/২৭সেপ্টেম্বর/আরকেএইচ/ডিএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

অর্থনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

অর্থনীতি এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :