ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী গারো পাহাড়

শেরপুর জেলার ৫টি উপজেলার মধ্যে সীমান্তবর্তী এলাকায় গারো পাহাড়টি অবস্থিত। উপজেলা ৩টি হলো ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী এই গারো পাহাড়ের প্রাকৃতিক বন কেটে উজার ও বনভূমি থেকে পাথর এবং বালু উত্তোলন করার ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। পাহাড়টি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
উজারকৃত বনভূমি দখলদারদের হাতে চলে যাওয়ায় বনভূমির জায়গা সংকুচিত হয়েছে। বন বিভাগের ৩টি রেঞ্জের ১১টি বিটের আওতাধীন বনভূমির শতকরা প্রায় ২০-২৫ ভাগ অংশ দখলদারদের হাতে চলে গেছে। বেদখলকৃত বন ভূমির উদ্ধারের কোনো উদ্যোগ নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে উক্ত ঐতিহ্যবাহী গারো পাহাড়টি টিকে থাকবে না।
কেবল পাহাড় কেটে উজাড়ই নয়, অবেধভাবে পাহাড় খুঁড়ে কাঁচবালি, পাথর, সাদা মাটি উত্তোলন করে ভূমির প্রাকৃতিক গঠনও পরিবর্তন করা হচ্ছে। এতে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশের ভারসাম্য দারুণভাবে বিনষ্ট হচ্ছে। এমন অবস্থায় জলবায়ু ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে স্থানীয় সচেতন এলাকাবাসী ও পরিবেশবাদীরা জানিয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৮-৮৯ সালে বাংলাদেশ বন বিভাগ এডিবির অর্থায়নে প্রথম শেরপুরের গারোপাহাড় অঞ্চলে সামাজিক বনায়ন শুরু করে। তখন থেকেই ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার পাহাড়ী এলাকায় প্রাকৃতিক বনের গাছপালা কেটে পাহাড়ী বনাঞ্চল ন্যাড়া পাহাড়ে পরিণত করা হয়। এমনকি মাটি খুঁড়ে গাছের শেকড়গুলোও উপড়ে ফেলা হয়। শাল-গজারীর বাগান, প্রাকৃতিক বনের লতাগুল্ম কেটে, আগুন লাগিয়ে পুড়ে সাফ করে সেখানে সামাজিক বনায়নের নামে লাগানা হয় লাগানা হয় ইউকেলিপটাস, মিনজিয়াম, আকাশমনি, মিঞ্জিরির মতো দ্রুত বর্ধনশীল বিদেশী গাছ। প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে কৃত্রিম বনায়নের কারণে নিঃশেষ হয়ে যায় প্রাকৃতিক গাছপাল-লতাগুল্ম। বনের পশুপাখি, জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ হারায় তাদের বাসস্থান ও খাদ্যের উৎস। বনের ওপর নির্ভরশীল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষের জীবনেও ধীরে ধীরে নানা পরিবর্তন আসতে থাকে। আগে বন ও পাহাড় থেকে তারা যে সকল প্রাকৃতিক সবজি, পাহাড়ী আলু সংগ্রহ করে ক্ষুধা মেটাতো, সামাজিক বনায়নের ফলে তা থেকে বঞ্চিত হয়। কেবল তাই নয়, খাদ্যের সন্ধানে পাহাড় থেকে বন্য হাতির দল লোকালয়ে নেমে আসতে থাকে এবং মানুষের ঘরবাড়ি ও ফসলের ওপর বন্যহাতির আক্রমণও চলতে থাকে।
বন অধিদপ্তরের ২০১০ সালের প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে শেরপুরের ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী, শ্রীবরদী ও উপজেলায় মোট সংরক্ষিত বনের পরিমাণ ৬ হাজার ৩২৭ দশমিক ৬৬ একর। কিন্তু সংরক্ষিত বন থাকলেও সেখানে সংরক্ষিত গাছ নেই। বন বিভাগের সংরক্ষিত বনের ভেতরেই প্রাকৃতি শাল-গজারীর বাগান কেটে সামাজিক বনায়নের নামে আগর বাগান, রাবার বাগান করা হয়েছে।
পাহাড়ের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আগে সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের বন বাঘ, ভাল্লুক, হরিণ, বানর, বনমোরগ, শুকরসহ নানা প্রজাতির পশু-পাখিতে ভরপুর ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে এসব বন্য পশু-পাখি বিলুপ্ত হতে চলেছে। এখন আর আগের মতো এসব বন্য প্রাণী চোখে পড়ে না। প্রাকৃতিক বন উজার করার ফলে বন্যহাতি পাহাড়ী এলাকায় তান্ডব চালাচ্ছে বলে এলাকাবাসীরা জানান।
পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত অনেকেই বলেন, প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট পাহাড়ে প্রাকৃতিক সম্পদগুলো প্রকৃতির নিয়মেই বেড়ে ওঠতে দিতে হবে। প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছগুলো কেটে কৃত্রিম গাছ লাগানো পাহাড়ী জনপদের মানুষ ও বন্য প্রাণীদের কোনোভাবেই সুবিধা দিতে পারেনি। বরং তাদেরকে সংগ্রামে ঠেলে দিয়েছে। শ্রীবরদী ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক প্রাঞ্জল এম. সাংমা বলেন, প্রাণবৈচিত্র রক্ষা চুক্তি অনুযায়ী দেশের শতকরা ২৫ ভাগ বনভুমি থাকার কথা। এর মধ্যে শতকরা ১০ ভাগ সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকার কথা থাকলেও আমাদের দেশে তা না থাকায় প্রাণবৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে পড়েছে। গারো পাহাড়টি বেহাত হওয়া বনভূমি উদ্ধার ও রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এমন প্রত্যশা এলাকাবাসীর।
(ঢাকাটাইমস/৬নভেম্বর/এআর)

মন্তব্য করুন