সন্দেহপ্রবণতা মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায়

আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে গতিশীল জীবনে মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুকের জন্যে বাড়ছে পরিচিতমণ্ডল। বাড়ছে অপ্রয়োজনীয় সম্পর্ক। বাড়ছে নেতিবাচক আবেগ ও অনুভূতি। যা অন্যান্য সর্ম্পকগুলোর পাশাপাশি টানাপোড়েন সৃষ্টি করছে বৈবাহিক সম্পর্কেও। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সুখের সম্পর্ক ছোট ছোট কিছু ভুলে কিংবা অসচেতনতায় অথবা অবহেলায় দিনকে দিন তিক্ত হয়ে যাচ্ছে। একই ছাদের নীচে বসবাস করলেও স্বামী-স্ত্রী যেনো থাকেন যোজন যোজন দূরে। সুন্দর একটি সম্পর্কে দ্বন্দ্ব-কলহ লেগে থাকলে তার প্রভাব পরে সন্তানদের ওপর। তারা নিজেদের অজান্তেই সন্তানকে হতাশা আর অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছেন। যে কোনো সম্পর্কের সবচাইতে মূল্যবান ‘ভিত’ হচ্ছে “বিশ্বাস”। যেটা যে কোনো সম্পর্কেই অত্যন্ত জরুরি। বিশ্বাস না থাকলে সেখানে সম্পর্কের অস্তিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্বাস যখন থাকে না তখন দেখা দেয় সন্দেহপ্রবণতা।
ভালবাসারই অংশ আসলে সন্দেহপ্রবণতা! হঠাৎ করেই খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে ঠোকাঠুকি লেগে যাচ্ছে। এত দিন যে ছোটখাটো বিষয়গুলো নজরেই পড়ত না, তা হচ্ছে ঝগড়ার কারণ। আবেদন হারাচ্ছে শরীর। বদলে যাচ্ছে আচার-আচরণও।
হঠাৎ করেই সঙ্গীর হয়তো বেড়ে গিয়েছে ফোন নিয়ে ব্যস্ততা। জটিল হচ্ছে লক-প্যাটার্ন। ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ার পিছনেই হয়তো বেশির ভাগ সময় ব্যয় করছেন তিনি। সঙ্গীকে গোপন করে চলছে কথা কিংবা মেসেজ চালাচালিও।
ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সন্দেহপ্রবণতা বেশি। বিশেষত, যারা হোমমেকার তাদের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা বেশি দেখা যায়। হয়তো পারিবারিক চাপ, বাচ্চাদের বড় করা, এমন হাজারো দায়িত্বের মধ্যে জড়িয়ে থাকতে থাকতে কোথাও একা হয়ে পড়ছেন মানুষটি। তার থেকেই কোথাও জন্ম হচ্ছে ভিতরে সন্দেহপ্রবণতার।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সন্দেহ প্রবণতার জন্ম অধিকারবোধ থেকে। আর এ ব্যপারে ছেলেদের টেক্কা দেওয়াও মুশকিল। মনোবিদরা মনে করছেন, অতিরিক্ত অধিকারবোধ বা পজেসিভনেসও আসলে সন্দেহপ্রবণতারই প্রথম ধাপ।
কতটুকু সন্দেহ সম্পর্কের জন্য স্বাস্থ্যকর, বুঝে নিতে হবে সেটাও। অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবণতাও কিন্তু এক ধরনের মানসিক রোগ। ডিপ্রেশন বা অবসাদের থেকেও আসতে পারে সন্দেহপ্রবণতা। দীর্ঘদিনের ডিপ্রেশন হ্যালুসিনেশন তৈরি করে। যার থেকে মন ভাবতে শুরু করে, হয়তো সঙ্গী অন্যত্র জড়িয়ে পড়েছে। ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলে ‘ইলিউশন অফ ইনসিবেলিটি’। ডিপ্রেশন ছাড়াও সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, অ্যালঝাইমার্স, এই ধরনের অসুস্থতার ক্ষেত্রেও দেখা যেতে পারে সন্দেহপ্রবণতা। অতিরিক্ত মাদকাসক্তি থেকেও আসে সন্দেহপ্রবণতা। যৌন অতৃপ্তি থেকেও সন্দেহের জন্ম হয়।
চলুন জেনে নেয়া যাক সঙ্গীর প্রতি অহেতুক সন্দেহ বাতিক থেকে কীভাবে বের হওয়া যায়:
স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব থাকলে সন্দেহপ্রবণতার সমস্যা হতে পারে। সময়ের সাথে সাথে মানুষের চাওয়া পাওয়া বদলাতে পারে এটা মাথায় রাখতে হবে।
ঝগড়া, কান্নাকাটি, ইমোশনাল অত্যাচার! একেবারেই নয়। আলোচনার পথে এগোন। অসুবিধের কথা জানুন এবং জানান। যদি মনে হয়, উল্টো দিকের মানুষটির সন্দেহ অমূলক, তাকে প্রমাণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করুন। বড়দের মতামত নিন। প্রয়োজনে ম্যারেজ কাউন্সিলার বা মনোবিদের সাহায্য নিন। হয়তো সামান্য যোগাযোগের ভুলেই এত কিছু। আর যদি বুঝতেই পারেন সঙ্গীটির চাওয়া বা পাওয়া একান্ত ভাবেই অন্য কোথাও—জোরাজুরি করবেন না। সুস্থ স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকতে থাকতে বেরিয়ে আসুন।
দুই জনের মধ্যে একজনের কোনো বিশেষ মানসিক সমস্যা হতেই পারে। কিন্তু সেটা অপরজনের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। নইলে সেটা মনের মধ্যে জমিয়ে রাখলে তা পরে গিয়ে বড় আকার ধারণ করতে পারে।
কমিউনিকেশনের সমস্যা হলেও এমনটা হয়। একজন একরকম ভাবছেন এবং অন্যজন অন্যরকম ভাবছেন। আবার কেউ কাউকে মন খুলে কিছু বলতে পারছেন না। তখনও এই সমস্যা প্রবল হয়ে ওঠে।
সবার আগে বুঝতে হবে যে সেই ব্যক্তি হয়তো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে আপনাকে নিয়ে। তিনি হয়তো ভাবেন যে রাশ আলগা করে রাখলে সঙ্গী তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে। তাই সে নিজের কঠোর ভাবমূর্তি ধরে রাখতে চায়।
আপনার স্বামী বা স্ত্রীর ওপরে বিশ্বাস রাখুন। বিশ্বাসের উপরেই টিকে থাকে একটা সম্পর্কের স্থায়িত্ব। আপনি যখনি আপনার ভালোবাসার মানুষটিকে মন থেকে বিশ্বাস করবেন দেখবেন এসব সন্দেহ আপনার ধারে কাছেও আসবে না। তাই একে অপরের প্রতি বিশ্বাস কাছেও আসবে না। তাই একে অপরের প্রতি বিশ্বাস রাখুন। একে অন্যের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন। তাহলেই আর এসব সন্দেহ মনে বাসা বাঁধতে পারবেন না।
স্বামী বা স্ত্রী যদি আপনাকে অহেতুক সন্দেহ করে তাহলে রেগে না গিয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করা শিখুন। তার কথায় কান না দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলুন, তাকে পাত্তা না দিয়ে মনকে শক্ত করুন। পরিস্থিতিকে সময়ের উপর ছেড়ে দিন। বাস্তবে কেউ যখন আপনাকে সন্দেহ করছে তখন সে হয় তো কল্পনা করে সন্দেহ করছে অথবা কেউ তাকে আপনার নামে মিথ্যা অভিযোগ ঢুকিয়ে দিয়েছে সেক্ষেত্রে আপনার করণীয় হবে বাস্তবে চুপ করে থাকা। এই সব পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে চুপ করে থাকলে সময়ের কারণে এসব অমূলক সন্দেহ এমনি এমনি দূর হয়ে যাবে।
স্ত্রী বা স্বামীকে নিজের সম্পত্তি মনে করেন। অন্য কারও সঙ্গে কথা বলাটাকেও সন্দেহের চোখে দেখেন। এটা এক ধরনের মানসিক রোগ। আর এরকম অসুস্থ সন্দেহের পেছনে থাকে না কোনও যৌক্তিক কারণ বা প্রমাণ। বিপরীত লিঙ্গের সহকর্মী বা সহপাঠীর সাথে মেলামেশার ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে আপনাকেই। সম্ভব হলে এই সম্পর্কগুলোকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলুন। আর কখনও এমন মানুষগুলোর সাথে দেখা হয়ে গেলে জীবনসঙ্গীর সামনেই তাদের সাথে কথা বলুন, তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিন।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শুধু ভালবাসা থাকলেই যে সংসারের বন্ধন দৃঢ় হবে, সেটা কিন্তু নয়। অনেক সময় পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে যে কোনও একজনের মনে অপরজনকে নিয়ে জন্ম নিতে পারে ভয়, ঈর্ষা অথবা হীনম্মন্যতা। এহেন নেতিবাচক আত্মধারণা পরবর্তীতে সন্দেহ রূপে প্রকাশ পায়, যা মানসিক যন্ত্রণা দেয় দুজনকেই। নেতিবাচক আবেগে মন তিক্ত হওয়ার আগে সুযোগ বুঝে সরাসরি কথা বলুন। যদি তার কোনও অক্ষমতা থাকে, সেটা সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করুন। সঙ্গিনীর ভালো দিকগুলো তুলে ধরুন। এতে তিনি ভুল সংশোধনে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন।
দাম্পত্য জীবনে অশান্তি সৃষ্টির একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে- এই সম্পর্কে তৃতীয় পক্ষের কোনও কথায় প্রভাবিত হওয়া। অথবা স্বামী-স্ত্রীর ভুল বুঝাবুঝি তৈরি হলে তৃতীয় পক্ষকে (আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী) জড়ানো। এই বিষয়টিও সুখের সংসারে সন্দেহ হয়ে ঘর বাধে এবং ধীরে ধীরে ভয়াল ব্যধির মতো নিঃশেষ করে দিতে চায় মধুর স্মৃতিগুলোকেও। সম্পর্কের জটিলতায় সবসময় সরাসরি কথা বলুন। কাউকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করবেন না। কারণ, সর্ম্পক যত সরাসরি হবে, ভুল বুঝাবুঝি ততোই কম হবে।
সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে সময়। সঙ্গীকে সময় দেওয়ার বিষয় নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। সঙ্গী যে সময়টা আপনার কাছে চাইছে, সেটি দিতে না পারা অথবা আপনার সঙ্গীর কাছ থেকে যে সময়টা চাইছেন তা না পাওয়ার মতো বিষয় হতে পারে সমস্যার কারণ। দুজনে বোঝাপড়া করে নিজেদের সময় দিন।
অর্থনৈতিক কারণেও সম্পর্কে অনেক সমস্যা আসে। এটি অন্যতম একটি বড় কারণ। তাই প্রথমেই এ বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মাঝে কথা বলে রাখা উচিত। নইলে সঙ্গীর কাছ থেকে আপনি যা আশা করেন, তা যদি পূরণ না হয় তা হলে অশান্তি ও ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়।
যে কোনো একজনের বিশেষ মানসিক সমস্যা থাকতে পারে অথবা দুজনের মানসিকতা একদমই আলাদা হতে পারে। এমন মনে হলে দুজনে খোলামেলা আলোচনা করুন। শুরুতেই এটি ঠিক না হলে পরে তা অনেক বড় আকার ধারণ করতে পারে।
সুনির্দিষ্ট বাস্তব কোনো প্রমাণ না থাকলে অকারণে সন্দেহ করবেন না এবং সন্দেহমূলক প্রশ্ন করে সম্পর্কের জটিলতা বাড়াবেন না। কেননা যাকে সন্দেহ করছেন তিনি যদি সত্যিই সন্দেহের কিছু না করে থাকেন, তবে তার জন্য বিষয়টি একই সঙ্গে অপমানজনক, কষ্টকর এবং রাগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যদি সুনির্দিষ্ট বাস্তব প্রমাণ থেকে থাকে, তার পরও আরেকটু সময় নিন, বিষয়টা ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করুন। এক-দুটি প্রমাণের ভিত্তিতেই গর্জে উঠবেন না।
খুব ইতিবাচক পদ্ধতিতে সুন্দরভাবে স্বামী/সঙ্গীকে আপনার সন্দেহের বিষয়টি জিজ্ঞেস করুন। তিনি যেন এ রকম মনে না করেন যে তার পেছনে টিকটিকি লেগেছে।
যদি মনে হয় সঙ্গী আপনাকে ভুল বোঝাচ্ছেন, সব কিছু লুকাচ্ছেন, তবে দুজনের সম্মতিতে আলোচনায় বসুন। আপনি আপনার প্রমাণগুলো ইতিবাচক পদ্ধতিতে উপস্থাপন করুন।
অসুস্থ পর্যায়ের সন্দেহ হলে অবশ্যই অবশ্যই সাইকিয়াট্রিক চিকিৎসক দেখাতে হবে ও ওষুধ সেবন করতে হবে। সন্দেহ বাতিক নারী-পুরুষ উভয়েরই হতে পারে। সন্দেহপ্রবণতা একটি চিন্তার পদ্ধতিগত জটিলতা বা মানসিক রোগ, এটি নারী-পুরুষ যারই হয়ে থাকুক না কেন, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।
সংবাদটি শেয়ার করুন
ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
ফিচার এর সর্বশেষ

খাবার বারবার গরম করে খাচ্ছেন? বিপদের শেষ থাকবে না কিন্তু

ডায়াবেটিস ও হার্টের মহৌষধ ধনে! উচ্চ রক্তচাপও রাখে নিয়ন্ত্রণে

রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন? সমস্যার সমাধান রয়েছে কিছু খাবারেই

অজান্তেই শিশুর লিভার নষ্ট করে দিতে পারে যে পাঁচ খাবার

অন্যদের চেয়ে শীত বেশি লাগে? ভয়ংকর কিছুর লক্ষণ নয় তো

পুষ্টিগুণে ভরপুর দুধের সঙ্গে যেসব খাবার খেলেই মারাত্মক বিপদ

কলা নিঃসন্দেহে উপকারী, কিন্তু বেশি খেলে মারাত্মক সব ক্ষতি

নিজে ঘুমায় ফুটপাতে, বিড়াল ঘুমায় রাজ প্রাসাদে!

ক্যানসার-ডায়াবেটিস-ওজন নিয়ন্ত্রণসহ বহু রোগের মহৌষধ ব্রোকলি
