বাঙালি জাতি যত দিন থাকবে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গৌরব ও অহংকার করবে

মো. খসরু চৌধুরী সিআইপি
 | প্রকাশিত : ১৬ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:৫৭

১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে আনন্দের ও গৌরবের দিন এই ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠেছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নামটি অর্জনের পেছনে জড়িয়ে আছে দীর্ঘ শোষণ-বঞ্চনার কষ্টগাথা, রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ইতিহাস।

বাঙালি জাতির ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সবচেয়ে গৌরবদীপ্ত ঘটনা। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি বর্বর সেনাদের গণহত্যার মুখে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় দেশমুক্তির সশস্ত্র সংগ্রাম। নয় মাস পর ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি দখলদারদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় মুক্তিযুদ্ধের মহান বিজয়।

বিজয়ের দিনে স্মরণ করছি ৩০ লাখ শহীদকে, যাঁরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। স্মরণ করছি সেই সময়ের কোটি কোটি মানুষকে, যারা হানাদার বাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়ন সহ্য করেছেন, ঘরবাড়ি ছেড়ে পরবাসী হয়েছেন, বনে-জঙ্গলে রাত কাটিয়েছেন, তার পরও মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বতোভাবে সহায়তা করেছেন। তাদের সবাই আমাদের তথা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নমস্য।

বাঙালি জাতি যত দিন বেঁচে থাকবে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গৌরব করবে, অহংকার করবে। প্রতিটি ১৬ ডিসেম্বরে তারা নতুন করে শপথ নেবে এগিয়ে যাওয়ার, বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর। এই দিনটি আমাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় দিন, আনন্দের দিন হয়েই থেকে যাবে। কারণ শতসহস্র বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালের এই দিনটিতেই বাঙালি জাতি প্রথমবার প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করেছিল। বিশ্বের মানচিত্রে একটি গর্বিত জাতি হিসেবে নিজেদের স্থান করে নিয়েছিল বাংলাদেশ।

স্বাধীনতার ৫১ বছরে বাংলাদেশ যে হারে এগিয়েছে সেটা সত্যিই অনেকের জন্যই ঈর্ষণীয়। অর্থনীতির অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দারুণ সাফল্য অর্জন করেছি। পৃথিবীর অনেক দেশই আমাদের অনুসরণ করছে। করোনা মহামারীতেও বাংলাদেশ তার সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। মহামারীতে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ যেখানে ধরাশায়ী সেখানে এই মহামারীতেও আমরা উচ্চতর প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছি। সবচেয়ে বড় কথা দেশে কোনো খাদ্য সংকট নেই। এ ছাড়া নেই বড় কোনো অর্থনৈতিক সংকটও। এখন আমরা বাংলাদেশকে নিয়ে গর্ব করে বলতে পারি সেই তলাবিহীন ঝুড়ি আজ বিশ্বের বিস্ময়, উন্নয়নের এক রোল মডেল।

স্বাধীনতার সময়ে অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে পাকিস্তান এগিয়ে ছিল। আজ ৫১ বছর পর পুরো চিত্রই উল্টো। এটিই আমাদের স্বাধীনতার বড় অর্জন। স্বাধীনতার ৫১ বছরে নারীর ক্ষমতায়নেও আমরা সাফল্য অর্জন করেছি। সবকিছুতেই নারীর অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো।

বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। পাঁচ হাজার বছর আগেও এ ভূখণ্ডের অধিবাসীদের বীরত্ব সম্পর্কে সমীহ করা হতো। মহাবীর আলেকজান্ডারের সঙ্গীরা এই বীর জাতির শৌর্যবীর্যের প্রশংসা করেছেন। আড়াই হাজার বছর আগে রোমান কবি ভার্জিলের কবিতায় গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের অধিবাসীদের বীরবন্দনা প্রকাশ পেয়েছে। সেই প্রাচীনকালে বাঙালি বীর বিজয় সিংহ লঙ্কা জয় করে দূর দেশেও নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের কৃতিত্ব দেখান। তারপরও বলা যায়, ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা এ ভূখণ্ডের মানুষের ইতিহাস খুব একটা সুখকর নয়। এ দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য বিদেশি হানাদাররা বার বার আঘাত হেনেছে। বৈদেশিক আধিপত্যে এক পর্যায়ে বাঙালি তার স্বকীয় মর্যাদাও হারিয়ে ফেলে।

বাঙালি মুসলমানদের অগ্রণী ভূমিকায় ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও শুরুতেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয় পদ্মা মেঘনা যমুনা বুড়িগঙ্গা পাড়ের মানুষ। সংখ্যালঘিষ্ঠ পশ্চিম পাকিস্তানিরাই এ দেশের ভাগ্য-বিধাতা হয়ে ওঠে। শোষণ ও নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয় বাঙালিরা। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাঙালির সাহসী নেতা বঙ্গবন্ধু।

১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হলে পাকিস্তানিরা তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। শুধু তাই নয়, তারা একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় গণহত্যা। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয় এবং শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। জাতি এ বছর একাত্তরের মহান বিজয়ের ৫১তম বার্ষিকী পালন করছে।

একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন। তার সুযোগ্য কন্যার হাত ধরে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। পদ্মা সেতু নির্মাণ, সমুদ্র সীমানা বিজয়, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, ফ্লাইওভার নির্মাণ, জেলেদের খাদ্য সহায়তা প্রদান, দারিদ্র্যতার হার নিম্ন পর্যায়ে, যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিচার, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, বিনামূল্যে প্রত্যেকেটি শিক্ষার্থীদের হাতে বই বিতরণ, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, মাথা পিছু আয় বৃদ্ধি, গরিব শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন ব্যবস্থা, রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধাদের সম্মানী ভাতা প্রদান, প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল তথ্য সেবা কেন্দ্র, বিভিন্ন জেলায় বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণ, বিভিন্ন জেলায় শিল্প পার্ক নির্মাণ, দেশের বিভিন্ন স্থানে ইকোনমিক জোন নির্মাণ, গ্রামীণ রাস্তাঘাট ও কালভার্ট নির্মাণ, মোবাইল ও ইন্টারনেট গ্রাহক বৃদ্ধি, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, কৃষিতে সফলতা, জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনে সফলতা, এশিয়া হাইওয়ে রোড প্রকল্প, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদান, নারীর ক্ষমতায়ন, বিধবা ভাতা প্রদান, মাতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধি, বয়স্ক ভাতা প্রদান, মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান, ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যকর, মেট্রোরেল প্রকল্প, হাতিরঝিল প্রকল্প, এলিভেটেড এক্সপ্রেস প্রকল্প, মাদক নিধন, ভিক্ষুক মুক্তকরণ, অসংখ্য প্রাইমারি স্কুল সরকারিকরণ শেখ হাসিনা সরকারের বড় অবদান।

অফুরন্ত সম্ভাবনার অপর নাম বাংলাদেশ। এ দেশের রয়েছে অমিত সম্ভাবনাময় ষোল কোটি মানুষের বত্রিশ কোটি হাত। ষোল কোটি মানুষ বাংলাদেশের জন্য অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ। কেননা আবহমান কাল থেকেই এ দেশের মানুষরা কর্মনিষ্ঠ, পরিশ্রমী। অচিরেই এ দেশ পরিণত হবে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ পোশাক, জুতা, ওষুধ, সিরামিক ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানিকারক দেশে। সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায় ধন্য এদেশে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বর মাটি আর দূষণমুক্ত পানি। গ্যাস ও কয়লার প্রাচুর্যের পাশাপাশি এ দেশে বছরে তিনবার ফসল উৎপাদিত হয়।

কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পাশাপাশি দেশের দরিদ্র, শ্রমজীবী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নির্ভর প্রবাসী আয়কে পুঁজি করে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। বিশ্বের বুকে বাঙালি জাতি প্রতিষ্ঠা করেছে তার স্বতন্ত্র জাতিসত্তা। বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ জেল-জুলুম সয়ে তাঁর অসামান্য নেতৃত্বে উজ্জীবিত বাঙালি জাতিকে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দেশকে অর্থনৈতিকভাবে মুক্তি দেওয়ার সময় পাননি। এখন সেই অসমাপ্ত কাজটিই নিরলস প্রচেষ্টায় দক্ষতার সঙ্গে করে যাচ্ছেন তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার আমলে দেশের প্রতিটি খাতেই উন্নয়ন-সমৃদ্ধির ছোঁয়া লেগেছে।

লেখক: রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী শিল্পোদ্যোক্তা। পরিচালক, বিজিএমইএ; শিল্প বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ; চেয়ারম্যান, নিপা গ্রুপ কেসি ফাউন্ডেশন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :