লন্ডনের বাঙালিপাড়া পরিদর্শনে ব্রিটিশ রাজা ও কুইন কনসোর্ট ক্যামিলিয়া
পূর্ব লন্ডনের বাঙালি অধ্যুসিত বাংলাটাউনের আলতাব আলী পার্ক, ব্রিকলেন ও ব্রিকলেন জামে মসজিদ পরিদর্শন করেছেন রাজা তৃতীয় চার্লস ও কুইন কনসোর্ট ক্যামিলা।
বুধবার সকাল ১০টায় রাজা প্রথম আসেন ব্রিটিশ বাঙালিদের বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতির পতিক আলতাব আলী পার্কে। রাজা ও কুইন কনসোর্ট ক্যামিলা সেখানে এসে পৌঁছালে তাদের স্বাগত জানান রাজ সফরের আয়োজক ব্রিটিশ বাংলাদেশি পাওয়ার অ্যান্ড ইন্সপিরেশন (বিবিপিআই)-এর প্রতিষ্ঠাতা আয়েশা কোরেশি এমবিই জেপি এবং কাউন্সিলার আবদাল উল্লাহ।
আলতাব আলী পার্কে রাজা ও কুইন কনসোর্ট ক্যামিলাকে লন্ডনে বাঙালিদের বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও বাঙালির ভাষা আন্দোলনের পতিক শহীদ মিনার সম্পর্কে ব্রিফ করেন আয়োজকরা। ষাট ও সত্তর দশকের বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ব্রিটিশ বাঙালিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন রাজা তৃতীয় চার্লস ও ক্যামিলা।
এরপর রাজা চলে আসেন ব্রিকলেনে। ব্রিকলেনের বাংলাটাউন গেটে রাজাকে স্বাগত জানান লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম। এসময় রাস্থার উভয় পাশে ব্রিটিশ পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে রাজাকে স্বাগত জানান বাঙালিসহ অন্যান্য কমিউনিটির লোকজন। ব্রিটিশ বাংলাদেশি নৃত্যশিল্পীরা রাজার সামনে বাঙালি নৃত্য পরিবেশন করেন। রাজা ও কুইন কনসোর্ট ক্যামিলিয়া রাস্তার উভয় পাশে দাঁড়ানো ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের সাথে করমর্দন করেন। বাংলা টাউনে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পিঠাপুলি দিয়ে রাজাকে আপ্যায়ন করা হয়। কুইন কনসোর্টকে উপহার দেওয়া হয় বাংলাদেশি ঐতিহ্যের স্মারক জামদানি শাড়ি।
এরপর রাজা আসেন ব্রিকলেন জামে মসজিদে। মসজিদ ট্রাস্টের সদস্যরা রাজ দম্পতিকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি ব্রিকলেন মসজিদের ইতিহাস তুলে ধরেন। রাজা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাটাউনে এটাই তার প্রথম সফর। রাজা হওয়ার আগে প্রিন্স চার্লস ২০০১ সালে ইস্ট লন্ডন মসজিদ পরিদর্শনে এসেছিলেন। তারও আগে ১৯৮৭ সালে ব্রিকলেনে একটি প্রকল্পের অগ্রগতি পরিদর্শনে এসেছিলেন। কিন্তু, বাংলাদেশি কমিউনিটির ব্রিটেনে চার প্রজন্মের সংগ্রামের ইতিহাসের পথ বেয়ে বিভিন্ন অর্জন, ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের ব্রিটেনের উন্নয়নে বিভিন্ন খাতে অভাবনীয় সাফল্যকে অনুপ্রাণিত করতে আজকের এই সফর বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে।
বাংলাদেশ থেকে ব্রিটেনে অভিবাসীদের আগমনের সূচনা ঘটে গত শতকের ত্রিশের দশকে। মূলত বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষেরা কলকাতা থেকে ব্রিটিশ জাহাজ কোম্পানিতে কাজ নিয়ে প্রথমদিকে অভিবাসনের প্রক্রিয়া শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে শ্রমিক স্বল্পতার কারণে ব্রিটিশ সরকার উপনিবেশগুলো থেকে বিপুলসংখ্যক অভিবাসন প্রত্যাশীকে সেই দেশে স্বাগত জানায়। ধীরে ধীরে শিক্ষা এবং চাকরির সন্ধানে অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষ ব্রিটেনে পাড়ি জমান। এভাবে একসময় ব্রিটেনে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষদের একটি বৃহৎ সমাজ গড়ে ওঠে। লন্ডনসহ ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে গত শতকের ষাট ও সত্তরের দশকে কয়েকটি উগ্র জাতীয়তাবাদী শ্বেতাঙ্গ সংগঠনের তৎপরতা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এসব সংগঠন অভিবাসীবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম, যেমন- ঘৃণা ও জাতিবিদ্বেষ ছড়াচ্ছিল। বাংলাদেশিরা ছিল তাদের টার্গেট। ফলে যুক্তরাজ্যে তথা লন্ডনে অবস্থানকারী বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের অভিবাসীদের ওপর সহিংস বর্ণবাদী হামলা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনই একটি সহিংস বর্ণবাদী হামলায় ১৯৭৮ সালের ৪ মে মাত্র ২৪ বছর বয়সে আলতাব আলী নামে এক বাঙালি গার্মেন্টস কর্মী নিহত হন। আলতাব আলী ১৯৫৩ সালে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার সৈরদরগাঁও ইউনিয়নের মোল্লাআতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বর্ণবাদী হামলায় আলতাব আলীর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্রিটেনে অবস্থানরত বাঙালিসহ অন্যান্য অভিবাসীরা বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন। হ্যাকনি এলাকায় এই রকম আরেকটি বর্ণবাদী হামলায় ১৯৭৮ সালের জুন মাসে ইসহাক আলি নামে আরও একজন বাঙালি বর্ণবাদী হামলায় নিহত হন।
আলতাব আলীর মৃত্যুর ঘটনায় পূর্ব লন্ডনের ব্রিকলেন এলাকায় অভিবাসীদের ওপর ক্রমবর্ধমান জাতিবিদ্বেষ এবং বর্ণবাদী হামলার বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশি কর্মীরা বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। আলতাব আলীর মৃত্যুর দশ দিন পর প্রায় ৭ হাজার মানুষ তার কফিন নিয়ে লন্ডনের হাইড পার্ক, ট্রাফালগার স্কয়ার এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে মিছিল ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং বিক্ষোভকারীরা পূর্ব লন্ডনের অভিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় অবিলম্বে জাতিবিদ্বেষ এবং বর্ণবাদী আক্রমণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। সেই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বরে এক বিশাল বর্ণবাদবিরোধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেই সমাবেশে বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের লক্ষাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করে।
পরে ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং বিশেষত বাঙালি অভিবাসীদের আন্দোলনের ফলে ধীরে ধীরে পূর্ব লন্ডনে বর্ণবাদী হামলা কমে আসে। ১৯৮৯ সালে বর্ণবাদী হামলার শিকার সব মানুষের স্মরণে সেইন্ট মেরি পার্কে একটি তোরণ নির্মাণ করা হয়। পরে ১৯৯৮ সালে পার্কটির নাম পরিবর্তন করে ‘আলতাব আলী পার্ক’ রাখা হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিতে শহীদদের স্মরণে এই পার্কের ভেতরে একটি শহীদ মিনার নির্মিত হয়। প্রতিবছর ৪ মে যুক্তরাজ্যে ‘আলতাব আলী দিবস’ পালিত হয়ে আসছে।
(ঢাকাটাইমস/০৮ফেব্রুয়ারি/এলএ)