ভারতের ট্রেন কেন লাইনচ্যুত হয়
শুক্রবার সন্ধ্যায় ভারতে ঘটে যাওয়া ত্রিমুখী ট্রেনের সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৩০০ জনের মতো মানুষ এবং আহত হয়েছে ৮০০ জনের বেশি। কিন্তু ঠিক কি কারণে এই দুর্ঘটনা? তা নিয়ে রয়েছে বেশ কিছু উত্তরহীন প্রশ্ন।
রিপোর্ট বলছে এই ত্রিমুখী সংঘর্ষের মধ্যে একটি ছিল স্থির মালবাহী ট্রেন। এর কোচগুলি তৃতীয় আরেকটি ট্র্যাকে উল্টে যায়, যার ফলে একটি আগত ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, সিগন্যাল ত্রুটির ফলে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।
গভীর তদন্তই একমাত্র এই দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ এবং সত্য উদঘাটন করতে পারবে। এরপরেও দুর্ঘটনাটি ভারতে রেলওয়ের নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগকে পুনরায় জাগিয়ে দিয়েছে।
ভারতের বিস্তৃত রেল ব্যবস্থা বিশ্বের বৃহত্তমগুলির মধ্যে একটি। দেশব্যাপী ১ লাখ কিলোমিটারের বেশি বিস্তৃত ট্র্যাকের নেটওয়ার্ক জুড়ে প্রতিদিন প্রায় আড়াই কোটি যাত্রী যাতায়াত করে। রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের মতে, গত বছর প্রায় ৫২০০ কিলোমিটার নতুন ট্র্যাক স্থাপন করা হয়েছিল। এছাড়াও প্রতি বছর ৮ হাজার কিলোমিটার ট্র্যাকগুলিও আপগ্রেড করা হচ্ছে।
বৈষ্ণব সম্প্রতি বলেছেন, বেশিরভাগ ট্র্যাকগুলি ১০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে চলা ট্রেনগুলিকে চালানোর জন্য আপগ্রেড করা হচ্ছে। এছাড়াও ১৩০ কিমি/ঘণ্টা এবং ১৬০ কিমি/ঘণ্টা পর্যন্ত গতির জন্য আলাদা আলাদা দুটি অংশ প্রস্তুত করা হচ্ছে।
স্পষ্টতই, এটি সারা দেশে দ্রুতগামী ট্রেন চালানোর জন্য সরকারের পরিকল্পনার অংশ যার অধীনে বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাই এবং আহমেদাবাদ শহরের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য উচ্চ-গতির রেললাইন তৈরি করা হচ্ছে।
ট্রেনের লাইনচ্যুত হওয়ার বিষয়ে প্রাক্তন রেলওয়ে বোর্ড চেয়ারম্যান, বিবেক সাহাই বলেছেন, একটি ট্রেন বিভিন্ন কারণে লাইনচ্যুত হতে পারে। হতে পারে ট্র্যাকের বাজে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার জন্য, ত্রুটিপূর্ণ কোচের কারণে কিংবা ড্রাইভিংয়ে ত্রুটির কারণে।
২০১৯-২০ সালে প্রকাশিত সরকারি রেলওয়ে নিরাপত্তা প্রতিবেদনে দেখা গেছে ৭০ শতাংশ রেল দুর্ঘটনার পেছনে কারণ ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়া যা আগের বছরের তুলনায় ৬৮% বেশি। বাকি দুর্ঘটনার মধ্যে রয়েছে ট্রেনে অগ্নিকাণ্ড (১৪%) এবং সংঘর্ষ (৮%)।
প্রতিবেদনটি পর্যালোচনাধীন বছরে ৩৩টি যাত্রীবাহী ট্রেন এবং সাতটি মালবাহী ট্রেনের ৪০ বার লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৭টি লাইনচ্যুত ট্র্যাক ‘ত্রুটির’ কারণে হয়েছিল। রিপোর্ট অনুযায়ী ট্রেন-ইঞ্জিন, কোচ, ওয়াগন-এর ত্রুটির কারণে মাত্র নয়টি ঘটনা লাইনচ্যুত হয়েছে।
ধাতব পাতের তৈরি রেলওয়ে ট্র্যাকগুলো গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড তাপে প্রসারিত হয় এবং শীতকালে তাপমাত্রার ওঠানামার কারণে সংকোচনের মধ্য দিয়ে যায়। এজন্য নিয়মিত ট্র্যাকের রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন।
এপ্রিল ২০১৭ এবং মার্চ ২০২১ এর মধ্যে ফেডারেল অডিটরদের লাইনচ্যুত সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে কিছু ফলাফল ছিল- ট্র্যাকগুলির জ্যামিতিক এবং কাঠামোগত অবস্থার মূল্যায়ন করার জন্য প্রয়োজনীয় ট্র্যাক রেকর্ডিং গাড়ির মাধ্যমে ‘পরিদর্শনে ৩০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত ঘাটতি’ ছিল।
লাইনচ্যুত হওয়ার একটি প্রধান কারণ ছিল ট্র্যাকগুলির রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে সম্পর্কিত। যান্ত্রিক কারণে ১৮০টির বেশি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে এক তৃতীয়াংশের বেশি কোচ এবং ওয়াগনের ত্রুটির কারণে ঘটেছে। খারাপ ড্রাইভিং এবং অতিরিক্ত গতি লাইনচ্যুত হওয়ার জন্য দায়ী অন্যান্য প্রধান কারণ।
রেলওয়ের এক কর্মকর্তার মতে, ভারতীয় ট্রেনে অ্যান্টি-কলিশন ডিভাইস ইনস্টল করার বিষয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে, তবে সিস্টেমটি এখন কেবল দুটি প্রধান রুটে ইনস্টল করা হচ্ছে—দিল্লি-কলকাতা এবং দিল্লি-মুম্বাই। কিন্তু এই ধরনের প্রযুক্তি ট্রেনের লাইনচ্যুতি এড়াতে ঠিক কতটা সহায়তা করবে তাও স্পষ্ট না।
২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গে একটি যাত্রীবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত এবং একটি আসন্ন মালবাহী ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষে ১৫০ জনের বেশি লোক নিহত হয়েছিল। তদন্তকারীরা বলেছেন, মাওবাদী বিদ্রোহীরা ট্র্যাকটিতে নাশকতা করেছিল যার ফলে কলকাতা-মুম্বাই যাত্রীবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত হয় এবং এর পাঁচটি বগিকে অন্য ভাল ট্রেনের আসারে পথে ফেলেছিল। তবে শুক্রবারের দুর্ঘটনায় এখনো কোনো নাশকতার আভাস পাওয়া যায়নি।
(ঢাকাটাইমস/৪জুন/এসএটি)