উপমহাদেশ খ্যাত ধামরাইয়ের ঐহিত্যবাহী রথযাত্রা

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ঐতিহ্যবাহী ধামরাইয়ের রথ নিয়ে লিখেছেন, ‘ধামরাই রথ, কোন অতীতের বৃদ্ধ সুত্রধর, কতকাল ধরে গড়েছিল এরে করি অতি মনোহর।’ একটি কথা প্রচলিত আছে, হিন্দুদের বারো মাসে তের পার্বণ। সনাতন সম্প্রদায়ের তেমনই এক লোকারণ্যের উৎসব রথযাত্রা। বলছি, প্রায় ৪০০ বছরের পুরানো উপমহাদেশ খ্যাত ঢাকা জেলার ধামরাইয়ের ঐতিহ্যবাহী শ্রী শ্রী যশোমাধব রথযাত্রার কথা।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলায় পাল বংশের রাজা ‘যশোপাল’ একদিন হাতির পিঠে চড়ে ধামরাই অঞ্চলের পাশের গ্রাম শিমুলিয়া বেড়াতে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে হঠাৎ লাল মাটির একটি উঁচু ঢিবির সামনে রাজাকে বহনকারী হাতিটি থেমে যায়। শতচেষ্টা করেও মাহুত যখন হাতিকে সামনে নিতে পারলো না, তখন রাজা ভীষণ অবাক হলেন। রাজা যশোপাল তখন হাতি থেকে নেমে স্থানীয় লোকজন কে ওই মাটির ঢিবি খনন করার নির্দেশ দেন। রাজা নিজেই এই খনন কার্য তত্ত্বাবধান করেন। এক পর্যায়ে সেই মাটির ঢিবিতে একটি সুরক্ষিত মন্দিরের সন্ধান মিলে। মন্দিরটিতে শ্রী বিঞ্চু মূর্তির অনুরূপ শ্রী মাধব মূর্তি পাওয়া যায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাজা যশোপাল ছিলেন পূজাবৎসল ও খুবই ধার্মিক। তিনি ফিরে ধামরাই সদরে ঠাকুরবাড়ির পঞ্চাশ গ্রামের বিশিষ্ট পণ্ডিত শ্রী রামজীবন রায় কে ওই মাধব মূর্তি প্রতিস্থাপনের দ্বায়িত্ব দেন। শ্রী মাধবের নামের সঙ্গে রাজা যশোপালের নামটি যুক্ত করায় বিগ্রহের নতুন নাম হয় ‘শ্রী শ্রী যশোমাধব’। পরবর্তীতে শ্রী শ্রী যশোমাধব কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে ধামরাইয়ে শ্রী শ্রী যশোমাধব মন্দির এবং রথযাত্রা ও মেলার সূচনা হয়।
যশোমাধব ঠাকুরের কুষ্ঠিনামা অনুসারে বাংলা ১০৭৯ সালে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১২০৪ সাল পর্যন্ত রথযাত্রা চলে এসেছে। সূচনালগ্নে একটি বাঁশের রথ নির্মাণ করে পণ্ডিত রামজীবন রায় মৌলিক এই রথ উৎসবের প্রচলন করেন ধামরাইয়ে। বাংলা ১২০৪ থেকে ১৩৪৪ সাল পর্যন্ত বালিয়াটির জমিদাররা বংশানুক্রমে ধামরাইয়ে চারটি রথ তৈরি করেন। বালিয়াটির জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় রথযাত্রা অব্যাহত থেকেছে। ১৩৪৪ সালে রথের ঠিকাদার ছিলেন নারায়ণগঞ্জের স্বর্গীয় সূর্য নারায়ণ সাহা। এ রথ তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় এক বছর (বাংলা ১৩৪৩ শ্রাবণ থেকে ১৩৪৪ আষাঢ় পর্যন্ত)। কালিয়াকৈর, সাটুরিয়া, সিংগাইর ও ধামরাইয়ের কাঠশিল্পীরা যৌথভাবে নির্মাণ কাজে অংশ নিয়ে ৬০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট রথটি তৈরি করেন। এ রথটি ত্রিতলা বিশিষ্ট ছিল। রথের ঘোড়া দুটি খোঁদাই করেছিলেন বালিয়াটির যোগেন্দ্র লাল সূত্রধর। এই রথ টানার জন্য ২৭ মণ পাটের কাছি দরকার হতো। ১৩৪৪ সালের রথে ও পূর্বের রথে যে চিত্রকর্ম খোদিত ছিল তা হিন্দু ধর্মের মহাভারত, রামায়ণের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলী নিয়ে চিত্রিত ছিল। তাছাড়া পৌরাণিক চিত্রের সাথে সামঞ্জস্য ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর চিত্রিত ঘটনার দৃশ্যও স্থান পেয়েছিল সেই রথের গায়ে। ধামরাই রথের শিল্পকর্ম একসময় ঢাকা আর্ট কলেজের শিক্ষার্থীদের সিলেবাস ভুক্ত ছিল।
১৯৫০ সালে (১৩৫৬ বঙ্গাব্দ) জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা (আর.পি সাহা) এগিয়ে আসেন। বিখ্যাত সমাজসেবক আরপি সাহা পাক বাহিনীর হাতে অপহৃত (৭ মে, ১৯৭১) হওয়ার আগ পর্যন্ত এই রথ উৎসবের যাবতীয় খরচ বহন করেছেন। ১৯৭১ সালে (বাংলা ১৩৭৭ সালের ২৭শে ও ২৮শে চৈত্র) উপমহাদেশ খ্যাত ধামরাইয়ের ঐতিহ্যবাহী গৌরবময় নিদর্শন ৬০ ফুট উচ্চতার রথটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় পুড়িয়ে দেয়। বর্তমানে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট্রের চেয়ারম্যান আরপি সাহার নাতি রাজিব প্রসাদ সাহা শ্রী শ্রী যশোমাধব মন্দিরে সহায়তা অব্যাহত রেখেছেন। বাংলাদেশস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের অনুদানে ধামরাইয়ের বর্তমান রথটি ২০১০ সালে নির্মাণ করা হয়।
রথযাত্রা উপলক্ষে ধামরাইয়ের মাধববাড়ী থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত প্রায় এক কিমি সড়কের দু’পাশ জুড়ে হরেক রকমের পসরা সাজিয়ে মেলা বসে। নগরায়নের ফলেও মেলার জৌলস ফুরিয়ে যায় নি। মেলায় দেখা মিলবে বাহারি রঙের মৃৎ শিল্প ও কারুশিল্পের দোকান, সার্কাস দল, নাগরদোলা, পুতুল নাচ, শিশুদের খেলনা, কাঠের ফার্নিচার, কাঁসা-পিতল ও কুটির শিল্পের উপকরণসহ কয়েকশ স্টল। এছাড়াও বিভিন্ন রকমের মনোহারি খাবারসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তো আছেই। মেলা নিয়ে বাবু গুহঠাকুরতা লিখেছিলেন, ‘আমি মেলা থেকে তাল পাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি। বাঁশি কই আগের মতো বাজে না। মন আমার তেমন যেন সাজে না। তবে কি ছেলেবেলা অনেকদূরে ফেলে এসেছি।’
অতীতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এমনকি ভারত, নেপাল, বার্মা থেকেও এই রথমেলা ঊপলক্ষে লোকজন এসে ভীড় জমাতো ধামরাইয়ে। এখনও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভক্তরা এসে ভীড় জমায় প্রতি রথের মেলায়। এক সময় ধামরাই সদরের মধ্যভাগ দিয়ে বয়ে যাওয়া বংশী ও কাকিলাজানি নদীর দুপাড়ে তীর্থ যাত্রীদের নৌকা এসে ভীড়ত। এর মধ্যে দ্বিতল নৌকার দৃশ্য খুবই মনোহর ছিল বলে স্থানীয় প্রবীণদের কাছ থেকে জানা যায়। নদীমাতৃক বাংলাদেশে যোগাযোগের অন্যতম প্রধান মাধ্যম নদী পথে পাল তুলা নৌকা আজ বিরল। যুগের প্রবাহে বংশী-কাকিলাজানি নদীর নাব্যতা কমেছে কিন্তু শ্রী শ্রী যশোমাধব দেবের রথযাত্রা উৎসব প্রাচীন এ জনপদের মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে আজো মিশে আছে। এ বছর শ্রী শ্রী যশোমাধব দেব এর রথযাত্রার শুভ উদ্বোধন হবে ২০ শে জুন (মঙ্গলবার) এবং যাত্রাবাড়ি থেকে উল্টো রথযাত্রা ২৮ জুন অনুষ্ঠিত হবে।

মন্তব্য করুন