বঙ্গবন্ধু অনন্য এক মনস্তাত্ত্বিক গবেষক
এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার
প্রকাশিত : ১১ আগস্ট ২০২৩, ১০:১৮

মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় রেখে ধুরন্ধর পাকিস্তানি ইন্টেলিজেন্স তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বিশেষ এক শ্রেণির সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অন্ধতা উপলব্ধি করে পাকিস্তানি শাসকদেরকে যে গুরুত্বপূর্ণ শলা পরামর্শ দিয়েছে তা চল্লিশের দশকের গোড়া থেকেই বিশেষ কায়দায় নানা ধরনের সুবিধা প্রদানের মধ্য দিয়ে ধর্মীয় মোড়কে একটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষ গড়ে তোলবার চেষ্টা করেছে এই ভেবে যে, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের এ অংশের প্রগতিশীলরা যেন কোনোভাবেই স্বাধীনতার স্বপ্নকামী হতে না পারে । সেই সঙ্গে রাষ্ট্রনীতির জনপ্রশাসন এবং অন্যান্য প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য কোনো বাঙালি অফিসারের পদায়ন তখন ছিল না বললেই চলে। ধর্মীয় অন্ধতা পুঁজি করার আরেকটি বড় সুযোগ তাদের হাতে সৃষ্টি হয়েছিল ব্রিটিশদের সঙ্গে লেজুড়বৃত্তি করে অবনত মস্তকে তোষামোদি করে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের ভাগ হিসেবে ১৯৪৭ এ মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের জন্ম হওয়াতে খুব সহজেই তদানীন্তন পাকিস্তানের এই অংশের মানুষকে মুসলমান হিসেবে আবেগ তাড়িত করে ধর্মের বাইরে যাতে কোনো জাতীয়তাবাদের জন্ম হতে না পারে সে লক্ষ্যে এ শ্রেণির মানুষদেরকে পাকিস্তানি ভাবধারায় চিন্তাভুক্ত করবার জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল। যদিও বলতে মোটেও দ্বিধা নেই, ইসলাম ধর্মের এমন কোনো নবী রাসুল কিংবা অধ্যাত্ম মার্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো আল্লামা ইকবাল ব্যতিত কোনো অতিমানব কিংবা অধিমানবের উল্লেখযোগ্য কোনো ইতিহাস পশ্চিম পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ছিল না। তদুপরি তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের বিরাট সংখ্যক মুসলমানের মধ্যে এমন একটি ধর্ম ভাবের জন্ম দিতে তারা সক্ষম হয়েছিলেন এমন করে যেন ইসলাম ধর্মের মূল চেতনা, মর্মার্থ, দর্শন, মূল্যবোধ নান্দনিকতা সবকিছুই পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে উদ্ভূত হয়েছে, এমনই নানান চাতুরতার বীজ বপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন আজকের এ বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে।
আমার জানামতে বঙ্গবন্ধু ব্যতীত বিশ্বের আর কোনো নেতা ধর্মীয় মনস্তত্ত্বকে পরিবর্তন করে সাংস্কৃতিক ভাবধারার অসাম্প্রদায়িক মনস্তত্ত্বের কোনো জাতিরাষ্ট্রের জন্ম দিতে সক্ষম হননি। সে বিবেচনায় নিঃসন্দেহে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বনন্দিত অনন্য এক মনস্তাত্ত্বিক গবেষক।
এ মহান নেতাকে জানতে চাইলে ব্যাখ্যায়িত বিষয়গুলো আরো অনেক বেশি গবেষণার প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে অপ্রকাশিত, অজানা বঙ্গবন্ধুর পরিসর হয়তো সসীমকে ছাড়িয়ে তারও পরে হাতছানি দেয়। হাজার হাজার বছর পূর্বে যাত্রা শুরু করে বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে সংস্কৃতির বিভিন্ন রূপ-রস-গন্ধের মধ্য দিয়ে কর্ষিত হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরিপূর্ণতা পায় ক্ষণজন্মা মানুষোত্তম শ্রেষ্ঠ পুরুষ মহাকালের মহাবীর বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হাতে।
প্রাসঙ্গিক আলোচনায় সমালোচনাকে বিবেচনায় নিলে বাংলা ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় ভারত অংশের কলকাতা আসাম ত্রিপুরা এসব অঙ্গরাজ্যে বাঙালি মানুষের বসবাস থাকায় সেখানে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে শিল্প সাহিত্য ধর্ম নানাবিধ বিষয়কে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে নানাবিধ গ্রুপ তৈরি হতে দেখা যায়। তাদের মধ্যে বিশেষ একটি অংশ এপার বাংলা কেন্দ্রিক যেকোনো শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি রাজনীতি কিংবা ভাষার প্রশ্নে তারা সবসময়ই বেশ আপোষহীন চরিত্রের ভূমিকা রেখেছেন, তা হোক না খুব মহামূল্যবান কিংবা সামান্য বুদ্ধিবৃত্তিক, বিরোধিতা করাই তাদের বিদ্যা প্রকাশের অবলম্বন।
বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে এদের মধ্যে কেউ কেউ সেটি অখন্ড বাঙালি জাতীয়তাবাদ নয় বলে ব্যাখ্যা যুক্তি অনেক কিছুর অবতারণা করেছেন। জাতীয়তাবাদ বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য চেতনার চেয়ে সীমানা প্রাচীরের মধ্যেই সুকৌশলে মূলত আটকে রাখার চেষ্টাই করেছেন তারা। অবশ্য বলতে দ্বিধা নেই, শক্তিশালী পাকিস্তান সামরিক জান্তার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে পূর্ববাংলার বাংলা ভাষাভাষী মানুষ তাদের প্রাণের ভাষা রক্ষা ও জাতীয়করণের লক্ষ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে জীবন উৎসর্গ করে পৃথিবীর ইতিহাসে রক্ত দিয়ে ভাষা বাঁচাবার মৌলিক ইতিহাস রচনা করেছেন যা ভারতীয় অংশের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের এমনতর অহংকারের জায়গাটি তৈরি করা সম্ভব হয়নি। বরং বললে অত্যুক্তি হবে না যে দিল্লির মসনদকেন্দ্রিক তারা নিজেদেরকে কেন্দ্রীভূত করে হিন্দি ভাষার পতাকা তলে বাংলা ভাষাকে সমর্পিত করে নিজেদেরকে মানিয়ে নিয়েছেন বেশ।
তাত্ত্বিক এ মানুষগুলোর চেয়ে বঙ্গবন্ধুর অন্তর্দৃষ্টি ছিল হাজার গুণ অগ্রসরমান। তাই তিনি সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী পশ্চিমবাংলার বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ রচনার প্রেক্ষাপটে একত্রিকরণ করে আলোচকদের দৃষ্টিভঙ্গির বাঙালি জাতীয়তাবাদ রচনায় তিনি দৃঢ় পদক্ষেপ রাখেননি। কারণ যৌক্তিকভাবেই তারা স্বাধীন ভারতের নাগরিক। অন্যদিকে ভাষা প্রশ্নে পূর্ব বাংলার মানুষের মতো অত্যাচার নিপীড়নের শিকার হয়ে পশ্চিম বাংলার মানুষকে ভাষা রক্ষার আন্দোলন করবার কোনো প্রয়োজনীয়তার মুখোমুখি হতে হয়নি। তাছাড়াও বঙ্গবন্ধুর অন্তর্দৃষ্টির দূরদৃষ্টি পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করবার একান্ত লক্ষ্যে অটুট ছিল। সে প্রেক্ষাপটে সমস্ত বাঙালি ভাষাভাষীর মানুষের সমগ্র ভূখণ্ড নিয়ে একটি জাতি রাষ্ট্র গঠন করার মতো এতটা অদূরদর্শী কিংবা অপরিণামদর্শী জাতীয়তাবাদী নেতা ছিলেন না বঙ্গবন্ধু মোটেও।
জেনে রাখা দরকার, ভাষা সংস্কৃতি দর্শন মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার সমন্বিত নান্দনিক বোধে যে জাতীয়তাবাদ ভাবনা আত্মপ্রকাশ করে তাকে কোনো ভূখণ্ড দ্বারা সীমায়িত করে রাখা সম্ভব নয়। বুদ্ধিজীবিতার প্রশ্নে কলকাতা ভিত্তিক বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই সেটি অনুধাবন করতে না চাইলেও বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অনুভূতিতে তা ছিল ক্রিস্টাল ক্লিয়ার। অবশ্য পশ্চিম বাংলার সাধারণ বাঙালি ও বিশেষ এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা বঙ্গবন্ধুকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলে হৃদয়ে লালন পালন করেন আর তার প্রমাণ তারা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চায় এখনো যেমন বঙ্গবন্ধুকে সেই মর্যাদার আসনে রেখেছেন সেই সঙোগ স্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সার্বিক সহযোগিতা করে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ জন্ম দেয়ার মধ্যে দিয়ে চূড়ান্ত বাঙালি জাতিরাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে।
প্রসঙ্গক্রমে পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বঙ্গবন্ধুর প্রতি হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বাংলাদেশ সফরে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করে মন্তব্যে উল্লেখ করেন, ‘এই উপমহাদেশের প্রতিটি মুক্তিকামী, মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষের মনে বঙ্গবন্ধু এক জ্বলন্ত অনুপ্রেরণা। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্থপতি এবং পিতা। বাংলা ভাষাকে বিশ্বের মঞ্চে অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বে মর্যাদা এনে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সেই বিরল নেতা, যার প্রতি ধর্মমত নির্বিশেষে সকল মানুষ প্রণাম জানিয়ে ধন্য হয়।’
একদিকে পাকিস্তানিদের ধর্মকেন্দ্রিক মনস্তত্ত্ব অন্যদিকে ভারতকেন্দ্রিক বাংলা ভাষাভাষী বুদ্ধিজীবীদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত মনোভাবকে অত্যন্ত নিখুঁত ব্যবচ্ছেদ করে নিজস্ব ধারার জাতীয়তাবাদের ছায়াতলে সব ধর্মবর্ণের মানুষকে একত্রিত করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতিরাষ্ট্র তথা স্বাধীন বাংলাদেশকে বিশ্বমানচিত্রে জায়গা করে দিয়ে বিশ্বদরবারে বঙ্গবন্ধু আজও রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বের অনন্য গবেষক হিসেবে সমাদৃত।
লেখক: পুলিশ সুপার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

মন্তব্য করুন