বর্ষা মৌসুমেও বাজারে নেই দেশীয় মাছ

রেজাউল করিম, টাঙ্গাইল
  প্রকাশিত : ১৭ আগস্ট ২০২৩, ১৭:২২| আপডেট : ১৭ আগস্ট ২০২৩, ১৭:২৬
অ- অ+

টাঙ্গাইলের ওপর দিয়ে জালের মতো ছড়িয়ে আছে যমুনা, ধলেশ্বরী, বংশাই, পুংলী, ঝিনাই, লৌহজং, এলংজানি ও বৈরানসহ বেশ কয়েকটি নদী। ভরা মৌসুম। চারদিকে বর্ষার পানি থৈথৈ করছে। অথচ বাজারে নেই দেশীয় প্রজাতির মাছ। ক’দিন আগেও বলা হত মাছে-ভাতে বাঙালি। গোলার ধান আর পুকুরের মাছ যেন সহজলভ্য ছিল প্রতিটি বাঙালির কাছে। নব্বই দশকেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। একবিংশ শতাব্দি বাঙালি দরজায় যখন থেকে নাড়া দিল তখন থেকেই মাছে-ভাতে বাঙালি কথাটা যেন হারিয়ে যেতে লাগল।

বর্তমানে কৃষিজমিতে ব্যাপক হারে কীটনাশক ও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে নদী-নালা, খাল-বিল, উন্মুক্ত জলাশয়ের পানি দূষিত হচ্ছে। ফলে জলাশয়ের স্বচ্ছ পানি বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে দেশীয় মাছ কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া বর্ষার শুরুতে বেড়জাল ও কারেন্ট জাল দিয়ে মা মাছগুলো নিধনের ফলেও দেশীয় মাছ বিলপ্ত হচ্ছে। একটি অসাধু চক্র মাছে ডিম ও পোনা মাছ ধরেও দেশীয় মাছের সংকট সৃষ্টি করছে। এতে প্রায় দেশীয় অর্ধশতাধিক প্রজাতির মাছ বিলপ্ত হয়েছে। দেশীয় মাছের বাজার দখল করেছে বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির হাইব্রিড মাছ। টাঙ্গাইলের নদ-নদীতে মাছ কমে যাওয়ার ফলে দিনদিন পেশা ছাড়ছে এ অঞ্চলের জেলেরা। দারিদ্র্য জেলেরা মাছ ধরতে না পেরে অর্থাভাবে অন্য পেশায়ও যেতে পারছে না। ফলে অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করছে। ভরা বর্ষা মৌসুমেও বাজার ঘুরে দেশীয় মাছের আকাল দেখা গেছে। কোথাও কোথাও দেশীয় মাছ মিললেও দামে চড়া।

দেশীয় প্রজাতির মাছ বিশেষ করে মাগুর, চাপিলা, শিং, পাবদা, টাকি, রুই, কাতল, মৃগেল, চিতল, রিটা, গুজি আইড়, কৈ, বোয়াল, খৈলসার মতো সুস্বাদু দেশীয় মাছগুলো এখন আর তেমনটা চোখে পড়ে না। দেশি সরপুঁটি, গজার, জেব্রা, এলঙ, বামাশ, টাটকিনি, তিতপুঁটি, বাঘা আইড়, গুলশা, কাজলি, গাং মাগুর, চেলা, বাতাসি, বউরাণী, টেংরা, কানি পাবদা, পুঁটি, মলা, কালোবাউশ, শোল, মহাশোল, রিটা, তারা বাইম, বেলেসহ ৪০ থেকে ৫০টি জাতের মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে। হাট-বাজারে গেলেও দেশীয় মাছের দেখা মেলে না। পুকুরে চাষ করা হাইব্রিড মাছে সয়লাব মাছের বাজার। যেসব পুকুরে একসময় দেশীয় প্রজাতির মাছ পাওয়া যেতো, সেইসব পুকুরে এখন বিভিন্ন প্রজাতির হাইব্রিড মাছ চাষ হচ্ছে । ফলে মিঠা পানির দেশীয় প্রজাতির মাছের স্থান দখল করেছে পুকুরে উৎপাদিত হাইব্রিড মাছ।

বাজারগুলোতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় খামারে চাষ করা পাঙ্গাশ মাছ। শিং,কই বা পাবদাও এখন হাইব্রিড। উন্মক্ত জলাশয়ের এসব মাছ এখন আবদ্ধ পুকুরে চাষ হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, সেচ দিয়ে মাছ শিকার, মুক্ত জলাশয়ের মাছের জন্য নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে চলাচলে বাধাগ্রস্ত এবং অবাধ মৎস্য নিধনের কারণে বিলুপ্ত হচ্ছে দেশীয় মাছ। বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজাতিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে মহাবিপন্ন, সঙ্কটাপন্ন ও বিপন্ন প্রজাতি। মহাবিপন্ন প্রজাতি মাছের মধ্যে রয়েছে টাটকিনি, ঘারুয়া, বাঘাইড়, রিটা, রাণী, পাঙ্গাশ, বামোশ, নাফতানি, চিতল, ও চাকা। সঙ্কটাপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে বাচা, ছেপচেলা, ঢেলা, বাঁশপাতা, কুঁচে, নাপতে কই, বাতাসিয়া টেংরা, ফলি ও গুজিআইড়। বিপন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে রয়েছে গুলশা, গনিয়া, দাড়কিনা, আইড়, পাবদা, বড়বাইম, গজার, তারাবাইম, তিতপুঁটি, নামা চান্দা ও কালোবাউশ।

দেশে উন্মক্ত জলাশয়ের আয়তন ৪০.৪৭ লাখ হেক্টর, যা মোট অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের শতকরা ৮৮.৪৬ ভাগ। তথ্য বলছে, বাংলাদেশের জলাশয়ে ২৬০ প্রজাতির দেশীয় মাছ, ১২ প্রজাতির বিদেশি মাছ এবং ২৪ প্রজাতির চিংড়ি রয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্য খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। স্থুল জাতীয় উৎপাদনে এ খাতের অবদান শতকরা প্রায় ৪ ভাগ এবং কৃষির উৎপাদনে শতকরা ২১ ভাগ। জাতীয় রপ্তানি আয়ে মৎস্য খাতের শরিকানা শতকরা প্রায় ৪ ভাগ। আমাদের নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৫৮ ভাগ সরবরাহ আসে মাছ থেকে। এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডে প্রায় ১৩ লাখ শ্রমিক সার্বক্ষণিকভাবে এবং ১ কোটি ২৫ লাখ শ্রমিক খণ্ডকালীনভাবে নিয়োজিত আছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, কর্মসংস্থানে, দারিদ্র্য মোচনে এবং প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি দূরীকরণে মৎস্য খাতের উন্নয়ন অপরিহার্য।

বদ্ধ জলাশয়ের মধ্যে আছে পুকুর, মরা নদীর অংশ বা বাঁওড় ও উপকূলীয় চিংড়ি খামার। এর আয়তন ৫.২৮ লাখ হেক্টর, যা মোট অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের ১১.৫৪ শতাংশ। আমাদের সমুদ্র তটরেখা ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ। মোট সামুদ্রিক জলসম্পদের আয়তন ১৬৬ লাখ হেক্টর, যা দেশের মোট জলসম্পদের ৭৮.৩৯ শতাংশ। এছাড়া দেশে অসংখ্য পুকুর রয়েছে, যার মোট জলভাগের আয়তন প্রায় ৩,০৫,০২৫ হেক্টর। জাতীয় পর্যায়ে প্রায় ৪৬% পুকুরে (পুকুরের মোট আয়তনের ৫২%) মাছচাষ হয়।

দেশীয় মাছ কমে যাওয়ায় জেলেদের চলছে মানবেতর জীবন। তারা বলছেন, জালে ওহন আর মাছ পাই না। আগে নদীতে গেলেই মাছ পাইতাম। বেলা উঠার আগেই পাড়ার জেলেদের নিয়ে নদীতে যাইতাম। কতো সময় পালানে (পরিত্যক্ত জমি) জাল বাইতাম। ঘণ্টা খানেক জাল বেয়ে ১০টার আগেই বাজারে মাছ উঠাইতাম। কাওরে ভাগ ভাটওয়ারাও দিতে অইতো না। যা কামাইতাম ওতেই সংসার চইলা যাইতো। ওহন মাছ সব পালা। খোলা পানিতে চাইলেই মাছ পাই না। ওহন পালা মাছ মাইরা দিতে অয়। একদিন একজনের পুকুরে পালা মাছ মাইরা দিলে পরের দিন বেকার বইয়া থাকি। টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইলের জেলে ফনিন্দ্র রাজবংশী, লক্ষণ রাজবংশী, কানাই রাজবংশীর সাথে কথা বলে এমন বক্তব্য পাওয়া গেল। ওদের মতো জেলে পাড়ার অনেকেই এখন মানবেতর জীবন যাপন করছে। মা মাছ নিধন, কারেন্ট জালের ব্যবহার, কৃষিজমিতে ব্যাপক হারে কীটনাশক ও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে নদী-নালা, খাল-বিল ও জলাশয়ের পানি দূষিত হচ্ছে। আর এ কারণে আগের তুলনায় জলাশয়ে মাছ অনেক কমে গেছে বলে মনে করছেন জেলা মৎস অফিসসহ এ অঞ্চলের জেলেরা।

কানাই রাজবংশী বলেন, এক সময় মাছ ধরতে গেলে মাছে নৌকা বোঝায় হয়ে যেতো। কিন্তু এখন আগের উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরা যায় না। খাল-বিলে মাছ কমে যাওয়ায় অনেক জেলে বাব-দাদার পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। আগে খোলা নদীনালা থেকে স্বাধীনভাবে মাছে ধরে সংসার ভালোভাবেই চলত। এখন মুক্ত নদনদীতে আগের মতো মাছ না থাকায় চাষ করা পুকুরে দিনমজুর হিসেবে মাছ ধরে দিতে হয়। এতে সপ্তাহে দু-একদিন পুকুরে মাছ ধরার সুযোগ পেলেও বেশিরভাগ দিন কাটে বেকারে।

মৎস সপ্তাহের সময় নানা পদক্ষেপে স্বপ্ন দেখালেও সারা বছর বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যায় না এমন অভিযোগ জেলেদের।

জেলা মৎস্য অফিস জানায়, জেলায় ৪১ হাজার ৪৯৫টি পুকুর রয়েছে। এছাড়াও বিল ২৯৮টি, বাওড় ৩টি, পেন কালচার ৪টি, টি নদী ও ১২৮টি খাল রয়েছে। এ এলাকায় মাছের চাহিদা ৭৩ হাজার মেক্ট্রিকটন। মুক্ত জলাশয়ে মাছ কমে যাওয়ায় বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষ বাড়িয়ে মাছের চাহিদা পুরণ হচ্ছেনা। বর্তমানে হাইব্রিড বিভিন্ন জাতের মাছ চাষ হচ্ছে। ফলে এসব মাছ চাষের আগে পুকুর ও ডোবার পানিতে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোয় মাছ, শামুক ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রজননক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। এদিকে অধিক মুনাফার আশায় হাইব্রিড মাছের চাষ করতে গিয়ে জলাশয়গুলো থেকে দেশীয় মাছের বিলুপ্তি ঘটানো হয়েছে। এছাড়া অতিমাত্রায় পুকুর সেচের কারণেও দেশীয় মাছ বিলুপ্তি হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এখনই কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে দেশে আমিষের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন মৎস্য সম্পদের পাশাপাশি জলজ সম্পদও বিলুপ্ত হতে পারে, ফলে প্রকৃতি হারাতে পারে ভারসাম্য। এজন্য কারেন্ট জালের ব্যবহার রোধ করা, প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা মাছ না ধরা,অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ না করা, জলাশয় সংলগ্ন রাসায়নিক সারের ব্যবহার রোধ করাসহ প্রয়োজনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (মাভাবিপ্রবি) পরিবেশ বিজ্ঞান ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, দেশীয় মাছ বিলপ্তির পথে। ইতোমধ্যে মৎস্য বিভাগ এ নিয়ে গবেষনা করছে। সফল হয়েছে। ফলে পাবদা, টেংরা , গুলশা ও কই পাওয়া যাচ্ছে। তবে সেগুলোর দাম বেশি হওয়ায় সাধারণ মানুষের নাগালের বাইওে রয়েছে। দেশীয় মাছ ফিরিয়ে আনতে দুষণমুক্ত পানি, মা ও পোনমাছ নিধন বন্ধ করতে হবে। মৎস্য বিভাগের নির্ধারিত আইনের প্রয়োগ হলে দ্রুত সুফল পাওয়া যাবে।

টাঙ্গাইল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, কৃষিজমিতে ব্যাপক হারে কীটনাশক ও মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারে নদী-নালা, খাল-বিল ও জলাশয়ের পানি দূষিত হচ্ছে। ফলে আগের তুলনায় প্রাকৃতিক মাছ অনেক কমে গেছে। তিনি আরও বলেন, দেশীয় মাছ সংরক্ষণ, পেনা ও ডিমওয়ালা মাছ ধরা বন্ধে আমরা জেলেসহ সাধারণ মানুষদের সচেতন করছি। লিফলেট বিতরণ করছি। এছাড়া নিয়মিত অভিযান কার্যক্রম করছি। বিভিন্ন উন্মক্ত জলাশয়ে সরকারি উদ্যোগে পোনা ছাড়ার ব্যবস্থাও করেছে মৎস্য বিভাগ। ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী ইউনিয়নের খানুরবাড়ির সরাতলা কালীমন্দিও যমুনা নদী থেকে টাঙ্গাইল সদরের ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত অভয়শ্রম ঘোষণা করা হয়েছে। এই সীমানার মধ্যে মাছ ধরা নিষিদ্ধ। এতে পরবর্তীতে সুফল পাওয়া যাবে।

(ঢাকাটাইমস/১৭আগস্ট/এআর)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
ধেয়ে আসছে বৃষ্টিবলয় ‘ঝংকার’, জানুন কতদিন সক্রিয় থাকবে
আজ আবারও শাহবাগ ব্লকেড
শুভ বুদ্ধপূর্ণিমা আজ
যুদ্ধবিরতিকে পাকিস্তানের ঐতিহাসিক বিজয় বললেন শাহবাজ শরিফ
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা