রাজপথ দখলের লড়াইকে ঘিরে বাড়ছে জনমনে উদ্বেগ-আতঙ্ক

দ্বাদশ জাতীয় সংসদকে সামনে রেখে দেশের প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি চূড়ান্তভাবে মুখোমুখী এসে দাঁড়িয়েছে। চলতি অক্টোবর মাস ঘিরে রাজপথ পুরোপুরি দখলে রাখার ঘোষণা দিয়েছে দু’দলই। ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি চলতি অক্টোবরকে ঘিরে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক যেসব কর্মসূচি তুলে ধরেছে তা ইতোমধ্যে জনমনে বেশ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি করেছে। বিএনপি চায় সরকার পতনের আন্দোলনকে চূড়ান্তরূপ দেওয়ার লক্ষ্যে সরকারের ওপর সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করে সরকারের পতন ঘটাতে; আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চায় বিএনপি-জামাত জোটের বিপরীতে পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে নির্বাচন পর্যন্ত মাঠ নিজেদের দখলে রাখতে এবং নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময়সীমার বাইরে গিয়ে একদিন আগেও ক্ষমতা না ছাড়তে। সরকারবিরোধী দলগুলোর হাতে নেওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি ও তা প্রতিহত করতে ক্ষমতাসীন সরকারি দল আওয়ামী লীগের পাল্টা কর্মসূচির মাধ্যমে চলতি এ মাসটি যতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠুক না কেন তা সাধারণ মানুষের জন্য কোনো আনন্দবার্তা বয়ে আনে না—বরং অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাই অধিকতর মূর্ত হয়ে ওঠে।
যদিও অতীতে দেখা গেছে, যেকোনো জাতীয় নির্বাচনের পাঁচ-ছয় মাস আগে থেকেই রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিরোধীপক্ষের ডাকা হরতাল-অবরোধসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও ও মানুষ হত্যার মতো অসংখ্য চরম ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে। সে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বর্তমানে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে সাধারণ জনগণের মধ্যে উদ্বেগ-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক।
তবে বলার অপেক্ষা রাখে না যে— স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পরে নব্বই দশকে বাংলাদেশ যে নব্য গণতান্ত্রিক ধারায় প্রবেশ করেছিল তা থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের মতো কোনো জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশ কখনোই এতটা ভাঙচুর ও জ্বালাও-পোড়াওসহ চরম অরাজক পরিস্থিতিবিহীনভাবে অতিক্রম করেনি। অস্বীকার করা যাবে না যে—এটা জনমনে এক ধরনের দারুণ স্বস্তিদায়য়ক অবস্থা নিয়ে এসেছিল। যদিও নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি পণ্যের মূল্য আকাশছোঁয়া এবং নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ অত্যাশ্যকীয় এসব পণ্যক্রয় করতে বাজারে গিয়ে যারপরনাই হিমশিম খাচ্ছে, তারপরও তাদের মুখে এক ধরনের স্বস্তির ভারসাম্য রেখা দেখা যেত এটা ভেবে যে হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের জঙ্গীরূপ তাদের তেমন একটা দেখতে হয়নি। সাধারণ মানুষ তার কর্মস্থলে অবাধে যাতায়াত করতে পেরেছে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুই স্বাভাবিক গতিতে সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু এখন সাধারণ মানুষের স্থিতিশীল জনজীবনে এক অস্থির ও অস্থিতিশীল বলিরেখা দেখা দিতে শুরু করেছে। এর প্রধান কারণ, বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো চলতি এ অক্টোবর মাসে সরকার পতনের আন্দোলনকে চূড়ান্তরূপ দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করেছে এবং সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকারও ঘোষণা দিয়েছে। এর ফল কী হতে পারে তা কারোরই অজানা নয়। গাড়ি ভাঙচুর, পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ, আগুন সন্ত্রাসসহ জানমালের ব্যাপক ক্ষতিকর বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কাজ অতীতে হয়েছে। বিএনপি-জামাত জোট যদি আবার এসব চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে তৎপর হয়Ñ তাহলে জনমনে উদ্বেগ-আতঙ্ক বিরাজ না করে উপায় কী! পাশাপাশি বিএনপির যেকোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি বানচাল করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা যদি মাঠে অবস্থান করে তাহলে উভয় পক্ষের সংঘাত-সংঘর্ষও অনিবার্য হয়ে ওঠবে। এহেন সম্ভাব্য অরাজক পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে সাধারণ আমজনতার মধ্যে উদ্বেগ-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে ইতোমধ্যেই—যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ইতোমধ্যে ধারণা করা খুব শক্ত হয়ে ওঠছে না যে—নভেম্বরের শুরুতেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে পারে নির্বাচন কমিশন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে উপলক্ষ্য করে এর অব্যবহিত আগের সময়টা যে খুবই স্পর্শকাতর হিসেবে আমলে নেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তা বলাই বাহুল্য। এছাড়া বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি প্রয়োগ—এ বিষয়টা নিয়েও বর্তমান সরকার দারুণভাবে চাপে রয়েছে। এ সুযোগটা সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে বিএনপি যারপরনাই ওঠেপড়ে লেগেছে। বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা পুর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় একটু বেশিই অস্থিতিশীল; যেকোনো সময় চূড়ান্ত-কিছু ঘটে যেতেও পারে। ইতোমধ্যে বিএনপি বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করানোর সবরকম চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে কিন্তু সর্বশেষ প্রাপ্ত সংবাদে জানা গিয়েছে যে, তাদের সেরকম সকল চেষ্টা নাকচ হয়ে গিয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে—আইন অনুযায়ী তাকে কোনোভাবেই বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করানো যাবে না; দেশে রেখেই তাকে সকল চিকিৎসা সম্পন্ন করাতে হবে। বর্তমানে বিদেশে অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকার থেকেও সকলে জানতে পেরেছে যে, বিশেষ বিবেচনায় প্যারোলে মুক্তিপ্রাপ্ত কোনো আসামির বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, আগে বেগম খালেদা জিয়াকে আবার কারাগারে ঢুকতে হবে, অতঃপর আদালতে আবেদন করতে হবে এবং আদালত মঞ্জুর করলে তবেই কেবল বেগম জিয়া বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পাবে। এ থেকে স্পষ্ট ধারণা করা অমূলক নয় যেÑ উল্লিখিত বিষয়গুলোকে পুঁজি করে বিএনপি নিশ্চয়ই একটা মরণকামড় দিতে সচেষ্ট হবে। এটি হবে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোর জন্য দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধী আন্দোলনের শেষ ধাপ। বর্তমানে রাজধানী ঢাকা ঘিরে সমাবেশ ও অঞ্চলভিত্তিক রোডমার্চ কর্মসূচি চলছে। ১৯শে অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ১৫ দিনের এ কর্মসূচি ৫ই অক্টোবর কুমিল্লা-ফেনী-মিরসরাই হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রোডমার্চের মধ্যদিয়ে শেষ হবে। চট্টগ্রামে রোডমার্চ শেষে সমাবেশ থেকে পরের কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করার সম্ভাবনা রয়েছে। ধারণা করা কঠিন নয় যে, ৫ই অক্টোবরের পরে বিএনপি বর্তমান সরকারের পতনের লক্ষ্যে সম্ভাব্য সবরকম শক্তিই প্রয়োগ করতে মাঠে নামবে। সংগত কারণেই সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে আওয়ামী লীগ রাজপথ দখলে রেখে পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে রাখার সর্বোচ্চ কৌশল গ্রহণ করবে এবং সার্বিক অবস্থা মোকাবিলা করার সবরকম চেষ্টাই তারা করে যাবে।
এহেন সম্ভাব্য উত্তপ্ত অবস্থা এড়াতে দেশের দায়িত্বশীল বড়ো দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ইতিবাচক ভূমিকার কোনোই বিকল্প নেই। দুই দলেরই সরকার পরিচালনা ও বিরোধী দলে থাকার দীর্ঘ এতিহ্য রয়েছে। রাজনৈতিক উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে বড়ো দলগুলোর সহনশীলতা ও ধৈর্য ধারণ করতে হবে সর্বোচ্চ মাত্রায়। সাধারণ জনগণ দেশের ঐতিহ্যবাহী ও বৃহৎ দুই রাজনৈতিক দলের পেশীশক্তির মহড়া দেখতে চায় না। চায় না কোনো সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিতে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হোক দেশ ও জনগণের। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন খুবই সন্নিকটে— সকল দলের সমান অংশগহণে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য সাধারণ নির্বাচনই সকলের কাম্য।
আলী হাসান: সাংবাদিক, কলাম লেখক।
সংবাদটি শেয়ার করুন
রাজনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
রাজনীতি এর সর্বশেষ

ইসিতে দ্বিতীয় দিনের মতো আপিল শুরু

দেশজুড়ে নির্বাচনি ব্যস্ততা, কোন পথে বিএনপির রাজনীতি

নায়ক ফেরদৌসের আয় ও সম্পদ সম্পর্কে হলফনামায় যা রয়েছে

আসন পাচ্ছেন ইনু-মেননসহ কয়েকজন, বাকিদের কী হবে?

রাজধানীতে জামায়াতের বিক্ষোভ মিছিল

স্বৈরাচার এরশাদের মতো এ মাসেই অবৈধ সরকারের পতন হবে: রিজভী

দশম দফায় ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ শুরু

জোটবদ্ধ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, ছাড় দেবে যোগ্য শরিকদের

জামিনে কারামুক্ত বিএনপি নেতা দুলু
