রাজনীতির ভাষা পরিশীলিত হওয়া জরুরি

আলী রেজা
  প্রকাশিত : ১৩ নভেম্বর ২০২৩, ১৪:৫০| আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৩, ১৪:৫৭
অ- অ+

নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন রাজনীতির মাঠ ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরাই শুধু নয়, কেন্দ্রীয় নেতারাও এখন জনগণের একটু বেশিই কাছে আসার চেষ্টা করছে। এই নির্বাচনি হাওয়ায় সংসদের বিরোধী দলসহ সংসদের বাইরে থাকা অন্যান্য বিরোধী দলও নানা কর্মসূচি ঘোষণা করছে। ক্ষমতাসীন দলও নানা পাল্টা কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের সক্রিয় জনবান্ধব অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করছে। জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে রাজনীতির মাঠের এটি একটি সাধারণ অবস্থা বলেই মনে করেন সকলে। তবে যে বিষয়টি সাধারণ মানুষকে সবচেয়ে বেশি আহত করে সেটি হলো প্রতিহিংসামূলক ও অসম্মানজনক রাজনীতির পরিভাষার ব্যবহার। রাজনীতির ভাষায় সাধারণত তোষামোদ ও নেতৃত্বের বন্দনাই বেশি থাকে- এটা নতুন কিছু নয়। বিষয়টির চর্চা অতীতেও ছিল। এ কারণেই হয়তো এক সময় রাজনীতিক ও লেখক-সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ ‘তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা’ নামে একটি বই-ই লিখেছিলেন। যাহোক, আমার বলবার বিষয়- সম্প্রতি বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ রাজনৈতিক ভাষার সঠিক ব্যবহার করছেন না। তাদের ভাষায় রাজনৈতিক শিষ্টাচারের যথেষ্ট অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সিনিয়র-জুনিয়র বিবেচনা করা হচ্ছে না। রাজনীতিতে ভাষাগত শিষ্টাচার এখন তলানিতে নেমে গেছে বলা যায়। এর কারণ যদি হয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অশোভন ভাষার ব্যবহার দ্বারা নিগৃহীত করা তাহলে সেটা হবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি নৈতিক অবক্ষয়। রাজনীতিবিদদের ভাষাসংস্কৃতি ক্রমশ অশোভন হওয়ার ব্যাপারটি ঠিক মানায় না। অপ্রাসঙ্গিক ও লক্ষ্যহীন কথাও বলতে শোনা যায় রাজনীতিবিদদের। যেকোনো সহিংস ও ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিপক্ষকে দায়ী করার একটা বালখিল্য বিবৃতি দেন অনেক শীর্ষনেতা। অথচ তদন্ত শেষেই কেবল সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে এ সংক্রান্ত বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার কথা। রাজনীতিবিদদের এ ধরনের আগাম বক্তব্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল প্রমাণিত হয়। এর ফলে রাজনৈতিক বক্তব্য অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। রাজনীতিকরাও জনগণের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েন।

ইদানীং রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মধ্যে অশোভন ও অশালীন ভাষার ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা টকশোতে দেখা যায় অনেকে ব্যক্তিগত আক্রমণ পর্যন্ত করছেন, অনেকে ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকারও হচ্ছেন। অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে দর্শকদেরকেও হতাশ করছেন উভয় পক্ষ। অপ্রয়োজনীয় ও অশালীন ভাষার ব্যবহারে সাধারণ মানুষও আহত হচ্ছেন এসব জায়গায়। কখনো কখনো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে মানুষ। শীর্ষনেতাদের বক্তব্যে পর্যন্ত এখন পারস্পরিক শ্রদ্ধার ছিটেফোঁটাও লক্ষ্য করা যায় না। দেশের সাধারণ জনগণের আবেগ ও সংকটের বিষয় নিয়ে মন্ত্রী পর্যায় থেকেও যে ধরনের কথা বলা হয় তা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনেক সময় ভদ্রতা ও শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এলিট শ্রেণির মানুষ এখন রাজনীতির ভাষাকে কোনো গুরুত্ব দেন না। সম্প্রতি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ যখন দিশেহারা তখন বাণিজ্যমন্ত্রী বলে ফেললেন- ‘দেশের মানুষ সুখে আছে। মেয়েরা এখন তিনবার লিপস্টিক দিচ্ছে।’ এটা কোনো শোভন কথা হতে পারে! রাজনীতিবিদদের মুখে এ ধরনের বাহুল্য কথা প্রায়ই শোনা যায়। বাণিজ্যমন্ত্রীর এসব কথা বলার কি খুব প্রয়োজন ছিল? সময় বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, বাজারে এখন শীতকালীন নতুন শাক-সবজি উঠতে শুরু করেছে। স্বাভাবিকভাবেই এখন কাঁচাবাজারের দর নামতে শুরু করবে। মানুষ একটু হাফ ছেড়ে চলা শুরু করবে। এ সময় এরকম বেফাঁস কথার কোনো প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয় না। রাজনীতির ভাষা মানে সমাজভাষা। যে ভাষায় সমাজ আহত হয় সেটা রাজনীতির ভাষা হতে পারে না। রাজনীতিতে এক সময় মানি সর্বনাম ব্যবহার করা এবং নামের সঙ্গে ‘জনাব’ ‘সাহেব’ জাতীয় সম্মানসূচক শব্দ ব্যবহার করার রেওয়াজ ছিল। এখন মানি শব্দের প্রয়োগ হয় বটে কিন্তু সেখানে তাচ্ছিল্যের গন্ধ পাওয়া যায়। প্রতিপক্ষের সম্মানহানি করাই এখন রাজনীতির ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতে এতটা খারাপ অবস্থা ছিল না। সাতই মার্চের উত্তাল জনসমুদ্রে ভাষণ দিতে গিয়েও বঙ্গবন্ধু যথাযোগ্য রাজনৈতিক শিষ্টাচার বজায় রেখেছেন। ‘আসুন, দেখুন, বিচার করুন’- এই জাতীয় মানি শব্দের ব্যবহার করেছেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু বর্তমানে রাজনীতিতে সে শিষ্টাচার দেখতে পাওয়া যায় না। প্রতিপক্ষের প্রতি ভাষার ব্যবহারে বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ এখন রুচিহীনতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। বিরোধীপক্ষের অনেক নেতাকর্মীর মুখে সরাসরি ‘শেখ হাসিনা’ সম্বোধন রাজনৈতিক ভাষার শোভন ব্যবহার হতে পারে না। আবার ক্ষমতাসীন দলের কোনো নেতাকর্মীর মুখে সরাসরি ‘খালেদা’ সম্বোধনও শোভন নয়। বর্তমানে দেশের সাধারণ মানুষকে দুঃখের সঙ্গে এসব অশিষ্ট ভাষা হজম করতে হচ্ছে। মানুষমাত্রই বাকসংযমী হওয়া উচিত। তবে রাষ্ট্র পরিচালনার যেকোনো গুরুদায়িত্বে নিয়োজিত থাকলে তাকে আরো বেশি বাকসংযমী হতে হবে। জনগণ যাদের কথা শোনার জন্য কান খাড়া করে রাখে সেই রাজনীতিবিদগণ যখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত, গুরুত্বহীন, হাস্যকর কিংবা অন্যকে আহত করার জন্য কোনো অশালীন কথা বলেন তখন সেটা জাতীয় সংকটে পরিণত হয়।

পরিশীলিত ও সম্মানজনক ভাষা একটি সাংস্কৃতিক সম্পদ। এ সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের সমাধান সম্ভব হয়। আবার ভাষার অশালীন ব্যবহারের ফলে অনেক নতুন সংকটেরও জন্ম হয়। যেকোনো দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পরিবেশ তৈরি করার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটি পরিশীলিত ভাষা। আমন্ত্রণের ভাষা সঠিক না হলে অনেকেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন না। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক তাঁর এক কবিতায় লিখেছিলেন ‘ভাষাই আপন করে আর সেই ভাষা করে পর (পরানের গহীন ভিতর-২৩)।’ সমাজভাষার অপপ্রয়োগ যে অনাকাঙিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তা চলমান রাজনৈতিক ভাষাকাঠামো থেকেই বোঝা যায়। কারো বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সেটাকে রাজনৈতিক বক্তব্য কিংবা ব্যক্তিগত বক্তব্য বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলের বক্তব্যই হোক কিংবা কোনো রাজনৈতিক নেতার ব্যক্তিগত বক্তব্যই হোক- সাধারণ জনগণ সেটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সে বক্তব্যকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেন। একটা কথা মনে রাখা জরুরি যে, দায়িত্বশীল রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত নেতাদের বক্তব্য জনগণের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। রাজনীতিবিদদের নিকট থেকে জনগণ গুরুত্বহীন, অশালীন ও হাস্যকর কোনো কথা শুনতে চায় না। গণমাধ্যমকর্মীরা সব সময় রাজনীতিবিদদের কথা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত থাকেন। তাঁদের একটি ভুল কথায় কিংবা ভুল সিদ্ধান্তে দেশের মানুষ হতাশ হয়ে যেতে পারে। বিক্ষুব্ধ হয়ে ধ্বংসাত্মক কাজে যুক্ত হতে পারে। তাতে জীবন ও সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। আবার উল্টো চিত্রও দেখা যায়। নেতার আহ্বানে দেশের মানুষ দেশরক্ষায় কিংবা দেশসেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। স্বেচ্ছায় জীবন দিতেও কুণ্ঠিত হয় না। সুতরাং নেতার কথার শক্তি অপরিসীম। এ শক্তিকে তুচ্ছ মনে করার কোনো কারণ নেই। মঞ্চে দাঁড়িয়ে জনগণের উদ্দেশে দেওয়া নেতার কোনো ভাষণ কিংবা সাংবাদিক সম্মেলনে দেওয়া কোনো বক্তব্যকে জনগণ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যই মনে করে। পরস্পরের প্রতি হিংসাত্মক বক্তব্য, সম্মানহানিকর বক্তব্য বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনকে ক্রমশ দূষিত করে তুলছে।

নেতাদের অশালীন ও আক্রমণাত্মক কথায় সাধারণ মানুষ আজ যারপরনাই বিস্মিত। এই ভাষা-সংস্কৃতি থেকে রাজনীতিবিদদের বেরিয়ে আসতে হবে। এ প্রসঙ্গে ছোট্ট একটি গল্প মনে পড়ল। গল্পটি এরকম: প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ’র কাছে গিয়ে তাঁর এক প্রতিবেশী যুবক বলল, স্যার ঢাকা যাচ্ছি, দোয়া করবেন। প্রিন্সিপাল স্যার বললেন, তা ঢাকায় গিয়ে কোথায় থাকবে? উত্তরে যুবকটি বলল, বড়ো চাচা যেখানে থাকে। এবার প্রিন্সিপাল স্যার বললেন, বড়ো চাচা যদি ‘থাকে’ হয় তাহলে ‘দন্ত্য ন’টা তুমি কোথায় লাগাবে? তার মানে বড়ো চাচা ‘থাকে’ নয়, বড়ো চাচা ‘থাকেন’ হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে ভাষা-সংস্কৃতি চালু হয়েছে তাতে মানি সর্বনাম বা মানি সম্বোধন বিলুপ্তির পথে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ভাষা ব্যবহারে আরও সতর্ক হতে হবে। সিনিয়র নেতাদের ব্যাপারে কথা বলার সময় যথাযোগ্য সম্মান দেখানো যেমন জরুরি তেমনি কর্মীদের প্রতিও শোভন আচরণ করতে হবে। সম্প্রতি অনেক শীর্ষনেতার অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। বক্তব্যগুলো ব্যাপকভাবে সমালোচিতও হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের রাজনীতির ভাষা সাধারণ মানুষ প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হবে।

আলী রেজা: সহকারী অধ্যাপক। পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
মোহাম্মদপুরে ৩৮০০ পিস ইয়াবাসহ মাদক কারবারি গ্রেপ্তার
সাংবাদিক সাইদুরের প্রাণনাশের হুমকির প্রতিবাদে সাতক্ষীরায় বিক্ষোভ 
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই গণহত্যার তদন্ত রিপোর্ট দাখিল সোমবার
এবার বাংলাদেশের চার টিভি চ্যানেল ইউটিউবে বন্ধ করল ভারত
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা