হরতাল-অবরোধ একটি অকার্যকর রাজনৈতিক কর্মসূচি

আলী রেজা
| আপডেট : ১৯ নভেম্বর ২০২৩, ১৪:০৩ | প্রকাশিত : ১৯ নভেম্বর ২০২৩, ১৩:৫৩

জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সরকারবিরোধী নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। ইতোপূর্বে সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল, বিভাগীয় সমাবেশ করেছে বিএনপি। সবশেষে ২৮ অক্টোবরের সমাবেশ সফল করতে না পেরে বিএনপি সারা দেশে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে। তারপর থেকে দফায় দফায় এ অবরোধ কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে দলটি। সমমনা দলগুলো বিএনপির ডাকা এ অবরোধকে সমর্থন দিয়ে আসছে। কিন্তু মাঠে তাদের কোনো কার্যকর কর্মতৎপরতা চোখে পড়ছে না। এদিকে এ অবরোধকে গুরুত্বই দিচ্ছে না সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগ। বিরোধী পক্ষের এ অবরোধ ঠেকানোর জন্য পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে সারা দেশে শান্তি সমাবেশ করে চলেছে আওয়ামী লীগ। শান্তি সমাবেশ থেকে তারা সরকারের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দলটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি রাজপথে অবস্থান করছে। ফলে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর ডাকা অবরোধ কর্মসূচি কোনো কার্যকর প্রভাব ফেলতে পারছে না। এই হরতাল-অবরোধে দূরপাল্লার বাস না চললেও ট্রেন চলছে। টাউন সার্ভিস বাস কমবেশি চলেছে। স্থানীয় অটোরিকশা ও সিএনজি চলেছে পুরোদমে। সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বিমা ও দোকানপাট খোলা আছে যথারীতি। অতি প্রয়োজনে দূর-দূরান্তেও চলে যাচ্ছে ট্রেনে চেপে। মোটকথা সবাই নিজ নিজ কাজ করতে পারছে। এই হচ্ছে চলমান অবরোধের বাস্তব চেহারা। এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার পতন সম্ভব নয়। চলমান অবরোধ জনজীবনে দুর্ভোগ বাড়াচ্ছে কিন্তু বিএনপি কোনো রাজনৈতিক সুফল পাচ্ছে না। অবরোধের পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে শান্তি সমাবেশ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরছে। এতে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। দীর্ঘ সময় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থেকে দলটি অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে- এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিগত দুটি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে মাঠপর্যায়ে বিতর্ক আছে। বছরের পর বছর এ বিতর্ক চললেও সরকার তা সামাল দিয়ে চলতে সক্ষম হয়েছে। সরকার রাজনৈতিকভাবে বড়ো ধরনের চাপে পড়ে- এমন কোনো কার্যকর গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি বিএনপিসহ বিরোধী পক্ষ। যদিও গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়কে অস্বাভাবিক মনে করে সাধারণ মানুষ। তারপরও আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে পূর্ণ মেয়াদে টিকে থেকেছে। পাঁচ বছরেও নির্বাচন বাতিল কিংবা মধ্যবর্তী নির্বাচনের কোনো পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি বিএনপি। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষ দিশেহারা অবস্থায় ছিল, এখনও দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে আসেনি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো গণঅসন্তোষ সৃষ্টিকারী এই মোক্ষম ইস্যুটিকেও কাজে লাগাতে পারেনি বিএনপি। দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে, মাঠপর্যায়ে ব্যাপক জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও কার্যকর নেতৃত্বের অভাবে কোনো কর্মসূচি সফল করতে পারছে না দলটি। শীর্ষনেতা কারাগারে ও দ্বিতীয় শীর্ষনেতা লন্ডনে অবস্থান করার ফলে নেতৃত্ব শক্তিশালী হতে পারছে না বলে অনেকে মনে করেন। দলের অসংখ্য নেতাকর্মীকে মামলা দিয়ে দুর্বল করে রাখা হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ তার দীর্ঘ শাসনামলে এমন কিছু দৃশ্যমান উন্নয়ন করেছে যা আসন্ন নির্বাচনের মাঠে জনগণের সামনে উচ্চৈঃস্বরে উপস্থাপন করতে পারছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অনেক মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ে তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছে আওয়ামী লীগ। মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিএনপি সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। প্রকল্প খাতে ও ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি হয়েছে বলে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে। কিন্তু সাধারণ মানুষকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মাঠে নামানো যায়নি। সাধারণ মানুষ নিরপেক্ষ ভূমিকাই গ্রহণ করেছে। চোখের সামনে দৃশ্যমান উন্নতি দেখে প্রমাণসাপেক্ষ দুর্নীতির বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায়নি। নেতাকর্মীদের নির্লজ্জ দলবাজি সাধারণ মানুষের পছন্দ নয়। রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতিতে মিথ্যাচার ও অতিকথন এখন সাধারণ মানুষের কাছে চরম বিরক্তির বিষয় হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষ এখন শান্তিতে থাকতে চায়। রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চায়। বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ এ ধরনের মনোভাব পোষণ করে বলে বিএনপি তাদেরকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামাতে পারেনি।

বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর ডাকা চলমান অবরোধ জনসমর্থন পাচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে আরো কিছু বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথম কথা হলো সাধারণ মানুষ মনে করে সরকার পরিবর্তন হলেও তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না। দ্বিতীয়ত আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বিএনপি এর চেয়ে বেশি সুশাসন উপহার দিতে পারবে বলে মনে করে না বেশিরভাগ মানুষ। আওয়ামী লীগ যেটুকু পেরেছে বিএনপি তার চেয়ে বেশি কিছু করে দেখাতে পারবে- এটা বিশ্বাস করা কঠিন। তাই পরিবর্তন নিয়ে জনগণের খুব একটা মাথাব্যথা নেই। বাস্তবতা হলো এখন মানুষ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চায়। কর্মসংস্থানের সুযোগ চায়। বিকর্তিত নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে পূর্ণ মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে এটাই প্রমাণ হয় যে, জনগণ সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেনি। সরকারও জনস্বার্থে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। দেশের জনগণ উন্নয়নের সুফল ভোগ করছে। সারা দেশে সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটেছে। দেশের প্রায় সকল মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত হয়েছে। সড়ক যোগাযোগ নির্বিঘ্ন ও দ্রুততর করার জন্য সারা দেশে অসংখ্য বাইপাস সড়ক ও আন্ডারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। উড়াল সড়ক ও মেট্রোরেল ঢাকা শহরের চেহারা পাল্টে দিয়েছে। পদ্মা সেতুর সুফল ভোগ করছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের আপামর মানুষ। দৃশ্যমান এ উন্নয়নকে অস্বীকার করার উপায় নেই। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া বিএনপি জনস্বার্থে বড়ো কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করেনি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হয়েছিল। এখনো নিত্যপণ্যের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালে আসেনি। কিন্তু দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ইস্যুতে বিএনপি কোনো হরতাল-অবরোধ করেনি। চলমান অবরোধ কর্মসূচিও যতটা দলীয় স্বার্থে ততটা জনস্বার্থে নয়। একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি প্রথমত দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ। এই দায়বদ্ধতাকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। দলটি বারবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিল। ভবিষ্যতে আবার আসবে- এটাই স্বাভাবিক। কোনো ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে দলটি জনবিচ্ছিন্ন হতে পারে না। জ্বালাও-পোড়াও কিংবা মানুষ হত্যার পরিবেশ সৃষ্টি হয়- এমন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি দলটির জনপ্রিয়তা হ্রাস করবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার ইস্যুটি বিএনপির সবচেয়ে বড়ো রাজনৈতিক কর্মসূচি হতে পারতো। কিন্তু সেটা হতে পারেনি। দুর্নীতি, ব্যাংক জালিয়াতি ও দেশের সম্পদ পাচারের বিরুদ্ধে বিএনপি গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারত। কিন্তু তা পারেনি। বিএনপি যে ইস্যুটিতে বারবার আন্দোলনে নেমেছে তা হলো- নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি। দ্রব্যমূল্য, দুর্নীতি ও কর্মসংস্থান ইস্যুতে জনগণ যতটা ঐক্যবদ্ধ ও স্বতঃস্ফূর্ত হতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে জনগণ ততটা ঐক্যবদ্ধ হয়নি। ফলে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর চলমান অবরোধ কর্মসূচি সফল হচ্ছে না। দফায় দফায় অবরোধ দিয়ে এই মুহূর্তে কোনো গণআন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রচার নিয়ে আওয়ামী লীগ এখন মাঠপর্যায়ে ব্যাপকভাবে সরব। ফলে তাদের পক্ষেই জনসমর্থন বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। হরতাল-অবরোধ জাতীয় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে স্বাভাবিকভাবেই জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি পায়। তার ওপর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো ধ্বংসাত্মক ঘটনাও ঘটে। সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে। ফলে সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ হরতাল-অবরোধকে সমর্থন করে না। পেটের দায়ে কাজে যোগ দেয়। চলমান অবরোধে অটোরিকশা-সিএনজি জাতীয় স্থানীয় যানবাহন এতটাই নির্বিঘ্নে চলছে যে জনজীবনে এর কোনো প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অবরোধ সমর্থক কিছু উগ্র দুষ্কৃতকারী গণপরিবহনে অগ্নিসংযোগ করছে। বিএনপি এদেরকে নিজেদের কর্মী বলে অস্বীকার করলেও দায়মুক্ত হতে পারছে না। চলমান অবরোধের সময় বিভিন্ন মামলায় বিএনপির বেশকিছু শীর্ষনেতা গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু এঁদের মুক্তির দাবিকে আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেনি বিএনপি। তবু নির্বাচনে সমতল মাঠ তৈরির প্রয়োজনে এখন বিরোধীপক্ষের গ্রেপ্তারকৃত নেতাকর্মীদের জামিনে মুক্ত করার আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। নির্বাচনকালীন সরকার এ ব্যাপারে যথাসাধ্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। অপরপক্ষে এ ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠার জন্য বিএনপিকে হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও জাতীয় ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি পরিহার করে জনবান্ধব ও জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

আলী রেজা: পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :