নৌকার মাঝি হলেও নির্বাচন থেকে সরে আসতে হচ্ছে যাদের
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজ নিজ সংসদীয় আসন থেকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে দলীয় মনোনয়ন পেলেও নির্বাচন থেকে সরে আসতে হচ্ছে অনেককে। মহাজোটের সমীকরণ এবং আসন ভাগাভাগিতে জোটের শরিক দলকে আসন ছাড়তে হচ্ছে তাদের।
আওয়ামী লীগ এবং মহাজোটের অন্যান্য দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি মোটামুটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। শেষ মুহূর্তে বড় ধরনের কোনো নাটকীয়তা না ঘটলে কমপক্ষে শরিক দলগুলোর জন্য আওয়ামী লীগ প্রায় ৬০টি আসন ছেড়ে দিতে পারে।
সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ৩৫টি আসন পেতে পারে জাতীয় পার্টি। এছাড়াও ওয়াকার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ), তরীকত ফেডারেশন ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জাতীয় পার্টিও (জেপি) কমবেশি আসন পেতে পারে।
একাদশ সংসদে ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে প্রতিনিধিত্ব আছে ওয়ার্কার্স পার্টির তিনটি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) তিনটি এবং তরীকত ফেডারেশন ও জাতীয় পার্টির (জেপি) একটি করে। সব মিলিয়ে আটটি আসন রয়েছে তাদের।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসন সমঝোতা নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে দেন-দরবার চলছে জাতীয় পার্টি ও কেন্দ্রীয় ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের। আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২টি ফাঁকা রেখে ২৯৮ আসনে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে। ইতিমধ্যে ৬টি আসনে নৌকার প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে আসন সমঝোতায় আরও কত নৌকার মাঝিকে বলি হয়ে নির্বাচন থেকে সরে আসতে হচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান একাদশ জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টি থেকে ২৩ জন এমপি রয়েছেন। তবে আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করলেও আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কমবেশি ৩৫টি আসনে ছাড় পেতে যাচ্ছে।
বর্তমান সংসদে জাতীয় পার্টির এমপিরা হলেন-
এছাড়া আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের ৫টি আসনে ছাড় দেবে এমন আভাস দিয়েছে দলটি। এর মধ্যে কুষ্টিয়া-২ আসনে কোনো প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ। ফলে এ আসনটি জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে দেওয়া হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন মনোনয়নপত্র তুলেছেন বরিশাল-২ ও ৩ আসন থেকে। তিনি চান বরিশাল-২ আসন। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী তালুকদার মো. ইউনুস। ফলে মেননকে রবিশাল-২ আসনে নৌকা দিতে হলে তালুকদার মো. ইউনুসকে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে হবে। এছাড়া জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু পিরোজপুর-২ আসন চান। কিন্তু পিরোজপুর-২-এ কানাই লাল বিশ্বাসকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এ আসনে মঞ্জুকে নৌকা দিতে হলে কানাই লাল বিশ্বাসকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে হবে।
তরিকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারি চট্টগ্রাম-২ আসন চান। এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী খাদিজাতুল আনোয়ার। তাকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে হবে। নৌকা চান বাসদ আহ্বায়ক রেজাউর রশিদ খানও।
জাসদ সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার ফেনী-১ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য। তিনিও নৌকা চান। কিন্তু এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আলাউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী। ফলে শিরিন আখতারকে এ আসনে নৌকা দিতে হলে আলাউদ্দিনকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে হবে। কিন্তু শিরিন আখতারকে নৌকা দিতে নারাজ আওয়ামী লীগ। তাকে সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য করতে চায় আওয়ামী লীগ।
এর বাইরেও ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর-কাঁঠালিয়া) আসনে আওয়ামী লীগের আলোচিত প্রার্থী বিএনপির সাবেক নেতা মেজর (অব.) শাহজাহান ওমরের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইকালে কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সালাহ উদ্দীন আহমদের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে নোয়াখালী-৩ (বেগমগঞ্জ) আসনে বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মামুনুর রশিদ কিরণের। বরিশাল-৪ আসনের আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী শাম্মী আহমেদ এবং কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসনে নাসিরুল ইসলাম খান আওলাদেরও মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া কক্সবাজার-১ আসনে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের মনোনয়পত্র বৈধ হয়েছে।
এদিকে, সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন কলারোয়া উপজেলা আ.লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ স্বপন। তবে আসনটিতে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ দিদার বখতকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সাতক্ষীরা-২ (সদর আসন) থেকে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান (পদত্যাগ) আসাদুজ্জামান বাবু। এ আসনটিতে জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেখানে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়েছেন সাতক্ষীরা জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক, ব্যবসায়ী ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব আশরাফুজ্জামান আশু।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের এক সদস্য ও দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য বলেন, আওয়ামী লীগ একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দিতে চায়। ইতিমধ্যে প্রায় ২৯টি দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে। যেহেতু বিএনপি নির্বাচনে আসেনি, সে ক্ষেত্রে নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে অনেক কিছু হিসাব-নিকাশ করতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। কোন দল বিরোধী দল হিসেবে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করবে, সেই হিসাবটাও করতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে আসন বণ্টন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা হয়েছে। এই শরিক দলগুলোকে ৫-৬টি আসন দেওয়া হতে পারে। যেসব আসনে তাদের প্রার্থী করা হবে, সেখানে নৌকার প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করবে।
মনোনয়ন বোর্ডের ওই সদস্য আরও বলেন, জাতীয় পার্টির সঙ্গেও আলোচনা চলছে। তাদের সঙ্গে সমঝোতা হলে, সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করবে না ডামি ক্যান্ডিডেট হিসেবে থাকবে, সেটি আলোচনার ভিত্তিতে সমাধান হবে।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য ঢাকা টাইমসকে বলেন, সমঝোতা হলে অনেক কিছুই হতে পারে। তবে সমঝোতা কতটুকু হয়, সেটি আগে দেখি। এখনও অনেক সময় আছে। এখনও আলোচনা চলছে। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগের দিন পর্যন্ত এটি চলবে।
(ঢাকা টাইমস/০৭ডিসেম্বর/ইএস)