ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে

ফকির ইলিয়াস
 | প্রকাশিত : ০৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১৩:১২

আগামী ৭ই জানুয়ারি ২০২৪ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন নির্বাচনমুখী। কিছু দল নির্বাচনে অংশ না নিলেও, নির্বাচনে ভোটাররা ভোট দেবেন- তা জোর দিয়েই বলা যায়। কারণ এই সময়ে মানুষ খুবই সচেতন। ডিজিটাল যুগে মানুষজন জানেন- তাদের অধিকার কী!

বাংলাদেশে নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে- ততই সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এটা চরম দুঃসংবাদ। কারণ এবারের ভোটে কমপক্ষে ৬৫% ভোট কাস্ট করতে হবে- করা দরকার, তা সরকার, প্রশাসন ও ইসি সকলেই জানেন। তাহলে, এই মারামারি কেন? যদি সরকারের তালুক না থাকে, তা হলে তো এই রাজনীতিক এমপি পদপ্রার্থীদের তালুকও থাকবে না। এটা কি তারা বুঝতে পারছেন না?

মানুষ ভোট দেবেন। তাদের পরিচিত ও যোগ্য মানুষদেরই ভোট দেবেন। তা কোনোভাবেই ক্ষুণ্ন হতে পারে না। আমরা জানি, ২০২৩ সালের শেষ তিনমাস বাংলাদেশ ছিল টালমাটাল। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পরিসংখ্যান বলছে, ২৮শে অক্টোবর থেকে ৯ই নভেম্বর পর্যন্ত ৬৪টি বাস পোড়ানোর ঘটনায় নগরীর বিভিন্ন থানায় ৬৪টি মামলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্স (এফএসসিডি) সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২৮শে অক্টোবর থেকে ২৪শে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৮৯টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এফএসসিডি সদর দপ্তরের মিডিয়া সেল জানায়, এ সময় ঢাকাসহ সারা দেশে মোট ২৮৫টি যানবাহন ও ১৫টি বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আগুন দেওয়া গাড়িগুলোর মধ্যে রয়েছে; ১৮০টি বাস, ৪৫টি ট্রাক, ২৩টি কাভার্ড ভ্যান, ৮টি মোটরসাইকেল এবং ২৯টি অন্যান্য যানবাহন। এছাড়া, কয়েকটি ট্রেনের বগিতেও আগুন দেওয়া হয়েছে। ট্রেন লাইন গ্যাসকাটার দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে। এভাবেই এগিয়েছে, ইলেকশনের রোডম্যাপ। দেখার বিষয় হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুব কড়াভাবেই মোকাবিলা করেছেন অনেক প্রতিকূলতা।

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। একটি বন্ধু এবং সঙ্গী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্মান জানাই আমরা’। বাংলাদেশের নির্বাচন দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয় উল্লেখ করে রাশিয়া ও চীনের পক্ষ থেকেও বিবৃতি দেয়া হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ তৎপরতা দেখা গেছে নভেম্বর মাসে। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘পূর্বশর্ত ছাড়া’ সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে ১৩ই নভেম্বর একটি চিঠি পাঠান। এতে কোনো ফল হয়নি।

নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বলে সরকারের একজন মন্ত্রীর বক্তব্য ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয় গেল বছরটিতে।

১৭ই ডিসেম্বর একটি টেলিভিশন চ্যানেলে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের একটি সাক্ষাৎকার প্রচার হয়। সেখানে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে আনার জন্য বিএনপির সব কারাবন্দী নেতাকে মুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। বিএনপি সেই প্রস্তাবেও রাজি হয়নি’।

এই বক্তব্য নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা তৈরি হলে সরকারের মধ্যেও অস্বস্তি তৈরি হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এমন বক্তব্যকে কৃষিমন্ত্রীর 'ব্যক্তিগত মত' বলে উল্লেখ করেন। জানান, এমন কোনো প্রস্তাব সরকার বিএনপিকে দেয়নি।

তিনি ২৬শে ডিসেম্বর বলেন, ‘বিরোধী দল নির্বাচনের বাইরে থাকুক এটা আমরা কখনোই চাইনি। কিন্তু বিএনপিসহ যারা নির্বাচনে আসেনি, তারা আসলে নির্বাচনটা আরো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতো’।

নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ২৯টি দল ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। সমঝোতার পর ২৬ আসন জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। তবে, এবারের নির্বাচনকে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করবে বলে মনে করছে ক্ষমতাসীনরা।

এই যে স্বতন্ত্র প্রার্থী, এরা কি ঠিকঠাক মতো তাদের নির্বাচন করতে পারবেন? তাদের উপর ক্ষমতবানরা হামলে পড়বে না তো ? এই প্রশ্নটি আসছে ঘুরে ফিরে বার বার।

এটা প্রায় নিশ্চিত যে, এবারের নির্বাচনে বেশ কিছু হেভিওয়েট ঝরে পড়তে পারেন। সমস্যা দেখা দিয়েছে- এই ঝরে পড়া নিয়ে। কারণ এরা কোনো মতেই পরাজয় মেনে নিতে পারছেন না।

পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে- যেদিন আওয়ামী লীগ তাদের মনোনয়নপ্রাপ্তদের তালিকা ২৯৮ আসনে প্রকাশ করে- সেই দিনই শেখ হাসিনা অনুমোদন দিয়ে দিয়েছিলেন, যে-কেউ চাইলে স্বতন্ত্র ইলেকশন করতে পারবেন! তিনি কাউকে দিয়েছেন ‘নমিনেশন’, কাউকে দিয়েছেন ‘পারমিশন’। এই পারমিশনের কারণেই মুলত জমে উঠেছে ইলেকশন।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, প্রতিদ্বন্ধিতা না থাকলে, মানুষ নির্বাচন নিয়ে মাথাই ঘামাতেন না! ভোটার সংখ্যা হতো খুবই কম। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতেই শেখ হাসিনা নতুন রোল প্লে করেছেন। যা বদলে দিয়েছে ভোটের মাঠ। যে বিষয়টি জরুরি, তা হচ্ছে- আগামী নির্বাচন ও স্থিতীশীলতার উপর নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যৎ। দেশ স্ট্যাবল না থাকলে বিদেশিরা বিনিয়োগে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলবে। সেটা মোটা দাগে আসবে আলোচনায়।

রাষ্ট্র দল নির্ভর নয়- রাষ্ট্র গণমানুষ নির্ভর তা প্রমাণ করতে হলে নির্বিঘ্নে ভোটে যাওয়ার নিরাপত্তা মানুষকে দিতে হবে। আরেকটি বিষয় মনে রাখা দরকার, ভোটাররা যদি ভোট দেওয়ার মতো নিরাপদ পরিবেশ না পায় তাহলে ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার কথাও ভাবতে পারেন। অপরদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে ভোটারদের প্রতি ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার দাবি নিয়ে বিভিন্ন প্রচারণা চালানো হচ্ছে দেশব্যাপী। অভিযোগ উঠেছে, কিছু ক্ষমতাসীন এমপিও চাইছেন- তাদের প্রতিদ্বন্ধী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোটাররা যাতে ভোট দিতে না যান! তাহলে কথা হলো, এরা তো শেখ হাসিনার নির্দেশই অমান্য করছেন! প্রধানমন্ত্রী চাইছেন- সবাই ভোটকেন্দ্রে যাবেন। আর কেউ কেউ তা বাধাগ্রস্ত করতে চাইছেন!

এবারের নির্বাচন ঘিরে যাতে কোনো রকম সমালোচনা এবং অশান্তি না হয় সেদিকে জোর দিচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন। ভোটগ্রহণ যাতে সুষ্ঠুভাবে হয় তা নিশ্চিত করতে একাধিক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে কমিশন। সেইসঙ্গে, এবারও সেখানে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা হচ্ছে। তবে সেখানে যে সামান্য পরিমাণও অনিয়ম হবে না সেটা এখন বলা যাবে না বলে জানিয়েছেন সিইসি।

সিইসি বলেছেন, ‘সহিংসভাবে ভোটবিরোধী কিছু হলে, ভোট দিতে বাধা দিলে সংকট দেখা দেবে। এই সংকট প্রতিহত করতে হবে। যেকোনো মূল্যে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা বজায় রাখতে হবে। জাল ভোট দেওয়া, কালো টাকা ছড়ানোর যে চেষ্টা করা হয় সেগুলি প্রতিহত করতে হবে।'

সিইসি আরও বলেছেন, ‘এবারের নির্বাচন যে সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে সেটা দেখাতে হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে। ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে সেটাও বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। এই নির্বাচন স্বচ্ছতার সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে।'

এই লেখাটি যখন লিখছি, সেই সময়েই বাংলাদেশে নির্বাচন ঘিরে সেনাবাহিনী মাঠে নামার রুটিন তৈরি আছে। আশা করা যাচ্ছে, সেনাবাহিনী সবগুলো স্থাপনা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেবেন। যে আসনগুলোতে বেশি সহিংসতা হতে পারে, সেগুলো হচ্ছে- মনোনয়ন বাতিল, মনোনয়ন বঞ্চিত, আভ্যন্তরীণ দলের ইন্ধনদাতা ও কিছু হেভিওয়েটদের আসন। এসব এলাকায় জোর সেনাটহল রাখতে হবে। র‌্যাব, বিজিবি ও গোয়েন্দাদের রিপোর্ট দেখে ওসব এলাকায় স্ট্রাইকিং ফোর্স বাড়াতে হবে। প্রতিটি কেন্দ্রে পুলিশের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য রিজার্ভ রাখতে হবে।

কোনো সরকারি কর্মকর্তা যাতে পক্ষপাতদুষ্ট না হন- সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে উচ্চপদস্থদের।

এবারের নির্বাচন একটি মডেল নির্বাচন। মানুষ উদার চিত্তে ভোট দিতে পারলেই দেশে যোগ্য নেতৃত্ব তৈরির পথ সুগম হবে। আর তা না হলে, এর পরিণাম ভোগ করতে হবে দীর্ঘমেয়াদী ।

ফকির ইলিয়াস: কবি, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :