শীতে ফুসফুস সুস্থ রাখে খেজুরের গুড়

শীতকালে ঠান্ডা আবহাওয়ার প্রভাব বাঙালির জীবন মানসে সবচেয়ে বেশি। এ সময় কুয়াশার চাদরে আবৃত থাকে শীতের সকাল। খেজুরের রস ও গুড় দিয়ে বানানো হয় নানা রকম পিঠাপুলি। শীত এলেই শরীরে রোগশোক জেঁকে বসে। ঠাণ্ডা-কাশিসহ সব সমস্যায় যেন শীতকালে বেড়ে যায়।
শীতকালের ঠান্ডায় ফুসফুস সুস্থ রাখা একান্ত জরুরি। শীতের ঠান্ডা থেকে অনেকের ফুসফুসে সংক্রমণের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি হয়। শীতের সময় ফুসফুস সঠিকভাবে কাজও করে না অনেকের। তাদের চিন্তা খানিকটা বেশি। ঠান্ডায় ফুসফুসজনিত অন্য কারণগুলোর মধ্যে নিউমোনিয়া, ভাইরাসজনিত জ্বর, ফুসফুসের ক্যানসার অন্যতম। নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগী সাধারণত কাশি, কাশির সঙ্গে রক্ত পড়া, উচ্চমাত্রার জ্বর ও আক্রান্ত দিকে তীব্র বুকের ব্যথা নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে পারে।
সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন, ভাল মানের খেজুরের গুড় ফুসফুসের যে কোনও রকম সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে। খেজুরের গুড় বা যে কোন গুড় খেলে ফুসফুস ভালো থাকে। স্বাস্থ্য সচেতনরা অনেকেই রান্নায় গুড় ব্যবহার করেন। কিন্তু শ্বাসযন্ত্র পরিষ্কার করতে কি গুড় কোনওভাবে সাহায্য করতে পারে?
কথায় বলে, গুড় হল ‘গরিবের চকোলেট’। কিন্তু দামে কম হলেও বৈজ্ঞানিকভাবে এ কথা প্রমাণিত যে, গুড় ফুসফুসের মধ্যে থাকা অ্যালভিওলাইয়ে আটকে থাকা কার্বনের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কণাগুলোকে বের করে আনতে সাহায্য করে। ফলে ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাস্থমা এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে জড়িত সমস্যাগুলো থেকে অনেকটাই মুক্তি পাওয়া যায়।
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খেজুরের গুড়ের ভূমিকা অনেক। ফুসফুস পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে গুড়। যারা অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়ায় ভোগেন তাদের জন্য আদর্শ গুড়। খাবার পরে একটুকরো গুড় খেলেই হজম নিমেষে হয়। গুড় কোষ্ঠকাঠিন্যও সারায় দ্রুত।
প্রতি ১০০ গ্রাম খেজুরের রসে প্রোটিনের পরিমাণ ১.০৮ গ্রাম, লিপিডের পরিমাণ ১.১৫ গ্রাম, ফাইবার ০.১৮ গ্রাম, অ্যাস ০.৪৬ গ্রাম, শর্করা ৮৫.৮৩ গ্রাম, রিডিউসিং সুগার ৩.৯৫ গ্রাম, ক্যালরি ৩৫৮ কিলোক্যালরি। এতে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন বিদ্যমান। ভিটামিন এ ৪১০ আইউ (ওট), থায়ামিন (ভিটামিন বি ১) ০.৫ মিলিগ্রাম/১০০ গ্রাম, রাইবোফ্লোবিন (ভিটামিন বি ২) ০.৬২ মিলিগ্রাম/১০০ গ্রাম, নিয়াসিন (ভিটামিন বি ৩) ১২.৩ মিলিগ্রাম/১০০ গ্রাম, প্যানটোথেনিক এসিড (ভিটামিন বি ৫) ০.১২৭ মিলিগ্রাম/১০০ গ্রাম, পাইরিডক্সিন (ভিটামিন বি ৬) ০.৪৫ মিলিগ্রাম/১০০ গ্রাম, এসকরবিক এসিড (ভিটামিন সি) ১২.৭৫ মিলিগ্রাম/১০০ গ্রাম । এ ছাড়াও সামান্য পরিমাণে ফলিক এসিড (ভিটামিন বি ৯), সায়ানোকোবালঅ্যামিন (ভিটামিন বি ১২), কোলেক্যালসিফেরল (ভিটামিন ডি ২ ও ডি ৩), বায়োটিন (ভিটামিন এইচ) ও ফাইটোনাডিওন (ভিটামিন কে) রয়েছে যার পরিমাণ নির্ণয়যোগ্য মাত্রার নিচে।
ম্যাক্রো উপাদানের মধ্যে রয়েছে ক্যালসিয়াম ৪.৭৬ মিলি.গ্রাম/১০০ গ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ২.২৩ মিলি.গ্রাম/১০০ গ্রাম, পটাশিয়াম ৮০ মি.গ্রাম/১০০ গ্রাম, ফসফরাস ১৮০.৯ মিলি.গ্রাম/লিটার। এতে সোডিয়াম ১৮.২৩ মিলিগ্রাম/১০০ গ্রাম, কপার ২.১৩ মিলিগ্রাম/লি, জিংক ৭.২৩ মিলিগ্রাম/লি, আয়রন ১৫.৮ মিলিগ্রাম/লি।
খেজুরের রস থেকে তৈরি করা হয় মিষ্টি গুড়। অনেক দেশে পামের রস থেকেও গুড় তৈরি করা হয়। রস সংগ্রহ করার পরে তা বড় পাত্রে সংরক্ষণ করা হয় এবং তা কিছুক্ষণ স্থিরভাবে রেখে দিয়ে জ্বাল দেয়া হয়। এই রস আগুনের তাপে ফুটে ওঠে এবং গুড়ে পরিণত হয়।
সারা শীতে সুস্থ থাকতে চাইলে গুড় খেতেই হবে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, রোজ খাবার শেষে একখণ্ড গুড় থাকলে সর্দি-কাশি-জ্বর পালাতে পথ পাবে না। শরীর গরম রাখবে। ফলে, রক্তসঞ্চালন দ্রুত হবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়বে।
রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক থাকলে প্রেসার এমনিতেই নিয়ন্ত্রণে থাকে। সেই কাজটাই করে গুড়। তাই একটুকরো গুড় হাইপ্রেসারের রোগীদের জন্য খুবই ভালো।
শেষপাতে গুড় মানেই দ্রুত হজম। শীতে অম্বল, বদহজম, গ্যাস থেকে মুক্তি পেতে চাইলে রোজ একটুকরো গুড় মাস্ট।
কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতেও সাহায্য করে গুড়। ফাইবার সমৃদ্ধ হওয়ায় এটি পারগেটিভের কাজ করে।
লিভার ভালো রাখতে সাহায্য করে গুড়। এর মধ্যে থাকা জিঙ্ক আর সেলেনিয়াম রক্তও পরিশ্রুত করে।তাই আয়ুর্বেদে গুড় দিয়ে কাঁচা হলুদ সকালে খালিপেটে খাওয়ার কথা বলা আছে।
সর্দি-কাশি-জ্বর কমাতে সিদ্ধহস্ত। ঈষদুষ্ণ পানিতে এক চা-চামচ গুড় মিশিয়ে খেলে সর্দি কমে ঝটপট। সর্দি-কাশি-জ্বর কমায় গুড়।
গুড়ে থাকা আয়রন, জিঙ্ক, সেলেনিাম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস একযোগে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। রক্তাল্পতায় ভুগছেন যারা তারা রোজ গুড় খান। অ্যানিমিয়া কমে হিমোগ্লোবিন বাড়বে ওষুধ ছাড়াই। প্রতিদিন অল্প পরিমাণে গুড় খেলে শরীরে আয়রনের ঘাটতি কমতে পারে।
দেশে আজকাল খেজুরের গুড়ে মেশানো হচ্ছে ভেজাল। খেজুরের গুড় তৈরি হচ্ছে কৃত্রিম চিনি ও রাসায়নিক রং দিয়ে। এসব খেজুরের গুড়ে স্বাদ ও গন্ধ কিছুই থাকে না। অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক চিন্তা এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের অতি লোভ খেজুরের ভেজাল গুড় তৈরির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাড়তি চাহিদা সামাল দিতে এবং রং উজ্জ্বল করতে খেজুর গুড়ে চিনি, ফিটকিরি ও রাসায়নিক মেশানোর অভিযোগ রয়েছে।
বেশি মিষ্টি করার জন্য গুড়ে মেশানো হচ্ছে কৃত্রিম চিনি, কালচে রং আনতে মেশানো হচ্ছে কৃত্রিম রং। সেই গুড়ের স্বাদ থাকে না আর গন্ধও পাওয়া যায় না! চড়া দাম দিয়ে আপনিও থলি ভর্তি করে ভেজাল গুড় নিয়ে আনছেন না তো? খেজুরের গুড়ে আদৌ কোনও ভেজাল আছে কি না, তা বুঝবেন কী করে? জেনে নিন খাঁটি খেজুরের গুড় পরীক্ষা করার কয়েকটি সহজ কৌশল।
খেজুরের গুড় কেনার সময়ে একটু চেখে দেখুন। যদি নোনতা স্বাদ পান, তা হলে বুঝবেন এই খেজুরের গুড়টি মোটেই খাঁটি নয়। এতে কিছু ভেজাল মেশানো রয়েছে।
খেজুরের গুড় কেনার সময়ে গুড়ের ধারটা দুই আঙুলের মাঝে রেখে একটু চেপে দেখুন। যদি নরম লাগে, বুঝবেন গুড়টি ভাল মানের নয়। শক্ত গুড় না কেনাই বুদ্ধিমানের কাজ।
খেজুরের গুড় দেখে যদি অতিরিক্ত চকচকে মনে হয়, তা হলে বুঝবেন, খেজুরের গুড়ে প্রচুর মাত্রায় চিনি মেশানো রয়েছে।
যদি খেজুরের গুড় একটু তেতো স্বাদের হয়, তবে বুঝতে হবে গুড়টি বহু ক্ষণ ধরে জ্বাল দেওয়া হয়েছে। তাই একটু তিতকুটে স্বাদ নিয়েছে। সেই গুড় দিয়ে মিষ্টি বানালে স্বাদ বিগড়ে যেতে পারে।
খেজুরের গুড় দেখে যদি অতিরিক্ত চকচকে মনে হয়, তা হলে বুঝবেন, গুড়ে প্রচুর মাত্রায় চিনি মেশানো রয়েছে।
সাধারণত খেজুরের গুড়ের রং গাঢ় বাদামি হয়। হলদেটে রঙের গুড় দেখলেই বুঝতে হবে, তাতে অতিরিক্ত রাসায়নিক মেশানো হয়েছে। সেই গুড় কিনলে কিন্তু ঠকতে হবে। গুড় যত কালচে হবে, ততই খাঁটি সেই গুড়।

মন্তব্য করুন