বাকস্বাধীনতা না থাকলে ভাষা থেকেও লাভ হয় না: ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য (ভিসি) প্রফেসর ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, বাকস্বাধীনতা না থাকলে ভাষা থেকেও লাভ হয় না। সরকারের নানা পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশে এমন এক ভয়ের সংস্কৃতি চালু হয়েছে, যেখানে অনেকেই মুক্তভাবে তাদের মনের কথা বলতে পারছেন না।
সম্ভাবনার বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠনের আয়োজিত ‘ভাষা দিবসের চেতনা ও আজকের বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী এসব বলেন। মঙ্গলবার বিকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে এ সেমিনার হয়।
দৈনিক নয়া দিগন্তের সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিনের সভাপতিত্বে ও ড. আব্দুল মান্নানের সঞ্চালনায় সেমিনারে প্রধান আলোচক ছিলেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. আব্দুল লতিফ মাসুম। আলোচনায় আরও অংশ নেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি রহুল আমিন গাজী, কবি আবদুল হাই শিকদার, বিএফইউজে মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলম প্রমুখ। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও ঢাকা সিটি কলেজের সাবেক বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর নূর নবী মানিক।
আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী বলেন, সমাজ, রাষ্ট্রে মানুষের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা যদি রক্ষিত না হয় তাহলে অশুভ শক্তির বিকাশ দৃশ্য-অদৃশ্য সব স্তরে ঘটে। ফলে সহনশীল সংস্কৃতির পরিবর্তে, অসহনশীল দানবীয় সংস্কৃতি জায়গা করে নেয় যা রাষ্ট্র ও সমাজকে আক্রান্ত করে এবং সৃষ্টিশীলতার পথ স্বাভাবিকভাবেই রুদ্ধ হয়ে আত্মবিকাশের প্রশ্ন হয়ে ওঠে সাংঘর্ষিক। এজন্য আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের মূল শর্ত পক্ষ-বিপক্ষের চিন্তার অধিকার রক্ষা করা।
দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, কবি ও সাংবাদিকরা সেমিনারে বলেন, মুক্তিযু্দ্ধের চেতনার কথা বলে মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে একদলীয় শাসন জনগণের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।এর বিরুদ্ধে আজ কথা পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না। প্রকৃত ভাষা সৈনিক ও ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দানকারী প্রতিষ্ঠান তমাদ্দুন মজলিসের নাম উচ্চারণ করা হয় না। সালাম বরকত রফিক জব্বারদের নাম বাদ দিয়ে এক ব্যক্তির অবদান নিয়ে কোরাস গাওয়া হচ্ছে। এভাবে ইতিহাস বিকৃতির মচ্ছব শুরু হয়েছে।
বক্তারা বলেন, ক্ষমতা দখলে সহযোগিতার বদৌলতে বাংলাদেশকে ভারতের অঙ্গরাজ্য বানানোর চক্রান্ত চলছে। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হলে ভারতীয় আধিপত্যবাদ মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হবে। দিল্লির আধিপত্যবাদ থেকে আমাদের বাংলা ভাষা ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হবে। আধিপত্যবাদের পক্ষের শক্তি তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আজ সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিক্ষা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ইতোমধ্যে করে ফেলেছে। জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য বিরোধী পাঠ্যপুস্তক রচনা করা হয়েছে যেন ভবিষ্যত প্রজন্ম অখন্ড ভারত প্রেমিক হয়ে উঠে।
প্রফেসর ড. আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আজকে যে সংগ্রাম, তা আমাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম। বাংলা ভাষা আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আজও লেখা হয়নি। পাল আমলে বাংলা ভাষা ও জ্ঞান চর্চা হয়েছে। সেন রাজারা বাংলার মানুষের উপরে জুলুম নির্যাতন চালিয়েছে এবং বাংলা ভাষা চর্চা ও কথা বলা নিষিদ্ধ করেছিল। বৌদ্ধ থেকে এবং হিন্দু থেকেও মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ইসলামের সাম্যের বাণী দেখে। বাংলায় ইসলাম প্রচার ও প্রসারে সূফী আন্দোলন ও আলেম উলামাদের ভূমিকা অনেক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য বলেন, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা আজও চালু হয়নি। আজ শাসক গোষ্ঠীর কারণে বাংলা ভাষা সর্বস্তরে চালু হয়নি। বাংলা ভাষা আজ অবহেলিত। দেশে আজ বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। আমি নিজে একটি শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলাম। কিন্তু আজও সেই কমিশনের একটি সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি।
আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আজ ভারতের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে যে শিক্ষা দেয়ার কথা সে শিক্ষা পাচ্ছে না আমাদের সন্তানেরা। আজ শিক্ষার নামে কুশিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে দেশপ্রেমিক নাগরিক গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
প্রফেসর ড. আব্দুল লতিফ মাসুম বলেন, ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার প্রকৃত শিক্ষা যদি আমরা গ্রহণ করতে পারতাম তবে আমরা আরও উন্নত হতাম। শেখ হাসিনা কথায় কথায় মদীনা সনদের কথা বলেন। কাওমি জননী খেতাব প্রাপ্ত হন। কিন্তু তিনি সেই অনুযায়ী দেশ চালান না। জাতি রাষ্ট্র নির্মাণে মুসলিম মূল্যবোধ গঠনের বিকল্প নেই। বাংলাদেশের মুসলমানরা যে ভাষায় কথা বলে সেটাই বাংলা ভাষা এবং বাংলাদেশের কালচার। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে না, যদি না আমরা ঈমানি শক্তিতে বলিয়ান না হই। এ দেশের তরুণরা যদি এগিয়ে না আসে তবে আমাদের ভাষা সংস্কৃতি রক্ষা কঠিন হবে।
কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, একুশে বই মেলায় ভিন্ন মত পোষণ করার জন্য স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয় না অনেক বিখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে। ইসকনকে বই মেলায় স্টল বরাদ্দ দেওয়া হলো। আওয়ামী দূষিত চেতনার কারণে আজ বাংলা ভাষা হুমকির মুখে এবং মুসলিম সংস্কৃতি হুমকির মুখে। বৌদ্ধ শাসন সময়ে বাংলা ভাষার চর্চা হয়। বাংলায় সেন আগ্রাসনের সময় বৌদ্ধদের উপরে গণহত্যা চালায়। সেন রাজারা জাতিগত বৈষম্যের বর্ণ প্রথা চালু করে এবং বাংলা ভাষা চর্চা ও কথা বলা নিষিদ্ধ করে। বাংলা ভাষায় কথা বললে জিহ্বা কেটে ফেলা হতো সেন শাসনকালে। রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে বাংলার বৌদ্ধ ও মুসলমানদের এবং বাংলা ভাষাকে রক্ষা করেন বখতিয়ার খলজি।
আবদুল হাই শিকদার বলেন, বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকার বিজিপির ফর্মুলা অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছে। বখতিয়ারের বাংলা জয়ের পর বাংলা ভাষা রাজ দরবারে ভাষার সম্মান লাভ করে। মুসলমানরা যদি বাংলা বিজয় না করতো তবে বাংলা ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যেত। দিল্লির আধিপত্যবাদ থেকে আমাদের বাংলা ভাষা ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হবে।
রুহুল আমিন গাজী বলেন, বাংলাদেশের মানুষ আজ কথা বলার অধিকার থেকে বঞ্চিত। মানুষের ভোটের অধিকার নাই। সরকারি দল ও পুলিশি শাসনে বিরোধী দল ও সাধারণ মানুষ জুলুমের শিকার। মানুষের বাক স্বাধীনতা নাই। জুলুম নির্যাতন মুক্ত স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করতে হবে।
বিএফইউজে মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী বলেন, বাকস্বাধীনতা না থাকলে ভাষা থেকেও লাভ হয় না। সব নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করাই ছিল ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেসব অধিকার থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়েছে, গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে, চিন্তার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, কথা বলার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং লেখার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
কাদের গণি বলেন, জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পর এবং স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পরও আমাদের বাকস্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
বাক স্বাধীনতা ও ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে ভাষা আন্দোলনের চেতনা ভুলুন্ঠিত করা হচ্ছে উল্লেখ করে কাদের গণি বলেন, একুশের মর্মবাণী হচ্ছে মাথা নত না করা। অধিকার ও দেশের মালিকানা নিজেদের রাখা। বাক স্বাধীনতা,গণতন্ত্র, ভোটাধিকারহরণসহ দেশের মানুষকে নানাভাবে অধিকারহীন করে একুশের স্বপ্নকে ভুলুন্ঠিত করা হয়েছে।
এই সাংবাদিক নেতা বলেন, অধিকার আদায় এবং অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে ভাষাশহীদরা আমাদের প্রেরণার উৎস। প্রকৃতপক্ষে এই মহান ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতিসত্তার বিকাশে এবং একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রথম সোপান হিসেবে কাজ করেছে।
কাদের গণি বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের মানবাধিকারের চিরন্তন ধারক ও বাহক। একুশ আমাদের মুক্তির চেতনা। কিন্তু এ চেতনা আজ বাংলাদেশের সর্বত্র অনুসৃত হচ্ছে না। মানুষের মৌলিক ও গনতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়ে বর্তমান সরকার একুশের চেতনার রংকে বর্ণহীন ও ফিঁকে করে দিয়েছে। জাতির মধ্যে তৈরি করছে বিভেদের পাহাড়সম দেয়াল, যা মহান একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাই এই সোনার বাংলার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সচেতন করে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য একুশের চেতনাকে সর্বদা জাগিয়ে রাখতে হবে; কোনোভাবেই তা ম্লান হতে দেওয়া যাবে না।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধে প্রফেসর নূর নবী মানিক বলেন, ভাষা দিবসের চেতনা জাতি হিসেবে আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে পথ প্রর্দশকের ভূমিকা রেখেছে। ভাষার উপর আঘাত বাঙালি জাতিকে অধিকার সচেতন করে তোলে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের জাতীয় ঐক্য তৈরিতে এর রয়েছে যুগান্তকারী প্রভাব। ভাষা আন্দোলনের মূল চেতনা হলো অগণতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চেতনা। ৫২'র ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে আসে বাঙালীর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। স্বাধীনতা অর্জনের পর আজকের বাংলাদেশ একটি আগ্রাসী শক্তি দ্বারা পরিবেষ্টিত। আজ বাংলাদেশের অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে ভিন্ন দেশের অগ্রাসন চলছে। ফলে আজও সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারা গড়ে উঠেনি।
সভাপতির বক্তব্যে আলমগীর মহিউদ্দিন বলেন, আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আবার নতুন করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। ইসলাম ও মুসলমান বলে বিভাজন তৈরি করা হচ্ছে তা পরিহার করতে হবে। স্বাধীনতার ঘোষিত মূল চেতনা হলো সাম্য, মানবতা ও ইনসাফ বা সামাজিক ন্যায় বিচার। যারা স্বাধীনতার লক্ষ্য বাস্তবায়নে আধিপত্যবাদ, গণতন্ত্র হরণকারী কর্তৃত্ববাদ, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে তারা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি।
(ঢাকাটাইমস/২৭ফেব্রুয়ারি/জেবি/কেএম)

মন্তব্য করুন