কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ: ভারপ্রাপ্ত দিয়ে আর কতদিন? 

কাপাসিয়া প্রতিনিধি, ঢাকা টাইমস
| আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২৪, ০০:১০ | প্রকাশিত : ০২ মার্চ ২০২৪, ২৩:৫০

গাজীপুরের ঐতিহ্যবাহী কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ। প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠটিতে গত পাঁচ বছর যাবত কোনো অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। ফলে বছরের পর বছর কলেজটি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এ কারণে দিন দিন প্রতিষ্ঠানটি তার ঐতিহ্য হারাচ্ছে এবং শিক্ষার মানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীর সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিতে আছ, কলেজে অধ্যক্ষ পদ শূন্য হলে অধ্যক্ষের অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে উপাধ্যক্ষ/জেষ্ঠ্যতম ০৫ (পাঁচ) জন শিক্ষকের মধ্য হতে যেকোনো একজনকে দায়িত্ব প্রদান করতে হবে এবং সেই সঙ্গে পরবর্তী ৬ (ছয়) মাসের মধ্যে বিধি মোতাবেক অধ্যক্ষ নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদানের এক বছরের মধ্যে নিয়মিত অধ্যক্ষ নিয়োগ দান করতে ব্যর্থ হ’লে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের স্বাক্ষরকৃত কাগজপত্র ও কার্য্যবিবরণী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক স্বীকৃত অথবা গৃহীত হবে না।

এ কারণেই সঙ্গত ভাবে প্রশ্ন জাগে, তাহলে গত পাঁচ বছর প্রতিষ্ঠানটি কিভাবে চলছে? কলেজ পরিচালনা পরিষদ অথবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এ ব্যাপারে কি ভূমিকা পালন করছে?

কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ ১৯৬৫ সালে স্থানীয় রমনাথ কর্মকারের পরিত্যক্ত বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়। কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ঢাকার উত্তরে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের শিক্ষা বিস্তারে কলেজটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে এসেছে। দূর দূরান্ত থেকে এখানে শিক্ষার্থীরা অধ্যয়ন করতে আসতো। শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশি থাকায় এরশাদ সরকারের সময় কলেজটিতে একটি ছাত্রাবাসও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সেই ছাত্রাবাসটি এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বর্তমানে কলেজটিতে ডিগ্রির পাশাপাশি চারটি বিষয়ে অনার্স চালু রয়েছে। তারপরও এই বিদ্যাপীঠে নেই আর আগের মত শিক্ষার্থী। কলেজটিতে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। একসময় কলেজটিতে পাঁচ থেকে ছয় হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করত। এই দশার কারণ কলেজ ব্যবস্থাপনা কমিটির অনিয়ম, স্বজন প্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, অদক্ষতা, দীর্ঘ সময় কলেজটিতে অধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে ব্যর্থতায়, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিয়ে কলেজ পরিচালনার কারণে বর্তমানে কলেজটি নানা সংকটের মুখে পড়েছে। এক সময় এই কলেজে এই উপজেলার বাইরে থেকে শিক্ষার্থীরা আসত এই কলেজে শিক্ষা গ্রহণ করতে।

বর্তমানে এই উপজেলার শিক্ষার্থীরাই তাদের বাড়ির কাছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করতে আগ্রহ হারাচ্ছে অব্যবস্থাপনার কারণে। শিক্ষার্থী আশঙ্কা জনকভাবে কমে যাওয়ায় কলেজের আয় কমে গেছে।অনিয়ম দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে খরচ বেড়ে গেছে। অধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য একাধিকবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েও কলেজের আভ্যন্তরীণ স্বার্থন্বেষী মহলের তৎপরতায় এখানে অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে পাঁচ বছর ধরে কলেজটি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। কলেজটির এই দুর্দশা থেকে মুক্তি কোন পরিত্রাণ নেই। অথচ কাপাসিয়া কলেজের ২২ বছর পরে ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ইউনিয়ন ডিগ্রী কলেজ হাইলজোর। কলেজটি ২০১৮ সালে নাম পরিবর্তন করে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সরকারি কলেজে রূপান্তরিত হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের দাবি, কলেজটিকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পরিচালনা করা এবং শিক্ষার মান বৃদ্ধির স্বার্থে খুব দ্রুত এখানে একজন অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ সহ শুন্য পদে সকল নিয়োগ সম্পন্ন করা প্রয়োজন। উপজেলা সদরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজটি সরকারি করা কলেজটি পুরনো ঐতিহ্য ফিরে পাবে।

কলেজ সূত্রে জানা যায়, কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন আলতামাছুল ইসলাম। তিনি ১৯৬৫ সালের পহেলা জুলাই থেকে ১৯৬৯ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তারপর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কলেজটিতে মোট ২২ জন শিক্ষক অধ্যক্ষ অথবা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

সর্বশেষ ২০১২ সালের ১৭ মার্চ কলেজ অধ্যক্ষ শামসুল বারী এক বৈরি পরিস্থিতির কারণে চলে যেতে বাধ্য হন। তারপর কলেজটির উপাধ্যক্ষ মোঃ সানাউল্লাহ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করলে কলেজটিতে শনির দশা শুরু হয়। তিনি ১০ মাস ২৯ দিন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি অধ্যক্ষ হিসেবে কলেজটিতে দীর্ঘ ছয় বছর চার মাস ১৪ দিন দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় তিনি কলেজটিতে অনিয়ম দুর্নীতির রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। কলেজ পরিচালনা পরিষদ নির্বাচন ও বেশ কিছু শিক্ষক নিয়োগে তিনি ব্যাপক অনিয়ম করেন। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন ও অন্যান্য ফি আদায়সহ নানা অনিয়ম এবং দুর্নীতির কারণে কলেজটিতে চরম অব্যবস্থাপনা ও অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। শিক্ষকদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ লাভ করে। বিভিন্ন মহল থেকে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপিত হলে প্রতিকূল অবস্থার মুখে তিনি কলেজটি থেকে বিদায় নেন। তার বিদায়ের মধ্য দিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিয়ে কলেজের যাত্রা শুরু হয়।

২০১৯ সালের ২০ মে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান ওয়াজিদুর রহমান। তিনি আট মাস আট দিন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তারপর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হন মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ। তিনি ১ বছর ১০ মাস ১৩ দিন ছিলেন। নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত হওয়া উপাধ্যক্ষ মো. আমজাত হোসেন কলেজে উপাধ্যক্ষ হিসাবে পুনর্বহাল হলে ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর তাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তিনি ৩ মাস ২৩ দিন দায়িত্ব পালনের পর পুনরায় মো. আলী এরশাদ হোসেন আজাদ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হন। তারপর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হন মো. হুমায়ুন কবির।

অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে পাঁচবার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে পরিবর্তন করা হলেও অধ্যক্ষ নিয়োগের সফলতা আসেনি। ফলে ভারমুক্ত হতে পারছে না ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। ভারপ্রাপ্তের বাড়ে শিক্ষার মান, শিক্ষার পরিবেশ এবং কলেজের অবস্থান ক্রমাগত ভাবে নিম্নমুখী হচ্ছে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে কলেজ পরিচালনা পরিষদের অভিভাবক প্রতিনিধি দুলাল চন্দ্র বণিক বলেন, বিগত তিন বছরে যে সকল প্রতিনিধি অধ্যক্ষ পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করেছেন তারা কেউই কোন ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ হওয়ার যোগ্য ছিল না। আবেদনকারীরা ভাইবা বোর্ডে ভালো ফলাফল করতে পারেননি। যে কারণে কাউকে নিয়োগ দেওয়া যায়নি।

কলেজ পরিচালনা পরিষদের শিক্ষক প্রতিনিধি জহিরুল ইসলাম বলেন, আমি পরিচালনা কমিটিতে এ বছরের নতুন। তবে আমি যতটুকু জানতে পেরেছি যোগ্য প্রতিনিধির অভাবে অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। এবছর নিয়োগ প্রক্রিয়া কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। আশা করছি খুব শিগগিরই নিয়োগ সম্পন্ন হবে।

কলেজ পরিচালনা পরিষদের বিদ্যোৎসাহী সদস্য মো. আসাদুজ্জামান বলেন, কলেজের অধ্যক্ষের জন্য যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছিল না। যে কারণে অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। নতুন সার্কুলার দেয়া হয়েছে। নতুন করে অনেকে আবেদন করেছে, যাচাই-বাছাই চলছে। খুব শিগগিরই একজন অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া হবে।

কলেজের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. হুমায়ুন কবির বলেন, আমি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে প্রায় সাত মাস ধরে দায়িত্ব পালন করছি। অধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য পঞ্চম বারের মতো নতুন করে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। আগ্রহী প্রার্থীরা আবেদন করেছেন। আবেদন যাচাই-বাছাই করে নিয়োগ বোর্ডের কাছে পাঠানো হবে। নিয়োগ বোর্ড নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করবেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. প্রফেসর মশিউর রহমান বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুই এর নীতিমালায় ভিন্নতা রয়েছে। এই ভিন্নতার কারণে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে ডিগ্রি কলেজগুলোতে অধ্যক্ষ নিয়োগে একটু জটিলতা দেখা দিয়েছে।

এই বিষয়গুলো তুলে ধরে মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পেলে আশা করছি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।

(ঢাকাটাইমস/৩মার্চ/এআর)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :