চট্টগ্রাম রেল: সব অনিয়মই যেন নিয়ম!

দেশে রেলের দুর্নীতি কিংবা অব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা দীর্ঘদিনের। এতে যোগ হয়েছে ঘনঘন দুর্ঘটনা, যার ফলে এখন রেলযাত্রা নিয়েও যাত্রীদের মাঝে শঙ্কা বেড়েছে।
এদিকে রেলে হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ হলেও যে সংকট তা কাটছে না। কারণ সেবার মানোন্নয়নে যে পরিমাণ লোকবল দরকার তা নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। আবার নিয়োগ শুরু হলে সেখানে বড় ধরনের দুর্নীতির চিত্র উঠে আসছে বারবার। রেললাইন ও রেল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এখন প্রচুর কর্মী আছে। কিন্তু কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি ও কারখানা না থাকলে রেলপথ নামক শিরা-উপশিরা ক্রমান্বয়ে অচল হয়ে পড়ছে। বর্তমানে এমন অবস্থায় যেন বিরাজ করছে রেলওয়েতে যেখানে সব অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়েছে। বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না রেলওয়ে। একের পর এক দুর্ঘটনা যেন রেলের পিছু ছাড়ছে না।
এদিকে পর্যটন শহর কক্সবাজারকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে, প্রায় কাজ শেষ হলেও প্রতিটি স্টেশনের সংকেত বোর্ড দেওয়া হয়নি এখনো, যে সংকেত বোর্ড দেখে ট্রেনচালক ট্রেনের গতি বা সতর্কতা অবলম্বন করবে। যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে ক্রমান্বয়ে সবই হবে। অনিয়ম ও অবহেলার কারণে বারবার যে রেল দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে এর দায়ভার কে নেবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলছেন, প্রত্যেক জেলায় রেলের সংযোগ স্থাপন করতে নতুন রুট তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
রেল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিশ্বমানের কাতারে দাঁড়াতে প্রয়োজন দক্ষ ও সুউচ্চ কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন রেলকর্মী, যা বাংলাদেশে নেই। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে রেলওয়ে খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া হলেও অতীতে ট্রেনিং সেন্টারে কর্মরত ব্যক্তিদের বিভিন্ন অনিয়মের ফলে তা বাস্তবায়ন হয়নি। রেল সম্পর্কিত কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ট্রেনিং সেন্টারের অনিয়ম-দুর্নীতি প্রায় সময় খবরের শিরোনাম হলেও তা তদন্ত কমিটি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমিতে আন্তর্জাতিক মানের কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হলে দক্ষ প্রশিক্ষক ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন লোকের প্রয়োজন। রেল সেবা উন্নত করা ও দক্ষ প্রশিক্ষক তৈরি করার জন্য দেশে রেলওয়ে বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি প্রদানকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও নেই। দেশের কারিগরি ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রেলওয়ে প্রযুক্তির বিষয়ে বিভাগ খুলে পড়াশোনাও চালু হয়নি। যার কারণে পর্যাপ্ত কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনবল পাচ্ছে না রেলওয়ে।
জানা যায়, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ খোলার ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে বিভিন্ন সময়ে চিঠি দেয় রেলপথ মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ চালু করার জন্য সুপারিশ করে রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। এছাড়া ২০১৮ সালে ভারতে রেলওয়ের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করে সেই আদলে বাংলাদেশে একটি রেলওয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করে সংসদীয় কমিটি। তবে এসব বিষয়ে আর অগ্রগতি বা আলোর মুখ দেখেনি।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রামের হালিশহরে বাংলাদেশ রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভাগীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রেলওয়ে অনুমোদিত জনবল ৭৩ জন, তবে তা শুধু কাগজে-কলমেই। বাস্তবে কর্মরত আছেন মাত্র ২৩ জন। এছাড়া পাহাড়তলী, ঢাকা, ঈশ্বরদী ও পার্বতীপুরে চারটি রেলওয়ে ওয়ার্কশপ ট্রেনিং ইউনিট (ডব্লিউটিইউ) রয়েছে। এই ট্রেনিং ইউনিটগুলোতে যান্ত্রিক বিভাগের ও লোকোমোটিভ এবং রেলওয়ে অপারেশন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। চারটি ডব্লিউটিইউতে ট্রেনিং অফিসার, সিনিয়র প্রশিক্ষক ও ডেমোনেস্ট্রেটর এবং কর্মচারী এই সীমিত সামর্থ্য নিয়ে রেলওয়েতে প্রশিক্ষণের কাজ চলছে। রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমি হালিশহরে কর্মরত রেক্টর আহমেদ মাহাবুব চৌধুরী ঢাকা টাইমসকে বলেন, গত বছরের ৩১ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে জনবল সংকটের কথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। বর্তমানে এখানে ২৩ লোকবল কাজ করলেও তাদের মধ্যে ৫ জন রয়েছেন এডিজি (অর্থ) বা হিসাব বিভাগের। বাকি ১৬ লোকবল দিয়ে কোনো রকমে চলছে ট্রেনিং একাডেমি। আমি এখানে আসার আগে ট্রেনিং একাডেমির অনেক অনিয়ম দূর করতে বেগ পেতে হয়েছে। জনবল সংকটে একাডেমি পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তারপরও চেষ্টা করে যাচ্ছি অতীতের বদনাম ঘুচাতে।
সম্প্রতি চালু করা হয়েছে আউটসোর্সিং। রেলের বিভিন্ন বিভাগে তাদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। কিন্তু এ আউটসোর্সিং কাদের নিয়ন্ত্রণে? রেল কর্তৃপক্ষ নাকি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান? তারা যদি কোনো ধরনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তখন এর দায়ভার কে নেবে? এ ব্যাপারে কেউ মন্তব্য করতে নারাজ! কারণ সম্প্রতি হিসাব বিভাগ থেকে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে কোটি টাকা উধাওয়ের ঘটনায় একজন টিএলআরের নাম উঠে আসে। এ ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষ এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব (প্রশাসন) ঢাকা টাইমসকে বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশের রেলযোগাযোগের সামর্থ্যরে সঙ্গে আমাদের দেশের রেল ব্যবস্থাপনাকে সামঞ্ছস্যপূর্ণ করে তুলতে কাজ করতে হবে। বিশ্বমানের দক্ষ কর্মী তৈরিতে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ একাডেমিসহ আনুষ্ঠানিক উচ্চ ডিগ্রি প্রদানকারী কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে প্রতিষ্ঠা করার সব ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সঙ্গে অন্যান্য কারিগরি ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রেলওয়ে প্রযুক্তির বিষয়ে বিভাগ খুলে উচ্চ ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, যারা অবসরে গেছেন তাদের কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতাকে সামনে রেখে রেলওয়ের নিজস্ব পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গঠন করা যায়। এতে যেমন রেলওয়ের বিভিন্ন প্রকল্পের পরামর্শক ব্যয় কমে আসবে, তেমনি কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ নিজেকে দেশের কল্যাণে নিয়োজিত করার সুযোগ পাবেন। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, আমরা অবসরে যাওয়া যোগ্য ব্যক্তিদের ইদানীং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিচ্ছি। যারা তাদের কর্মজীবনে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছে এমন ব্যক্তিদের আমরা এখন কাজে লাগাচ্ছি। আশা করি তাদের দক্ষতা ও মেধার মাধ্যমে রেল সেবার মান আরও বাড়বে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদ্য নিযুক্ত রেলমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জিল্লুল হাকিম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় রেলসংযোগ ও রেল সেবা পৌঁছে দেওয়া হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যেই দেশের এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাতায়াতে রেলসেবা জনগণ গ্রহণ করতে পারবে খুব সহজে। এ লক্ষ্যে রেলের কোচ ও ইঞ্জিন আমদানি করা হয়েছে, আরও কিছু আমদানি হবে।’ তিনি আরও বলেন, রেলের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। মাঝে লোকবল নিয়োগের জন্য আমাদের কোনো নীতিমালা ছিল না। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ হস্তক্ষেপে সেটা আমরা করে ফেলেছি। ২-৩ বছরের মধ্যে রেলে লোকবল ঘাটতি দূর করা সম্ভব হবে। তিনি আরও বলেন, সমৃদ্ধ স্মার্ট সোনার বাংলা বিনির্মাণে বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকা রেখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে ‘আমরা পারি বাংলাদেশ রেলওয়ে।
(ঢাকাটাইমস/৬মার্চ/এআর)

মন্তব্য করুন