শালুক রজতজয়ন্তী সম্মিলন ২০২৪: খোলা হলো চিন্তার নতুন দুয়ার

পারভেজ আহসান
 | প্রকাশিত : ২০ মার্চ ২০২৪, ০৯:৩৫

মৃত্তিকার ওমে সুপুষ্ট হয়ে, শেকড়ের তীব্র টান অনুভব করে সম্প্রতি শালুকের রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দেন অধুনাবাদের চেতনায় শাণিত অসংখ্য কবি ও সাহিত্যিক। তাদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস জানান দিচ্ছিল শালুকের প্রতি তাদের প্রবল অনুরাগ এবং দীর্ঘ পঁচিশ বছরের পথ পরিক্রমা প্রথাবিরোধী এই ছোটকাগজটি মাথা উঁচু করে অকুতোভয়ে বিপরীত চিন্তার লেখা প্রকাশ করে সর্বমহলে কতোটা গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে।

রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানের প্রথম দিন ৮ মার্চ বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য নটরাজ বন্দনার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা, অনুষ্ঠানের উদ্বোধক রবীন্দ্র গবেষক অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেনের বৈদগ্ধপূর্ণ ভাষণ, ‘শালুকের ২৫ এবং পায়ে হাঁটা উড়ন্ত ঘোরা’ শীর্ষক শালুক সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশের বক্তব্য পাঠ, বিপরীত চিন্তার লিটল ম্যাগের ভূমিকা নিয়ে আলোচকদের তাৎপর্যপূর্ণ মূল্যায়ন যেভাবে উপস্থিত সকলের চিত্তে জ্ঞান ও আনন্দের সংশ্লেষ ঘটিয়েছিল, ঠিক একইভাবে ৯ মার্চ অনুষ্ঠানের ২য় দিনে কাঁটাবনের পাঠক সমাবেশ কেন্দ্রে দুটি সেশনে ‘সাহিত্যচর্চায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা’ এবং ‘বাংলা সাহিত্যের বিশ্বায়ন কতটা দুরূহ, কতটা সম্ভাবনাময়?’ শীর্ষক আলোচনা ছিল ভীষণ উপভোগ্য। প্রত্যেক বক্তাই ছড়িয়েছিলেন অর্জিত জ্ঞানের আলোকপ্রভা। দর্শক-শ্রোতা ও আলোচকদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল নিবিড় সংযোগ।

৯ মার্চ বিকাল ৩টায় বাচিকশিল্পী পলি পারভীনের সঞ্চালনায় শুরু হয় দ্বিতীয় দিনের আয়োজন। উপস্থাপক শুরুতে দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানসূচি ঘোষণা করে শালুক সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশকে প্রথম সেশন সঞ্চালনার জন্য অনুরোধ করেন। আলোচনার বিষয় ছিল, ‘সাহিত্যচর্চায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা’। আলোচনায় অংশ নেন ভারতের কবি সমরজিত সিংহ, কবি অধ্যাপক শামীম রেজা, কবি ও প্রকাশক খোরশেদ বাহার, পশ্চিমবঙ্গের কবি ও শিল্পসমালোচক দেবাশিস চন্দ, কবি নভেরা হোসেন ও কবি জাফর সাদেক। তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত উন্নতির ফলে সাহিত্য চর্চার মাধ্যমেও দ্রুত পরিবর্তন আসায় আলোচনাটি বেশ জমে উঠেছিল। প্রত্যেকের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। একজনের লেখা দ্রুত পাঠকের কাছে চলে যাওয়ায়, সহজেই ব্যবহার উপযোগী হওয়ায় অনেক কবি ও সাহিত্যিক এই মাধ্যমটি ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ফলে শিল্প সাহিত্যের অনেক ফেসবুক পেইজ ইদানীং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আলোচকবৃন্দ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বিশেষত ফেসবুকের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরেন।

শুরুতেই দেবাশিস চন্দ এক ভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করেন। তিনি আমেরিকান পাবলিশার্স ফেডারেশন কর্তৃক প্রদত্ত তথ্য উল্লেখ করে বলেন সাহিত্যচর্চার জন্য বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল প্লাটফর্ম থাকা সত্ত্বেও পুস্তক বিক্রি মোটেও কমেনি। কিনড্যালের প্রতি সাধারণ পাঠকদের আকর্ষণ কমে যাচ্ছে। ফলে আমাজানকে কানাডায় বেশ কিছু স্টোর স্থাপন করতে হয়েছে। তিনি বলেন, মানুষ বইয়ের পাতার শব্দ শুনতে চায়, পাতাকে স্পর্শ করতে চায়। ইলেকট্রনিক ফর্ম মানুষকে স্বস্তি দেয় না।

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কবি ও সাহিত্যিক সমরজিৎ সিংহ বলেন, ফেইসবুকে সময় দেয়ার কারণে অধ্যয়ন ও লেখালেখির ধৈর্যশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন ধরনের পুস্তক ঘেঁটে একটি লেখা তৈরি করতে মন চায় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বহুসংখ্যক লেখকের সক্রিয়তা দেখে তিনি ব্যঙ্গ করে বলেন, জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত উক্তি- ‘সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি’ এখন আর প্রযোজ্য নয়, বরং কথাটি উল্টিয়ে বলা যেতে পারে, ‘এখন কেউ কেউ কবি নয়, সকলেই কবি’। কবি ও প্রাবন্ধিক খোরশেদ বাহার ও সিমরজিৎ সিংহের বক্তব্য ছিল কিছুটা সাদৃশ্যপূর্ণ। খোরশেদ বাহারের মতে, “ফেইসবুকে অধিক সময় দেয়ার কারণে সৃষ্টিশীলতা কমে যায়। মানুষের চিন্তন শক্তি হ্রাস পায়। এ মাধ্যমটির সুবিধাকে অবজ্ঞা করা যাবে না। যোগাযোগের এই মাধ্যমটির কারণে সাহিত্যকর্মের প্রচার-প্রসার দ্রুত হয়।”

এ প্রসঙ্গে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ও শালুক সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশ বিশিষ্ট কবি ও শিল্পসমালোচক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের একটি মন্তব্য তুলে ধরেন। বহুমাত্রিক লেখক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কাছে বইমেলায় বহুসংখ্যক নিম্নমানের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ এবং এগুলো নিয়ন্ত্রণে করণীয় কী তা জানতে চাইলে বলেছিলেন, “দেশে তো বড় বড় দুর্নীতি হচ্ছে। উচ্চ পর্যায়ে সংঘটিত হচ্ছে অপরাধ; সেটা নিয়ে তো মাথাব্যথা নেই; আর একজন একটা বই প্রকাশ করছে তা নিয়ে এত ভাবনার কী আছে? তারা তো আর চুরি করছে না, দুর্নীতি করছে না, একটা ভালো কাজ করারই তো চেষ্টা করছে। এদের ভেতর থেকে হয়তো কেউ একজন ভালো লিখবে।” সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভালো লেখা ও মন্দ লেখার কোনো মানদ- না থাকার বিষয়টি ইঙ্গিত দিয়েই হয়তো প্রখ্যাত সাহিত্যিক বোরহানউদ্দিন জাহাঙ্গীরের উক্তিটি উল্লেখ করেছিলেন সঞ্চালক ওবায়েদ আকাশ।

‘বাংলা সাহিত্যের বিশ্বায়ন কতটা দুরূহ, কতটা সম্ভাবনাময়?’ শীর্ষক আলোচনা ছিল বিকাল ৫টায় দ্বিতীয় সেশনে। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কবি শাহেদ কায়েস। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খায়রুল আলম সবুজ, মুজতবা আহমেদ মুরশেদ, গৌতম গুহ রায়, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, অংশুমান কর, বিপাশা মন্ডল ও পলি শাহীনা। আলোচনায় পরে যুক্ত হন কবি জুয়েল মাজহার। অনুষ্ঠানের শুরুতেই বিপাশা মন্ডল বক্তব্য রাখেন। বিশ্বমানের অনুবাদকের অভাবকে অন্যতম অন্তরায় হিসেবে অবিহিত করেন তিনি। অর্থপ্রাপ্তি না থাকায় অনেকেই অনুবাদে আগ্রহী হয়ে উঠছে না। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একজন দক্ষ অনুবাদকের তত্ত্বাবধানে অনুবাদ কার্য পরিচালনা এবং সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পৌঁছে দেয়ার কথা বলেন তিনি।

আমেরিকা প্রবাসী কথাসাহিত্যিক পলি শাহীনা মনে করেন, বাংলা সাহিত্যে অনেক রত্ন রয়েছে। এগুলো ভালোভাবে অনুবাদ করা হলে নিকট ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্য অনেকটা ছড়িয়ে পড়বে পৃথিবীময়। বিশ্বের নানা প্রান্তে বাংলা ভাষা থেকে বিভিন্ন ভাষায় যাঁরা অনুবাদ করছেন তাঁদেরকে যদি সহায়তা করা যায়, তবে বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক প্রসার ঘটবে। মুজতবা আহমেদ মুরশেদ বাংলা সাহিত্যের বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু অন্তরায় উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাংলা সহিত্যের বিশ্বায়নের বিষয়টি ভাবতে হলে প্রথমে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদের বিষয়টি চলে আসে। তবে অন্যান্য ভাষায়ও অনূদিত হতে পারে। আমাদের কারিকুলামে কমিউনিকেটিভ ইংরেজি শেখানো হয়। কিন্তু সাহিত্যের ভাষা হতে হয় উন্নত। প্রত্যেকটি ভাষার নিজস্ব প্রাণ আছে, নানান রঙ আছে। যে ভাষায় সাহিত্যকর্মটি অনূদিত হবে সেই ভাষায় উন্নত ব্যুৎপত্তি অর্জন করা প্রয়োজন। এছাড়াও সেই ভাষাভাষি মানুষের সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকাটা আবশ্যক। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলা সাহিত্যের প্রসার ঘটাতে হলে সরকারি অথবা বেসরকারিভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন। সেই প্রতিষ্ঠানটি নিরপেক্ষভাবে পুস্তকগুলো নির্বাচন করবে, অন্তর্জাতিক মানের অনুবাদ করিয়ে সারাবিশ্বে বিপণনের ব্যবস্থা করবে।

এ প্রসঙ্গে কবি ও পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অংশুমান কর সাহিত্যমান বজায় রেখে অনুবাদ, প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিপণনের জন্য প্রকাশনা সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথের পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর ও সত্যজিৎ রায়ের কিছু কিছু অনুবাদ হয়েছে।

তার মতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নোবেল পুরস্কার পাবার যোগ্য, যদি তাদের লেখাগুলো সাহিত্যমান বজায় রেখে অনূদিত হয় এবং বিপণনের ব্যবস্থা করা হয়। ভালো অনুবাদ না হলে বাংলা সাহিত্যের মান নিয়ে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হতে পারে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।

অধ্যাপক অংশুমান কর বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের আনিসুর রহমান ও পশ্চিমবঙ্গের অরুণাভ সিনহা ভালো অনুবাদ করছেন। অরুণাভ সিনহার অনেক বই পেঙ্গুইন প্রকাশ করেছে। বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে হলে প্রতিষ্ঠানসমূহকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে। পেঙ্গুইন, হার্পার কলিন্স এবং ব্লুমস্বারির মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লিয়াজোঁ করতে হবে। এই প্রকাশনা সংস্থাগুলো দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্য প্রকাশ করতে আগ্রহ প্রকাশ করছে।

কবি, নাট্যকার ও অনুবাদক খায়রুল আলম সবুজ একজন অনুবাদকের দুটো ভাষায় সমান দক্ষতা অর্জনের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।

চৈতালী চট্টোপধ্যায় বলেন, বাংলা সাহিত্যের বিশ্বায়নের জন্যে একটি ভালো পরিকাঠামো দরকার। শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে জড়িত তুখোড় অনুবাদকের দরকার।

একটি লেখাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দিতে হলে এজেন্টের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের বিষয়ে গৌতম গুহ রায় আলোকপাত করেন।

কবি ও অনুবাদক জুয়েল মাজাহার একটি ভাষা থেকে অন্য একটি ভাষায় অনুবাদ করার সময় ভাষার অর্থ পরিবর্তন না হওয়ার বিষয়ে অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন।

আলোচনা অনুষ্ঠানের পর ছিল নির্বাচিত কবিদের কবিতা পাঠ। কবিতা পাঠ করেন- কবি প্রীতি আচার্য, জুনান নাশিত, কবি চামেলী বসু, সুহেলী শায়লা স্বাতী, ভাগ্যধন বড়ুয়া, শাহেদ কায়েস, খালেদ চৌধুরী, আহমেদ বাসার, ফারুক আফিনদী, রনি রেজা, খোরশেদ বাহার, শামস হক, চয়ন শায়েরী, মনিরুল মোমেন, পূর্ণিয়া সামিয়া, নাসরীন জাহান, পারভেজ আহসান, অদ্বৈত মারুত, জাফর সাদেক, আমির হামজা, মামুন মুস্তাফা, শেলী সেনগুপ্তা, ফরিদুজ্জামান, মোস্তাক মুকুল, জব্বার আল নাঈম, কবীর হোসেন, আবীর বাঙালি প্রমুখ।

শালুক সম্পাদক কবি ওবায়েদ আকাশ এবং সহযোগী সম্পাদক কবি ভাগ্যধন বড়ুয়ার সমাপনী ভাষণ ও ফটোসেশনের মধ্য দিয়ে দুদিনব্যাপী শালুক রজতজয়ন্তী সম্মিলন ২০২৪-এর ইতি টানা হয়।

(ঢাকাটাইমস/২০মার্চ/এফএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :