নানা জটিলতায় আটকে আছে গণহত্যা দিবসের বিশ্বস্বীকৃতি

১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ, অপারেশন সার্চলাইট নামে পাক হানাদার বাহিনী রাতের আঁধারে মারণাত্মক অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরীহ বাঙালি জাতির ওপর। মুক্তিকামী বাঙালির ওপর নির্মম নির্যাতনসহ গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তাদের গণহত্যায় প্রাণ কেড়ে নেয় অর্ধ লাখ মানুষের। অভিযানের পর ২৭ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ক্যান্টিনের সামনে কয়েকটি মৃতদেহ পড়ে ছিল।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রধান শাহরিয়ার কবির ঢাকা টাইমসকে বলেন, ২০০৫ সালে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য ইউনেস্কোকে চিঠি দিয়েছিলাম। তখন থেকেই তারা ২৫ মার্চ দেশে গণহত্যা দিবস পালন করে আসছে। এরপর ২০১৫ সালে সংগঠনটি জানতে চেয়েছিল বাংলাদেশে এই দিনটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করা হয় কি না।
শাহরিয়ার কবির বলেন, তখন বাংলাদেশে দিনটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত না হওয়ায় জাতিসংঘ থেকে আমাদের বলা হয়েছে, নিজ দেশের জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করা হয় না তাহলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কিভাবে দেওয়া হবে।
এরপর ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদের চতুর্দশ অধিবেশনে ২৫শে মার্চকে 'গণহত্যা দিবস' ঘোষণা করা হয়।
২৫শে মার্চের ঘটনায় আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব কি না এমন প্রশ্নের জবাবে শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, যেহেতু প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস পালিত হচ্ছে তাই ২৫শে মার্চের ঘটনায় আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি হচ্ছে না। তবে আমরা ২৫শে মার্চ থেকে দীর্ঘ ৯ মাসের গণহত্যায় ৩০ লাখ প্রাণ গিয়েছে আমরা সেই ঘটনার স্বীকৃতি দাবি করছি।
তিনি আরও বলেন, জাতিসংঘের স্বীকৃতি পাওয়ার আগে সদস্য দেশগুলো থেকে স্বীকৃতি পেতে হবে। এরপর জাতিসংঘের স্বীকৃতি। বাংলাদেশ তো এখন পর্যন্ত বন্ধু রাষ্ট্র ভারত থেকেই স্বীকৃতি আনেনি। আমার জানামতে এখন পর্যন্ত কোনো দেশকেই সরকার স্বীকৃতি চেয়ে চিঠি দেয়নি।
গণহত্যার স্বীকৃতি পেতে হলে দেশের সরকার এবং নাগরিক সমাজকে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে বলেও জানান তিনি।
‘গণহত্যা দিবস’-এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে দেশের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় উপসচিব (ইতিহাস সংরক্ষণ, গবেষণা ও প্রকাশনা) শবনম মুস্তারী রিক্তা ঢাকা টাইমসকে বলেন, গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়টি নিয়ে আমরা তেমন কাজ করছি না। তবে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এই বিষয় নিয়ে কাজ করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল’ গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করে। এরপর বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে গণহত্যা নিয়ে কাজ শুরু হয়।
গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ‘সেন্টার ফর দ্য স্ট্রাডি অব জেনোসাইড এন্ড জাস্টিস (সিএসজিজে)’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম এবং তরুণ গবেষকরাও গণহত্যা নিয়ে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। তবে একযুগের বেশি সময় পার হলেও বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে তেমন কাজ হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ '৭১ নামের সংগঠনটি।
এদিকে দেশে এখন পর্যন্ত গণহত্যা দিবসকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আনতে কার্যকর পদক্ষেপ বা দৃশ্যমান ভূমিকা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তেমন হচ্ছে না বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। এছাড়াও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অনেক দপ্তর এই বিষয়ে তেমন কোনো সঠিক তথ্যও দিতে পারেনি।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (গেজেট) হরিদাস ঠাকুর ঢাকা টাইমসকে বলেন, গণহত্যার বিভিন্ন বিষয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করা হচ্ছে। প্রতি বছরই সেখানে বিভিন্ন সংস্থা কার্যক্রম করে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অনুষ্ঠান করে তা বিশ্ব দরবারে তুলে ধরছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পেলেও প্রতি বছরই ২৫শে মার্চ দেশে জাতীয় দিবস হিসেবে গণহত্যা দিবস পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘের ‘দ্য কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইড’ এর তথ্য বলছে, জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের ব্যাপকহারে হত্যা করলে, তাদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিসাধন করলে, কোনো জাতিগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ক্ষতিসাধনের লক্ষ্যে সুকৌশলে কোনো কর্ম পরিচালনা করলে, সদস্যদের প্রজননক্ষমতা বিনষ্ট করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলে এবং শিশুদের পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন বা নিজ জাতিগোষ্ঠী থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার মতো অপরাধ করলে গণহত্যা বলে স্বীকৃত হবে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) রথীন্দ্র নাথ দত্ত ঢাকা টাইমসকে বলেন, গণহত্যা দিবস নিয়ে সরকার নানামুখী কার্যক্রম চালাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় দেশের বিভিন্ন স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ করেছে, এখনও এই কাজ চলমান আছে। এছাড়াও আমরা সাড়ে ৪শ গেজেট করেছি, আরও অনেক কাজ চলমান আছে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য আমাদের যা যা করণীয় আমরা তাই করছি। বিভিন্ন প্রমাণ আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপস্থাপন করে আসছি। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে গণহত্যার প্রমাণাদি আমরা সেখানে উপস্থাপন ও সংরক্ষণ করে রাখছি। প্রতি বছরই সেখানে দেশি বিদেশি পর্যায়ে বিভিন্ন সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক সংস্থা অনুবিভাগের মহাপরিচালক মিজ্ ওয়াহিদা আহমেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমরা গণহত্যার স্বীকৃতির বিষয়টি খুবই জোরালভাবে দেখছি। বর্তমানে জেনোসাইডে ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের যুদ্ধে গণহত্যার বিষয়টি উঠে এসেছে। যখন এ ধরনের ঘটনা ঘটে তখন বিভিন্ন দেশ ভোট করতে পারে। বিভিন্ন দেশের সাথে আমরাও এই বিষয়টি উপস্থাপন করতে পারবো। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, যদি ইচ্ছে করে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা করা হয় তাহলে সেটি ‘জেনোসাইড’ বলে বিবেচিত হতে পারে৷
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ ৯ই ডিসেম্বর দিনটিকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস হিসাবে ঘোষণা করে।
১৯১৫ সালে আট লাখ আর্মেনিয়ানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে অটোমান কর্তৃপক্ষ।ওই সময় শত শত আর্মেনীয় বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে। তৎকালীন সময়ে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করলে এর বিপক্ষে অবস্থান নেয় তুরস্কসহ বেশ ক’টি দেশ। শত বছর পর আর্মেনীয়রা জাতিসংঘের কাছ থেকে তাদের এই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সক্ষম হয়। জাতিসংঘ ওই হত্যাকাণ্ডকে বিশ্বের নিকৃষ্টতম গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
(ঢাকাটাইমস/২৫মার্চ/এইচএম)

মন্তব্য করুন