উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ২০২৪: দলগুলোর নানা সমীকরণ

এবার দেশে ষষ্ঠবারের মতো উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ৪৯৫টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচন চার ধাপে অনুষ্ঠিত হবে। এরই মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষিত হয়েছে। প্রথম ধাপে ১৫২টি উপজেলার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ৮ই মে। দ্বিতীয় ধাপে ১২১টি উপজেলার নির্বাচন হবে ২১শে মে। ঈদের পর বাকি দুই ধাপের তপশিল ঘোষিত হবে। জাতীয় সংসদের পর এটি সবচাইতে বড়ো স্থানীয় সরকার নির্বাচন যা নিয়ে সব মহলেরই বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। দেশে এখন ঈদ উদ্যাপনের প্রস্তুতি চলছে। মানুষ গ্রামে-গঞ্জে শহর থেকে নাড়ির টানে বাড়ি যাচ্ছে। ঈদের পরপরই বেশিরভাগ যার যার কর্মস্থলে আবার ফিরে যাবে। তারপরও যেসব উপজেলায় প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনি তপশিল ঘোষিত হয়েছে সেখানে ঈদ-উৎসব আর নির্বাচনি আমেজ একাকার হয়ে ওঠছে বলে গণমাধ্যম সুত্রে জানা যাচ্ছে।
এবারের উপজেলা নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা ধরনের উত্তেজনা বিরাজ করছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, দলীয় প্রতীক নৌকায় কাউকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে না, দল থেকে কাউকে স্বতন্ত্র হিসেবেও সমর্থন করা হবে না। উপজেলায় যেসব নেতৃবৃন্দ রয়েছেন তারা নিজেদের যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার উপর ভিত্তি করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন- এমনটিই দলের প্রত্যাশা। দলীয় কোনো এমপি অথবা মন্ত্রী উপজেলার নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত না হওয়ার সিদ্ধান্তও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে গতবার দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে গিয়ে যে দ্বন্দ্ব ও রেষারেষি তৈরি হয়েছিল সেটির রেশ এখনো অনেক জায়গায় কাটেনি। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে নির্দলীয়ভাবেই অনুষ্ঠিত হতো, সেটি দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু নানাজনের নানা অভিমত শুনে আওয়ামী লীগ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীক বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নিয়ে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে তা মোটেও সুখের হয়নি। সে কারণেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীক বরাদ্দের সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে এসেছে। তাতে আওয়ামী লীগের শুভাকাক্সক্ষী ও তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী খুশি হলেও মনে মনে ক্ষুদ্ধ হয়ে আছেন নির্বাচন প্রত্যাশী কিছু কিছু নেতা। তাদের হিসাব-নিকাশ হচ্ছে দলীয় প্রতীক পাওয়া গেলে নির্বাচনে জয়লাভ করা সহজ হয়ে যায়। এখন দলীয় মনোনয়ন বা প্রতীক না পাওয়াতে তাদেরকে পড়তে হচ্ছে ভোটারদের চরম পরীক্ষার মুখে- যা তারা রাজনীতির কর্মী হওয়া সত্ত্বেও অনেকদিন ভুলতে বসেছিলেন। কিন্তু এবার তাদেরকে ভোটারদের কাছে তাদের আসল জনপ্রিয়তা নিয়েই যেতে হবে। আওয়ামী লীগের জন্য এই নির্বাচনটি অনেক আসনে মোটেও সহজ হবে না।
অন্যদিকে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ত্রিমুখী সংকটে পড়েছে। বিএনপির মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী দাবি করছেন যে- ‘আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। আমরা এখনো এ সিদ্ধান্ত বহাল রেখেছি। তাই দলের কেউ যদি এ সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে নির্বাচন করে তাহলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ অন্যদিকে বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী। তারা দলের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে চাপ সৃষ্টি করছে। এইসব নেতৃবৃন্দকে হতাশ করা হলে অনেকেই কুমিল্লার মতো বিদ্রোহী হয়েও যেতে পারে। কোনো উপজেলায় যদি কোনো নেতা মনে করেন যে- তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হলে জয়লাভের সম্ভাবনা রয়েছে তাহলে তিনি কেন সেই সম্ভাবনা হাত ছাড়া করবেন? বিএনপির অভ্যন্তরেই ব্যাপকসংখ্যক নেতাকর্মী রয়েছেন যারা আর নির্বাচন বর্জনের পক্ষে নন। তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীদের ধরে রাখার জন্য হলেও বিএনপির এইসব নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন। রাজনীতির বিশেষজ্ঞগণও মনে করেন যে, বিএনপির উচিত হবে সব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। তাতে নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য হয় কি না সেটিও প্রমাণিত হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে এখন যেভাবে টিয়া পাখির মতো মুখস্ত বিদ্যায় বলা হচ্ছে ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনে জনগণ বিএনপির ডাকে সাড়া দিয়ে অংশগ্রহণ করেনি, নির্বাচনে কেউ বলেন দুই শতাংশ, কেউ বলেন ছয় শতাংশ, কেউ বলেন কোনো ভোটই পড়েনি- এধরনের তথ্য-প্রমাণবিহীন কথাবার্তা দলের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করে। দেশে আওয়ামী লীগের ভোটারের সংখ্যা কি নাই হয়ে গেছে? বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনকারীদের কথা শুনে তাদেরকে টিয়া পাখির মতোই মুখস্ত বিদ্যা বারবার আওড়াতে দেখে মনে হয় রাজনীতিবিদ হিসেবে তাদের অবস্থান কোথায় নেমে গেছে সেটি তারাও বুঝতে পারছেন না। সে কারণেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে কারো কারো প্রতি অসন্তোষ থাকা সত্ত্বেও সাধারণ জনগণ বিএনপি কিংবা যুগপৎ আন্দোলনকারীদের ডাকে তেমন কেউ সাড়া দিচ্ছে না। রাজনীতিতে কখন বর্জন করা প্রয়োজন তা যারা বোঝে না তাদের পেছনে গিয়ে সর্বশান্ত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এখন বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়া নিয়ে উভয় সংকটে পড়েছে। অংশ নিলে অনেকেই বলবে ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিতে সমস্যা কি ছিল? আবার উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নিলে তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীদের ধরে রাখাও বেশ কঠিন হতে পারে। অন্যদিকে জামায়াত ঠিকই উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে। তাহলে বিএনপির এতো অনড় অবস্থানের রহস্যটা কোথায় লুকিয়ে আছে? জামায়াত মনে করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তারা জামায়াত, বিএনপি এবং সরকার বিরোধী ভোটারদের ভোট টানতে পারবে। তাছাড়া তারা জনগণের কাছে গিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অনেক নালিশই করার সুযোগ পাবে। এইসব সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চায় না। যেহেতু এই নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের বাধ্য বাধকতা নেই, নির্বাচন কমিশন তাদেরকে কোনো আইনে আর ধরতে পারবে না, তাই তারা সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নয়। জামায়াতের রাজনীতি বোঝার সক্ষমতা হয়তো বিএনপির নেই, সে কারণে একই জোট ও আদর্শের হওয়া সত্ত্বেও জামায়াত তার রাজনীতি নানা কৌশলেই চালিয়ে যাচ্ছে।
উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় পার্টি লাঙল প্রতীক নিয়েই অংশ নেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। জিএম কাদের অনেক কথা আওড়াচ্ছেন-শোনাচ্ছেন। মরহুম ভাইয়ের কল্যাণে তিনি জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে এসে এখন দলীয় সভাপতি হয়েছেন। ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তিনি ভাইয়ের মতোই নানা কৌশলে খেলা খেলেছেন। নির্বাচনে ১১টি আসন পেয়ে বিরোধী দলীয় নেতা হয়েছেন। বিএনপি অংশ নিলে তিনি বা তার দলের অবস্থা কী হতো তখনই কেবল বোঝা যেত। তারপরও তিনি যেসব কথা বলেন তা জাতীয় পার্টিকে কতটা জনগণের কাছে প্রিয় করে তুলছে তা হয়তো তিনি উপজেলা নির্বাচনে হাতেনাতে ফল দেখতে পাবেন। উপজেলা নির্বাচনে আরো বেশ কিছু দলের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছেন, এটি শুভ লক্ষণ হতে পারে। উপজেলা নির্বাচনটি অংশগ্রহণ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হোক। এতে নির্বাচন কমিশন পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করুক, কোনো ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি না হোক, সরকারকেও যেন এই নির্বাচনটিতে কোনোভাবেই প্রশ্নের মুখোমুখি না হতে হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে- এটি সকলে আশা করে। সরকারের জন্য এই নির্বাচনটি একটি পরীক্ষাও বটে।মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: ইতিহাসবিদ, কলাম লেখক ও সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন