ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ

শাহনূর শাহীন
| আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৪৬ | প্রকাশিত : ১১ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৪১

‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’- প্রতি বছর রমজান মাসজুড়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী এই গানটি আমাদেরকে ঈদুল ফিতরের আগমনী বার্তা শুনিয়ে যায়। মর্মে মর্মে বেজে উঠে ঈদের আগমনী শুভেচ্ছা। গানটির সুর, ছন্দ ও সহজবোধ্যতা মানুষকে এতটাই আকর্ষণ করে যে, ঈদের দিনে গানটি না গাইলে মনে হয় ঈদের আনন্দটাই অনেকটা অপূর্ণতা থেকে যায়।

কবিতা পাঠকের মনকে নাড়া দেয়। কবিতার সুর ও ছন্দ শ্রোতার হৃদয় উদ্বেলিত করে। একটি কবিতা বা গান যখনই বাস্তবমুখী এবং সহজবোধ্য হয় তখনই পাঠক-শ্রোতার হৃদয়ে তা জায়গা দখল করে নেয়। কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত এই গীতিকবিতার পরতে পরতে মানুষের মনের কথাগুলো সাজানো হয়েছে। যার জন্য প্রতিবছর পুরোনো এই গানটিই নতুন করে শ্রোতার হৃদয়জুড়ে আনন্দের ঝড় তোলার জন্য ফিরে আসে। বাংলাদেশের বিখ্যাত প্রায় সব শিল্পীর কণ্ঠেই কালজয়ী এই গানটি শোনা যায়। বাঙালির মন ও মননে নজরুলের এ গানটি চিরায়ত হয়ে আবেদন রাখছে এবং রাখবে যুগ যুগান্তর ধরে। লেখা বড়ো হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আপাতত ছোট্ট পরিসরে গানের প্রথম দুটি লাইন নিয়েই কথা বলবো।

‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ এবং ‘আপনাকে আজ বিলিয়ে দে তুই আসমানী তাগিদ’। এ গান শুধু গান নয়- এটি একটি কালজয়ী আহ্বান। এই গানে নজরুল শুধু খুশির খবরই শুনাননি। গানের ভিতর দিয়ে করে গেছেন মানুষ হওয়ার আহ্বানও। করেছেন মানবতার আহ্বান, মনুষত্বের আহ্বান।

ঈদের খুশির খবর জানান দেওয়ার পরপরই বলা হয়েছে, ‘আপনাকে আজ বিলিয়ে দে তুই আসমানী তাগিদ’। অর্থাৎ আপনাকে মানে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এখানে কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিলিয়ে দাও নিজেকে মানুষের মাঝে। মানবতার মাঝে। মিটিয়ে দাও নিজের আমিত্বকে। আপনার ভিতর থাকা আমিত্ব, অহংকার, হিংসা, বিদ্ধেষ, লোভ, পরনিন্দা, চোগলখুরি সব কিছু ছেড়ে দাও। অন্তরে লুকিয়ে থাকা আমিত্বকে বিলীন করে দিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দাও মানুষের তরে মানবতার তরে। আপন করে নাও মানুষকে।

কেন এসব করবে? কেন নিজেকে মিটিয়ে দিবে? কেন নিজেকে অপরের মাঝে বিলিয়ে দিবে? কারণ এটা আসমানী তাগিদ। আসমানের মালিকের শিক্ষা এমনই। এটা তার আহ্বান। আসমানের মালিক তোমাকে এই আহ্বান করেছেন। কাবার মালিক তোমাকে বলেছেন, নিজেকে বিলিয়ে দাও মানুষে মাঝে। আপন করে নাও মানুষকে। গাও মানবতার জয়গান। কেননা ঈদের এই আনন্দের সাথে প্রচ্ছন্নভাবে জড়িয়ে আছে দীর্ঘ এক মাসের উপবাসের স্মৃতি। রোজার শেষে ঈদ এসেছে কথার দ্বারা- এ কথার দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, রোজার শেষে এই আনন্দ যদি সবার মাঝে ভাগাভাগি করে নেওয়া না যায় তাহলে এই দীর্ঘ উপবাস একদমই বৃথা।

আনন্দের দিনে কেউ এক মাসের উপবাসমুক্তির আনন্দ উদ্যাপনে উদরপূর্তি করে খাবে আর অন্যদিকে কেউ সারা বছর উপবাস থাকবে এটা প্রভুর শিক্ষা নয়। সুতরাং খোঁজ নাও তোমার আশেপাশে কে আছে উপবাসকারী। নিজেকে বিলিয়ে দাও উপবাসবকারীর মাঝে। আপনার আমিত্বকে বিলীন করে মানুষের সাথে মিশে যাও। সারা পৃথিবীজুড়ে করোনা মহামারীর ধকল শেষে এখন যুদ্ধের ভার বহন করছে মানুষ। যুদ্ধাবস্থার এই সময়ে বিশ্বময় বেড়েছে খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন সামগ্রীর দাম। বাংলাদেশেও তার আঁচ লেগেছে। কারণে-অকারণে, যৌক্তিক-অযৌক্তিকভাবে দেশের বাজারে পণ্যমূল্যের দাম এখন আকাশ ছোঁয়া।

ঈদ আনন্দের পূর্ণতার এই গান আনন্দের বার্তা দিলেও সাধারণ খেটে খাওয়া ও অল্প আয়ের মানুষের ঈদ যেন গোপন করা চোখের পানি নিয়ে আসে। প্রতি বছর রমজান আসার আগেই দেশের ব্যবসায়ীরা এক ধরনের অসাধু পণ করেন। যেকোনোভাবেই হোক, সারা বছর যা আয় করেছেন; রমজানে তার দ্বিগুণ আয় ঘরে তুলবেন। ব্যবসায়ীদের এই অতি লোভী মনোভাবের কারণে প্রতিবছরই দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ঈদের বাজারে গিয়ে নীরবে চোখের জল ফেলেন অনেক বাবা। কিংবা কারো মা, কারো ভাই, কারো বোন। পরিবারের দায়িত্বে থাকা মানুষটি কিংবা জ্যেষ্ঠ সদস্য পুরো রমজানে ইফতার ও সাহরির বাজার করে হিমশিম খেয়ে যান। এরই মধ্যে চলে আসে আনন্দের ঈদ। শহরে থাকা মানুষগুলো নাড়ির টানে বাড়ি ফিরতে মুখিয়ে থাকেন। সেখানেও বাগড়া দেয় পরিবহণ ব্যবসায়ী ও চালক-হেলপাররা। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে মরিয়া হয়ে ওঠেন তারা এই সময়ে। ফলে যার আয় আছে তার আয় আরও বাড়ে, যার আয় কম তার আরও কমে। দেশের ইতিহাসে অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছরের ঈদ আরও বেশি কষ্টসাধ্য হয়েছে ব্যবসায়ীদের লাগামহীন লোভাতুর মানসিকতার কারণে। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী যে, তাদের সামনে দেশের সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রও অনেকটা অসহায়। মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে বলেন, তাদের ধরা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন, কিন্তু কোনো কাজ হয় না। সংশ্লিষ্ট এক মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব বলেন, সরকারের একার পক্ষে নাকি অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। আল্লাহর রাসূল ঘোষণা দিয়েছেন, যারা রমজান পেল কিন্তু নিজের গোনাহ মাফ করাতে পারলো না তাদের ওপর অভিশাপ। দুর্ভাগ্য সেই সব মানুষের জন্য যারা মানুষ হয়েও মানুষের কষ্ট বাড়ানোর ফন্দি আঁটেন। নিজের প্রবৃত্তির সংযম না করে বরং উল্টো প্রতারণা ও অন্যকে ঠকানোর পরিকল্পনা করেন।

অতি লোভি কিছু মানুষের উচ্চ-আকাঙ্ক্ষার কারণে সমাজের অধিকাংশ মানুষের মুখের হাসি মলিন হয়ে যায়। বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে ভাটা লেগেছে অনেক ধন্যাঢ্য পরিবারেও। তারপরও এই অবস্থায় যারা এখনো দু’মুঠো ভাত খেতে পারছেন ভালোভাবে; তারা এগিয়ে আসুক না খাওয়াদের সাহায্য করতে। এটাই মহান প্রভুর শিক্ষা, এটাই আসমানী তাগিদ। আমরা যেন নজরুলের এই কালজয়ী গান থেকে এমন শিক্ষাই নিতে পারি সকলে।

শাহনূর শাহীন: লেখক, সিনিয়র সহসম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :