শহিদ মিনার থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ: স্বাধীনতার চেতনায় ‘একুশ ও একাত্তর’

বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ত্রিশ লক্ষ শহিদ আর দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি তাদের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা অর্জন করে। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে ১৯৫২ সালে সংঘটিত ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙালি যে লড়াকু মনোভাবের পরিচয় দেয়, বিশ্বের ইতিহাসে সেই ঘটনা তুলনারহিত। মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে রাজপথে রক্ত দেয় সাহসী বাঙালি। বাঙালি জাতিসত্তা, জাতি রাষ্ট্রের সম্পর্কের সেতুবন্ধন ছড়িয়ে গিয়ে জড়িয়ে আছে আমাদের দু’টি অনন্য স্মারক স্মৃতিতে। একটি শহিদ মিনার, আরেকটি জাতীয় স্মৃতিসৌধ। দেশপ্রেম ও ইতিহাস চেতনার অবিস্মরণীয় স্বাক্ষর দুটিকে ঘিরেই আত্ম-অনুসন্ধানে আলোকিত ইতিহাসকে দেখার চেষ্টা করবো। কারণ গুরুজন বাক্য- ‘আত্মবিস্মৃত জাতি কখনো বড়ো হয়ে ওঠে না, উঠতে পারে না। আর তাই চাই ইতিহাসের সত্যান্বেষণ।’ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চরণ স্মরণ না করলেই নয়- ‘মোদের চক্ষে জ্বলে জ্ঞানের মশাল বক্ষে ভরা বাক্ / কণ্ঠে মোদের কুণ্ঠা-বিহীন নিত্য-কালের ডাক।’ সেই আহ্বানেই সাড়া দিতে আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের উৎসমুখ থেকে বিজয়ের পরিণতির স্বাধীনতার চেতনায় ‘একুশ থেকে একাত্তর’ অনুধাবনে সচেষ্ট হব।
২.
বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের গৌরবগাথা ভাষা আন্দোলন। ঐতিহাসিক এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই মূলত বাঙালি জাতিসত্তার জন্ম হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে প্রতিটি গণআন্দোলনের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে মহান ভাষা আন্দোলন। একুশের চেতনা এক অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনারই গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে খণ্ডন করেই ভাস্বর হয়ে ওঠে। একুশ মানে অবৈজ্ঞানিক ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে মিথ্যা প্রমাণ করে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার নাম। জাতিসত্তার চেতনায় প্রাণিত বাংলার ছাত্রসমাজ আত্মদান করে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। কে জানত, ’৪৮-এর ১১ই মার্চের পথ ধরেই ’৫২, ’৬২, ’৬৯-এর পরিক্রমায় ’৭১-এ একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনায় স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ প্রতিবছর অমর একুশের শহিদ দিবসে, ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে, ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বাঙালির সূর্যসন্তানদের শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করে। অমর একুশে ফেব্রুয়ারি রক্তের প্লাবনের মধ্য দিয়ে আজ সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবময় আসনে আসীন। শুধু বাঙালি নয়, বিশ্বের প্রতিটি জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা, স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও মানুষের মতো বাঁচার দাবির সংগ্রামের দুর্জয় অনুপ্রেরণা সৃষ্টির চির অনির্বাণ শিখার দীপ্তিতে দিগন্ত উদ্ভাসিত করেছে একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশে ফেব্রুয়ারি এ দেশের মানুষকে শিখিয়েছে আত্মত্যাগের মন্ত্র, বাঙালিকে করেছে মহীয়ান। জাতি হিসেবে আমরা আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সমন্বয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করেছি। মহান ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে এসেছে মহত্তর স্বাধীনতার চেতনা।
৩.
কোনো ধরনের স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা স্মৃতিফলক নেই, এমন স্বাধীন দেশ পৃথিবীতে খুবই বিরল। সাধারণ অর্থে স্মৃতিফলক বা স্মৃতিস্তম্ভ হলো এমন একটি বস্তু যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা ঘটনাকে স্মরণ করা হয়। নামফলক, সমাধিক্ষেত্র, কবর ফলক, ভাস্কর্য, গণকবর, বধ্যভূমি থেকে শুরু করে দেওয়াল, ভবন, মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনা, পার্ক যেকোনো কিছুই স্মৃতিচিহ্ন বা স্মৃতিসৌধ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে। যেকোনো ঐতিহাসিক ঘটনা স্মরণীয় করে রাখতে মানুষ নির্মাণ করে স্মৃতিস্তম্ভ। এর মাধ্যমে ইতিহাসকে হৃদয়ে ধারণ করা অনেক সহজ হয়, সরল হয়ে যায় অমর ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা জানানোর কঠিন কাজটাও। আর সেজন্যই ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে বাংলা ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গ করেছিলেন যারা, তাদের স্মরণে নির্মিত হয় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার। ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রাঙ্গণে অবস্থিত আমাদের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে রক্ত দিয়েছিলেন এ দেশের দামাল ছেলেরা।
বায়ান্নর মাতৃভাষার স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পথ ধরেই স্বাধিকারের আন্দোলন এবং স্বাধীনতা লাভ। তাই শহিদ মিনার শুধু ভাষা সংগ্রামের স্মারকই নয়; সব অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, শোষণ, দুঃশাসন অবসানের জন্য সংগ্রামের প্রতীক। স্মৃতিস্তম্ভ ‘শহিদ মিনার’ বাংলা ভাষার ও বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রাণের প্রতীক হয়ে উঠেছে। বিশ্বের যেখানেই বাংলা ভাষাভাষীরা আছেন সেখানেই মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে গৌরবের শহিদ মিনার। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত শহিদ মিনার জাতির সব আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার অধিকারের জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেওয়ার নজির কেবল এদেশেরই আছে। এই ইতিহাস কারও অজানা নয়।
৪.
গল্পটা অবিভক্ত পাকিস্তানের। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয়। উদ্দেশ্য একটাই উর্দু নয়, বাংলাই যেন রাষ্ট্রভাষা হয়। কিন্তু পাক হানাদাররা সে দাবি সহ্য করতে পারছিল না। ফলে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি মিছিলে শহিদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ নাম না জানা আরও অনেকে। এই শহিদদের আত্মত্যাগের ফলেই বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি লাভ করে। এটি কেবল ভাষার দাবিতে সংগ্রাম ছিল না। এই সংগ্রামে আসলে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের বীজ রোপিত হয়েছিল। আর সেই বীজ থেকেই ১৯৭১-এ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন দেশ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে বাংলাদেশ। বায়ান্নর একুশের রক্তঝরা ঘটনার এক দিন পরই মহান শহিদদের স্মরণে গড়ে উঠেছিল শহিদ মিনার। একুশের সব স্মৃতি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার লক্ষ্যে নির্মাণের পরদিনই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেও দ্বিতীয়বারের মতো শহিদ মিনার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় কামানের গোলায়। কিন্তু সেই অপচেষ্টা সফল হয়নি। নিশ্চিহ্ন করা যায়নি বাঙালির স্মৃতির মিনার।
আধুনিক বাংলাদেশের কেন্দ্রবিন্দু থেকে শুরু করে আনাচে-কানাচে শহিদের রক্ত বুকে নিয়ে সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শহিদ মিনার। আর একুশ যখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেল, তখন এই স্মৃতির মিনার ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। দেশের সীমা ছাড়িয়ে শহিদ মিনার মাথা তুলছে বিশ্বের দেশে দেশে। একুশের স্মৃতিবাহী শহিদ মিনারই সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র স্মৃতিস্মারক, যার অনুরূপ মিনার গড়ে উঠেছে দেশব্যাপী। দেশের এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে না, যেখানে একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হয় না, যেখানে শহিদ মিনার নির্মিত হয়নি। শুধু দেশেই নয়, বিশ্বের যেখানেই গড়ে উঠেছে বাঙালি জনবসতি, সেখানেই পরম মমতায় গড়ে উঠছে শহিদ মিনার। শহিদ মিনার যেমন চেতনাকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে থাকে, তেমনি সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধও একটি জাতির আত্মত্যাগ আর বিজয়ের গৌরব গাথার বয়ান পৌঁছে দেয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে। এই জাতীয় স্মারক স্থাপত্যটি, বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে শহিদদের চিরস্মরণীয় করে রাখতে নির্মিত হয়। জাতীয় স্মৃতিসৌধ এমন অনন্য একটি স্মৃতিস্তম্ভ যেটি বিশ্ব দরবারে লাল-সবুজ পতাকা, দোয়েল, কাঁঠাল কিংবা ইলিশের পাশাপাশি আমাদের জাতীয় প্রতীক হয়ে উঠেছে, সেটিই বাঙালির মুক্তির জন্য আত্মত্যাগের স্থাপত্যশিল্প সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অমূল্য জীবনদায়ী শহিদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ঢাকা জেলার সাভারের নবীনগরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়।
৫.
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিকে বলা যায় বাংলাদেশের রাজনীতির এক অনন্য ধারার সূত্রপাত হিসেবে। সেইদিন যে ধারার সূত্রপাত হয়, ১৯ বছরের মাথায় সেই ধারাই পরিপুষ্ট হয়ে রূপ নেয় জাতীয়তাবাদী ধারণার স্রোতে, জন্ম দেয় স্বাধীন বাংলাদেশের। একুশ ফেব্রুয়ারি যে অফুরান ধারার সূত্রপাত, একুশের ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জাতীয় ও রাজনৈতিক জীবনে ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। একুশের সঙ্গে একাত্তরের রয়েছে রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা। দল-নির্বিশেষে একথায় ভিন্নমত দেখা যায় না।
উনিশশ সাতচল্লিশের দেশভাগের পর নানাভাবে বাঙালিদের উপর শোষণ-নির্যাতনের পরিক্রমায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তর, শত চাপ উপেক্ষা করে যে রাষ্ট্রের জন্ম, তার স্মৃতিসৌধটি তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল স্মৃতি, আবেগকে সম্মান জানাতে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একই সঙ্গে ত্রিশ লক্ষ প্রাণের আত্মত্যাগ এবং প্রত্যাশিত বিজয়ের সুতোয় গাঁথা। বাঙালি জাতি সবসময়ই তাদের মহান ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরব প্রকাশে আগ্রহী। আর তাই বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা ভাষার জন্য রক্তদানের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে যেমন শহিদ মিনার, তেমনি বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম ও বিজয় প্রকাশের উপযুক্ত প্রতীক হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে জীবন দেওয়া লাখো শহিদের স্মরণে নির্মিত বিভিন্ন স্মৃতিস্তম্ভ ও ভাস্কর্যের মধ্যে প্রধান এবং প্রথম হলো সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ।
জাতির যে আকাক্সক্ষাকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, আমাদের যোদ্ধারা অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন, তাদেরই আত্মত্যাগের ইতিহাস বহন করা জাতীয় স্মৃতিসৌধ সম্পর্কে এ প্রজন্মের তরুণদের জানাতে হবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তারুণ্যের ইতিহাস। তরুণদের এ ইতিহাস আগলে রাখতে হবে। সে জন্য তাদের জানতে হবে সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা। জাতীয় স্মৃতিসৌধ জানান দিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সংগ্রাম আর রক্তদানের কালের সাক্ষী হিসেবে। সেইসাথে স্মারক হয়ে আছে একুশ থেকে একাত্তরের মহান চেতনার আলোকিত অনুভবের প্রতিরূপ হিসেবে।
৬.
ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক থেকে নজর দিলেই দেখতে পাই- লাল ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা চারদিক। মাঝখানে প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকতেই সরাসরি চোখ চলে যায় জাতীয় স্মৃতিসৌধের উঁচু মিনারের দিকে আর মনে পড়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা। স্মৃতিসৌধে প্রবেশের পর প্রথমেই চোখে পড়বে শ্বেতপাথরে উৎকীর্ণ একটি লেখা। ‘বীরের এ রক্তস্রোত মাতার এ অশ্রুধারা / এর যত মূল্য সে কি ধরার ধূলোয় হবে হারা’-এর একটু সামনেই শ্বেতপাথরের ভিত্তিপ্রস্তর। এরপরেই ডানদিকে রয়েছে নজরকাড়া উন্মুক্ত মঞ্চ। সোজা হেঁটে গেলে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সাতটি পর্যায়কে ফুটিয়ে তোলা মূল স্থাপত্যশিল্পটি- স্মৃতিসৌধ। এই জাতীয় স্মৃতিসৌধটি শুধু মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের স্মৃতি স্মরণের জন্যই নয়, এর ভাঁজের মাঝে লুকিয়ে আছে আমাদের আলোকিত অতীতের অজানা ইতিহাসমালা। যে ইতিহাস, যে ঘটনা আমাদের স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে দ্রুত গতিতে এবং স্বল্প সময়ে। আমরা হয়ে উঠেছি অপ্রতিরোধ্য।
একটি স্বাধীন দেশের নেশায় বাংলার নারী-পুরুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধে, ছিনিয়ে এনেছে বিজয়। শেকড় থেকে শিখরে পৌঁছানোর ধাপগুলো চেতনার বিকাশের ধাপগুলো স্মরণ করিয়ে দিতে স্মৃতিসৌধের ছবিটি আমাদের মনের ক্যানভাসে চিরস্থায়ী আসন দখল করে আছে। জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, সব চাপ উপেক্ষা করে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে বিশ্বে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছে, স্বাধীন হয়েছে, সেটিই তিনি এখানে তুলে ধরেছেন। দেড়শ’ ফুট বা ৪৫ মিটার উঁচু এই স্মৃতিসৌধে রয়েছে ৭টি ফলক। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ৭টি পর্যায়কে চিহ্নিত করা হয়েছে। পর্যায়গুলোর প্রথমটি হলো বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। এরপর চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ছাপ্পান্নর শাসনতন্ত্র আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন এবং উনসত্তরের গণঅভ্যুথানের পর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় আর স্বাধীনতা। অর্থাৎ প্রতিটি বড়ো পরিসরের ঘটনা, আন্দোলন ও বিজয়ের ধারণা এক করে জাতীয় স্মৃতিসৌধের রূপ দেওয়া হয়েছে।
এই সাতটি ঘটনাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিক্রমা হিসেবে বিবেচনা করেই সৌধটি নির্মাণ করা হয়েছে। এই সাত সংখ্যাটি একটু অন্যভাবেও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। এই সালটির দুটি সংখ্যার যোগফল ৫+২= ৭। আবার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ৭ তারিখেই। আমাদের বিজয় দিবস হচ্ছে ১৬ই ডিসেম্বর। এই তারিখের দুটি সংখ্যার যোগফলও কিন্তু ১+৬= ৭। আবার ৭ দিয়ে বোঝানো হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠকেও।
৭.
১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর প্রথম বিজয় দিবসে বাংলাদেশের স্থপতি, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই স্মৃতিসৌধের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৭৮ সালে স্মৃতিসৌধটি তৈরির কাজ শুরু হয় এবং ১৯৮২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর জাতীয় স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করা হয়। ৩৪ হেক্টর (৮৪ একর) জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত স্মৃতিসৌধের পুরো কমপ্লেক্স। এছাড়া রয়েছে একে পরিবেষ্টনকারী আরো ১০ হেক্টর (২৪ একর) জায়গা জুড়ে বৃক্ষরাজি পরিপূর্ণ একটি সবুজ বলয়। এই সবুজ বেষ্টনী সবুজ শ্যামল বাংলাদেশের প্রতীক। স্মৃতিসৌধের পাশে রয়েছে বেশ কটি গণকবর ও একটি প্রতিফলন সৃষ্টিকারী জলাশয়। আমাদের জাতীয় স্মৃতিসৌধে বাংলাদেশ সফরকারী বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানগণ নিজ হাতে স্মারক বৃক্ষরোপণ করে থাকেন।
আমাদের সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্সের প্রধান ফটক দিয়ে কেউ যখন এ এলাকায় প্রবেশ করেন তখন প্রথমেই স্মৃতিসৌধটি চোখের সামনে দেখতে পান। যদিও মূল সৌধ পর্যন্ত যেতে হলে তাকে বেশ দীর্ঘ পথ হাঁটতে হয়। এই পথের মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো উঁচু নিচু চত্বর। এই চত্বরগুলো পার হতে হলে তাকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি দিয়ে বেশ কয়েক বার ওঠা নামা করতে হয়। তারপর পার হতে হয় বড়ো একটি কৃত্রিম জলাশয়। জলাশয় পার হওয়ার জন্য রয়েছে সেতু। এই পথের দু'পাশে রয়েছে গণকবর। এই প্রতিটি চত্বর ও সিঁড়ি লাল ইটের তৈরি। স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য জাতিকে যে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে চড়াই-উতরাই পার হতে হয়েছে। তারই প্রতীক হয়ে ওঠে এই দীর্ঘ হাঁটা পথটি।
স্বাধীন স্বদেশ পাওয়ার জন্য যে রক্ত দিতে হয়েছে তার বিমূর্ত প্রতীক লাল ইট। আর জলাশয়টি বেদনার অশ্রুর প্রতীক। সেইসাথে গণকবর স্মরণ করিয়ে দেয় শহিদদের মহান আত্মদানের আলোকিত ইতিহাস। এসব ছাড়াও স্মৃতিসৌধে রয়েছে হেলিপ্যাড, মসজিদ, অভ্যর্থনা কক্ষ, ক্যাফেটেরিয়া। তাছাড়া আছে জাতীয় স্মৃতিসৌধের অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ সব সময়ই সঙ্গ দেয় এর দর্শকদের। যেখানে গেলে শুধু প্রকৃতির কাছেই যাওয়া যাবে না তার সাথে নিজের মতো করে উপলব্ধি করা যাবে মহান মুক্তিযুদ্ধকে, চিনে নেওয়া যাবে একুশ থেকে একাত্তরের চেতনা জগতকে, অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে। সেই ভাব-অনুভবকে অনন্য গীতিকার মোহিনী চৌধুরীর গীতিভাষ্যে উচ্চারণ করি, ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে / কত প্রাণ হলো বলিদান / লেখা আছে অশ্রুজলে।’
আবদুল্লাহ আল মোহন: লেখক, গবেষক ও সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

মন্তব্য করুন