উপন্যাস

পতঙ্গপ্রাণ

সমীর আহমেদ
| আপডেট : ১৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:২৪ | প্রকাশিত : ১৫ এপ্রিল ২০২৪, ১০:০৯

যাত্রা

দূরে কোথাও যেন পাখি ডেকে উঠল এত রাতে কোকিল! শের আলী গাজী ভাবলেন, না না, কোকিল আসবে কোত্থেকে? বসন্তকাল তো এখনো আসেইনি মাঘ শেষ হতে আরও কিছুদিন বাকি তাহলে এবার বসন্ত আসার আগেই কি ডাক শুরু করলো কোকিল! নাকি তিনি আধোঘুমে ভুল শুনছেন? এ কোকিল নয়- অন্য কোনো পাখি তার মনটাই বা আজ হঠাৎ এত উতলা হয়ে উঠল কেন? ঘরে বসে থাকতে আর ইচ্ছে করছে না তিনি উঠে বিছানায় বসে রইলেন কিছুক্ষণ না, পাখিটা এখন আর ডাকছে না হয়ত বা ডাকেইনি কোনো পাখি এত রাতে নাকি ডেকেছিল, দূরে কোথাও!

তার স্ত্রী ফাতেমা বিবি পাশে নেই তিনি পির বংশের মেয়ে ধর্মকর্ম নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন হয়ত অনেক আগেই বিছানা ছেড়ে তাহাজ্জুদ নামাজে দাঁড়িয়েছেন শের আলী গাজী বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে গেলেন পাল্লা ফাঁক করে বাইরে তাকালেন এক টুকরো আলো ঘর থেকে লাফিয়ে বাইরে পড়ল জানালার ও-পাশের আঁধার বেশ খানিকটা পাতলা হয়ে ছড়িয়ে আছে তার ও-পাশে, একটু দূরে, ওই যে ঝোড়ঝাপটায় এখনো আঁধার ঘন হয়ে জমে আছে শাদা শাদা পাতলা মিহি কুয়াশা মাঘের শেষে শীত এখনো জেঁকে আছে ভালোই আমগাছ ও জামগাছগুলো আঁধার ও কুয়াশা জড়িয়ে ভূতের মতো স্থির দাঁড়িয়ে চারদিকে জেগে ওঠার একটা গোপন আয়োজন চলছে যদিও পাখিটা এখন আর ডাকছে না কোথাও তবু তার রেশ যেন রয়ে গেছে কানে ওটা কি আদৌ উড়ে গেছে দূরে? নাকি এখানেই কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছে? তার মনটা আজ বড়ো আনচান করছে কেন?

ওই তো ওদিকে হিজলগাছের ঘন সবুজ পাতার আড়াল থেকে ভেসে আসছে আরেকটা পাখির ডাক ভারি মিষ্টি কণ্ঠ তো! মনপ্রাণ একেবারে জুড়িয়ে যায় কী যেন নাম পাখিটার? কয়েকবার চেষ্টা করেও পাখিটার নাম মনে করতে পারলেন না শের আলী গাজী মনে মনে বললেন, বড়ো বিচিত্র এ দেশ মনোরম এর প্রকৃতি কত রকম পাখি যে এখানে দেখা যায়, কত কী যে নাম তাদের, তা বলে আর শেষ করা যাবে না জমিদারি দিয়ে একজীবন শুধু পাখির পেছনে কাটিয়ে দিলেও বোধ হয় সব পাখি তার চেনা হয়ে উঠবে না

মসজিদ থেকে ভেসে এল মোয়াজ্জিনের সুরেলা কণ্ঠে আজান ... আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম...আরেকটা গাছের ডালে কিচিরমিচির ডেকে উঠল কয়েকটা শালিক

তিনি অজু করে ফজরের নামাজ পড়লেন বিছানায় আর গেলেন না ফাতেমা বিবি জায়নামাজে বসে একাগ্রচিত্তে তসবিহর দানা টিপছেন শের আলী গাজী ঘরের দরোজা খুলে বাইরে এলেন হাঁটতে হাঁটতে ফুলবাগানে ঢুকলেন এদিকটায় হাস্নাহেনার ম ম গন্ধ, পাতলা আঁধার ও শাদা কুয়াশা ভেদ করে চারদিক ছড়িয়ে পড়ছে

বাগানে নানা জাতের ফুল হাস্নাহেনা, গন্ধরাজ, বেলী, বকুল, জবা, কাঁঠালিচাঁপা, চামেলী, নীল অপরাজিতা, চন্দ্রমল্লিকা আরও আছে অলকানন্দা বাগানের মাঝামাঝি তিনটি বসরাই গোলাপ গাছ সম্রাট বাবরের খুব প্রিয় ছিল গোলাপ ভারতবর্ষের মাটিতে তিনিই প্রথম গোলাপের চারা পুঁতে দেন তিনি কি সেই চারা বসরাই থেকে এনেছিলেন, না কি অন্য কোনো দেশ থেকে? তা জানেন না শের আলী গাজী তবে তিনি প্রায় পাঁচ মাস আগে চারাগুলো কোলকাতা থেকে এনেছেন কোলকাতায় এই চারা এসেছে সুদূর বসরাই নগর থেকে মালির নিবিড় পরিচর্যায় এই কয়েক মাসেই চারাগুলো ডালপালা ছড়িয়ে সবুজ পাতার সমারোহ ও ডালে ডালে তীক্ষè কাঁটা নিয়ে বেশ বেড়ে উঠেছে আজ বাগানে ঢুকে দেখলেন একটি গাছে ফুটে আছে টকটকে রক্ত গোলাপ বসরাই গোলাপ এত সুন্দর হয়! কী টকটকে লাল! কী সুন্দর মিষ্টি গন্ধ! এ জন্যই খৈয়াম গোলাপ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন? শায়ের লিখেছেন:

‘দীর্ণ হিয়ার কোন সে রাজার

রক্তে নাওয়া এই গোলাপ

কার দেওয়া সে লালচে আভা

হৃদয় ছে্যঁচা শোণিত ছাপ’

সতেজ পাপড়ি মেলে মনোহর সুগন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে চারদিকে পাপড়ির ভাঁজে অশ্রুর মতো জমে আছে কয়েক ফোঁটা শিশির মনে হচ্ছে সৌন্দর্যের সব বেদনা এখানে জমে আছে কিংবা বেদনার সবটুকু সৌন্দর্য তার মনে একটু আগে যে আনন্দ দোলা দিয়েছিল, তা মুহূর্তে উবে গেছে এখন অনুভব করলেন বেদনা সুন্দরের পাশে কলঙ্ক, আনন্দের পাশে বেদনা আছে বলেই কি জীবনে সুন্দর ও আনন্দকে গভীরভাবে স্পর্শ করার অনন্ত বাসনা মানুষের!

গোলাপটি তিনি ছিঁড়ে নিয়ে ফুলদানিতে রাখতে চাইলেন হাত বাড়িয়ে দিয়েও আবার ফিরিয়ে আনলেন, না না, ঠিক হবে না বরং এখানেই তার শোভা বেশ লাগছে আহা! এই গোলাপের সৌন্দর্যও একদিন ফুরিয়ে যাবে! তারপর গোলাপটি শুকিয়ে এখানেই ঝরে পড়বে শুধু গোলাপ কেন, খৈয়াম তো বলেছেন, ‘যে ফুলটি প্রস্ফুটিত হলো এক সময় তাকে মরতেই হবে’ আহা মৃত্যু! আহা জীবন! এ দুএর মাঝে মাত্র চুল পরিমাণ ফাঁক! গোলাপের কাছ থেকে তিনি ধীরে ধীরে সরে গেলেন হাস্নাহেনার দিকে সেখান থেকে নীল অপরাজিতার কাছে না, কোনোকিছুই আজ ভালো লাগছে না মনটা বড়ো বিক্ষিপ্ত, আনমনা কেন এমন হচ্ছে তিনি বুঝতে পারলেন না কোনো কোনো সময় কোনো কারণ ছাড়াই তার মনের ভেতর কেন এত বেদনার মেঘ জড়ো হয়? আজ আর কিছুতেই ঘরে কিংবা কাছারিতে বসে জমিদারির প্রথাবদ্ধ খবরদারি করতে ভালো লাগবে না আজ তার মন ছুটে যেতে চাইছে কাছেদূরে কোথাও কোথায়? তা ঠিক তিনি জানেন না তবে আজ তিনি কিছুতেই ঘরে বসে থাকতে পারবেন না তাকে বের হতে হবে কোথায় যাওয়া যেতে পারে, শিকারে? না, মনের আনন্দের জন্য পশু-পাখি বধ করা আজ তার ভালো লাগছে না তার চেয়ে বরং সারাদিন তিনি ঘুরে বেড়োবেন গাছপালা, পশু-পাখি, ফসলের মাঠ দেখবেন নায়েবকে বলে শকট প্রস্তুত করতে বলবেন নাকি ময়ূরপঙ্খি নৌকা? ময়ূরপঙ্খি নৌকাই তো ভালো মৃগী নদী দিয়ে গড়জরিপা থেকে দশকাহনিয়ার দর্শা গ্রামে কানুনগো অফিস অনেকদিন অফিসে যাওয়া হয় না আজ সেখানে গিয়ে একটু খোঁজখবর নেওয়া যেতে পারে মৃগী নদীর দুপাড়ের দৃশ্য বেশ মনোরম নদীতীরে ঘরবাড়ি, গাছপালা, ঘাটে ঘাটে মানুষের আনাগোনা, খেয়া নৌকায় লোক পারাপার, এসব দেখতে তার ভালোই লাগে মনটা উদাস হয়ে যায় ফুলবাগান থেকে বের হয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ালেন রাস্তায় দেখা হয়ে গেল নায়েব দস্তগীরের সাথে মসজিদ থেকে বের হয়ে তিনি ঘরে ফিরে যাচ্ছেন ডেকে বললেন, নায়েব সাহেব, দশকাহনিয়া দর্শা গ্রামে যাবো

কানুনগো অফিস?

হুম মাঝিকে ময়ূরপঙ্খি প্রস্তুত করতে বলেন তাড়াতাড়িই বের হবো

দস্তগীর বললেন, ঠিকাছে, জনাব, এখনই বলে দিচ্ছি

তাড়াতাড়ি তিনি চলে গেলেন চারদিক বেশ ফরসা হয়ে আসছে গাছে গাছে পাখির কিচিরমিচির পাখা ঝাপটানি শের আলী গাজী ঘরে ঢোকলেন ফাতেমা বিবি জায়নামাজ ছেড়ে বিছানায় তার চোখের কোণে চিকচিক করছে পানি মাঝে মাঝে জায়নামাজে বসে তিনি চাপাস্বরে কাঁদেন আল্লাহর কাছে কী প্রার্থনা করে কাঁদেন, কে জানে! আজও হয়তো কেঁদেছেন সেই কান্নার রেশ লেগে আছে চোখে শের আলী গাজী কিছু জিজ্ঞেস করলেন না আলমারি খুলে গায়ের পোশাক বদলে নিলেন ফাতেমা বিবি আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন শের আলী গাজী জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে বিবি?

না, কিছু না আঁচল দিয়ে তিনি চোখের কোণ মুছে ফেললেন

বাইরে যাবো আজ

কোথায়?

কানুনগো অফিস

খুব কি কাজ?

না, তেমন না যাবো একটু খোঁজখবর নিতে অনেকদিন ওদিকে যাই না

আজ কি না গেলে হয় না?

শের আলী গাজী চুপ করে রইলেন ফাতেমা বললেন, মনটা অকারণেই ভার হয়ে আছে কিছু ভালো লাগছে না

ওহ এই কথা! কিন্তু তারও তো ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না স্ত্রীকে বললেন, আমি যাওয়ার জন্য মন স্থির করে ফেলেছি

ফাতেমা বিবি কিছু বললেন না স্বামীর দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে রইলেন তার চোখ থেকে আবারও গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা জল সাথে সাথে সেই জল মুছতে তিনি ভুলে গেলেন শের আলী গাজী বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আজ তোমার কী হয়েছে বিবি? কাঁদছো কেন?

জানি না তবে আজ আমার মন ভালো নেই মনে হচ্ছে আমার কী যেন নেই কিংবা মূল্যবান কিছু আমি হারাতে যাচ্ছি বুকের ভেতরটা বেশ খাঁ খাঁ করছে খোয়াব দেখেছি, আমার কাছে থেকে এক টুকরো আলো ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে তারপর থেকেই মনটা...

আশ্চর্য! তারও তো এমনিই অনুভূত হচ্ছে কিঞ্চিৎ হেসে বললেন, এ কিছু নয় মানুষ কত অকারণেই তো স্বপ্ন দেখে আবার ভুলেও যায় ঠিক হয়ে যাবে

ফাতেমা বিবি বললেন, আপনার কথা যেন সত্যি হয় কিন্তু আমার ভেতরে কীসের যেন আশঙ্কা বহুদিন এমন হয় না এর আগে যখন এমনটি হয়েছে, তা সত্যি হয়ে গেছে আপনার মনে আছে কি না জানি না সেবার যখন...

থাক! শের আলী গাজী আবার মৃদু হাসলেন, জগতে হাজারো কাজ থাকতে কত তুচ্ছ বিষয় নিয়েই-না আমরা ভাবি গুরুত্ব দিই স্ত্রীকে বললেন, আল্লাহ ভরসা বিপদ-আপদে তিনিই তো আমাদের সহায় তাঁকে স্মরণ কর

অবশ্যই তিনি আমাদের সহায়

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফাতেমা বিবি বললেন, তবু আগামীকাল গেলে হয় না!

শের আলী গাজীও আগামী কাল যাওয়ার কথা ভেবেছেন কী এমন কাজ যে আজই যেতে হবে! কাল, পরশু কিংবা আরও পরে গেলেও তো ক্ষতি নেই কিন্তু তার মন কিছুতেই বাড়িতে থেকে যেতে সায় দিচ্ছে না দম বন্ধ হয়ে আসছে ভেতরে কেমন যেন একটা অস্থিরতা কোনো বিষয়ে একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে এমন হয় এখানে এখন তাঁর মন টিকছে না কিন্তু ফাতেমাকে তা বলা যাবে না তাহলে সে আরও দুশ্চিন্তা করবে তাকে আটকানোর জন্য আরও অনুরোধ করবে, যা তার কাছে এখন একেবারে অসহ্য কোনো বিষয়ে একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে তা পরিবর্তন করতে একেবারেই ইচ্ছে হয় না তার তাতে লাভ-ক্ষতি যা-ই হোক না কেন, তিনি সব সময় নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তিনি গলায় হিরা ও মুক্তার মালা পরে বললেন, অযথা ভেবো না

ফাতেমা বিবি বোঝেন তার স্বামীর মতিগতি তাকে এখন কিছুতেই ফেরানো যাবে না কারও বারণই এখন তিনি কানে তুলবেন না যাক, ভালোয় ভালোয় যেন তিনি ফিরে আসেন পথে, কোনো বিপদ যেন না হয় তার চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠল শের আলী গাজী তা মোটেও পাত্তা দিলেন না, বললেন, তবে সময় থাকলে একবার শাহ কামালের দরগা থেকেও ঘুরে আসতে পারি

ফাতেমা বিবি খুশি হলেন, তাই! তাহলে তো ভালোই হয় আমার জন্য বাবার কাছে দোয়া চেয়ে আসবেন আমার মনে হয় না আজ আমি ভালো স্বপ্ন দেখেছি

ঠিক আছে চিন্তা করো না সময় থাকলে অবশ্যই যাবো তোমার জন্য দোয়াও চাবো

শাহ কামালের প্রতি খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা ফাতেমা বিবির শের আলী গাজীরও কি কম? নামটা মনে পড়লেই শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়ে ওঠে তার মন শুনেছেন বড়ো বুজুর্গ মানুষ তিনি অনেক বছর আগে মুলতান থেকে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য এসেছিলেন দশকাহনিয়ায় স্থায়ী নিবাস গড়ে তুলেছিলেন ব্রহ্মপুত্র নদের ওই পাড়ে দুর্মট গ্রামে ইস্পানদিয়ার খান গাজী ও রাজা মনীন্দ্রনাথের নিকট থেকে তিনি জায়গীর পেয়েছিলেন গোয়ালপাড়ায় কড়ৈবাড়ির নিচে বহমান ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বাকলাইতে তার অনেক শিষ্য-ভক্ত আছে এই বাকলাইও তাকে নিষ্কর দিয়েছেন কড়ৈবাড়ির জমিদার ভক্তবৃন্দ সেখানে তার একটি দরগা বানিয়ে নিয়েছেন

কত অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনি এই তো ব্রহ্মপুত্র নদ তীব্র স্রোতে ভাঙতে ভাঙতে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছিল তাঁর আবাস ভিটার দিকে তার ভক্তরা হতাশ হয়ে একদিন বলল, যেভাবে নদ ধেয়ে আসছে, তাতে এই ভিটা তো থাকবে না খুব শীঘ্রই ব্রহ্মপুত্রে বিলীন হয়ে যাবে এর কি কোনো বিহিত করা যায় না, হুজুর?

তিনি মৃদু হেসে বললেন, নিশ্চয় যে উপরঅলা আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন, নিশ্চয় তিনি একটা বিহিত করবেন, ইনশা আল্লাহ...

ভক্তের কথা শুনে, তখনই তিনি হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে পাড়ে দাঁড়িয়ে বললেন, আর এদিকে আসবি না যা, পূর্ব পাড়ে সরে যা

আর কী আশ্চর্য, তারপর থেকে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহিত স্রোত উল্টোদিকে পূর্বপাড় দিয়ে বইতে থাকে শাহ কামালের আবাসের দিকে আর একবারও ভাঙে না এমন কামেল পিরকে কি শ্রদ্ধা না করে পারা যায়! এই তো কিছুদিন আগে, শের আলী গাজী গিয়েছিলেন তার দরগায় সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন বেশ কিছু উপঢৌকন তাকে দেখে তিনি খুব যে বেশি খুশি হয়েছিলেন তা নয় হুজুরের ব্যবহারে শের আলী গাজী কিছুটা হতাশই হয়েছিলেন তবে তার শিষ্যরা বলেছিল, কারো সাথেই হুজুর বেশি কথা বলেন না শের আলী গাজী তার খানকায় ঢুকলে হুজুর তার মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে গেলেন আস্তে আস্তে অনুচ্চস্বৈরে উচ্চারণ করলেন, কয়েকটি শব্দ, সংযত হও, গাজী সংযত হও তারপরই চলে যাওয়ার জন্য ইঙ্গিত করলেন মনে কিছুটা ব্যথা নিয়েই চলে এসেছিলেন শের আলী গাজী কিন্তু পরে যখন শুনলেন, হুজুর ওরকমই কারো সাথেই তিনি বেশি কথা বলেন না কাউকে তার কাছে বেশিক্ষণ থাকতে দেন না, তখন তার মনের বেদনা আর ছিলই না আজ ভাবলেন, দর্শা ঘুরে যদি হাতে সময় থাকে, তাহলে, দুর্মুটে যাবেন শাহ কামালের দরগা না গিয়ে ঘরে ফিরবেনই না বিবির মন ভালো করার জন্য তার কাছে দোয়া চাইবেন

দরোজার বাইরে প্রহরীর গলা, মহারাজ, ময়ূরপঙ্খি প্রস্তুত

তিনি ধীরে ধীরে দরোজার বাইরে পা রাখলেন কী আশ্চর্য, এতক্ষণ স্ত্রীর কারণে তার মনে যেটুকু অবসাদ জমে উঠেছিল, বাইরে পা দেয়ার সাথে সাথে তা মিলিয়ে গেল! শীতের সকালে সোনাঝরা রোদ! চনমনে হাওয়া মাঘের শেষে হাওয়ায় বসন্তের আগাম বার্তা যেন খুব সংগোপনে ছড়িয়ে পড়ছে আহ! এখন মনটা কী ঝরঝরে, ফুরফুরে লাগছে তার! মনে হয়, বহুদিন পর তিনি মুক্ত আলো-বাতাসে পা রাখলেন, শ^াস-প্রশ^াস নিলেন তার এখন অবাধে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করছে, অসীম আকাশে উড়ে বেড়াতে ইচ্ছে করছে মনে হচ্ছে, এই তো আকাশটা ইচ্ছে করলেই হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যায় চারপাশের গাছপালা, প্রকৃতি কী শান্ত! প্রহরীদের চোখে-মুখেও লেগে আছে মায়া আনন্দের গহন সুর যেন গোপনে ছড়িয়ে পড়ছে তার ভেতরে খেলে যাচ্ছে অদ্ভুত আনন্দের ঢেউ ফাতেমার করুণ মুখ তার মনে পড়লো অহেতুক আশঙ্কা তার! এমন একটা অনুভবময় সুন্দর দিন তার নষ্ট করা উচিত নয় সময়টাকে পুরোপুরি উপভোগ্য করে তুলতে হবে

হুঁশিয়ার! বাংলার স্বাধীন জমিদার, মহামান্য শের আলী গাজী আসছেন

ঘাটে অপেক্ষা করছে ময়ূরপঙ্খি নাও; অপরূপ রঙে সেজে একটা বিশাল ময়ূর যেন জলে পা ডুবিয়ে একমাত্র তার অপেক্ষায় নায়েব, গোমস্তাদের নিয়ে তিনি ময়ূরপঙ্খিতে উঠলেন ছইয়ের ভেতরে গিয়ে পালঙ্কে বসে পড়লেন একা ছইয়ের বাইরে নায়েব, গোমস্তা নায়ের আগে-পিছে বন্দুক ও তলোয়ার নিয়ে পাহারায় প্রহরীগণ প্রহরীদের প্রধান নিয়ামত আলী শূন্যে গুলি ছুঁড়লেন গুলির শব্দে চারদিক কেঁপে কেঁপে উঠল কয়েকটি কাক কা কা করে উড়ে গেল দূরে মাঝিরা নাও ছেড়ে দিলো আগা নায়ে দু পাশে ছয়টি করে মোট বারোটি দাঁড় তালে তালে জলে ডুবছে, উপরে উঠছে মাঝিদের কারো বয়সই ত্রিশ পেরোয়নি সবারই স্বাস্থ্য সুঠাম এমনকি পেছনে হাল ধরেছে যে, দাঁড়িদের চেয়ে তার বয়স একটু বেশি হলেও এখনো ত্রিশ পার করেনি সেও ময়ূরপঙ্খি চালনায় তারা সবাই খুব দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রত্যেকেরই বার তেরো বছর দাঁড়টানা ও হালধরার অভিজ্ঞতা রয়েছে

শীতকালেও মৃগীর স্রোত একেবারে কম নয় উজানে নৌকা ঠেলতে গেলে কলকল, খলবল শব্দ হয় জলে মাস্তুলে পাল বেঁধে গুটিয়ে রাখা হয়েছে বাতাসের বেগ বাড়লেই বাঁধন খুলে দেওয়া হবে দাঁড়ের জোরে উজান ঠেলে সামনের দিকে ভালোই এগিয়ে যাচ্ছে নাও মৃগীর জলও বেশ স্বচ্ছ নিরাকজলে তাকালে নিজের চেহারা ভেসে ওঠে

দুজন চাকর শের আলী গাজীর পালঙ্কের পাশে দাঁড়িয়ে তারা সার্বক্ষণিক তার সেবায় নিয়োজিত জমিদারের ইশারায় ইতোমধ্যেই তারা খুলে দিয়েছে ময়ূরপঙ্খির দুদিকের দুটি বড়ো জানালা পালঙ্কের নরম আসনে বসে নদীর দু পাড়ের দৃশ্য ভালোই দেখা যায় দেখা যায় টুকরো আকাশও তারপরও শের আলী গাজীর ভালো লাগছে না কেমন যেন বন্দি বন্দি লাগছে নিজেকে তার মন তো আজ পাখি সে আজ উড়তে চায়, ঘুরতে চায় আকাশের সীমানায় সোনার খাঁচায় পাখির কি ভালো লাগে! তিনি পালঙ্ক থেকে নেমে নৌকার সামনে গেলেন নায়েব, গোমস্তাদের হুকুম দিলেন ছৈয়ের ভেতরে গিয়ে নিজেদের কক্ষে বসার জন্য তারা ভেতরে চলে গেল শের আলী গাজী বসে পড়লেন তার জন্য পাতা রাজকীয় আসনে আজকের দিনের প্রকৃতির তাবৎ সৌন্দর্য তিনি একাই উপভোগ করতে চান, আপন খেয়ালে! তিনি তাকিয়ে থাকেন মৃগী নদীর জলের দিকে নদীতে ভেসে যাচ্ছে কিছু কিছু কচুরিপানা সেদিকে তাকিয়ে তিনি মনে মনে হাসলেন, ভাবসাগরে লোহাও ভাসে আর এ তো কচুরিপানা!

নদীর দুপাড়ে মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে ঘাট পোলাপান লাফঝাপ দেয় জলে কৃষকরা তাদের গরুগুলো গোসল করায় বউ-ঝিরা মাঝে মাঝে আসে জল নিতে ঘোমটার আড়াল থেকে তারা ময়ূরপঙ্খি দেখে এত সুন্দর নাও! কার গো এই নাও! আমাগো জমিদারের! নাওয়ের ওপর থেকে সহজে চোখ সরানো যায় না! শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে তারপরও তারা তাড়াতাড়ি জল ভরে কলসি কাঙ্খে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় জমিদার তাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে কাছেধারে কোথাও ভিড়বে নাকি ময়ূরপঙ্খি! একটু আগে যেসব পোলাপান জলে দৌড়ঝাপ করছিল, তারাও বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ময়ূরপঙ্খির দিকে কৃষকরা গোসল ভুলে তাকিয়ে থাকে ময়ূলপঙ্খির দিকে কেউ কেউ ফিসফিসিয়ে জানতে চায়, কোথায় ভিড়বে এই নাও? কানুনগো অফিস? নাকি নদী ভ্রমণে বেরিয়েছেন জমিদার সাহেব? নাকি সামনে নৌকা থামিয়ে ঢুকে পড়বেন জঙ্গলে হরিণ কিংবা বাঘ শিকারে? সবাই মাথা উঁচু করে তাকাতে চায় ময়ূলপঙ্খির দিকে কিন্তু বরকন্দাজগুলো যেভাবে বন্দুক তাক করে আছে! একটু হেরফের হলে কখন আবার গুলি ছুঁড়ে দেয় আর পাইকপেয়াদাগুলোও লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে দেখলেই ডর লাগে যদিও সেরকম কোনো সম্ভাবনা নেই তারপর তারা কেউই ডরে ভালো করে চোখ তুলে তাকায় না ময়ূরপঙ্খির দিকে ঘাটের সবচেয়ে নির্বোধ লোকটিও মাথা নিচু করে থাকে জমিদার বলে কথা! কখন কী মতিগতি হয় কে জানে! সে নিজের গোসল সারে কিংবা গোরু ঝাপানোর দিকে মনোযোগ দেয়

উত্তর থেকে রাশি রাশি জল নিয়ে আসে মৃগী এ জলই নদীর প্রাণ! কী কলকল বেগে বয়ে চলে দিনরাত ভাটির দেশে! কত নাও বাণিজ্যের পসরা নিয়ে যাওয়া-আসা করে উজানে-ভাটিতে, কখনো দাঁড় বেয়ে, কখনো পাল তুলে মাঝিদের কলরব, গানের সুর, জলের কল্লোলের সাথে মিশে যায় হাওয়ায় হাওয়ায়, দূর দূরান্তে ময়ূরপঙ্খির পালে লেগেছে দুরন্ত হাওয়া কলকল করে এগিয়ে যাচ্ছে সে নদীর পাড় থেকে খানিকটা দূরে বিশাল একটা বটবৃক্ষ, ডালপালা, শেকড়বাকড় ছড়িয়ে কত বছর যাবৎ দাঁড়িয়ে, কেউ জানে না জিজ্ঞেস করলে বলে, আমার বাবা, তার বাবা, তার বাবার বাবাও নাকি এমনি দেখেছে এই বৃক্ষ বছর বছর শেকড়বাকড় গেড়ে, আশপাশের জায়গা-জমিন আরও দখল করে সদম্ভে দাঁড়িয়ে আছেন এ প্রাচীন বৃক্ষ তার ঘন নিবিড় শীতল ছায়ায় মাটিতে বসে, একটি গুড়িতে হেলান দিয়ে, মনপ্রাণ ডুবিয়ে বাঁশিতে সুর দিয়েছে এক রাখাল কয়েকটি গোরু চড়ে বেড়াচ্ছে কাছেধারে বাঁশির জাদুময় সুরে তারাও এখন তাকিয়ে আছে রাখালের দিকে বাঁশির বিরহসুরে শের আলী গাজীর মন মুহূর্তে উদাস যত দূরে সরে যাবেন, এ বাঁশির সুরও হারিয়ে যাবে তার চেয়ে বরং ময়ুরপঙ্খি কিছুক্ষণের জন্য তীরে ভেড়ালে কেমন হয়! কিন্তু পালে যেভাবে হাওয়া লেগেছে, তা দেখে আর ইচ্ছে হলো না তীরে ভিড়িয়ে কিছুক্ষণের জন্য যাত্রাবিরতি করতে ময়ূরপঙ্খি এগিয়ে যাচ্ছে বাঁশির সুর বিষণ্নতা ছড়িয়ে তাকে মোহগ্রস্ত করে আস্তে আস্তে দূরবর্তী হচ্ছে শের আলী গাজী ভাবলেন, আমরা বেদনা চাই না কিন্তু কখনো কখনো বেদনাই আমাদের মনে অদ্ভুত আনন্দ সৃষ্টি করে ভাসিয়ে নিয়ে যায় দূরে কোথাও এই বংশীবাদকের খোঁজখবর নিতে হবে তাকে চাকরি দিয়ে নিয়ে যেতে হবে রাজধানী গড়জরিপায় মাঝে মাঝে সে তাকে শোনাবে বাঁশির মায়াবী সুর

বাতাস যে কখন পড়ে গেছে তিনি খেয়ালই করেননি জলে ঝপাত ঝপাত উঠানামা করছে অনেকগুলো দাঁড় উজান ঠেলে নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে শীতকালে রোদের আহামরি তেজ না থাকলেও দাঁড় বাইতে বাইতে মাঝিরা ঘেমে উঠছে সকাল থেকে ওরা কিছুই মুখে দেওয়ার সুযোগ পায়নি না খেয়ে আর কতক্ষণ বাইতে পারবে দাঁড়! তাছাড়া তার নিজেরও তো ক্ষুধা লেগেছে ওই তো দর্শা গ্রাম তারপরেই কানুনগো অফিস অফিস প্রধান রমাবল্লভ নন্দী বয়সে তরুণ, সুদর্শন চেহারা কানুনগো পদে নতুন নিয়োগ পেয়েছে ভূমিকর নির্ধারণ ও আদায়, জমির মূল্য নির্ধারণ, জমি কেনাবেচা, বন্দকী বা বিনামূল্যে দেয়া উপহারের ফলাফল লিপিবদ্ধ করা, বার্ষিক উৎপাদিত শস্যের হিসাবনিকাশ ইত্যাদি তথ্য ভিন্ন ভিন্ন রেজিস্ট্রারে সংরক্ষণ করে, হালনাগাদ তথ্য ও আদায়কৃত ভূমিকর কেন্দ্রে প্রদান করাই তার কাজ শের আলী গাজী এ পর্যন্ত কোনো কানুনগোকে তোয়াক্কা করেননি তার অধিকৃত ভূমির করও তিনি কেন্দ্রে প্রদান করেন না অনেক বছর কোনো কানুনগো তার কাছে ভূমির কর চাইতেও সাহস পায় না তারা তার ক্ষমতা ও প্রভাবপ্রতিপত্তি সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল কেন্দ্রশাসকগণও শের আলী গাজীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাগ্রহণ করেন না জমিদারি পরিচালনায় তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীন

ওই তো দর্শাগ্রামের ঘাট দেখা যাচ্ছে কয়েকজন ছেলেমেয়ে খেলাধুলা করছিল এখন নৌকার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘাটে আর লোকজন নেই শের আলী গাজী বললেন, এই ঘাটে ময়ূরপঙ্খি ভিড়াও খেয়েদেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নাও তারপর আবার শুরু করবে যাত্রা

ঘাটের দিকে নৌকা আসতে দেখেই ছেলেমেয়েগুলো বাড়ির দিকে দৌড় দিলো আস্তে আস্তে ঘাটে ভিড়ানো হলো ময়ূরপঙ্খি পাচকরা খাবার গরম করে রেখেছিল খাসির মাংস, কাশ্মিরী নান শের আলী গাজী কামরায় গিয়ে যৎসামান্য মুখে তুলে বেরিয়ে এলেন এখন নৌকায় বসে থাকতে তার আর ভালো লাগছে না তীরে উঠে নদীর পাড় ধরে উজানে কিংবা ভাটির দিকে গিয়ে কিছুক্ষণ হেঁটে আসা যায় কিংবা হালট ধরে হাঁটতে হাঁটতে আশপাশের ফসলের ক্ষেত, সবুজ ঝোপঝাড়, বুনোফুলের গন্ধ শুকে শুকে কিছুদূর হেঁটে আসা যায় গ্রামের দিক থেকেও এই ফাঁকে মাঝি ও কর্মচারীগণ ভোজনপর্ব শেষ করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করুক তিনি তাকিয়ে দেখলেন ময়ূরপঙ্খি থেকে ঘাটে নামানো আছে গজারি কাঠের সিঁড়ি সেদিকে পা বাড়াতেই দুজন বরকন্দাজ ও দুজন লেঠেল ছুটে এলো তার সঙ্গে যেতে তিনি বাম হাত তুলে তাদের নিষেধ করে দিলেন তারা বিরস মনে তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শের আলী গাজী আস্তে আস্তে নিচে নেমে উঠে গেলেন পাড়ে আদিগন্ত বিস্তৃত মাঠ আশপাশের ঝোপঝাড়ে শীতে জবুথবু ও বিবর্ণ ডালপালা ও লতাপাতায় নতুন কুঁড়ি বসন্তের আভাস দিচ্ছে অনতিদূরে দর্শা গ্রাম, বেশ বড়ো এবং লম্বা উত্তর দিকে কানুনগো অফিস আম-জাম-কাঁঠালসহ আরও নানাজাতের গাছের নিবিড় ছায়া ও সবুজে আচ্ছাদিত এ গ্রাম মাঝে মাঝে তাল-নারকেল-সুপারি-দেবদারু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে অল্প দূরে মৃগী নদীর কূল ঘেঁষে বেশ খানিকটা জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে আছে ঘন কাশবন শাদা শাদা কাশফুল সগৌরবে মাথা উঁচু করে ফুটে আছে খসে পড়া পাপড়ি বাতাসে তুলোর মতো উড়ে যাচ্ছে শের আলী গাজী ঠিক করে ফেললেন, ভাটিতে নয়, তিনি হেঁটে যাবেন উজানে ওই কাশবনের দিকে তারপরই তো দর্শা গ্রাম

মিষ্টি রোদের মধ্যে দিয়ে তিনি হেঁটে চললেন ময়ূরপঙ্খি থেকে পেয়াদা ও বরকন্দাজ এবং লেঠেল বাহিনী হায় হায় করে উঠল, ওই বনে যদি হিংস্র কোনো প্রাণী থাকে! শের আলী গাজীকে নিরাপত্তা দিতে তারা ব্যাকূল, কিন্তু ওদিকে যাওয়া তো নিষেধ যদিও জমিদার সাহেবের কোমরে তরবারির খাপে ঐতিহ্যবাহী চকচকে তরবারি আছে একটি কোপে যে কোনো মানুষ কিংবা হিংস্র প্রাণীর গর্দান মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারবেন, তারপরও তার শাস্ত্রী বাহিনী কান উৎকর্ণ হয়ে নৌকায় দাঁড়িয়ে চোখ রাখছেন তার ওপর সামান্যতম দুর্ঘটনার আভাস পেলেই তারা লাঠিশোঠা, বন্দুক ও তরবারি নিয়ে ছুটে যাবেন মনিবকে রক্ষা করতে তারা ভালো করেই জরিপ করে দেখলো, কাশবন বেশি দূর বিস্তৃত নয়, ওপাশে আবার ফাঁকা মাঠ

শের আলী গাজী মনে করেছিলেন কাশবনে ঢুকতেই পারবেন না কিন্তু ঘন হলেও নদীর পাড় ঘেঁষে উজান ঠেলে এগিয়ে গেছে পায়েচলা সরু রাস্তা আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার পর তিনি আশ্চর্য হলেন দর্শা গ্রাম থেকে আরেকটি প্রশস্ত রাস্তা এই কাশবনের ভেতর দিয়ে নদীতে নেমে গেছে তার মানে এখানে আরেকটি ঘাট! দর্শা গ্রামে হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই বাস তাহলে মেয়েদের আব্রুর কথা ভেবেই কি এই রাস্তা! তিনি এক পলকে দেখলেন রাস্তাটি বেশ নির্জন ঘাটে নদীতে পা ডুবিয়ে কলসে জল ভরছে একটি সুন্দরী মেয়ে তার পরনে লাল শাড়ি কপালে টিপ শের আলী গাজী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সুন্দরীর জল ভরা দেখলেন মনে মনে তিনি বললেন:

‘জল ভরো সুন্দরী কইন্যা জলে দিছো ঢেউ

হাসিমুখে কও না কথা সঙ্গে নাই মোর কেউ

মনে মনে হাসলেন তিনি জল ভরা শেষে একটি ঝাঁকি দিয়ে কলস কাখে নিয়ে সে আনমনে ধীরে ধীরে ঘাটের ঢাল বেয়ে উঠে আসতে লাগলো ওপরে; সাপের ফণার মতো পেছনে বেণী করা চুল দুলিয়ে দুলিয়ে তার চেহারা গোলগাল, কাঁচা হলুদবর্ণ গা অদ্ভুত মায়াবী দুটো চোখ এত সুন্দরী মেয়ে এই দর্শা গ্রামে! তাকে তো এখানে নয়, রাজপুরীতে মানায় তিনি কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছেন না

সুন্দরী আসছিল নিচের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ সামনে রাজকীয় বেশভূষায় দীপ্তমান সুদর্শন পুরুষ দেখে সে ভীত ও চমকিত নির্জন রাস্তাটি ধরে গ্রামের দিকে তাকিয়ে সে আরও হতাশ হলো কোথাও কেউ নেই ভয়ে তাঁর বুকটা ধক করে উঠল এ কি স্বপ্ন না কি বাস্তব! সে কিছুতেই মেলাতে পারছে না আবার এই সুদর্শন পুরুষের থেকে সে চোখও অন্যদিকে ফেরাতে পারছে না অস্পষ্ট কণ্ঠে সে বলল, আপনি! এখানে কী করছেন?

শের আলী গাজীর বুকও কেন এত ধড়ফড় করছে! তিনি তো বংশপরম্পরায় বীর পুরুষ জমিদারি রক্ত তার শিরা-উপশিরায় বহমান তারপরও এই সুন্দরীর সামনে কথা বলতে তার কণ্ঠও কেন জড়িয়ে যাচ্ছে! নিজেকে কিছুটা সংযত করে ঠোঁটের কোণে সরুরেখার হাসি ফুটিয়ে তিনি বললেন, আমি শের আলী গাজী

আপনিই শের আলী গাজী!

সুন্দরী আরও অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে

হ্যাঁ, আমিই কেন বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার?

মেয়েটি কোনো কথা বলল না মাথা নিচু করে আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়াবে, না কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে বুঝতে পারছিল না কাখের কলসটি আজ হঠাৎ এত ভারি মনে হচ্ছে কেন? কলসটি সে বাম কাখ থেকে ডান কাখে নেবে কি না ভাবছিল ভাবতে ভাবতে সে পা বাড়ালো বাড়ির দিকে শের আলী গাজীর আরেকটু কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ তার কাখ থেকে জলের কলস মাটিতে পড়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল শুধু কান্দাটি অক্ষত শের আলী গাজী বললেন, কলস যে ভেঙে গেল সুন্দরী

মেয়েটি কিছু বলল না লজ্জায় তার চোখ-মুখ রাঙা হয়ে উঠছে ভাঙা কলসের কান্দার দিকে তাকিয়ে গাজী ভাবলেন, ইশ, শ্রীকৃষ্ণের মতো অলৌকিক ক্ষমতা যদি তার থাকতো, তাহলে এ কান্দাটিই ফুলের মালা করে তার গলায় পরিয়ে দেয়া যেত তাকে কিছুটা ভীত দেখে তিনি অভয় দিলেন, কোনো ভয় নেই নাম কী তোমার?

সুন্দরী কম্পিতকণ্ঠে বলল, পদ্মগন্ধা

পদ্মগন্ধা! বাহ সুন্দর নাম! ঠিক যেন দেবী!

পদ্মগন্ধার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল কিঞ্চিৎ হাসি

আমি এখন যাই

শের আলী গাজী বলতে চাইলেন, যেও না, আরও কিছুক্ষণ থাকো কিন্তু বলতে পারলেন না হঠাৎ তার পাশ দিয়ে গ্রামের দিকে দৌড় দিলো পদ্মগন্ধা এমনটি যে ঘটবে তিনি তা ভাবতেই পারেননি বিস্মিত হয়ে পদ্মগন্ধার ছুটে যাওয়া দেখতে লাগলেন, যতক্ষণ না সে গ্রামের ভেতর ঢুকে পড়লো তার ঠোঁটের কোণে জমে উঠল উল্লসিত হাসির রেখা

কী রূপ হেরিলাম

একটি মায়াবী রূপের জালের মধ্যে যেন শের আলী গাজী আটকা পড়ে গেছেন বারবার চেষ্টা করার পরও সেখান থেকে কিছুতেই বের হয়ে আসতে পারছেন না যেদিকে পা বাড়ান শুধু সুন্দরের ফাঁদ, মৃত্যুর ফাঁদ তাহলে এই ফাঁদে তিলে তিলে মরে যাওয়াই কি তার নিয়তি! তা না হলে কেন তিনি ভুলতে পারছেন না পদ্মগন্ধাকে? সেই ভীত কম্পমান ডাগর ডাগর চোখ, বাঁশির মতো নাক, কমলার কোয়ার মতো ঠোঁট, চাঁপাকলির মতো আঙুল, পিঠের ওপর দীঘল কালো ঢেউ খেলানো বেণী, গোলাকার মুখের গঠন, ক্ষীণকটি, আলতা রাঙানো চরণ যুগল, সব মিলিয়ে অপূর্ব দেহবল্লরী, দেবী সরস্বতী যেন সেদিন স্বয়ং স্বর্গ থেকে নেমে এসেছিল তার সামনে তারপর খুবই সংগোপনে তার দেহে-মনে-প্রাণে অলৌকিক বীণার ঝঙ্কার বাজিয়ে চলে গেছে এখনো সেই সুর কিছুতেই থামছে না শয়নে-স্বপনে-জাগরণে তিনি দেখতে পান সেই দেবীর মুখ স্বর্গ ছেড়ে মর্ত্যে সেদিন কেন এসেছিল সে? আর এসেছিল যদি, কেন সে তার সামনে পড়ে গেল! এখনো নিচের দিকে তাকালে তার চোখে পড়ে ভাঙা জলের কলস কত যুগ, কত কাল অপেক্ষার পর তৃষিত মাটি শুষে নিয়েছিল জল টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া কলসের চাড়ার ওপর অক্ষত কান্দা আহ ‘তুই যদি হইতে গলের মালা’! তারপর স্মিত হাসি দিয়ে দেবীর অন্তর্ধ্যান

জমিদারি কাজে তিনি মন বসাতে পারছেন না মন বসাতে পারছেন না সংসারেও চাকরবাকর আড়ালে-আবডালে কানাঘুষা করে, কী হয়েছে আমাদের জমিদার সাহেবের? কেন তিনি অমন অমনোযোগী, মনমরা হয়ে থাকেন? এমন তো কোনোদিন দেখি নাই জমিদারির কোথাও তো কোনো সমস্যার আভাস পাই নাই তাহলে? তাদের পাশ থেকে কেউ ফিসফিস করে বলে, সমস্যা শুধু জমিদারিতেই থাকে? আর কোথাও থাকে না বুঝি! এ জগৎসংসারে কখন কার কোথা থেকে যে অন্তর্গত বিষাদের সুর বেজে ওঠে, কে জানে! কেউ মনের কথা খুলে না বললে তা আমাদের বোধগম্যতার অতীতই থেকে যায়

ফাতেমা বিবি তসবির দানা টিপতে টিপতে তার দিকে তীক্ষè নজর হেনে বলেন, আপনার ভেতরে আপনাকে তো আমি খুঁজে পাই না গাজী সেদিন কানুনগো অফিস থেকে ফিরে আসার পর থেকেই আপনি কেমন যেন আনমনা হয়ে থাকেন আপনার চোখে-মুখে বিষণ্নতা, যখনই তাকাই অপার শূন্যতা, কোথায় কী হারিয়ে এলেন আপনি, বলবেন আমাকে?

বেদনার ওপর হাসির প্রলেপ ছড়িয়ে দিলেই কি তা ঢেকে রাখা যায়! তবু শের আলী গাজী চেষ্টা করেন ফাতেমাকে বলেন, তুমি তো জানো, মাঝে মাঝে আমার মন অকারণেই ভার হয়ে যায়

ফাতেমা বিবি কিছুটা শ্লেষের হাসি ছড়িয়ে বলেন, অকারণে কিছুই হয় না কোথাও

ধরা পড়েও শের আলী গাজী ধরা দিতে চান না মুঠোর ফাঁক দিয়ে চড়ুই পাখির মতো ফুড়ুত করে বেরিয়ে যেতে চান এই অন্দরমহল থেকে, এই গড়জরিপা থেকে অনেক দূরে, লোকচক্ষুর আড়ালে তিনি বলেন, আসলে আমি জানি না কেন এমন হয় তুমি তো জানো বিবি আমি শায়ের খুব পছন্দ করি আমার ভেতর কথা বলে ওঠেন হাফিজ, ওমর খৈয়াম, কবীর, গালিব, মিয়া তানসেন তারাই আমাকে উদাস বানিয়ে ফেলেন কিছুই আমার ভালো লাগে না মন চায়, এই জমিদারি ছেড়ে, এই সংসার ছেড়ে চলে যাই দূরে কোথাও তাদের মতো আমিও শায়ের লিখে জীবনটা কাটিয়ে দেই খৈয়াম কী বলেছেন, শোনো:

‘তুঙ্গি ময় লাল খোহাম ওয়া দিওয়ানি

সদ্দ রুমকী বায়েদ ওয়া নিফসে নাজী

ওয়াজ গাছ মান ওয়াতু নিশফতে দর ওয়ারাজি

খোশতুর বুদ আম সামলাকাতই সুলতানী’

আহা! আমি যদি পারতাম, এই জমিদারি ছেড়ে, অল্প কিছু আহার আর সুরা নিয়ে বনের তরুতলে সারাজীবন শায়ের লিখে কাটিয়ে দিতে! খৈয়ামের মতো এমন একটি শায়ের যদি লিখতে পারতাম! কিন্তু আমি নিরিবিলি বসে দেখেছি, তালপাতা নিয়ে কোনো ফল ফলে না ভাব আমার মনে বাতাসের মতো আসা-যাওয়া করে কিন্তু এমন আবেগ নিয়ে, শিল্পের এমন সত্তা নিয়ে কিছুতেই ধরা দেয় না বাক্যে তাই আমি খুব হতাশ...

ফাতেমা বিবি বলেন, এটাই কি আপনার আসল কথা? নাকি আরও কিছু আছে? কী হয়েছে আপনার খুলে বলুন আপনাকে আজ সত্যি খুব অন্যরকম লাগছে এ আমার দেখা শের আলী গাজী নয় আমার মনে হচ্ছে তাকে আমি হারিয়ে ফেলেছি যা আশঙ্কা করেছিলাম, তাই কি ঘটতে যাচ্ছে! হায় খোদা!

শের আলী গাজী বলেন, বিবি, অযথা দুশ্চিন্তা করো না আমার মন উতলা ঠিকই, তবে অন্য কোনো কারণে নয় শুধু শায়েরের ভাব আমাকে তন্ময় করে রেখেছে কদিন হয়তো এমন যাবে তারপর আবার ঠিক হয়ে যাবে, সবকিছু আগের মতো হবে যদিও যে জীবন আমরা যাপন করি, তা আসলে প্রকৃত জীবন নয়

তাহলে প্রকৃত জীবন কী?

সব বন্ধন ছিন্ন করে মুক্ত জীবনযাপন করা চারপাশের প্রকৃতির মতো

মানুষ তো কখনো বন্ধন মুক্ত হতে পারে না বেঁচে থাকতে হলে তাকে কোনো না কোনো বন্ধনে জড়িয়ে পড়তে হয়

শের আলী গাজী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তারপর বললেন, আসলে এই বিত্তবৈভব, ক্ষমতা, জমিদারি আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে আমার ভালো লাগে না আমি হাঁপিয়ে উঠছি হাফিজ কিংবা খৈয়ামের মতো যদি হতে পারতাম!

সে জীবনেও বড়ো ত্যাগ আছে, সাধনা আছে তাছাড়া আল্লাহপাক সবাইকে সব ধরনের প্রতিভা দেন না শায়ের চর্চা করলে তো আপনি এখানে বসেই করতে পারেন আপনাকে নিষেধ করেছে কেউ?

না তা কেউ করেনি তবে...

আমার মনে হয়, আপনার কয়েকদিন বিশ্রামে থাকা দরকার কিংবা কোনো কাজের মধ্যে ডুবে থাকা দরকার, যা আপনি পছন্দ করেন

শের আলী গাজী মৃদু হাসলেন হ্যাঁ, যা আমি পছন্দ করি সেই কাজ! প্রকৃত জীবনে ফিরে যাওয়া কি আমার পক্ষে আর আদৌ সম্ভব বলো? এই সংসার, এই জমিদারি, প্রভাব-প্রতিপত্তির মোহ তো ত্যাগ করা সম্ভব নয়

ফাতেমা বিবি বলেন, জানি না তবে তাই যেন হয়

অন্দরমহল ছেড়ে শের আলী গাজী আবারও বাগানে গোলাপের রঙ কিছুটা অনুজ্জ্বল হয়ে গেলেও এখনো ঢের সতেজ বিষণ্ন-করুণ এক চিলতে হাসির রেখা তার ঠোঁটে গোলাপ নিয়ে সম্রাট বাবরের শায়ের তার মনে পড়ে গেল:

‘লালে লাল গোলাপের কুঁড়ির মতো

আমার হৃদয়,

আগুনের ভাঁজে ভাঁজে মোড়া;

হাজারো বসন্তের হাওয়া কি পারবে

কোনোদিন

হৃদয়ের সে কুঁড়িকে

ফুটিয়ে দিতে গোলাপে?’

শের আলী গাজী ভাবলেন, বাবরের চোখে রাজ্যজয়ের স্বপ্নের আগুন থাকলেও গোলাপও তার হৃদয়ে প্রেমের বীজ বুনে দিয়েছিল ভারতবর্ষ দখল করে বিপুল বিত্তের মালিক হলেও তার মনে শান্তি ছিল না হয়তো গোলাপের জন্য তার মন হাহাকার করে উঠেছিল এদেশে বনবাদাড়ে ফুটে থাকে ফুল! কোথাও বাগান নেই তাই কাবুলের পর আগ্রায় গড়ে তুললেন বাগান সেখানেই পুঁতে দিলেন গোলাপের চারা! ভারতের মাটিতে প্রথম গোলাপ ফোটার পর বসন্তের হাওয়া কি পারেনি তার হৃদয়ের আগুন নিভিয়ে দিতে? একটু প্রশান্তি দিতে? শের আলী গাজীর শরীরেও বীরের রক্ত জমিদার ফজল গাজীর বংশধর সে বাংলার বার ভুঁইয়ার একজন ছিলেন তিনি কাউকে পরোয়া করতেন না তার এতই স্বাধীনচেতা শের আলী গাজী অথচ বাবরের মতো গোলাপ ফোটানোর জন্য তিনিও তো কত উন্মুখ! সুদূর বসরাই থেকে চারা এনেছেন এই যে ডালে ডালে কী সুন্দর গোলাপ ফোটা শুরু করেছে গোলাপের রূপে তিনি মোহগ্রস্ত তারপরও তার ভেতরে কেন এই কষ্টের ঢেউ? চারপাশের কোনো কিছুই তার ভালো লাগছে না বৈরাগ্যভাব তার মনে উদয় হয়েছে নিজেকে কিছুতেই আড়ালে রাখতে পারছেন না তার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে উদাসীনতা বিষণ্নতা অস্থিরতা চিত্ত সদা চঞ্চল, ভ্রমরের মতো হে মাবুদ, স্থির কর, বাক্যে, কর্মে আমার সবকিছু কেন এত এলোমেলো হয়ে যায় আজকাল? গোলাপের দিকে তাকালে তার ভেতর থেকে সুঘ্রাণ নিয়ে যেন উঠে আসে এক নারী- পদ্মগন্ধা! হেসে বলে:

হৃদয়ে প্রেমের বীজ বপন করে দিয়েছো

এবার কুঁড়ি তো মেলবেই, বিরহের বৃক্ষ

আগুন ছড়াবে, তোমাকে পোড়াবে যে বিষাদ

তার জন্য খুলে রেখেছো কি বুক শের আলী?

তুমিও শায়ের জানো পদ্মগন্ধা! পদ্মগন্ধা এ কথার কোনো জবাব দেয় না গোলাপ ছুঁতে গিয়ে শের আলী গাজীর হাতের আঙুল কাঁটার খোঁচায় রক্তাক্ত যন্ত্রণায় তিনি আহ করে উঠলেন পদ্মগন্ধা কিছুটা ক্রুর হেসে বলল:

গোলাপবাগে ঢুকে শুধু গোলাপ কেনই-বা ছোঁবে?

কাঁটার দুঃখ নেবে না? গোলাপ তো এই কাঁটারই

অংশ গোলাপ হাতে নিলে কাঁটাও সঙ্গে যাবে

না না, আসলে আমি এমনভাবে গোলাপ ছুঁতে চাই কিংবা কাছে দাঁড়িয়ে তার সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাই যেন কাঁটার স্পর্শ না লাগে!

তাই বুঝি! চাঁদ দেখবে, চাঁদের কলঙ্ক দেখবে না! তাহলে কী দরকার চাঁদের দিকে চোখ দেওয়ার?

আরও ক্রুর হেসে পদ্মগন্ধার অন্তর্ধ্যান! কোথায় গেল সে! শের আলী গাজীর হাতে তিনটি পাতাসহ একটি টসটসে লাল গোলাপ তিনটি আঙুল রক্তাক্ত গোলাপ হাতে তিনি ফিরে গেলেন অন্দরমহলে ফাতেমা বিবি এগিয়ে এলেন কাছে শের আলী গাজী মৃদু হেসে বললেন, বাগানে গোলাপ ফুটেছে

জানি

একটি তুলে আনলাম

আমার জন্য বুঝি!

হুম

বাহ! কী সুন্দর ফুল! বাগানে প্রথম ফুটলো, তাই না? কিন্তু ও কী! আঙুল যে রক্তাক্ত! কীসে?

এ কিছু না, সামান্যই, কাঁটায়

কাঁটায়!

গোলাপ ছিঁড়তে গেলে কাঁটায় এমন রক্তাক্ত হতে হয়

মালীকে বললেই হতো

তাহলে গোলাপ তুলে আনার আনন্দ পাওয়া যেত?

কী যে কথা!

তুমি বুঝবে না

শের আলী আবারও ঘর ছেড়ে বাইরে ফাতেমা বিবি বিড়বিড় করেন, গাজী, আমি আপনাকে আসলেও বুঝতে পারি না এ কেমন মতিগতি পুরুষের! বারবার চেষ্টা করেও অন্তর স্পর্শ করা যায় না!

বাইরে গিয়ে শের আলী গাজী ভাবেন, নাহ, এই নারী তাকে স্থির থাকতে দেবে না না ঘরে, না বাইরে চোখ বুজে থাকলেও সে মনের ভেতর থেকে উঁকি দেয় ঘুমিয়ে থাকলে দেখা দেয় স্বপ্নে এই যে সন্ধ্যার গোধূলি ঢেকে রাত্রির আঁধার ধীরে ধীরে নৈঃশব্দ্য বুকে নিয়ে ডুবে যাচ্ছে নিবিড় মগ্নতায়, শের আলী গাজী ফুলবাগানের পাশের রাস্তা দিয়ে একবার হেঁটে যাচ্ছেন ও-প্রান্তে, আবার ফিরে আসছেন এ-প্রান্তে, এর মধ্যেও সামনে এসে দাঁড়ায় পদ্মগন্ধা! শের আলী গাজী তাকে উপেক্ষা করতে চানÑ না, এ সম্ভব নয় কিছুতেই সম্ভব নয়, আমি মুসলিম জমিদার তাছাড়া বিবাহিত আমার সমাজ আছে, সংসার আছে পদ্মগন্ধা হিন্দু ব্রাহ্মণের মেয়ে তারও ধর্ম আলাদা, সমাজ আলাদা দুইকে এক করার সহজ কোনো পথ খোলা নেই হতে পারে মারাত্মক সংঘাত, রক্তপাতÑ এমনকি এ সম্পর্ককে কেন্দ্র করে দাঙ্গা কিংবা তা না হলেও সমাজে তার ঢিঁ ঢিঁ পড়ে যাবে প্রজারা যে তাকে ঢের মান্যিগণ্যি করে তা আর করবে না চাকরবাকররা সরাসরি কিছু বলার সাহস পাবে না বটে কিন্তু আড়ালে আবডালে কানাঘুষা করবে দূর থেকে ছুঁড়ে দেবে তাচ্ছিল্যদৃষ্টি আর ফাতেমা বিবি তাকে গোচরে-অগোচরে সইতে পারবে না হয়তো মুখ বুজে মেনে নেবে সব কিন্তু রাতদিন নিশ্চয় মনে মনে অভিসম্পাত করবে একদিকে শান্তি, আরেকদিকে চরম অশান্তি তাছাড়া সুযোগ বুঝে তার শত্রুরাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে শেষমেশ কোথাও শান্তি থাকবে না সুখ থাকবে না তাহলে জেনেশুনে কেন এই সম্পর্কের বিষচক্রের জালে জড়িয়ে পড়া? এখান থেকে তার এখনই তো বেরিয়ে আসা উচিত কিন্তু তিনি বেরিয়ে আসতে চাইলেও কি পদ্মগন্ধা দেবে? সে তো তার চাওয়া, না-চাওয়ার কোনো তোয়াক্কা করে না যখন-তখন উদয় হয়, এই অন্ধকারে কী আলোতে চেতনে কিংবা অচেতনে, তার সমগ্র সত্তা দখল করে বসে আছে অদৃষ্টের কোন পাকচক্রে তিনি পড়ে গেলেন! এ কী বিধাতার কোনো খেলা? তা না হলে কেন সেদিন তিনি ময়ূরপঙ্খি দর্শা গ্রামের ঘাটে ভেড়ালেন? আর ভেড়ালেনই যদি, ময়ূরপঙ্খি থেকে নেমে কেন তিনি হেঁটে গেলেন উজানে, কাশবনের দিকে? আর গেলেনই যদি তার সাথে দেখা হলো কেন? আরেকটু পরে গেলেই তো হতো পদ্মগন্ধার সাথে তার দেখা হতো না বুকে এ বিষের শেল তার বিঁধতো না মাঝে মাঝে মন ভালো না থাকলে, না হয় তিনি ডুবে থাকতেন খৈয়াম, কবীর ও হাফিজের শায়েরে কিংবা মিয়া তানসেনের গজলে

না, সম্পর্কের জালে তিনি কোনোভাবেই জড়াবেন না জেনেশুনে প্যান্ডোরার বাক্স তিনি খুলতে চান না তবে আরেকবার কি দেখে আসা যায় না সেই মুখ? ব্যক্তিগত ভৃত্য মোকাদ্দেসকে তিনি পদ্মগন্ধার খোঁজখবর নিতে পাঠিয়েছিলেন সে খবর এনেছে, বসন্তরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের একমাত্র কন্যা পদ্মগন্ধা বসন্তরঞ্জনের জমিজমা আছে ভালোই মোটামুটি সচ্ছল গৃহস্থ তবে জমি চাষ তার মূল কাজ নয় এ কাজে অন্য লোক নিয়োজিত আছে তিনি নামকরা বৈদ্য দর্শা গ্রামে বৈদ্যবাড়ি সবাই চেনে শুধু দর্শা গ্রাম কেন, আশপাশে বা দূর দূরান্তে অনেক গ্রামে বৈদ্য হিসাবে তার বেশ নামডাক রয়েছে শের আলী গাজী নিজেও একাধিকবার তার নাম শুনেছেন কিন্তু কোনো প্রয়োজন হয়নি বলে এই প্রাসাদে কখনো তার ডাক পড়েনি এখানে রয়েছে হেকিম আলী আকবর সুদূর মুলতান থেকে এসেছেন এই গড়জরিপায় তারও বেশ নামডাক রয়েছে বসন্তরঞ্জনকে তিনি কখনো কোথাও দেখেছেন বলে মনে পড়ে না শের আলী গাজীর মোসাদ্দেক বলে, দর্শা গ্রামে ঢোকার পর প্রথম দুটি বাড়ির পরই বামদিকে বসন্তরঞ্জনের বাড়ি বা বৈদ্যবাড়ি এই বৈদ্যবাড়ির ঠিকানা তিনি কেন জোগাড় করলেন? আদৌ তিনি কি যেতে চান সেই গ্রামে? যেতে চাইলেই কি যাওয়া যায়? কীভাবে যাবেন তিনি? কোনো কারণ ছাড়া? মাত্র কয়েকদিন আগে তিনি ঘুরে এসেছেন সেখান থেকে এখন আবার ওইদিকে যাত্রা করলে ফাতেমা কী মনে করবে? তাছাড়া তার চাকরবাকর, কর্মচারীরাইবা কী ভাববে? আর পদ্মগন্ধার বাড়িতেই বা যাবেন কোন উছিলায়? অসুখের উছিলায় অবশ্য যাওয়া যায় কিন্তু তার তো কোনো অসুখ নেই মিথ্যা বলা হবে মিথ্যা বলতে তার অস্বস্তি লাগে তাছাড়া বৈদ্যবাড়িতে গেলেও বিপদ আছে শের আলী গাজী চিকিৎসা নিতে বৈদ্যবাড়ি গিয়েছিল, সংবাদটি মুহূর্তে চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে প্রাসাদে ফেরার সাথে সাথে ছুটে আসবে আলী আকবর বিনয়ের সাথে বলবে, মহারাজ, আপনার কি অসুখ? এই অধমের কী অপরাধ? কেন আমাকে একবারও জানালেন না কী পথ্য দিয়েছে বৈদ্য? দেখি দেখি আপনার রোগ ঠিকঠাক ধরতে পেরেছে তো? নাকি ভুলভাল পথ্য দিয়েছে

তখন কী বলবেন শের আলী গাজী? যদি তিনি বলেন, না, কোনো অসুখ হয়নি তার শরীরও ঠিক আছে শুধু বসন্তরঞ্জনকে দেখতে গিয়েছিলেন, কেমন বৈদ্য সে তাহলেও কি আলী আকবর মন খারাপ করবে না? বিন্দুমাত্র সন্দেহ করবে না তাকে? তাছাড়া আলী আকবরকে না হয় বোঝানো খুব সহজ হবে কিন্তু ফাতেমা বিবিকে তিনি কী বলবেন? অন্দরে ফিরলে সেও তো ছুটে আসবে চিন্তিত মুখে বলবে, শোনলাম আপনি বৈদ্য বাড়িতে গিয়েছিলেন? শরীর খারাপ? কী অসুখ? কিছুই তো বললেন না কী এমন অসুখ যে আলী আকবরের চিকিৎসায় ভালো হবে না বৈদ্যবাড়িতে যেতে হলো

তখন তিনি যদি বলেন, না ওদিকে এমনই গিয়েছিলাম বৈদ্য হিসাবে চারদিকে বসন্তরঞ্জনের খুব সুনাম তাই তার খোঁজ-খবর নিতে গিয়েছিলাম হয়তো তার কথা বিশ্বাস করবে ফাতেমা বিবি কিন্তু প্রকৃত সত্য আড়াল করাও তো একধরনের অপরাধ এই বোধ তাকে সব সময় পীড়ন করবে তাই একবার সিদ্ধান্ত নিলেন, যাবেন না কী দরকার, অহেতুক যন্ত্রণা বাড়ানোর? ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার? কিন্তু পদ্মগন্ধা তাকে চুম্বকের মতো টানছে তার মুখ যখন মনে পড়ে, ভাবনা সব এলোমেলো হয়ে যায় যেতে তাকে হবেই কিন্তু কীভাবে যাবেন? ছদ্মবেশে? নাকি জমিদার বেশে? ছদ্মবেশে গেলে ঝামেলা বেশি রাস্তাঘাটে অনেকে তাকে চিনে ফেলতে পারে চারদিকে হৈ চৈ পড়ে যাবে, জমিদার শের আলী গাজী ছদ্মবেশে বেরিয়েছেন সাবধান তখন বিড়ম্বনার অন্ত থাকবে না তার চেয়ে জমিদার বেশে গেলেই ভালো জমিদার হিসাবে, তার অধিভুক্ত এলাকায় যে কোনো সময়, যে কোনো কারণে কিংবা বিনা কারণে তিনি যেতে পারেন এতে লজ্জা বা সংকোচের কিছু নেই কাল ভোরেই কি শকট ছুটিয়ে দেবেন, দর্শা গ্রামের দিকে? ময়ূরপঙ্খির চেয়ে শকটই তো ভালো তাড়াতাড়ি গিয়ে ফিরে আসা যাবে তাছাড়া বেশি চাকরের যাবার দরকার নেই শুধু শকট চালক হলেই চলবে পারিষদবর্গ নিয়ে যাবার দরকার নেই তাছাড়া শকটে সে রকম স্থানসংকুলানও হবে না শকট চালককে আজ রাতেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে কাল বিহানেই রওয়ান দিতে হবে দর্শা গ্রামে ঘোড়াশালের দিকে হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হলো, না, শকটেরও দরকার নেই ঘোড়া নিয়ে তিনি একাই বেরিয়ে পড়বেন

জলছত্রের খোঁজে

ঘোড়াটির নাম হামজা অ্যারাবিয়ান প্রজাতির বছর খানেক আগে শের আলী গাজী সিরিয়া থেকে এনেছেন গায়ের রং ধূসর বাদামি মুখে সাদা ছোপ পায়ে মোজার মতো সাদা ছোপ হাড়ের গঠন ঘন ও শক্ত ঘাড় লম্বা ও বাঁকানো লেজ উঁচু ঘাড়ের ওপর কালো কেশর খুবই সহনশীল ও ক্ষিপ্রগতি

হামজা ছুটছে গ্রামের রাস্তা দিয়ে আশপাশের ঘরবাড়ি, গাছপালা, মানুষজন পেছনে ফেলে দর্শার কানুনগো অফিসের দিকে সে বেপরোয়া, অপ্রতিরোধ্য ছুটতে ছুটতে তিনি পৌঁছে গেলেন কানুনগো অফিসে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখলেন লোকজন কাজ করছে নিবিষ্ট মনে এখানে তিনি কী করবেন? কোনো কাজ তো নেই মনের খেয়ালে ছুটে এসেছে এখানে কানুনগো অফিসেও তিনি থামলেন না বরং সে এলাকা কয়েকটা চক্কর দিয়ে আবার ছুটে গেলেন দর্শা গ্রামের অপর প্রান্তে বসন্তরঞ্জনের বাড়ির দিকে ঘোড়ায় সওয়ার হলে তার শরীরের রক্ত টগবগ করে যেন ফুটতে থাকে কোনোকিছুই তিনি পরোয়া করেন না কোমরের খাপে ধারালো তরবারি মুঘলদের দুর্দান্ত কোনো যোদ্ধার মতো তাকে মনে হয়

সূর্য বেশ ওপরে উঠে গেছে বসন্তরঞ্জনের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই তার অভিব্যক্তিতে কেমন যেন একটা জড়তা ও ভয় ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে লাগলো মোসাদ্দেক যেমন বলেছিল, প্রথম দুটি বাড়ির পর, তৃতীয় বাড়ি, বৈদ্যবাড়ি নামেই সবাই চেনে ওই তো দেখা যাচ্ছে বাড়িটি আম-জাম, সুপারি-নারকেল আর দেবদারুর ছায়ায় ঢাকা

আঙিনায় গোয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন শের আলী গাজী গোরু শূন্য গোয়াল বাড়িতে কেউ আছেন? বেশ বিনয়ের সাথেই হাঁক দিলেন কেউ এগিয়ে এলে কী যে বলবেন! হ্যাঁ, তৃষ্ণার কথা এত পথ ছোটাছুটি করে যথার্থই তৃষ্ণার্ত তিনি কারো সাড়াশব্দ না পেয়ে আবার হাঁক দিলেন, একটু জল খাবো কেউ আছেন? এবারও কারো সাড়া নেই শের আলী গাজীর মনে হলো, বাড়িতে কেউ আছে, তবে সাড়া দিচ্ছে না তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন দাঁড়িয়ে থাকলে নিশ্চয় আসবে কিন্তু সে পদ্মগন্ধা তো!

আরেকটু অপেক্ষার পর দেখলেন, কলাবতীর মতো ঘোমটা টেনে বামহাতে বড়ো একটা কাসার থালায় নাড়ু আর মুড়ি নিয়ে, ডানহাতে কাসার জলের গ্লাস নিয়ে কেউ একজন এগিয়ে আসছে পদ্মগন্ধা তো! আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে তার মনে হলো, এ পদ্মগন্ধাই কিন্তু তারপরও মনে দ্বিধা ও ভয়, যদি সে না হয়! আরও কাছাকাছি আসতেই মাথার ঘোমটা অকস্মাৎ পড়ে গেলে দেখলেন এই সেই দেবী- পদ্মগন্ধা! আজ তার মাঝে আগের সেই দ্বিধা ও ভয় নেই আরেকটু কাছে এসে থেমে গেল পদ্মগন্ধা চোখে-মুখে স্মিত হাসি পথিক কি খুবই তৃষ্ণার্ত?

কী বলবেন শের আলী গাজী? তার কণ্ঠ কেন জড়িয়ে আসছে এভাবে! অনেক কষ্টে জড়তা চেপে তিনি জবাব দিলেন, যথার্থই সকাল থেকে অনেক পথ ছুটতে হয়েছে

নিন তৃষ্ণা মেটান আগে তারপর এ সামান্যই জল খাবার যদি আপনার পছন্দ হয়

কেন হবে না নাড়ু-মুড়ি তো আমার খুব পছন্দের খাবার

তাই! আমার কেন যেন মনে হতো আপনি আবার আসবেন এ গাঁয়ে

শের আলী গাজীর বুক ধড়ফড় করতে লাগলো তৃষ্ণায় গলা আরও শুকিয়ে আসতে লাগলো মনে মনে বললেন, তাহলে তুমিও আমার কথা ভেবেছিলে সুন্দরী! শের আলী গাজীর চোখে-মুখে আনন্দের ঢেউ পদ্মগন্ধার দিকে তিনি নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন হেসে বললেন, তাই বুঝি! এখন থেকে মাঝে মাঝে তো আসতেই হবে এ গাঁয়ে এলে তৃষ্ণা মেটানোর মতো জল পাবো তো?

নিশ্চয়

জলের গ্লাসটা নেওয়ার জন্য তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন পদ্মগন্ধাও গ্লাসটা এগিয়ে দিলেন কিন্তু কীভাবে কী যে হলো, শের আলী গাজী বুঝতে পারলেন না, গ্লাসটা হাত দিয়ে ধরতে না ধরতেই পড়ে গেল মাটিতে পদ্মগন্ধার দৃষ্টি বিষণ্ন হয়ে উঠল শের আলী গাজী হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন গ্লাসের দিকে মাটি শুষে নিচ্ছে জল পদ্মগন্ধা কম্পিত হাতে প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল, এটুকু মুখে দিন আমি আবার এনে দিচ্ছি জল তবে অনুরোধ জল খেয়েই আপনি চলে যাবেন আমার মা-বাবা কেউই বাড়িতে নেই

কোথায় গেছে তারা?

বাবা, দূরে কোথাও রোগী দেখতে গেছে মাও সঙ্গে গেছে

ওহ তাহলে তো বাড়িতে বসাও যাবে না

বাড়িতে আমি একলা পাড়াপড়শিরা যদি কিছু মনে করে বসে!

তাহলে আর দেরি করি না আজ তৃষ্ণা নিয়েই ফিরে যাই আরেকদিন এসে পান করবো জল সেদিন খুব সাবধানে থাকবো, হাত থেকে জলের ভরা গ্লাস যেন পড়ে না যায় মাটিতে

মা বলেন কী জানেন?

কী?

হাত থেকে কোনো কিছু পড়ে যাওয়া অমঙ্গল

তাই! কিন্তু এ সব আমি বিশ^াস করি না আমি আবার আসবো

মাটি থেকে জলের গ্লাস তুলে পদ্মগন্ধা পা বাড়ালো ঘরের দিকে শের আলী গাজী উঠোন থেকে উঠে এলেন সড়কে ঘোড়ায় চড়ে পদ্মগন্ধার ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, দূর থেকে এক জোড়া মায়াবী চোখ তাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে তীরের ফলার মতো চোখা সেই দৃষ্টি শের আলী গাজীর বুকের ভেতর বুঝি বিঁধে গেল গোলাপের বিষকাঁটা! হৃদয় ছিন্নভিন্ন হোক, রক্তাক্ত হোক, তবু এ দৃষ্টি গেঁথে থাক আমার পরাণের ভেতর! তার মনে পড়ে গেল কবীরের শায়ের :

‘নয়না অন্তর আও তু তিউহি ন্যায়ন ঝাপেউঁ

না হউ দেখুঁ আওর কু না তুঝে দেখন দেউ’

পদ্মগন্ধা, তুমি আমার চোখের ভেতর এসো এখন থেকে চোখ বুজে, শুধু তোমাকে ছাড়া আর কাউকে আমি দেখতে চাই না তৃষ্ণা ও হাহাকার নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন তিনি রাজধানী গড়জরিপার দিকে

কলঙ্কিনী কূলনাশা

বসন্তরঞ্জন ও কমলা দেবী ফিরে এলেন সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে বাড়িতে ঢোকার আগেই হালটে দেখা, পাশের বাড়ির গৌরী দেবীর সাথে বয়স তার ষাট পার হয়েছে বছর পাঁচেক আগে মারা গেছেন স্বামী আছেন দুই ছেলে-বউ ও নাতিদের সংসারে তার বড়ো ইচ্ছে, জীবনের শেষ দিনগুলো কাশিতে কাটিয়ে দেয়া কিন্তু তাকে সেখানে পাঠানোর মতো ছেলেদের অত পয়সা নেই তাই তাদের ওপর গৌরী দেবীর খুব রাগ বাড়িতে মাঝে মাঝে ছেলে-বউদের সাথে এটা ওটা নিয়ে সামান্য কথা কাটাকাটি বা মনোমালিন্য হয় মনে অশান্তি হলে তিনি গ্রামের এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরে বেড়ান বয়স হলেও দেহ ও মনে বল আছে ছেলেদের তিনি বলেন, তোরা যদি আমাকে কাশিতে না পাঠাস তো আমি একদিন নিজেই চলে যাবো হাঁটতে হাঁটতে দিল্লি যাওয়া যায় দেখি কোনো তীর্থযাত্রীর দল এই পথ দিয়ে যায় কি না

বাড়ির দুই বউ মনে মনে খুশি হলেও দুই ছেলে ও নাতিরা থাকে আতঙ্কে না জানি কোনদিন কোন তীর্থযাত্রী দলের সাথে যাওয়ার জন্য সে গোঁ ধরে!

সন্ধ্যা লগ্নে পাশের বাড়ি থেকে গৌরী দেবী ঘরে ফিরছিলেন কমলা দেবীকে দেখেই বললেন, ও মা, তোমরা তাইলে আজ বাড়ি ছিলে না? দু¹া, দু¹া!

কমলা দেবী চমকে উঠলেন, কেন, কী হয়েছে জেঠী?

হবে আর কী? অমন সোমত্ত মাইয়া মানুষ ঘরে একলা রাইখা যাওন কি ঠিক?

কমলা দেবী আরও উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন, আহা! কী হইছে খুলে বলেন তো জেঠী

হবে আর কী তোমাগো বাড়ি ম্লেচ্ছ জমিদার আইছিল

দু¹া, দু¹া! তারপর?

জল খাইয়া চইলা গেছে

কমলা দেবী হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন, ঘরে ঢুকে নাই তো?

না তবে না ঢুকলেই-বা কী? লোকে কচ্ছে, ওদিকে মুসলমান বাড়িঘর কি কম আছে এত বাড়িঘর থাকতে তোমাদের বাড়িতেই কেন ম্লেচ্ছ জমিদার জলের তালাশে?

ও আচ্ছা! এই কথা! ঠিক আছে জেঠী, আমরা দেখছি

বসন্তরঞ্জন বললেন, এ নিয়ে এত মাথা ঘামাঘামির কী আছে, জেঠী? সে যদি আপনার কাছে জল চাইতো, না দিয়ে পারতেন?

গৌরী দেবী একটু চুপ থেকে বললেন, না, পারতাম না সে তো জমিদার আমাগো মনিব তবে ম্লেচ্ছ জল চাইলে তো না করা যায় না

তাহলে এ সব বলছেন কেন?

আমার বলাবলিতে কী আসে যায় বসন্ত? লোকের মুখ আটকাবে কী করে?

লোকে যা খুশি বলুক!

কমলা দেবী বললেন, আগে ঘরে ঢুকি, তারপর

হালট থেকে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন তারা ঘরে ঢুকে দেখলেন, বিছানায় মেয়ে বসে আছে চুপচাপ কমলা দেবী রাগ ঝাড়লেন, সাঁঝবেলায় কেউ এই ভাবে বইয়া থাকে? ঘরে আলো দিবি না?

নিজেই আইলার আগুনে দেশলাই জে¦লে সলতে ধরিয়ে দেখলেন মেয়ের মুখ, ও মা! এ যে গম্ভীর! গলায় কিছুটা আদর টেনে বললেন, কী হয়েছে? মন খারাপ, না কি শরীর?

নাহ ভালো আছি

কমলা দেবীর গলায় এবার সেই আগের ঝাঝ, তাইলে এই ভাবে লেটুর দিয়া বইয়া আছোস ক্যান?

পদ্মগন্ধা উঠে, বাইরে গিয়ে চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে আবার ঘরে কমলা দেবী বলেন, শোনলাম, জমিদার আইছিল বাড়ি, ঠিকনি?

হঁ

ক্যান আইছিল, জল খাইতে?

হঁ

আশপাশে এত ম্লেচ্ছ বাড়িঘর থাকতে আমার বাড়ি জল খাইতে আসে ক্যান?

আমি তার কী জানি?

জল দিছিলা?

পদ্মগন্ধা চুপ করে থাকে কমলা দেবীর রাগ হয়, তাইলে তুমি জল দিছিলা?

পদ্মগন্ধার কণ্ঠেও ক্ষোভ, হঁ দিছিলাম না দিয়ে উপায় কী? তুমি থাকলে কী করতে? দিতে না জল?

না, দিতাম না চুপ করে ঘরে দোর দিয়া বইয়া থাকতাম ডাকলেও সাড়া দিতাম না

পদ্মগন্ধা ভাবে, মায়ের বুদ্ধিটা তো খারাপ না দোর খুলে বাইরে বেরিয়ে না এলেই তো হতো! তাহলে, সে ভাবতো, বাড়িতে কেউ নেই কয়েকবার ডাকাডাকি করে চলে যেত ইশ! এ বুদ্ধিটা তখন কেন যে মাথায় খেলেনি! মাকে শান্ত করার জন্য সে বলে, জলের জন্য করুণ স্বরে হাঁক দিলো ভাবলাম, কোনো তীর্থ যাত্রী, সাধুসন্ত কিংবা মুসাফির হবে দীর্ঘ পথ ঘুরে ফিরে নিশ্চয় খুব ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত তাই একটু জল আর জলখাবার নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম আমি কি জানতাম, উনি জমিদার শের আলী গাজী? তৃষ্ণার্তকে জল দেওয়া তো মানুষের ধর্ম, মা তুমিই না একদিন বলেছিলে, ক্ষুধার্তকে খাদ্য আর তৃষ্ণার্তকে জল দিতে?

হঁ, বলেছিলাম তবে কোনো ম্লেচ্ছকে নয়

তৃষ্ণার্ত ম্লেচ্ছকে জল দিলে ভগবান নিশ্চয় অখুশি হবেন না ওরা তো আমাদের মতোই মানুষ, তাই না, মা?

হঁ মানুষ! ম্লেচ্ছ আবার মানুষ হলো কবে? তুমি তাকে জলের সাথে জল খাবারও দিলে?

পদ্মগন্ধা চুপ করে থাকে ম্লেচ্ছর প্রতি মায়ের এত ঘৃণা! কোনোদিন তো জানা ছিল না কিন্তু ওরাও তো মানুষ আমাদের মতো রক্তমাংসেরই মানুষ তার চোখে টলমল করে জল কমলা দেবী তখন কপাল চাপড়াচ্ছেন, দু¹া, দু¹া! এই মাইয়া আমাকে জ¦ালায়ে পুড়ায়ে একেবারে শ্যাষ কইরা ছাড়বো

বসন্তরঞ্জন বাড়ির পাশের ক্ষেত থেকে গোরুগুলো এনে গোয়ালঘরে দিয়ে বড়োঘরে ঢোকেন মেয়ের মুখচোখ দেখেই তিনি বুঝতে পারেন কমলা দেবী ব্যাপারটা নিয়ে ঢের ঝেড়েছে বউকে তিনি বলেন, অযথা এত রাগারাগি করছো কেন?

বাবাকে কাছে পেয়ে তার বুকে মুখ লুকিয়ে পদ্মগন্ধা ডুকরে ওঠে, বাবা!

বুইড়া মেয়ের ঢং দেখে বাঁচি না

আহা, চুপ কর

চুপ করবো ক্যান? রাগ করি কি সাধে! তোমার আহ্লাদ পাইয়াই দিন দিন মাইয়াডা এমন বেয়ারা হইয়া উঠছে বলে কি না ম্লেচ্ছকে জলের সাথে জলখাবারও দিয়েছে এখন আমার এত সুন্দর গ্লাস ও থালাটা ফেলে দিতে হবে

পদ্মগন্ধা বলে, জলখাবারের প্লেটটা সে ছুঁয়েও দেখেনি আর জলের গ্লাসটা আমার হাত থেকে পড়ে গেছে নিচে তারপর জল না খেয়েই সে চলে গেছে বিশ^াস করো, মা

কমলা দেবী দেখেন দরোজার পাশেই পড়ে আছে জলখাবারের থালাটা তাতে কিছু মুড়ি আর কয়েকটা নারকেলের নাড়ু পাশেই কাত হয়ে পড়ে আছে চকচকে কাসার গ্লাসটা সেদিকে ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে কমলা দেবী বলেন, তুমি বললেই হলো- ছোঁয়নি জল খায়নি তো জলের তালাশে এসেছিল কেন?

পদ্মগন্ধা চুপ করে থাকে বসন্তরঞ্জন বলেন, ধরলাম, এসবে ম্লেচ্ছর ছোঁয়া লেগেছে তাই বলে এগুলো ফেলে দিতে হবে? গোবর দিয়ে ঘষামাজা করে ধুয়ে আনলেই তো চলে

না, চলবে না আমার গা ঘিন ঘিন করছে এসব আমি ফেলে দেবো

কলাপাতা দিয়ে থালা ও গ্লাস পেঁচিয়ে সে বাইরে নিয়ে যায় বাড়ির বাইরে ফেলে দেবার ঝনন শব্দ হয় কমলা দেবী ফিরে আসেন ঘরে পদ্মগন্ধা তখনো বাবার বুকে লুকিয়ে ফুঁপাচ্ছে কমলা দেবীর রাগ আরও চড়ে যায় মেয়ের ওপর স্বামীকে সে বলে, এই মাইয়া একটা আগুনের ফুল তারে ঘরে আর বেশিদিন রাখা যাইবো না ম্লেচ্ছ জমিদারের চোখ পড়েছে ওর ওপর এবার আমার জাতপাত, সংসার, ধর্ম সব জ¦ালায়াপোড়ায়া শ্যাষ কইরা ছাড়বো তুমি কালই একবার কানুনগো পাড়ায় যাও রমাবল্লভ নন্দীর সাথে ওর বিয়ার কথাবার্তা পাকা কইরা আসো

উজানযাত্রা

‘হিরদে ভিতর দও জ¦লে ধুয়াঁ না পরগট হোয়

জাকে লাগি সোয় লখে কয়ি জিন লাজ সোয়’

কদিন ধরে কবীরের শায়ের পড়ছেন শের আলী গাজী যতই পড়ছেন ততই অবাক হচ্ছেন, জীবনের এত গূঢ় সত্য কীভাবে উঠে আসে তার শায়েরে! মাঝে মাঝে দু একটি পঙ্ক্তি নিয়েই কাটিয়ে দেন দিনরাত আজও তিনি বারবার বিড়বিড় করে আবৃত্তি করেই যাচ্ছেন এ দুটি লাইন আর ভাবছেন, সত্যিই তো হৃদয়ে দাবানল কিন্তু ধোঁয়া বের হয় না যার জ¦লে সে ছাড়া আর কেউ দেখে না তার অবস্থা তো এখন এরকমই দ্বিতীয়বার পদ্মগন্ধাকে দেখে আসার পর তার ভেতরে আগুন আরও দ্বিগুণ জ¦লে উঠেছে তাকে দেখার তৃষ্ণা আরও বেড়ে গেছে নিজের সঙ্গে নিজেই ভেতরে ভেতরে অনেক লড়াই করে যাচ্ছেন শের আলী গাজী কিন্তু পারছেন না বারবারই হেরে যাচ্ছেন- না, পদ্মগন্ধাকে আমার চাই তাকে ছাড়া আমার চলবে না এই যে আমার মনের ভেতর আগুন, বুকের ভেতর অনন্ত তৃষ্ণা তাকে পাওয়ার জন্য, এটা তো কোনোভাবেই দূর হচ্ছে না ফাতেমা এখন তাকে আর আকর্ষণ করে না তার দুঃখ-কষ্টের মূল্য এখন তার কাছে কানাকড়ি নেই পদ্মগন্ধা ছাড়াও তো জীবনে কত নারী তিনি দেখেছেন, এখনো দেখেন, এখানেও দাসিবাদি কম নেই, কিন্তু কারও দিকে তো কখনো তার চোখ পড়েনি কেউ তাকে আকর্ষণ করতে পারেনি পদ্মগন্ধার মতো কী আছে পদ্মগন্ধার ভেতর? কেন সে তাকে এত দুর্নিবার করে তোলছে? শুধু রূপই নয়, আরও কিছু শক্তি তার ভেতরে আছে, এ কারণে কিছুতেই তিনি তাকে উপেক্ষা করতে পারছেন না প্রতিনিয়ত সে উঠে আসছে তার কামনা-বাসনায় এটা কি খোদা তায়ালার ইচ্ছা নয়? হয়তো আল্লাহ পাকই পদ্মগন্ধার সাথে তার দ্বিতীয় জুটি বেঁধে দিয়েছেন, তা না হলে সেদিন কেনইবা তিনি গড়জরিপা থেকে বের হয়ে ওদিকে গেলেন, আর কেনইবা নদীর ঘাটে পদ্মগন্ধার সাথে তার দেখা হলো? আর দেখা হওয়ার পর থেকে কেন তিনি পদ্মগন্ধার থেকে এক মুহূর্তের জন্যও দৃষ্টি সরাতে পারছেন না মনকে কিছুতেই বোঝাতে পারছেন নাÑ পদ্মগন্ধা ছাড়া তার চলবে এখন তার মনে হচ্ছে পদ্মগন্ধার রূপ যেন শুধু রূপ নয়- আগুন; আর তার হয়েছে পতঙ্গস্বভাব ওই রূপের আগুনে ঝাপ দিয়ে মৃত্যু ছাড়া তার আর কোনো পথ খোলা নেই হ্যাঁ, এখন মরতেই তিনি চান কী হবে বুকের ভেতর এত কষ্ট নিয়ে বেঁচে থেকে? কী লাভ বুকের আগুনে পুড়ে তিলে তিলে নিজেকে গোপনে শেষ করে দিয়ে? তার চেয়ে আগুনে ঝাঁপ দেওয়াই ভালো হয় তিনি জ¦লেপুড়ে ছাই হবেন, না হয় নতুন জীবন নিয়ে বেঁচে উঠবেন সুখ-শান্তি ও আনন্দে কাটাবেন বাকিটা জীবন তাছাড়া, পদ্মগন্ধাকে পেতে কেনইবা তিনি এত দ্বিধা করছেন? পদ্মগন্ধা তো তাকে চায় সেদিন তৃষ্ণা নিবারণের ছলে বাড়িতে গিয়ে তাকে দেখে তো তার তাই মনে হয়েছে তার থেকে সেও চোখ সরাতে পারছিল না আর মনে হচ্ছিল, মনে-প্রাণে সে তারই অপেক্ষায় ছিল হয়তো এখনো সে তারই অপেক্ষায় আছে তার মতো পদ্মগন্ধার অন্তরেও জ¦লে উঠেছে প্রেমানল তাহলে আর বাধা কোথায়? ধর্ম? মুঘল হেরেমে তো যোধাবাঈ ছিলেন সম্রাট আকবরের স্ত্রী হয়ে যোধাবাঈ, হীরাবাঈ আরও কত নাম তার! রাজস্থানের রাজপুত ঘরানার রাজা ভারমলের জ্যেষ্ঠ রাজকন্যা সে; সেনাপতি মানসিংহের পিসি এবং ভগবান দাসের বোন সম্রাট আকবরের সাথে বিয়ের পর তিনি পরিচিতি পান মরিয়ম-উজ-জামানি নামে তার গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেন শাহজাদা সেলিম বা সম্রাট জাহাঙ্গীর আর জাহাঙ্গীরের ছেলে সম্রাট শাহজাহানই গড়ে তুলেছেন তাজমহল! কী জানি! পদ্মগন্ধাকে বিয়ে করলে হয়তো আমার কোনো বংশধর এই গড়জরিপায় গড়ে তোলবে দ্বিতীয় তাজমহল!

প্রথম দর্শনে যোধাবাঈকে দেখার পর সম্রাট আকবরের মনেও নিশ্চয় তারই মতো প্রেমের আগুন জ¦লে উঠেছিল তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যোধাবাঈকে ছাড়া তার চলবে না যেমন আমার চলবে না পদ্মগন্ধাকে ছাড়া তাহলে দশকাহনিয়ার জমিদার হয়ে কেন তাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে আমি এত সংকোচবোধ করছি? মুসলিম সমাজে ঢি ঢি পড়বে, এই ভয়ে? বিয়ের পর তার নাম পাল্টে আয়েশা কিংবা জয়নব রাখলেই তো তারা বেজায় খুশি শের আলী গাজী ভাবলেন, না, কাল সকালেই হামজাকে নিয়ে আবার ছুটে যাবো দর্শা গ্রামে পদ্মগন্ধাকে আমি দেখে আসবো আমার হাতের আংটি দিয়ে তাকে বলে আসবো, যদি তার আপত্তি না থাকে, তাহলে আমি তাকে আমার রাজধানী গড়জরিপায় নিয়ে যেতে চাই রক্ষিতা নয়, দাসি নয়, সে থাকবে আমার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী হয়ে ফাতেমা আমাকে বাধা দিতে পারবে না ইসলামে একসাথে চারজন স্ত্রী গ্রহণ করার নিয়ম আছে আমাদের মহানবী (সা.) এর তেরজন স্ত্রী ছিলেন আমি তো ফাতেমার পাশাপাশি পদ্মগন্ধাকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতেই পারি শরীয়তে কোনো বাধা নেই হোক সে হিন্দু বা ব্রাহ্মণের মেয়ে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেই তো হলো তাহলে মুসলিম সমাজে কারো কোনো আপত্তি থাকবে না বরং একজন ব্রাহ্মণের মেয়েকে নওমুসলিম বানানোর কারণে মুসলমানদের অনেকে খুব খুশিই হবে যাক, এসব ভেবে আমার কাজ নেই আমি চাই পদ্মগন্ধাকে যেকোনোভাবে তাকে পেলেই আমার চলে যদি পদ্মগন্ধা আমাকে পছন্দ করে, তাহলে, হিন্দু বা মুসলিম সমাজে আমাকে কে কী বলল, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই তার পরিবার কিংবা সমাজ যদি বাধা দেয়, তাতেও আমার কিছু যায়-আসে না সব বাধা মোকাবিলা করে আমি পদ্মগন্ধাকে নিয়ে আসবো এই গড়জরিপায় কিন্তু সে যদি আমাকে ভালো না বাসে? আমার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে রাজি না হয়, তাহলে? হয়তো আমি তাকে শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে জোর করে তুলে নিয়ে আসতে পারবো, যদি কেউ বাধা দিতে এগিয়ে আসে সামনে, নিঃসন্দেহে ধড় থেকে তার মাথাটা আলাদা হয়ে যাবে তলোয়ারের একটি মাত্র কোপে রক্তের বন্যা বয়ে যেতে পারে, তবু পদ্মগন্ধাকে তুলে আনতে কেউ আমাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না কিন্তু লাভ কি তাতে? সে যদি আমাকে ভালো না বাসে, তাহলে, আমার প্রতি তার বিদ্বেষভাব আরও বেড়ে যাবে আমি যতই তাকে হৃদয় খুলে ভালোবাসি, সে ততই আমাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করবে জোর করে তো মানুষের মন পাওয়া যায় না মন না পাওয়া গেলে তার কাছে থেকে ভালোবাসাও আশা করা যায় না জোর করে কিংবা ডরভয় দেখিয়ে হয়তো সংগম করা যায়, কিন্তু তা হবে স্রেফ ধর্ষণ মন ও ভালোবাসা ছাড়া দেহসম্ভোগে পৈশাচিকতা আছে, হিংস্রতা আছে, কিন্তু সংগমকে উপভোগ্য করে তোলার মতো কোনো সুখ নেই, শান্তি নেই পৈশাচিকতা বা হিংস্রতার মধ্যে দেহসম্ভোগে যে সুখ বা আনন্দ, তা আসলে মনোবিকলন ছাড়া আর কিছুই নয় আমি তা কোনোদিন চাইনি, ভবিষ্যতেও চাইবো না আমি পদ্মগন্ধাকে জয় করেই পেতে চাই, এতে যতদিন আমাকে অপেক্ষা করতে হয় করবো তবু তার অনুমতি ছাড়া কোনো কাজ আমি কখনো করতে পারবো না কুরুচিপূর্ণ কাজ তো নয়ই

কাল বিয়ানেই আমি হামজাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বো দর্শা গ্রামের দিকে পুরো এলাকাটা কয়েকটা চক্কর দিয়ে তারপর ঢুকে পড়বো পদ্মগন্ধাদের বাড়ি তারপর দেখি না কী হয়? যদি সে এগিয়ে আসে কাছে এবং যদি বুঝতে পারি, সে আমাকে ঘৃণা করে না- ভালোবাসে, তাহলে এই হাতের আঙুল থেকে সবচে দামি ডায়মন্ডের আংটিটি খুলে তার হাতে পরিয়ে দেবো আর বলবো, পদ্মগন্ধা, আমি তোমাকে ভালোবাসি তোমাকে পেতে চাই দেহ-মন-প্রাণে আমার কামনা-বাসনায়, ঘুম-জাগরণে, চেতনে-অবচেতনে, চিন্তাভাবনায়, সুখ-অসুখে, আনন্দ-বেদনায়, প্রেম-বিরহে তুমি আমার সমস্ত সত্তা দখল করে আছো, তোমাকে আমি চাই আমার দেহ-মন-প্রাণের সাথে তুমি সংগোপনে মিশে আছো তুমি এক অবিচ্ছিন্ন সত্তা তোমাকে আমি উপেক্ষা করতে পারি না, অস্বীকার করতে পারি না দূরে থাকার জ¦ালা সইতে পারি না সুতরাং তুমি চলো আমার সাথে তোমার রূপের উজ্জ্বল বিভায় আমার গড়জরিপা আরও আলোকিত হয়ে উঠুক আমার অন্তরে, অন্দরমহলে ফিরে আসুক সুখ-শান্তি-স্বস্তি

রাতে শের আলী গাজী ঘুমাতে পারেন না ফাতেমা কাটিয়ে দেন ইবাদত-বন্দেগীতে, জায়নামাজে বসে তসবিহর দানা টিপে টিপে আর শের আলী গাজী সারারাত বিছানায় এ-পাশ ও-পাশ করেন ঘুম-জাগরণে তিনি স্বপ্ন দেখেনÑ একটি সোনার পাখি খুবই সুন্দর মুহূর্তে তিনি পাখিটির প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন এত সুন্দর পাখি তো তিনি কখনো কোথাও দেখেননি পাখিটি জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েছিল তার অন্দরমহলে, বিছানায় হয়তো কিছু খুঁজছিল না পেয়ে, শের আলী গাজীকে মধুর মায়াবী সুরে জাগিয়ে বসে পড়লো জানালায় শের আলী গাজী পাখিটিকে ধরতে চাইলেন কিন্তু অন্দরমহলে কেউ নেই, যে, পাখিটি তাকে ধরে এনে দেবে এবার তিনি নিজেই উঠে জানালার কাছে গেলেন পাখিটি ফুড়ুত করে উড়াল দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো একটি গাছের ডালে তিনি মনে মনে হায় হায় করে উঠলেন, পাখিটি চলে যাবে না তো! নিজেই ঘরের কপাট খুলে বাইরে এলেন পাখিটি বসে আছে তারই ফুলবাগানের একটি অচেনা ফুলের ডালে! কী মিষ্টি ঘ্রাণ! পাখিটির গা থেকে আসছে, নাকি ফুল থেকে! এ-নিয়ে ভাবার তার সময় নেই, আপাতত, পাখিটি ধরাই তার একান্ত অভিপ্রায় তিনি এগিয়ে গেলেন ফুলগাছের ডালের দিকে পাখিটি আর সরে যাচ্ছে না বরং মাথা ও ঘাড় কাত করে কাজল কালো গোল দুটি চোখ দিয়ে তাকে দেখছে শের আলী গাজী যখন হাত বাড়ালেন পাখিটির দিকে, অমনি সে উড়াল দিয়ে চলে গেল চোখের আড়ালে তার হাত গোলাপের কাঁটায় রক্তাক্ত হলো তিনি অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলেন তারপর, হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে গেল তিনি বিছানায় বসে হাঁপাতে লাগলেন এ কেমন স্বপ্ন দেখলাম আমি! একটি সোনার পাখি! অচেনা ফুলের গাছ! মায়াবী ঘ্রাণ! গোলাপ কাঁটায় হাত রক্তাক্ত! মনে হলো পাখিটি তার খুব কাছেই বসে আছে হৃদয়ের চেয়েও কাছে, আত্মার মধ্যে এমন একটি সোনার পাখিই তো দেখেছিলেন দাউদ (আ.) সেই পাখিটির পেছনে ছুটতে গিয়ে দেখা পেয়েছিলেন একজন সুন্দরী রমণীর তার রূপে এতই মুগ্ধ হয়ে যান যে তিনি তাকে বিয়ে করতে চান কিন্তু সেই রমণী ছিলেন তারই সেনাবাহিনীতে কর্মরত একজন সৈনিকের স্ত্রী দাউদ (আ.) মনে মনে তার মৃত্যু কামনা করেন তা না হলে তিনি তাকে বিয়ে করতে পারবেন না তারপর তাকে এমন এক যুদ্ধে প্রেরণ করেন, সেখানে তার সত্যিই মৃত্যু হয় তখন সেই সুন্দরী বিধবা রমণীকে বিয়ে করেন দাউদ (আ.) তার সেই স্ত্রীর গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেন নবী সোলাইমান (আ.)! তাহলে আজকে স্বপ্নে দেখা এই সুন্দর সোনার পাখিটি কি আমার সৌভাগ্যের প্রতীক? পাখিটি কি আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল দর্শা গ্রামের পদ্মগন্ধার কাছে! নাকি পদ্মগন্ধাই স্বপ্নে সোনার পাখি হয়ে এসেছিল! কিন্তু তারপর কোথায় হারিয়ে গেল সে? সে কি আমাকে যেতে বলেছে দর্শা গ্রামে? আর গোলাপের কাঁটায় কেনইবা আমার হাত রক্তাক্ত হলো? যাক, এসব নিয়ে ভাবার মতো যথেষ্ট সময় এখন আমার হাতে নেই এ নিয়ে আরেকদিন ভাবা যাবে সকাল হয়ে গেছে সূর্যও উঠে যাচ্ছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে রওয়ানা দিতে হবে দর্শা গ্রামে এ পাখিটি আর কেউ নয়Ñ পদ্মগন্ধা সে-ই আমাকে যেতে বলেছে তার কাছে আমি আর দেরি করবো না তিনি বাইরে বেরিয়ে এগিয়ে গেলেন ঘোড়াশালের দিকে এই সাত সকালেই ঘোড়াশালের কর্মচারীরা উঠে পড়েছে ভোরে উঠেই তারা ঘোড়াগুলোর যত্ন নেয়, খাওয়ায় বলা তো যায় না, যদি ভোরে উঠেই শের আলী গাজী কোথাও বেরিয়ে পড়তে চান! হামজা ছাড়াও শের আলী গাজীর আরও তিনটি ঘোড়া আছে- ব্ল্যাক, জিপসি ও ডায়মন্ড ব্ল্যাক আনা হয়েছে স্পেনের আন্দালুসীয়র ইবেরীয় উপদ্বীপ থেকে এটি প্রায় হামজার এতই তেজী গায়ের রঙ প্রায় কালো বলেই তিনি নাম রেখেছেন ব্ল্যাক হামজার পরেই তিনি এই ঘোড়াটিকে পছন্দ করেন মাঝে মাঝে বাইরে নিয়ে যান কিছুদিন আগে জিপসি ও ডায়মন্ড আনা হয়েছে বৃটেন থেকে এদুটি এখনো পুরোপুরি পোষ মানেনি তবে তাড়াতাড়ি পোষ মানানোর চেষ্টা চলছে

ঘোড়াশালে শের আলী গাজীকে দেখে তারা চমকে উঠল, আগে থেকে কোনোকিছু না বলেই তিনি এই বিয়ানে এখানে! তাদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তিনি নির্দেশ দিলেন, হামজাকে প্রস্তুত করে দাও ঘাস মুখে নিয়েই হামজা তার দিকে তাকালো তাকালো ব্ল্যাকও শের আলী গাজী কাছে গিয়ে হামজার গলায় হাত বুলিয়ে একটু আদর করে দিলেন মনে মনে বললেন, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও হামজা, তোমাকে আজ সিংহের মতো ছুটতে হবে তারপর তিনি ব্ল্যাককে একটু আদর করে হেঁটে গেলেন অন্দরমহলের দিকে নামাজ শেষে ফাতেমা এখন ঘুমিয়ে পড়েছে বিছানায় ভেতরে গিয়ে বেশি দেরি করলেন না তাড়াতাড়ি সুসজ্জিত হয়ে ফিরে এলেন হামজার কাছে হামজাও প্রস্তুত পিঠে সওয়ার হয়ে তিনি যাত্রা শুরু করলেন

হিম হিম বাতাস কাঁপিয়ে, রোদের ঝিলিক গায়ে মেখে হামজা ছুটছে দুর্বার গতিতে তারপরও শের আলী গাজীর মনে হচ্ছে, গতি কি কমে গেল হামজার! দর্শা গ্রাম আর কতদূর?

জনপদ পেরিয়ে ধু ধু বিশাল ফাঁকা মাঠে এসে পড়লো হামজা এবং সেখান থেকে দর্শা গ্রামকে মোটাসোটা অজগরের মতো চোখে পড়লো গাজীর, তখন সে খুশি হয়ে উঠল ফসলশূন্য এই নির্বাক ও নির্জন মাঠটা পেরিয়ে যেতে পারলেই দর্শা গ্রাম মনে মনে বললেন, আজ গ্রামের চারদিকে চক্কর দেবো না সোজা ছুটে যাবো পদ্মগন্ধার বাড়ির আঙিনায়

দূরত্ব যত কমছে, গ্রামের নৈকট্য যত বাড়ছে, ততই তার চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠছে পদ্মগন্ধাকে আজ দেখতে পাবো তো সেই আগের মতো! নাকি আজ সে ঘর থেকে বেরই হবে না? বের না হলে কী করবেন তিনি? আজও কি জলের তালাশেই ঢুকে পড়বেন পদ্মগন্ধার আঙিনায়? ভাবতে ভাবতে তিনি উঠে এলেন দর্শা গ্রামের সড়কে জমিদার শের আলী গাজী আসছেন, সাবধান! সড়কের মানুষজন সড়ক থেকে নেমে ঢুকে পড়ছে আশপাশের বাড়িঘরের আড়ালে ধুলো উড়িয়ে হামজা ছুটছে পদ্মগন্ধার বাড়ির দিকে

বাড়ির সামনে ঘোড়া থামিয়ে তিনি অবাক হলেন, এমন লাগছে কেন বাড়িটা? মনে হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক পরিপাটি করে সাজানো কিন্তু বিশাল একটা ঝড় যেন বয়ে গেছে বাড়িটার ওপর দিয়ে বিধ্বস্ত, নীরব ঘোড়া থেকে নেমে সড়কের পাশে একটি তালগাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইলেন শের আলী গাজী বাড়িটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন আর তখনই বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন বসন্তরঞ্জন তার চোখমুখ ভীত মাথা নিচু কম্পিত কণ্ঠে তিনি বললেন, হুজুর, হঠাৎ এই গরীবের আঙিনায়! আসুন, বসুন কী প্রয়োজন? কী করতে পারি, বলুন?

না না, ব্যস্ত হতে হবে না আমি গ্রামগুলো দেখতে বেরিয়েছি কারো কোনো সমস্যা আছে কি না

কদিন আগেও বোধহয় এসেছিলেন, হুজুর

হ্যাঁ, এসেছিলাম এই বাড়িতেই জল চেয়েছিলাম জল দিয়েছিল...

আমার মেয়ে হুজুর, পদ্মগন্ধা খুবই লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে

বসন্তরঞ্জনের চোখ জলে ভরে এলো

কোনো সমস্যা?

না না গতরাতে মেয়েটার বিয়ে হয়েছে সাজ বিয়ের পরই চলে গেছে শ^শুরবাড়ি আজ বরের বাড়িতেই বাসি বিয়ে হবে

বিয়ে! কার সাথে?

এবার বসন্তরঞ্জনের চোখ-মুখ বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আপনি চিনবেন হুজুর কানুনগো রমাবল্লভ নন্দী পাত্র খুব ভালো আমার পদ্মগন্ধারে খুব পছন্দ করেছে ওরা আর দেরি করতে চাইলো না আমরাও...

তার চোখ থেকে কয়েক ফোটা অশ্রু ঝরে পড়লো মাটিতে বামহাতের তালুতে তা মুছে ফেলে বললেন, এখন মেয়ে আমার সুখি হলেই হয় আশীর্বাদ করবেন হুজুর আর মার্জনা করবেন, তাড়াহুড়োর কারণে আপনাকে জানাতে পারিনি

কোথায় যেন মনে মনে ডুব দিয়েছিলেন শের আলী গাজী হঠাৎ ভুস করে ওঠে সম্বিৎ ফিরে পেলেন বুকের ভেতর কষ্টের ঢেউ তড়পাচ্ছে তোমাকে প্রজার সামনে ভেঙে পড়লে চলবে না শের আলী গাজী! তুমি জমিদার বুকের ভেতর যতই কষ্ট থাক, তা পাথর চাপা দিয়ে রাখতে হবে নিজেকে সংবরণ করে তিনি বললেন, না না, তার দরকার নেই কী যেন বলছিলেন, আশীর্বাদ?

বামহাতের অনামিকা আঙুল থেকে সবচেয়ে দামি হিরার আংটিটি খুলে বসন্তরঞ্জনের হাতে দিয়ে বললেন, আশীর্বাদের উপহার, পদ্মগন্ধার জন্য

হুজুরের বহুত দয়া আপনার জমিদারি চির অক্ষয় হোক দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ুক আপনার সুনাম চারদিকে আরও বিস্তৃত হোক জমিদারি ... এবার বাড়ি চলুন হুজুর গরীবের বাড়িতে আপনার চরণধূলি দিয়ে যান

ঘোড়াটা অনেকটা পথ ছুটে এসেছে একটু বিশ্রাম দরকার ছিল ওর আমারও বিশ্রাম শেষ চললাম

ঘোড়ার জিনের ওপর উঠে বসলেন, শের আলী গাজী আর কোনো কথা নয় আজ আর কানুনগো অফিসে যাবেন না ছুটিয়ে দিলেন ঘোড়া গড়জরিপার দিকে

বিরহযাপন

পদ্মগন্ধার বিয়ে হয়ে গেছে! এটা শের আলী গাজী কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না যদিও বারবার তিনি নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছেন, বিয়ে যখন হয়েই গেছে, আর কিছু করার নেই তার এবার এখান থেকে মন ফেরাতেই হবে কিন্তু মাঝে মাঝেই পদ্মগন্ধার মুখ ভেসে ওঠে চোখের সামনে তাকে একেবারে আনমনা করে দেয় তিনি হাফিজ পড়েন, খৈয়াম পড়েন, কবীর পড়েন কিন্তু আগের মতো মনে শান্তি পান না স্বস্তি পান না মন ডুবে আছে বিষণ্নতায় কবীরের শায়ের তাকে আরও বেশি বিষণ্ন করে ফেলে:

‘ভুজঙ্গম প্যায়ঠি কারি কিয়া কলেজা ঘাও

সাধু অঙ্গ না মোড়হি জিউভাওয়ে তিও খাও’

বিরহের বিষধর সাপ শরীরে ঢুকে হৃদয় করেছে ঘাও,/ সাধু তিলমাত্র অঙ্গ নেড়ো না, চুপ করে সও কবীর সাধু বা সন্তু ছিলেন তিনি বিরহের বিষধর সাপের জ¦ালা সইতে পেরেছেন শের আলী গাজী ভাবেন, কিন্তু আমি তো সাধারণ মানুষ আমি সইবো কেমনে? আমি তো তাকে ইচ্ছে করলেই জোর খাটিয়ে পেতে পারতাম কেউ আমাকে বাধা দিতে পারতো না কিন্তু আমি সমাজের কালিমা গায়ে মাখতে চাইনি তারপর অনেক ভেবেচিন্তে, সমাজের সব অপবাদ সয়ে যখন তাকে পেতে মন স্থির করে ফেলেছি, তখন সে হয়ে গেল অন্যের ঘরনী! সে আমারই কানুনগো রমাবল্লভ নন্দীর বউ! কী সৌভাগ্য তার! হায় খোদা! পদ্মগন্ধার সাথে আমার কেন দেখা হয়েছিল? এখন অন্তরের এই অনন্ত আগুন আমি কী দিয়ে নেভাবো? নদীর জলে রাতদিন ডুব দিয়ে থাকলেও তো এ আগুন নিভবে না বরং নদীই জ¦লেপুড়ে খাক হবে কবীর এত বছর আগে কীভাবে বলে গেলেন আমার কথা!

‘বিরহা জ¦লন্তি ম্যায় ফিরুঁ জলত জলহারি জাউঁ

মো দেখয়া জলহারি জ¦লে সন্তোঁ কাহাঁ বুঝাউঁঁ’

পদ্মগন্ধাকে আমি পাবো না নদী আমাকে নেবে না কবীরের মতো আমারও তাহলে বিরহের আগুন নেভানোর কোনো জায়গা নেই! না, পদ্মগন্ধাকে ভুলে যেতে হবে সংসার আর জমিদারি নিয়েই তো আমি বেশ ছিলাম, শান্তিতে ছিলাম প্রজাদের সুখ দেখে আমি আনন্দ পেতাম তাদের দুঃখ আমাকে পীড়িত করতো তাদের সমস্যা আমি সমাধান করার চেষ্টা করতাম প্রজারা আমাকে খুব ভালোবাসতো হয়তো এখনো ভালোবাসে জমিদারি দেখাশোনা আর শায়ের পড়ে সময় কেটে যেত গাছের ডালে একটি পাখির নৃত্য দেখে আমার মন আনন্দে ভরে যেত সবুজের সৌন্দর্য দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে যেত মৃগীর ঢেউ, বয়ে চলা জলের কলকল শব্দ আমাকে মোহাচ্ছন্ন করে স্রোতের সাথে দূরে কোথাও ভাসিয়ে নিয়ে যেত রৌদ্রপোড়া মাঠ আমাকে শোনাতো বৃষ্টির গান, অবিরাম বৃষ্টিতে শিমুলের ডালে ভেজা কাক দেখেছি, দেখেছি তৃষিত মাটির গাছপালা আর লতাপাতার স্বস্তির নিঃশ^াস, কৃষকের চোখে-মুখে বীজ রুইয়ে দেয়ার উচ্ছ্বাস নির্জন মাঠে রাখালের বাঁশি আমাকে আনমনা করে দিতো অন্ধকার রাত আমাকে ডেকে নিয়ে যেত নক্ষত্রের ভীড়ে জোছনা আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত স্বপ্নলোকে আজ আমার কিছুই ভালো লাগে না কোনো দিকে ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করে না আমি আবার সেই আগের দিনগুলোতে ফিরে যেতে চাই পদ্মগন্ধাকে ভুলে যেতে চাই তাকে একদিন নদীর ঘাটে দেখেছিলাম, বাড়ির আঙিনায় দেখেছিলাম, দেখেছিলাম হরিণীর মতো চঞ্চল, ভীরু চোখে প্রেমের আহ্বান, যা উপেক্ষা করা সম্ভব নয়- সব আমি ভুলে যেতে চাই

আমি চাই, আমার প্রজারা আরও বেশি সুগন্ধিযুক্ত তুলসীমালা ধান উৎপাদন করুক এ চালের ভাত শুধু রাজাবাদশারাই কেন খাবে, জমিদার আর ধনীরাই কেন খাবে, যারা এই ধান উৎপাদন করছে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, তারাও পেট ভরে এই চালের ভাত খাক কৃষকের চোখে-মুখে পেটপুরে ভাত খাওয়ার তৃপ্ত হাসি দেখে আমি খুশি হই পদ্মগন্ধার কথা ভেবে কতদিন আমি কৃষকদের মুখের দিকে তাকাইনি তাদের এ হাসি থেকে আমি নিজেকেই বঞ্চিত করেছি আজ থেকে আমি আবার কৃষকদের মুখের দিকে তাকাবো তারা আসলে কতটুকু তৃপ্ত, কতটুকু সুখি, তা আমি উপলব্ধি করতে চাই

পদ্মগন্ধাকে নিয়ে অযথা ভেবে ভেবে সময় নষ্ট করবো না আমি প্রকৃতিমগ্ন হবো গ্রামগুলো আরও সবুজ হয়ে উঠুক ফসলের মাঠগুলো ভরে উঠুক শস্যের সবুজ সমারোহে আমি দুচোখ ভরে এই সবুজের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাই আগের মতো

মাছশিকার আমার নেশা কতদিন মৃগীতে যাওয়া হয় না মাছশিকারে মৃগীতে এখনও মহাশোল পাওয়া যায় পাওয়া যায় বিশাল বিশাল আইড় ও বোয়াল কী যে স্বাদ! আজই মাছধরার নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়বো জেলেরা জাল ফেলে বৈঠা দিয়ে নৌকা আস্তে আস্তে ঠেলে নিয়ে যাবে ভাটিতে হঠাৎ জালে মাছ আটকা পড়লে দ্রুত টেনে তুলবে জাল নৌকার মাঝখানে পাটাতনের ওপর সাজানো আমার আসনে বসে জলের দিকে অনড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবো জালে মাছ আটকা পড়লে যে ডাপ দেয়, তা সত্যি অসাধারণ ভালো লাগে নৌকার খোলে জীবন্ত মাছের লম্ফঝম্ফ আরও ভালো লাগে জোছনারাতে মৃগীতে মাছ ধরতে মাছের আঁশ চাঁদের আলোয় কী সুন্দর চকচক করে! দেখলে প্রাণটা জুড়িয়ে যায় আজ দিনে ও রাতে দুবেলাই মৃগী নদীতে মাঝ ধরতে যেতে হবে প্রবল আনন্দের মধ্যে জীবনকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে খৈয়াম কত সুন্দর করে বলেছেন তার উপলব্ধির কথা:

‘জীবন সুধায় মত্ত তুমি হলেই যখন

আনন্দে রও

গোলাপ-গালের সঙ্গ ক্ষণেক পেলেই যখন

আনন্দে রও

এই দুনিয়ার কর্মলীলা ফুরিয়ে গেলে

আর কিছু নেই

পার তো হতে আসোইনি, এলেই যখন

আনন্দে রও’

আনন্দেই থাকতে হবে আমাকে দুঃখ, হতাশা জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে তার ব্যক্তিগত কর্মচারী মোসাদ্দেককে ডেকে বললেন, মাছধরার নৌকাটা প্রস্তুত থাকতে বল এখনই মৃগীতে যাবো মাছ ধরতে

জি¦ হুজুর

মোসাদ্দেক বেরিয়ে গেল শের আলী গাজী মৃদু হাসলেন, ও মন যা পাবে না, তার জন্য কেন এত অস্থির হয়ে পড় জীবন ছোটো কাজের কত জায়গা রয়েছে আনন্দের কত উৎস রয়েছে চারপাশে দেখার মতো কত কিছু রয়েছে উপভোগ করার কত সৌন্দর্য রয়েছে- একটি নদীর সাথে ভেসে ভেসে কাটিয়ে দেয়া যায় জীবন! কিচিরমিচির করে একটি ছোট্ট পাখির গাছের ডালে ডালে নৃত্য করা, পাখা মেলে একটি চিলের আকাশে ভেসে থাকা, ফুলে ফুলে ভ্রমরের গুঞ্জন, মনোহর হরেক রঙের পাখনা মেলে প্রজাপতির ওড়াউড়ি, নদীর তীরে কিংবা বিলের কিনারে মাছশিকারের জন্য একটি বকের ধ্যানীদৃষ্টিতে একনাগারে জলের দিকে তাকিয়ে থাকা, আষাঢ়ে বৃষ্টিতে ডোবায় কোলা ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডাক, রোদের ঝিলিক, শিশুর অমলিন হাসি, ছোট্ট বাছুর কিংবা ছাগলের দৌড়ঝাপ, দাম্পত্যজীবন শুরুর আগে দুটি পায়রার প্রেম নিবেদন, ঝিমধরা দুপুরে হঠাৎ ডাহুক কিংবা ঘুঘুর ডাক, আঁধারের ঘনত্ব, তারার মৌন ঝিকিমিকি, চাঁদের নির্মল আলো, নিশাচর পাখির উড়ে যাওয়া, বাদুরের পাখাঝাপটানি, ফসলকাটার সময় কৃষকের মনকাড়া গান, বাতাসে ফসলের মাঠের দোল খাওয়া, আরও কতকিছু! চোখ থাকলেই এসবের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় তার মধ্যে ডুবে যাও শের আলী গাজী! একজন নারীকে কেন তোমার সবকিছু কেড়ে নিতে দেবে?

আধাঘণ্টা পর মোসাদ্দেক ফিরে এসে বলল, হুজুর মাছধরার নৌকা প্রস্তুত

চল, বেরিয়ে পড়ি

হাঁটতে হাঁটতে গাজী নৌ-ঘাটে গেলেন নৌকায় উঠে বসলেন, মাঝিরা ছেড়ে দিলো নাও তিনি জলের কলকল শুনতে লাগলেন কিছুক্ষণ পরই নৌকা খাল থেকে মৃগীতে নামলো তারপর পাল তুলে তীর ঘেঁষে স্রোতের উজান এগোতে লাগলো এভাবে কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর মাঝিরা তীর থেকে খানিকটা সরে গিয়ে জাল ফেলতে ফেলতে নৌকা নিয়ে গেল মাঝনদী পাড় হয়ে ওপাড়ের দিকে তারপর মাস্তুল থেকে খুলে ফেললো বাদাম এবার জলে অনেকক্ষণ ভেসে থাকা দুজন জেলে জালের কোণা শক্ত করে ধরে অনুভব করছে জালে কী পরিমাণ মাছ আটকা পড়েছে মাছের আকারই বা কেমন কিছুক্ষণ হঠাৎ জেলে ছদরুদ্দিন ফিসফিস করে বলল, হুজুর, আজ মৃগীতে মাছ বেশি জালে অনেক মাছ আটকা পড়েছে জাল অনেক ভারি লাগছে আর...

শের আলী গাজী তাকালেন তার চোখের দিকে আর?

মনে হয় একটা বড়ো মাছ আটকা পড়েছে জালে খুব গোত্তা খাচ্ছে মনে হয় ছিঁড়ে ফেলবে জাল

তাই! দেখি তো?

তিনি জালের কোণার দড়ি ধরে অনুভব করার চেষ্টা করলেন হ্যাঁ সত্যিই তো কিছুক্ষণ পর পর জোরে টান মারছে জালে মাছের এই টানে অন্যরকম আনন্দ জাগে মনে তিনি ফিসফিস করে বললেন, জাল ছিঁড়ে ফেলবে না তো?

ছিঁড়তেও পারে মাছটা বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে তাড়াতাড়ি তুলে ফেলতে হবে জাল

ঠিক আছে তুলে ফেলো

তারা জাল টেনে তুলতে লাগলো সত্যি, আজ অনেক মাছ আটকা পড়েছে জালে রুই, কাতলা, চিতল, ইলিশ, আরও কতরকম মাছ! নৌকার খোল ভরে উঠছে আরও কিছুক্ষণ জাল তোলার পর দেখা মিললো সেই বড়ো মাছের বিশাল এক বোয়াল যখন গোত্তা মারে, নৌকা কাত করে ফেলে ঠেলে নিয়ে যায় উজানে চার পাঁচজনে ধরে মাছটা নৌকায় তুলতে পারে কিনা সন্দেহ ছদরুদ্দিন বলল, স্যার, এই মাছ এক্ষণি নায়ে তোলা যাবে না তাহলে ঝামেলা হবে মাছটাকে পানিতে আরও কিছুক্ষণ রেখে দুর্বল করতে হবে গোত্তা খাইয়া খাইয়া ও যখন একেবারে দুর্বল হইয়া যাইবো, তখন তুলতে হবে নায়

কীভাবে বোঝবে তোমরা মাছটা দুর্বল হয়ে পড়েছে?

ও বোঝা যাইবো জালে ওর টানের ভাব দেইখ্যাই বুঝবার পারুম হুজুর

ঠিকাছে যেভাবে ভালো হয় কর

আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক নৌকা ভেসে রইলো জলে ছদরুদ্দিন জালে টান দিয়ে ও ঢিলা করে মাছটাকে উত্তেজিত করে তোললো উত্তেজিত হয়ে লাফঝাপ দিয়ে মাছটা এক সময় সত্যি খুব দুর্বল হয়ে পড়লো ছদরুদ্দিন আস্তে আস্তে টেনে তুলতে লাগলো জাল মাছটা নৌকার কাছাকাছি আসতেই দুজন জেলেকে ছদরুদ্দিন জলে নেমে মাছটাকে জাল দিয়ে আরও পেঁচিয়ে ফেলার নির্দেশ দিলো তারপর পাঁচ ছয়জনে ধরে আস্তে আস্তে জল থেকে নায়ে তুলে আনলো মাছটা বিশাল বোয়াল তেলে পেটের কিছু ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত হলুদরঙ ধারণ করেছে চল্লিশ সেরের কম হবে না মাঝিরা আনন্দে হৈ হৈ করতে লাগলো ছদরুদ্দিন ফিসফিস করে কয়েকবার ডাকলো, হুজুর, দেখুন, কত বড়ো মাছ এত বড়ো মাছ ধরার সৌভাগ্য সবার হয় না

শের আলী গাজীর কোনো সাড়াশব্দ নেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন জলের দিকে ছদরুদ্দিন মনে মনে বলল, হঠাৎ, কোথায় হারিয়ে গেলেন, হুজুর!

কিছুক্ষণ পর তন্ময়তা ভেঙে গেল তার! মাছের দিকে তাকিয়ে তিনি ম্লান হাসলেন! এত বড়ো বোয়াল! অন্দরমহলে সামান্য কিছু দিয়ে তোমরা ভাগ করে নিয়ে যেও সব মাছ

এই বোয়ালটাও! না না হুজুর, এটা অন্দরমহলে পাঠিয়ে দেবো নে

ছদরুদ্দিনের চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি গম্ভীরকণ্ঠে বললেন, তোমরাই তো কষ্ট করে মাছটা ধরেছো এই মাছে তোমাদেরও অধিকার আছে আমি একা কেন খাবো, এত বড়ো মাছ?

আর কেউ কোনো কথা বলতে সাহস পেল না নৌকা ঘাটে গিয়ে ভিড়লো নৌকা থেকে নামার আগে ছদরুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আজ রাতে আর মাছ শিকারে যাবো না

আস্তে আস্তে অন্দরমহলের দিকে হাঁটতে লাগলেন ছদরুদ্দিন ফিসফিস করে বলল, হঠাৎ কী হইলো হুজুরের! এত বড়ো মাছ দেখারও পর তার মনে আনন্দ নাই!

নীল হীরার অঙ্গুরীয়

একটি নীল হীরার আংটির দিকে তাকিয়ে আছে পদ্মগন্ধা কী প্রগাঢ় নীল! বিশ্বের সবচেয়ে দামি পাথর এত দামি যে, তা কেনার সামর্থ তাদের নেই রমাবল্লভ নন্দীরও নেই কেবল রাজাবাদশা ও জমিদাররাই এই আংটি পরার ক্ষমতা রাখেন তাদের হাতেই এ ধরনের আংটি মানায় এ আংটি বাবা কোথায় পেলেন?

বসন্তরঞ্জন বলেন, আমাগো জমিদার সাব আইছিলেন বাড়ি তোমার বিয়ার কথা জানতে পেরে, নিজের আঙুল থেকে খুলে দিয়েছেন আংটিটি তোমার বিয়ের উপহার

জমিদার সাব দিয়েছেন! কবে আইছিলেন তিনি?

তোমার বিয়ার পরদিন সকালে

পদ্মগন্ধার বুকের ভেতর অভিমান জমে ওঠে, মনে মনে বলে, তার আসার কী দরকার ছিল? এলেনই যদি আরও কয়েকদিন আগে আসতে পারলেন না? মানুষের মন কি তিনি বুঝতে পারেন না? তাহলে জমিদারি চালান কীভাবে? তার কণ্ঠ থেকে খানিকটা ক্ষোভ ঝরে, হীরার আংটি খুবই দামি আমাদের হাতে মানাবে না, বাবা জমিদার সাবকে ফেরত দিয়ে এসো

বসন্তরঞ্জন জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলেন, বলিস কী পাগলি! উনি আমাদের মনিব খুশি হয়ে উপহার দিয়েছেন, তা কি ফেরত দেয়া যায়? এ যে ঘোরতর অন্যায় উনি রেগে যেতে পারেন ম্লেচ্ছ হোক মানুষ হিসাবে তিনি খুবই ভালো আজ পর্যন্ত কোনো প্রজার ওপর উনি জুলুম করেন নি তার কাছে কেউ নালিশ জানালে ন্যায় বিচার পায় কেউ সাহায্য চাইলেও তারে বিমুখ করেন না

তুমি কি তার কাছে সাহায্য চেয়েছিলে?

না না তা চাইবো কেন? তোমার বিয়ে হয়েছে শুনেই হাত থেকে এই অঙ্গুরীয় খুলে দিলেন

তাই! আর কিছু বললেন না?

না আর কী বলবেন? অঙ্গুরীয় দিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে চলে গেলেন অনেক দূর পথ এসে ঘোড়াটা নাকি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল তাই আমাদের বাড়ির সামনে বিশ্রাম নিয়েছিল

ওহ! ঘোড়াটির রঙ ধুসর বাদামি মুখে শাদা ছোপ আছে, তাই না, বাবা?

হ্যাঁ তুই কীভাবে জানলি?

সেদিন ওই ঘোড়াটা নিয়েই তিনি এসেছিলেন খুবই তেজী ঘোড়া

ঠিক বলেছিস খুরায় ধূলো উড়িয়ে যেভাবে ছুটে গেল, মনে হলো তুফান

কোন দিকে গেল?

গড়জরিপার দিকে

তাহলে আমাকে দেখার জন্যই সে এসেছিল আবার! পদ্মগন্ধা আরও গম্ভীর হয়ে যায় বসন্তরঞ্জন বলেন, পদ্মগন্ধা মা

বল বাবা

একটা কথা ছিল

বল

জানিসই তো তোর মা ম্লেচ্ছদের একেবারেই পছন্দ করে না এই অঙ্গুরীয়র ব্যাপারে তোর মাকে আমি কিছুই জানাইনি জানালে হয়তো তোর মা এই অঙ্গুরীয় ফেলেই দিতো যত দামিই হোক তা সে বুঝতো না গ্রামের লোকজন জানতে পারলেও নানা রকম কুকথা ছড়াতো তুই জানিসই তো কিছু লোক আছে কোনো কিছুই সহজভাবে নেয় না স্বর্ণের মধ্যেও খাদ খোঁজে

স্বর্ণে তো খাদ থাকেই, বাবা থাকে না?

তা থাকে আমি বলছিলাম কি-

ব্যাপারটা কেউ জানবে না, এই তো?

বসন্তরঞ্জন চুপ করে থাকেন পদ্মগন্ধা ম্লান হেসে বলে, ঠিকাছে বাবা, কেউ জানবে না এমনকি তোমার জামাই বাবাজিও না- এই অঙ্গুরীয় কার, কোথা থেকে এলো

আংটিটি সে রেখে দেয় লোহার সিন্ধুকের ভেতর গয়নাগাটির বাক্সে কদিনেই সে বুঝেছে রমাবল্লভ নন্দী, ও সিন্ধুক ছুঁয়েও দেখবে না কোনোদিন কোনোকিছু প্রয়োজন হলে তার কাছেই চাইবে

রমাবল্লভ অফিসে গেলে, ঘরের দরোজায় খিল এঁটে, সে সিন্ধুক থেকে অঙ্গুরীয়টা বের করে আনে বাড়িতে একজন কাজের বুয়া ছাড়া আর কেউ নেই রমাবল্লভের বাবা-মা কলকাতায় থাকেন বিয়ে উপলক্ষ্যে এসেছিলেন বিয়ের কদিন পরই চলে গেছেন কলকাতায় আবার কবে ফিরে আসেন ঠিক নেই সেখানে তাদের সংসার আছে, ব্যবসা আছে তাছাড়া অনেক দূরের পথ ইচ্ছে করলেই যখন তখন আসা যায় না সম্ভবও নয়

আংটিটি আঙুলে নাড়াচাড়া করে পদ্মগন্ধা আংটিটি উল্টেপাল্টে, ঘুরিয়েফিরিয়ে হীরার রঙটা দেখে কী সুন্দর নীল! একবার কি আঙুলে পরে দেখবো? না, আঙুলে লাগবে না বড়ো হবে পরতে হবে কাপড় পেঁচিয়ে শাড়ির আঁচলের এক কোণা একটুখানি পেঁচিয়ে অনামিকা আঙুলে পরে সে এত মোটা তার আঙুল! চোখের সামনে যেন দাঁড়ায় শের আলী গাজী সিংহের মতো বুক! বিষণ্ন হেসে আবার মিলিয়ে যায় হীরার দিকে তাকিয়ে থাকে পদ্মগন্ধা এ যেন হীরা নয় এক টুকরো বিষের দলা তুমি হৃদয় না দিয়ে আমাকে বিষ দিলে গাজী! এ বিষ আমি সারাজীবন কীভাবে আগলে রাখবো বুকের ভেতর! আমি চাষাভুষার মেয়ে আমার শরীরে রাজরক্ত নেই চৌদ্দ পুরুষের কেউ কোনোদিন হীরার আংটি পরেছে কি না জানি না তবে গল্প শুনেছি দাদির কাছে, নীল হীরার আংটি সবচেয়ে দামি রাজাবাদশা আর তাদের বউঝিরা পরেন আর পরেন বিলাসী জমিদার বাবুরা এবং তাদের বউঝিরা এ অঙ্গুরীয় আমার আঙুলে মানায় না তবু কেন দিলেন? আমি তো আংটি চাইনি মনে মনে চেয়েছিলাম হৃদয় পাইনি না কি গোপনে দিয়েছিলেন হৃদয়, আমিই বুঝতে পারিনি এই ঘর, এই সংসার ভালো লাগে না আমার রমাবল্লভ নন্দীকেও আমি স্বামী হিসাবে মেনে নিতে পারি না তবু তাকে সব সময় ভালোবাসার ভাব দেখাতে হয় মুখ বুজে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক সহ্য করতে হয় বাসররাতে প্রথমবার তার শারীরিক সম্পর্কের পীড়নে আমি চোখের জলে আপনার জন্যই বুক ভাসিয়েছি পৌরষজয়ের আনন্দে রমাবল্লভ নন্দী খুশি হলেও আমার অন্তরের অতলে একটুও স্পর্শ করতে পারেনি সেই জায়গাটা শুধু শের আলী গাজীর জন্য খালি পড়ে আছে তার জন্যই এই অন্তর বারবার হাহাকার করে ওঠে রমাবল্লভ নন্দীর সাথে আমার বিয়ে হয়েছে শুনে আপনি কি সত্যি খুশি হয়েছেন গাজী? একটুও কষ্ট পাননি? এই অঙ্গুরীয় কি আশীর্বাদের চিহ্ন নাকি আপনার অন্তরের বেদনার বিষ! আমার মতো আপনারও কি কষ্ট হয় বুকে? আপনি কি সত্যি ভালোবাসেন আমাকে? যদি সত্যি ভালোবেসে থাকেন, তাহলে কেন আমাকে জোর করে তুলে নিলেন না কাছে? সেই ক্ষমতা, সেই শক্তি ও সাহস তো আপনার ছিল তবু কেন এগিয়ে এলেন না? বিয়ের পরদিনই কেন ছুটে এলেন? ঘোড়াটাকে থামালেন আমাদের বাড়ির সামনের হালটে? ঘোড়াটাকে বিশ্রামের ছলে কি আপনি আমাকেই দেখতে এসেছিলেন? খোঁজখবর নিতে এসেছিলেন, কেমন আছি আমি? আপনার মোহে আমি ডুবে আছি কি না? প্রথমবার, সেই সাক্ষাতের পরই তো আপনি আস্তে আস্তে আমাকে মোহগ্রস্ত করে ফেলেছেন তারপর থেকে আমি আর কোনোদিকে চোখ ফেরাতে পারিনি আমার বাবা, আমার সমাজ যার সাথে আমাকে গাটছড়া বেঁধে দিয়েছে, যার সাথে আমি সংসার শুরু করেছি, সেই রমাবল্লভ নন্দী, আমার হয়েও যেন সে আমার নয়, অনেক দূরের মানুষ, অচেনা অজানা কেউ আর আপনি আমার না হয়েও, অনেক দূরের পরমানুষ হয়েও, আমার আমার জীবনের সাথে, আমার আত্মার সাথে, আমার সমস্ত অস্তিত্বের সাথে মিশে আছেন আপনি আপনি আর কোনোদিন ঘোড়া ছুটিয়ে অসবেন না আমার কাছে আপনার ঘোড়ার খুরের খটাখট শব্দ আমার বুকের ভেতর পাথরের মতো ঘাই মারে খুরে খুরে পথের ধূলো নয়, যেন আমার বুকের শোণিত ছিটিয়ে আপনি ছুটে আসছেন কিংবা ফিরে যাচ্ছেন যে পথ দিয়ে আপনি আসেন কিংবা যে পথ দিয়ে চলে যান, সেই পথ দেখুন রাঙা হয়ে উঠেছে আমার বুকের টাটকা রক্তে আমি ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না অন্তর্যাতনায় আমি জানি, এই যাতনা নিয়েই আমাকে হাসিমুখে জীবন কাটাতে হবে আপনি এখন আমার কাছাকাছি এলেও কোনো লাভ নেই আমাকে জোর করে তুলে নিলেও কোনো লাভ নেই আমি এখন পরনারী, পরস্ত্রী, আপনার নয়Ñ শুধু রমাবল্লভ নন্দীর তার বীজ আমার শরীরে ঢুকে পড়েছে আস্তে আস্তে মহিরুহ হয়ে তা এই সংসারে শেকড়বাকড় গাঁড়বে শেকড়বাকড়ে, লতায়পাতায় এই সংসারে আমি যে বাঁধা পড়ে যাচ্ছি গাজী! আপনার এই অঙ্গুরীয় আঙুলে পরে কী হবে? এ যে আমার অন্তরে বিষ ছড়াবে বিষে বিষে আমাকে নীল করে ফেলবে কেউ দেখবে না, কেউ জানবে না, জানবে শুধু ভগবান আর আমি তাই এই অঙ্গুরীয় আঙুলে আমি পরতে পারবো না যতবার পরবো, যতবার একে নেড়েচেড়ে দেখবো, ততবার আপনাকে মনে পড়বে আমার হৃদয় হাহাকার করে উঠবে আপনাকে না-পাওয়ার যন্ত্রণায় তারচেয়ে এই বিষের অঙ্গুরীয় সিন্ধুকে লুকিয়ে রাখাই কি ভালো না? যেদিন আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করবে, সেদিন খুব গোপনে সিন্ধুক থেকে বের করে নেড়েচেড়ে দেখবো, আর রক্তাক্ত হবো আপনাকে স্মরণ করে?

হাতের আঙুল থেকে হীরার আংটি খুলে সিন্ধুকে রেখে দেয় পদ্মগন্ধা তার দু চোখ ভেসে যায় জলে

আমার বধূয়া আন বাড়ি

‘মুয়ে পিছে মাত মিলো কহে কবিরা রাম

লোহা মাটি মিল গ্যায়া তব পারস কেহি কাম’

পদ্মগন্ধা, তুমি আমার কেউ না, কানুনগো রমাবল্লভ নন্দীর স্ত্রী তবু আমি তোমাকেই কেন ভালোবেসে যাই! তোমার জন্য কেনইবা নির্ঘুম রাত কাটাই! আমি তো ডুবে থাকতে চাই শায়েরে, মাছশিকারে, প্রকৃতির রূপদর্শনে, সংসার আর জমিদারি কাজে কিন্তু এখন এসব আমার ভালো লাগে না এসবের কোথাও আমি মন বসাতে পারছি না তবে শায়ের আমাকে এখনো কাছে টানে কোনো কোনো শায়েরের প্রতিটি শব্দ আমার বুকের ভেতর জিয়লমাছের কাটার মতোই ঘাই মারে আমার চোখের ভেতর ঢুকে যায় প্রতিটি শব্দের ধারালো ফলা শায়েরের মর্মার্থ আমাকে হতচকিত করে তীরের ফলার মতো আমার আত্মার ভেতরে ঢুকে যায় আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখে বেদনার সাগরপাড়ে প্রতিনিয়ত ঢেউয়ের গর্জন আমাকে ক্লান্ত করে ফেলে সাগরের জল আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কূলহীন, ঠিকানাবিহীন গন্তব্যে কোথাও দেখি না আশার সবুজ দ্বীপ, স্বপ্নের বন্দর, পণ্যের পসরা সাজানো সুন্দর শহর এ কোন দুঃখের অতল, কূলহীন জলরাশির মধ্যে আমি নিপতিত হলাম! এখান থেকে সাঁতরে কিছুতেই আমি ডাঙায় উঠতে পারছি না কাছে-ধারে কোথাও দেখছি না উদ্ধারকারী জাহাজ, যে আমাকে এখান থেকে তুলে নিয়ে জীবন বাঁচাবে, পৌঁছে দেবে আমার বাড়ির আঙিনায় যেখানে দুঃখ নেই, ক্লেদ নেই, বিষাদ নেই পদ্মগন্ধা, আমার সংসার, আমার সমাজ তোমাকে কখনো চায়নি, চাইবেও না কোনোদিন কিন্তু আমার এই দেহ, দেহের ভেতর এই প্রাণ তোমাকে চায় মনে হয়, তুমি ছাড়া এ জীবন নিতান্তই অর্থহীন কী হবে এই সমাজ দিয়ে, সংসার দিয়ে, অঢেল বিত্তবৈভব দিয়ে, যদি এই দেহ, এই আত্মা অতৃপ্ত থাকে? কবীর তো ঠিকই বলেছেন, লোহা ক্ষয়ে ক্ষয়ে মাটিতে মিশে গেলে পরশপাথর দিয়ে কী হবে? লোহার অস্তিত্ব না থাকলে পরশপাথর অযথা ঘষলে তো আর সোনা হবে না? পদ্মগন্ধা, জীবদ্দশায় তোমাকে না পেলে মরার পরে তোমাকে পাবো, এ আশা মোটেও আমি করি না আমার যৌবন থাকতে আমি তোমাকে পেতে চাই ভালোবাসতে চাই তৃপ্ত হতে চাই আমার কামনা-বাসনায় এতদিন আমি শুধু নিজের সাথে নিজে বোঝাপড়া করেছি আমার পরিবার, আমার সমাজ আর আমার ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠতে পারিনি আজ আমি এ সবের মধ্যে থেকেও মুক্ত আজ আমি তোমার জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে পারি তোমার জন্য যেকোনো সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারি আমি বেঁচে থাকতে তুমি কেন একজন কানুনগোর ঘর করবে পদ্মগন্ধা? তুমি চাইলে আমি তোমাকে নিয়ে আসতে পারি যেকোনো সময়, যেকোনো মূল্যে কোনোকিছুই এখন আমি পরোয়া করি না আমি শুধু জানতে চাই, বুঝতে চাই, তুমি আমাকে ভালোবাসো কি না? নাকি অযথাই আমি এক মরীচিকার পেছনে ছুটছি! ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হচ্ছি, আরও বেশি পিপাসার্ত হচ্ছি কিন্তু কোথাও জলের দেখা পাচ্ছি না? নাকি ধু ধু মরুভূমিতে মরূদ্যানের স্বপ্ন দেখছি? আমি শুধু সত্যটা জানতে চাই, তুমি আমাকে ভালোবাসো কি না যদি বাসো, আমি সবকিছু উলটপালট করে দেবো হ্যাঁ, আমি, কাল সকালেই ছুটে যাবো কানুনগো পাড়ায়; শুধু তোমাকে দেখার ছলে মোসাদ্দেক আমাকে তথ্য দিয়েছে, কানুনগো অফিসের কাছেই তোমার বাড়ি আমি তার পাশ দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে যাওয়া-আসা করবো তুমি কি উঁকি দিয়ে দেখবে না আমাকে? ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে আসবে না রাস্তায়? না কি পিপাসার্ত আমি তোমার বাড়ির আঙিনায় গিয়ে জলের খোঁজ করবো- বাড়িতে কেউ আছেন? সেই আগের মতো? তারপর জলের গ্লাস হাতে জলখাবার নিয়ে তুমি ছুটে আসবে কাছে? তোমার সিঁথিতে থাকবে রক্তরাঙা সিঁদুর! পরনে লাল টুকটুকে শাড়ি! কপালে বড়ো লাল টিপ! চিবুকে কালো তিল! কানে ঝুমকা রক্তরাঙা ঠোঁট! আলতারাঙা চরণ যুগল! দু পায়ে মল! গায়ে উজ্জ্বল দ্যুতি! আমার মনপ্রাণ দিয়ে তোমাকে চাই তুমি কি আমাকে ফিরিয়ে দেবে, অত্যন্ত বিনয়ের সুরে বলবে, আর আসবেন না, লোকে মন্দ বলবে? জল পান না করে বুকের ভেতর জলের অনন্ত তৃষ্ণা নিয়েই আমি ফিরে আসবো গড়জরিপায়? তা হবে না, পদ্মগন্ধা তুমি আমার মনের আরাধ্য দেবী আমার সমস্ত প্রেম দিয়ে তোমাকে আমি জয় করতে চাই তোমাকে দেখে জুড়াতে চাই এই পোড়া চোখ রাতে ঘুমাতে পারলেন না শের আলী গাজী মনের ভেতর অস্থিরতা কাল আমি কানুনগো পাড়ায় যাবো তোমার সাথে আবার দেখা হবে আমার

সকাল হতে না হতেই হামজাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে ছুটছে হামজা ক্রমশ তপ্ত হয়ে ওঠা রোদে পুড়ে ঘেমে উঠছেন শের আলী গাজী তবু ঘোড়াটিকে কোথাও থামাচ্ছেন না নিজেও বিশ্রামের কথা একবারও ভাবছেন না আগে কানুনগো অফিস, তারপর বিশ্রাম

ফুরিয়ে আসছে পথ, নিকটবর্তী হচ্ছে কানুনগো অফিস রমাবল্লভ নন্দীর ওপর কেন তার এত রাগ হচ্ছে? ওর কোনো দোষ নেই সুন্দর পাত্রী দেখলে বিয়ে তো সে করতেই পারে কিন্তু অফিসের যত কাছাকাছি আসছে, ততই তার মনে হচ্ছে রমাবল্লভ নন্দী তার প্রতিদ্বন্দ্বী সে তার প্রিয়তমা পদ্মগন্ধাকে কেড়ে নিয়েছে তার জমিদারিতে বাস করে তাকেই পরিহাস করছে অফিসে রমাবল্লভ নন্দীকে দেখলে তিনি তাকে সহ্য করতে পারবেন তো? তাকে কেন তার খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে ইশ! দাউদ (আ.) নবীর মতো রমাবল্লভ নন্দীকে যদি আমি যুদ্ধে পাঠিয়ে দিতে পারতাম, যে যুদ্ধে গেলে নিশ্চিত তার মৃত্যু হতো

অফিস প্রাঙ্গনে ঢুকে পড়লো হামজা শের আলী গাজী ঘোড়া থামিয়ে নেমে পড়লেন অফিসে আরও দুজন কর্মচারী আছে জমিদারের ঘোড়া দেখেই তারা ছুটে এলো, হুজুর, আপনি! আসুন, বসুন

ঘোড়াটাকে একটা আমগাছের সাথে বাঁধতে বাঁধতে তিনি তাকালেন তাদের দিকে তারা জড়োসড়ো রমাবল্লভ নন্দীর ওপর তার ভীষণ ক্ষোভ ক্ষোভটাকে চাপা দিয়ে নিজের কণ্ঠস্বর সংযত করে বললেন, রমাবল্লভ কোথায়?

তিনি তো আজ সকালে মুর্শিদাবাদের পথে রওয়ানা হয়েছেন ফিরতে কদিন দেরি হবে

রাগটা দপ করে নিভে গেল যেন যাক, ভালো হয়েছে তবে সে থাকলেও তার ওপর রাগ করা উচিত হবে না তাকে কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না, পদ্মগন্ধার জন্য তার বুকের ভেতর রয়েছে অনন্ত তিয়াস দাউ দাউ করে জ¦লছে আগুন বিষয়টি তার কাছে চিরকাল গোপনই থাক

একজন কর্মচারী বলল, হুজুর, ভেতরে এসে বসুন কতদূর পথ ছুটে এসেছেন, একটু জলখাবারের ব্যবস্থা করি

এখানে জলখাবার কোথায় পাবে তোমরা?

গাছে ডাব আছে সাথে...

থাক দরকার নেই

রমাবল্লভ যেহেতু ভেতরে নেই, আমি আর ভেতরে গিয়ে বসবো না এই এলাকা কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখবো তারপর ফিরে যাবো গড়জরিপায়

আপনার যেমন ইচ্ছে হুজুর ভালো থাকুন কোনো কিছু দরকার পড়লে আমাদের জানাবেন আপনার সেবা করতে পারলে আমরা ধন্য হবো

আল্লাহ তোমাদের মঙ্গল করুন

আবার ঘোড়ায় চেপে বসলেন শের আলী গাজী অফিসে থেকে একটু দূরে ওই যে পাচিল ঘেরা একতলা পাকা বাড়ি, ঘন গাছপালা আর পত্রপল্লবে ঢাকা, ওই বাড়িতেই থাকে পদ্মগন্ধা! রমাবল্লভ নেই, সে কি বাড়িতেই আছে? নাকি চলে গেছে বাপের বাড়িÑ দর্শাগ্রামে?

ওই বাড়ির পাশ দিয়েই পূর্ব দিকে চলে গেছে পথ, বেশ খানিকটা দূর তারপর তাড়াই নদীর পাশ দিয়ে দক্ষিণ দিকে দূরের গ্রামে গিয়ে মিশেছে শের আলী গাজীর মন বলছে, পদ্মগন্ধা আছে আর যদি সে থাকে, তার ঘোড়ার খুরের শব্দ সে শুনতে পাবে

তার বাড়ির পাশ দিয়েই ছুটিয়ে দিলেন ঘোড়া তাড়াই নদীর দিকে বাড়ির দিকে তাকালেন না, জানালা দুটোই বন্ধ তাহলে পদ্মগন্ধা কি নেই! মনটা ভার হয়ে গেল কিন্তু তার মন বারবার কেন বলছে, পদ্মগন্ধা আছে? তাড়াই নদী পর্যন্ত গিয়ে আবার তিনি ফিরে এলেন বাড়ির সামনে আসতেই হঠাৎ ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলেন চিঁহি চিঁহি করে উঠল হামজা তারপর থামলো তিনি আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, জানালার একটি পাল্লা খোলা ও পাশে দুটি কাজল কালো তৃষ্ণার্ত চোখ! পদ্মগন্ধা তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে এখন তিনি কী করবেন? হামজার ওপর থেকে নেমে কোনো উছিলায় ঢুকে পড়বেন বাড়ির ভেতর? না, তা ঠিক হবে না যদি বাড়িতে আর কেউ না থাকে!

তিনি আবার ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন তাড়াই নদীর দিকে সেখান থেকে আবার ফিরে এলেন রমাবল্লভের বাড়ির সামনে দেখলেন পদ্মগন্ধা জানালার পাশে একইভাবে দাঁড়িয়ে আবার তিনি ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন তাড়াই নদীর দিকে আবার ফিরে এলেন দ্রুততম সময়ে এভাবে সাতবার চক্কর দেয়ার পর তিনি দেখতে পেলেন পাচিলের দরোজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মগন্ধা তিনি ঘোড়া থেকে নেমে এগিয়ে গেলেন দরোজার কাছে দেখলেন, তিনি যেমন চেয়েছিলেন, তেমনই সাজে দাঁড়িয়ে পদ্মবতী ফিসফিস করে সে বলল, আজও কি জলের ছলে এসেছেন?

জল খেতেই আসি কিন্তু বুকে অনন্ত তৃষ্ণা নিয়ে ফিরে যাই

আরেকজনের তৃষ্ণা যে জাগিয়ে যান সে খবর কি রাখেন?

না সেটা জানার জন্যই তো এতদূরে বারবার ছুটে আসি

এখন জানলেই বা কী আর না জানলেই বা কী? সে তো অন্যের হয়ে গেছে

পদ্মগন্ধা, আমি তোমাকে নিয়ে যেতে চাই গড়জরিপায় তুমি যাবে?

আগে কেন বলেননি?

বুঝতে পারিনি

নারীর মন বোঝেন না, তাহলে জলের খোঁজে আসেন কেন?

আসলে আমি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম তুমি কেন বলোনি পদ্মা?

আমিও দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম তাছাড়া সাহস পাইনি আপনি জমিদার আমি সাধারণ প্রজা এখন পরস্ত্রী

তাতে কী! তুমি চাইলে যেকোনো দিন...

না এখন তা সম্ভব নয়

কেন সম্ভব নয়? এখন তো আমি তোমার জন্য সব বন্ধন ছিন্ন করতে পারি

কিন্তু আমি তো পারি না

কেন পারো না পদ্মা? আমি তো নিজের সঙ্গে অনেক বোঝাপড়া করেই এসেছি

এই বোঝাপড়াটা আরও আগে কেন করলেন না? আমি তো আপনার অপেক্ষায় ছিলাম

তার চোখে টলমল করতে লাগলো জল কান্না দমিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা তার! শের আলী গাজী বললেন, আমি জানতাম না, এত তাড়াতাড়ি তোমার বিয়ে হয়ে যাবে আমি চেয়েছিলাম তোমার সাথে আমার আরেকটু বোঝাপড়া হোক

কিন্তু বুঝতে বুঝতেই দেরি হয়ে গেছে এখন কিছু করার নেই এটা ভাগ্য ভাগ্যকে মেনে নিতেই হবে

কিন্তু আমি যে মানতে পারছি না আমি তোমাকে চাই যেকোনোভাবে পেতে চাই, পদ্মা

পদ্মগন্ধা বলতে চায়, আর কীভাবে পাবেন? আমার শরীরে এখন রামবল্লভের বীজ আমি, আমি আসলে মা হতে চলেছি কিন্তু সে বলতে পারে না চুপ করে থাকে

শের আলী গাজী বলেন, আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্যই অপেক্ষা করবো, যতদিন আমি বেঁচে থাকি, ততদিন

আমার বাবা আসবেন আজ আমি নাইয়র যাবো আপনি আর জলের ছলে আমাকে দেখতে আসবেন না একদিন, দুদিন, তিনদিন, তারপর লোকে সন্দেহ করবে মন্দ বলবে হয়তো আপনার কিছু হবে না আপনি জমিদার কিন্তু আমরা আপনার সাধারণ প্রজা লোকের কুকথা আমাদের শুনতে হবে, যা সহ্য করা কঠিন

কুমানুষের কুকথা রাজা-বাদশাকেও নিচে নামিয়ে ফেলে আর আমি তো সামান্য জমিদার নিশ্চয় আমিও বাদ যাবো না তবু আমি এসব এখন পরোয়া করি না যাক বাদ দাও এসব কথা

আপনি সামান্য নয়, অনেক বড়ো জমিদার দশকাহনিয়ার স্বাধীন রাজা তাছাড়া ঘরে আপনার সুন্দরী, বিদুষী স্ত্রী আছেন

তুমি চাইলে তাকে আমি ত্যাগ করবো

না, তা হয় না আমার জন্য আরেকজন নিষ্পাপ নারী কেন কষ্ট পাবেন? তাছাড়া আজ আমার প্রতি আপনার মোহ আছে আগামী কাল নাও থাকতে পারে তখন আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো? কে আমাকে গ্রহণকরবে? এই রমাবল্লভ নন্দী না, আমার বাবা-মা না আমার ধর্ম, আমার সমাজÑ কেউ না, সবাই আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে একবার ভাবুন আমার কথা

পদ্মগন্ধা, আমি শুধু তোমার তোমাকে নিয়েই থাকতে চাই আর কিছু ভাবতে চাই না

না না, তা হতে পারে না আপনি চলে যান

ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি তবে আমাকে যে আসতেই হবে তোমাকে দেখার জন্য তোমাকে ছাড়া আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না আমার সঙ্গে যেতে না পারো, আমার সঙ্গে দেখা করতে না পারো, আমার ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনলে শুধু তোমার জানালাটা একটু খুলে দাঁড়িয়ে থেকো আমি দূর থেকে তোমাকে একনজর দেখেই অন্তরের তিয়াস মেটাবো তারপর চলে যাবো

পদ্মগন্ধা হু হু করে উঠল আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না সে ঘরের ভেতর ঢুকে দরোজা বন্ধ করে দিলো শের আলী গাজী উঠে বসলেন হামজার ওপর কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন পাঁচিলঘেরা একতলা বাড়িটার দিকে একটি নিঃসঙ্গ ডাহুকী চলে গেল ঝোপের আড়ালে গাঢ় একটা নিঃশ^াস বেরিয়ে এল ভেতর থেকে

ও মন খোঁজো তুমি যাকে

তোমার সকল হরণ করে

বধূয়া আজ আনবাড়ি থাকে

বিষণ্ন মনে ছুটে চললেন তিনি গড়জরিপার দিকে মনে মনে বললেন, তুমি কি আমাকে বিশ^াস কর না? তুমি কি সত্যি আমাকে বিশ^াস কর না, পদ্মগন্ধা! আমি তো শুধু তোমার জন্যই এতদুর ছুটে আসি তোমাকে দেখার জন্য এ প্রাণ কত যে আনচান করে, তা কিছুতেই বোঝাতে পারবো না আর কী হলে তুমি আমাকে বিশ^াস করবে, পদ্মগন্ধা?

‘যদি সে হইতো কালি, কলমে লইতাম তুলি

কলিজা ছিঁড়িয়া নামটি লিখি

পদ্মগন্ধার কথা

খিড়কির দরোজা খুললে গড়জরিপার সড়ক দেখা যায় সেদিকে তাকিয়ে আছে পদ্মগন্ধা শের আলী গাজী চলে যাচ্ছেন ধূলো উড়িয়ে অনেকটা পথ দূরে চলে গেছেন অত দূর থেকে ঘোড়ার খুরের শব্দ কানে এসে পৌঁছার কথা নয় কিন্তু পদ্মগন্ধার কেন মনে হচ্ছে ওই শব্দ এখনো তার কানে এসে অবিরাম বাজছেÑ থকথক পদ্মগন্ধা তাকিয়ে থাকে যতক্ষণ না তার ঘোড়াটি গ্রামের গাছপালার আড়াল হয় চলে যাও আর এসো না তারপর চোখের জলে গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে:

তুমি কতদূর আর যাবে, পথিক, কতদূর আর যাবে?

আমার হৃদয় পথে গেছ তুমি চরণচিহ্ন রেখে

দূরে গেলেই হয় কি দূরে যাওয়া?

তোমার ছায়াখানি ছুঁয়ে আছে আমার ঘরের দাওয়া

দখিন থেকে উঠে আসছে হাওয়া

কাঁপিয়ে দিচ্ছে গোলাপগাছের ডাল

কাঁটায় কাঁটায় গেঁথে গেছ স্মৃতির ছেঁড়া পাল

দুঃখদিনের গহনপথে আঁধার গেছে ঢেকে

তারই ভাবে, তারই রঙে, আমাকে রাঙাবে

তুমি কতদূর আর যাবে, পথিক, কতদূর আর যাবে?

না, বেশি দূর তুমি যেতে পারবে না গাজী আমার প্রতিটি নিঃশ^াস-প্রশ^াসে তোমাকে আমি অনুভব করি তুমি আছো আমার কল্পনায়, আমার স্বপ্নে আমার আত্মা, আমার শরীর ও মনের গহনপুরে তুমি হিরোকোজ্জ্বল দ্যুতি ছড়িয়ে বসে আছো আমার অন্তর্ভূমির অনেক গভীরে তোমাকে পাওয়া, না-পাওয়ার, কামনা-বাসনা ও বিচ্ছেদের শেকড় গ্রোথিত হয়ে আমাকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে বাঁচিয়ে রাখে এ শেকড় উপড়ে ফেললে আমি শূন্য হয়ে যাবো আমি নিঃশেষ হয়ে যাবো তখন কী নিয়ে বেঁচে থাকবো গাজী? আমি হয়তো ওই গোলাপগাছের মতো তুমি কাঁটা হয়ে বিঁধে আছো আমার শরীরে সব যন্ত্রণা হজম করে, শরীরের সব সুধা নিংড়ে একটি গোলাপ ফোঁটার মিথ্যে স্বপ্নে নিয়ে আমি বেঁচে আছি ইশ! আজ তাকে একবারও জল সাধা হয়নি নিশ্চয় খুব তৃষ্ণার্ত ছিল কতদূর পথ ছুটে এসেছে, আবার এই প্রখর রোদে পুড়ে ছুটে যাচ্ছে কত দূরের পথ নিশ্চয় কোথাও কিছু খায়নি, হয়তো খাবেও না তৃষ্ণায় ক্লান্ত হয়ে পড়বে গাজী পড়ুক তাতে আমার কী আসে যায়! কোনোদিন আমার জল সে পান করতে পেরেছে? অথচ সে জলের খোঁজেই আসে মাথার ওপর দিয়ে একটি চাতক ডেকে ডেকে উড়ে যাচ্ছে কোথায়? জলের খোঁজে?

জলছত্রে জল রেখে ও চাতক কোথায় তুমি ওড়ো?

এত জলের মাঝে থেকেও জলের তৃষ্ণায় মরো!

আমি কি আর হতে পারি ঘন মেঘের বারি?

তবে তৃষ্ণার আগুনে পোড়াও কেন এই অবলা নারী?

গাজী, গড়জরিপায় মতো জল থাকতে, চাতকের মতো জলের খোঁজে কেন তুমি আমার কাছেই আসো? আর কোথাও যেতে পারো না? তোমার তৃষ্ণার আগুনে পুড়িয়ে আমাকে কেন নিঃশেষ কর কষ্ট দাও দেখো, এই যে আমি যে ঘরে আছি, সেই ঘরে নেই সবাই দেখে আমার সুন্দর ঘর আছে, সুযোগ্য স্বামী আছে তবু ঘরহীন পর মানুষ আমি নদীর ঘাটে তোমাকে প্রথম দেখে আমি ভয় পেয়েছিলাম, নাকি হঠাৎ আমার সামনে এমন সুদর্শন একজন রাজপুরুষ দেখে অধিকতর বিস্মিত হয়েছিলাম, মনে পড়ে না তো ভয় ও বিস্ময় দুটিকেই আমি গুলিয়ে ফেলেছি বাড়ি ফিরে তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি স্বপ্নে-দুঃস্বপ্নে কেটে গেছে কত রাত তোমাকে দেখার তীব্র বাসনা জেগে উঠেছিল মনে জানো, গোপনে মন্দিরে গিয়ে আমি একদিন পূজোও দিয়েছি কায়মনবাক্যে বলেছি, ঠাকুর, এই রাজপুরুষের সাথে তুমি আমার জোড় বেঁধে দাও জীবনে আর কিছু চাই না শুধু তাকে চাই তুমি জানো না, কতরাত নির্ঘুম প্রার্থনায় কাটিয়ে সেদিন বাড়ির আঙিনায় তোমাকে দেখেছিলাম দেখে এতই বিস্মিত হয়েছিলাম যে প্রথমে আমি বিশ^াসই করতে পারিনি, তুমি দাঁড়িয়ে আছো মনে মনে খুব খুশি হয়েছিলাম, প্রজাপতির মতো ওড়ছিলাম আর ঠাকুরের কাছে মনে মনে বলছিলাম, তুমি আমার ডাকে সাড়া দিয়েছ এই অভাগীর দিকে মুখ তুলে চেয়েছ ঠাকুর এ কারণেই সে গড়জরিপা থেকে ছুটে এসেছে আমার বাড়ির আঙিনায় তাছাড়া আশপাশে তো কত বাড়ি ছিল সেখানে সে গেল না কেন? তোমার কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আমার তারপর আমার মনের বিশ^াস আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে, তোমাকে আমি পাবো আমার সমাজের বাধা, ধর্মের বাধা, ধনী-গরীবের বাধা, সব বাধাকে তুচ্ছ করে তুমি আমাকে নিয়ে যাবে বীরের মতো কিন্তু তখনো আমি বুঝিনি, এটা ছিল ঠাকুরের পরিহাস তা না হলে সেদিনই কেন বাবা-মা পাত্র দেখে পাকা কথা বলে আসবে? আর কদিনের মধ্যে কী তড়িঘড়ি করে বিয়ের আয়োজন! আমি যদি জানতাম, গাজী, তুমি আমাকে সত্যি ভালোবাসো, তাহলে সব বন্ধন ছিন্ন করে আমি পালিয়ে যেতাম গড়জরিপায় বিয়ের দিনও আমার ইচ্ছে হয়েছিল, পালিয়ে যাই, পাত্র যতই যোগ্য হোক, আমার তো তাকে মনে ধরেনি, আমি তাকে চাই না কিন্তু এখান থেকে পালিয়ে যাবো কোন ভরসায়? কেন যাবো, কার জন্যই বা যাবো? অকূলপাথারে পড়ে গেলে মানুষ বাঁচার জন্য একটু খড়কুটো চায়, আমার তো তাও নেই পালিয়ে গড়জরিপায় গেলে গাজী কি আমাকে গ্রহণ করবে? সে তো বলেনি, আমাকে ভালোবাসে যদি ব্যাপারটা নিতান্তই হাস্যকর হয়ে যায়, তাহলে, লোকে কী বলবে? আমি কি আর কোনোদিনও ফিরে আসতে পারবো আমার বাবা-মায়ের কাছে? এই সমাজে? এই ধর্মে? তাই সবকিছু মুখ বুজে সয়ে বিষের বড়ি আমি গিলে খেয়েছি গাজী ভেবেছি, হয় তিলে তিলে মরে যাবো, না হয় বিষ হজম করে বেঁচে থাকবো আমি বেঁচে থাকতে চাই এই পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ আমি পেতে চাই তাই সেই বিষজ¦ালা আমি আস্তে আস্তে সয়ে নিচ্ছিলাম শরীরে, মনে ভেবেছিলাম, তোমার সাথে আমার যা কিছুই ঘটুক, তা ছিল একটা দুঃস্বপ্ন তুমি নয়, আমিই মনে মনে তোমাকে ভালোবেসেছি তোমাকে পেতে চেয়ে নিঃস্ব হয়েছি মেনে নিয়েছি, রাজায়-প্রজায় এ সম্পর্ক হয় না তাছাড়া, ধর্মের বাধায়, সমাজের বাধায় আটকে যাবেই রমাবল্লভ নন্দীর সংসারে যখন আমি বটবৃক্ষের মতো আটকে থাকার আয়োজন করছি, তখনই, আজ এসে তুমি বললে, ভালোবাসি! এখন আমার ভেতর মৃগী নদীর উথালপাথাল ঢেউ এই ঢেউয়ের চোটে আমি ভেসে যাবো দূরে, নাকি ডুবে মরবো মাঝ নদীতে, ভেসে ভেসে কোনো দিন কি কোথাও কিনার পাবো, জানি না এখান থেকে আমাকে উদ্ধার করবে কে? কে হবে কাণ্ডারি আমার? গাজী, আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না চোখে অন্ধকার দেখছি তুমি আর এসো না দর্শা গ্রামে কিংবা দশকাহনিয়ার এই কানুনগো এলাকায় তোমাকে দেখতে না পেলে আমি হয়তো আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবো তুমি এসে আমাকে আর এলোমেলো করে দিও না রমাবল্লভ নন্দী, জমিদার নয় বটে, কিন্তু মানুষ হিসাবে সে একেবারে খারাপ নয় আমাকে ভালোবাসে কি না জানি না, তবে অবহেলা করে না কোনো কষ্টও দেয় না আমার কাছে সাজানো পরিপাটি একটি সংসার চায় আমি তাকে তা দিতে পারবো কি না জানি না তবে চেষ্টা করবো, নিশ্চয় চেষ্টা করবো তাকে মন দিতে না পারলে শরীর তো দেয়া যায়ই, হয়তো এটুকুই সে চায়, এটুকু তো তার প্রাপ্যই, তাই না? মনের খোঁজ সে রাখে না তোমার মতো চোখে চোখ রেখে সে সবকিছু গোপনে হরণ করতে পারে না সর্বনাশ করতে পারে না দিনদুপুরে খুন করতে পারে না শুধু শরীরের এটুকু দিয়ে একটি মানুষকে সুখী করতে কেনই-বা আমি কার্পণ্য করবো? মনটা আমার লুকানো থাক অতল গহীনে, তার খোঁজ আর করো না, গাজী এই মনের খোঁজ রমাবল্লভ নন্দীও না পাক কোনোদিন তাহলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে

খিড়কির দ্বার বন্ধ করে পদ্মগন্ধা তাকায় আকাশে শাদা শাদা পেজো তুলোর মতো কিছু মেঘ একটি নিঃসঙ্গ চিল বাড়িটির ওপরে পাখা মেলে ভেসে বেড়াচ্ছে বারবার করুণ সুরে কেন ও ডাকছে? ও কি ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর? নাকি হারিয়ে ফেলেছে ওর সঙ্গী? ওই চিলটির মতো এ বাড়িটিও নিঃসঙ্গ আশপাশের বাড়ি থেকে একটু ফাঁকা জায়গায় রমাবল্লভ না থাকলে, বাড়িটি আরও বেশি নিঃসঙ্গ লাগে দম বন্ধ হয়ে আসে রমাবল্লভ ফিরে আসতে দিন পনেরো তো লাগবেই এ কদিন সে বাবার বাড়ি থাকবে বসন্তরঞ্জনকে খবর পাঠানো হয়েছে একটি শকট ভাড়া করে নিয়ে আসার কথা শকট থাকলে বাড়ি যেতে আর কতক্ষণই বা লাগবে সে বাবার বাড়ি যাবে বলে কাজের মেয়েটাও আজ নেই সকালেই বাড়ি চলে গেছে একা একা আর ভালো লাগছে না চিলটি এখনো উড়ে উড়ে ডাকছে করুণ সুরে শের আলী গাজীর মুখ তার মনে পড়লো এতক্ষণে নিশ্চয় সে পৌঁছে গেছে গড়জরিপায় এখন সেখানে কী করছে সে? আজকে নিষেধ করার পরও সে কি আবার আসবে এখানে, তাকে দেখার ছলে অন্য কোনো কাজে? আসতে পারে, না-ও পারে যদি আসে, আর সড়ক থেকে তার ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়, তাহলে কী করবে পদ্মগন্ধা? সে কি দরোজা-জানালা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে বসে থাকবে? না কি জানালা খুলে তাকে দেখবে? তারপর দরোজা খুলে বাইরে গিয়ে পাঁচিলের পাশে দাঁড়িয়ে দেখা করবে তার সাথে? এ মুহূর্তে কেন তার কথা এত মনে পড়ছে? ঘোড়ার খুরের শব্দ কেন কানে এসে বাজছে? তার ঘোড়া এবং তার ছায়াতো আশপাশে কোথাও নেই তাহলে কেন তার এত বিভ্রম হচ্ছে? কেন বার বার মনের কোণে ভেসে উঠছে শের আলী গাজীর বিষণ্ন মুখ? তাকে বারবার দেখতে ইচ্ছে করছে ‘তোমারে না দেখলে আমার ঘরে রয় না মন’ আমার তো যেতে ইচ্ছে করে কিন্তু কীভাবে যাবো? ‘বিধি যদি দিতো পাখা যাইতাম উড়িয়া’ কিন্তু বিধি তো আমাকে পাখা দেয়নি, দেবেও না কোনোদিন মনের পাখা দিছে সেই পাখা আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে গড়জরিপায় নিজেকে কিছুতেই আটকে রাখতে পারছি না এই ঘরে আমার জাতকূলমান সব যাবে তারচেয়ে সে যদি হইতো জংলার পাখি! কাকাতুয়া কিংবা ময়না! ফুড়ুত করে উড়ে এসে বসতো বৃক্ষের ডালে আমি তাকে ধরে এনে পুষে রাখতাম খাঁচায় সকাল-বিকাল সে আমার নাম ধরে ডাকতোÑ পদ্মগন্ধা! ও পদ্মগন্ধা! কেমন আছো? আমি তো ভালো নেই পাখি জানো না, তোমাকে ছাড়া কখনো ভালো থাকতে পারবো না আমি একদিন হয়তো কোথাও কেউ গেয়ে উঠবেÑ

‘শ্যাম যদি হইতো পোষা পাখি, প্রাণ সখি

রাখিয়া হৃদয় পিঞ্জরে পুষিতাম যত্ন করে

এ জনমের মতো হইতাম সুখি

আমার কপালে সেই সুখ নেই পদ্মগন্ধার চোখ ভিজে ওঠে তুমি আবার এসো শের আলী গাজী আমি নিষেধ করেছি বলে অভিমান করে গড়জরিপায় চিরকাল বসে থেকো না তুমি তো জানো না, নারীরা বাইরে যতই ‘না’ বলে, ভেতর থেকে তারও অধিক ‘হ্যাঁ’ বলে তুমি এসো তোমার তেজী ঘোড়া ছুটিয়ে অহর্নিশি আমি তোমার ঘোড়ার খুরের শব্দের অপেক্ষায় কান পেতে থাকবো

শের আলী গাজী কথন

‘হায় বধুয়া! দাও পেয়ালা ঢালো শারাব মধুক্ষরা

সহজ ছিল পথটি প্রেমের দেখছি এখন কাঁটা ভরা

ভেবেছিলাম ভোর বাতাসে কস্তুরী বায় আসবে ভেসে

বধুর চিকন চিকুর হতে, কলজে হলো ঘায়েল শেষে’

হায় হাফিজ! আপনারও তাহলে প্রেমিকা ছিল! আপনার মর্মমূলেও সে রমণী আঘাত করেছিল তা না হলে এমন কবিতা আপনি লিখতে পারতেন না পৃথিবীর সব সুন্দরী রমণী কি পদ্মগন্ধার মতোই? যে শুধু আঘাত করতেই জানে, ভালোবাসতে জানে না হৃদয় হরণ করতে জানে, হৃদয় দিতে জানে না নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করতে পারে, ব্যথার উপশম দিতে পারে না কাছে টানতে পারে, ধরে রাখতে পারে না তারা রূপের অনল জ¦ালিয়ে রেখে মনে মনে বলে, এসো হে নির্বোধ পতঙ্গ অন্ধ উন্মাদের মতো এখানে ঝাপ দাও তোমার দেহ ভষ্ম করেই আমি আনন্দ পাই সুখ পাই এসো, আমার এখানে আত্মাহুতী দিয়ে তুমি প্রমাণ কর যে, তুমি আমাকে ভালোবাসো প্রকৃত প্রেমিকরা বোধ হয় এমন বোকাই হয়! তারা বাঁচা-মরার আশা করে না হিতাহিত জ্ঞান লোভ পায় তাদের সৌন্দর্যে অন্ধ হয়ে ঝাপিয়ে পড়ে, ছাই হয়ে যায়, নিঃশেষ হয়ে যায় বাস্তবিক হিসাবনিকাশ তারা করতে পারে না

প্রথম দর্শনেই পদ্মগন্ধাকে আমার ভালো লেগেছিল আমি ভেবেছিলাম, ধর্মের বাধা উপেক্ষা করে, সমাজের বাধা উপেক্ষা করে তাকে আমি অন্তর দিয়ে ভালোবাসবো স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে গ্রহণ করবো এই গড়জরিপায় সে হবে আমার আঁধার ঘরের আলো ফাতেমার মতো সে শুধু ধর্মকর্ম নিয়েই ঘরের এক কোণে পড়ে থাকবে না আমার মন বোঝবে, ভালোবাসবে আমার অভাব ও চাহিদাগুলো উপলব্ধি করবে বিপদে সঙ্গ দেবে দুঃখ এলে ভাগ করে নেবে বুকে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলবে, ভেঙে পড়ো না, সব ঠিক হয়ে যাবে তার মায়াবী চোখ দেখে, ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে নিমেষে দূর হয়ে যাবে আমার অন্তরের যাতনা

ফাতেমা তো আমার সাথে কোথাও বের হয় না আমি ভেবেছিলাম, পদ্মগন্ধাকে নিয়ে শকটে চড়ে বাইরে যাবো গ্রামের পর গ্রাম দেখবো, ফসলের মাঠ দেখবো চারপাশের নিসর্গের মধ্যে ডুব দিয়ে কাটিয়ে দেবো সকাল, দুপুর, বিকাল রাতে তার হাত ধরে হাঁটবো, জোছনা মাখবো গায় অন্ধকারে কোথাও পাশাপাশি বসে আকাশের তারা গোনবো ঘড়ির কাঁটার মতো মিলে যাবো দুজন মাঝে মাঝে তাকে নিয়ে বের হবো মাছশিকারে, পাখিশিকারে কিংবা জোছনারাতে নৌকা ভাসিয়ে দেবো মৃগীর জলে ভাসতে ভাসতে যতদূর খুশি যাবো আবার ফিরে আসবো গড়জরিপায় প্রজারা বলবে, অসাধারণ জুটি হয়েছে সুখেই আছে আমাদের জমিদার সাহেব

পদ্মগন্ধাকে নিয়ে এমন কত স্বপ্ন ছিল, কত সহজ ছিল যাপিতজীবনের হিসাবনিকাশ কিন্তু এখন সবকিছু দুঃখের একটা গন্তব্যে গিয়ে মিলেছে তাকে আমি পাইনি পাবো যে সেই আশায়ও গুড়েবালি এখন কী করবো? মন দিয়ে মন না পাওয়ার যন্ত্রণা যে কী, তা হাফিজ ছাড়া আর কে বুঝবে? ইরানের শিরাজিতে বসে গজল লিখেছেন, শায়ের লিখেছেন, আর তা স্পর্শ করেছে বঙ্গের এই আমাকেও মনে হচ্ছে আমার হয়েই তিনি এই যাতনা অনুভব করেছেন কিংবা আমিই এই শায়েরের প্রতিটি শব্দে উচ্চারণ করেছি পদ্মগন্ধার নিষ্ঠুরতা, আমার পরাণের গহীনের যাতনা পৃথিবীর সকল প্রেমিকার রূপ কি একই? সকল প্রেমিকের বেদনাও তাই? তা না হলে হাফিজ কীভাবে বলতে পারলেন আমার মনের কথা!

পদ্মগন্ধা, আমি কীভাবে তোমার কাছে না গিয়ে থাকতে পারবো? তোমাকে না দেখে থাকতে পারবো? বাইরে থেকে তুমি শুধু এই জমিদারের খোলসটাই দেখেছো, ভেতরটা দেখোনি বাইরের আর ভেতরের শের আলী গাজী এক নয়, ভিন্ন বাইরের শের আলী গাজী, যতটা বিত্তশালী, ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী, ভেতরের শের আলী গাজী তারও অধিক নিঃস্ব, ক্ষমতাহীন, ভিখিরি তুমি যতই তাকে যেতে নিষেধ কর, কাছে গেলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দাও, ততই সে যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে আমি যে জমিদারÑ সেই কবেই ভুলে গিয়েছি আমার পূর্ব পুরুষ পাহলোয়ান গাজী ছিলেন সুফি ঘরানার দরবেশ ইরান থেকে এসেছিলেন এদেশে ধর্ম প্রচার করতে আর ফিরে যাননি এদেশে স্থিত হয়েছিলেন এই ভারতবর্ষের মাটিতে ঘুমিয়ে আছেন তার সফল উত্তরসূরি ফজল গাজী বাংলার বার ভুঁইয়াদের একজন প্রচণ্ড প্রতাপের সাথে জমিদারি করে গেছেন আমি তো তারই উত্তরসূরি তাদের রক্তের ধারা বইছে আমার শরীরে জমিদারি পরিচালনায় আমি তো কম সফল নই প্রজারা আমাকে ভালোবাসে আমিও তাদের মঙ্গল চিন্তায় ও কাজে ডুবে থাকি অথচ তোমাকে ভালোবেসে জাতের ফাতা সাধবাজারে বিকিয়ে দিয়েছি আমি হাফিজ হতে চেয়েছিলাম, ওমর খৈয়াম হতে চেয়েছিলাম, কবীর হতে চেয়েছিলাম এখনো এদের মতো একজন উচ্চাভিলাষী কবি হতে চাই লিখে যেতে চাই আমার অন্তর্গত বেদনার কথা তাই জমিদারির দিকে আমার চোখ নেই এ সব দেখে শুনে রাখে বিশ^স্ত কর্মচারীরা আমি ডুবে থাকি হাফিজের গজলে, আমির খসরু, খৈয়াম আর কবীরের শায়েরে গোলাপবাগের পাশ দিয়ে হাঁটি, পরান ভরে ফুলের সুবাস নেই বিড়বিড় করে শায়ের পাঠ করি আর ডুবে থাকি তোমার ভাবনায় রাতে আমার ঘুম আসে না আঁধার আমাকে ডাকে, জোছনা আমাকে হাতছানি দেয় আমার কেন ভালো লাগে ঝিঁঝির ডাক! নদীর ঢেউ! নীল আকাশ! মেঘের ভেলা! ঘাসের বুকের মুক্তোর মতো শিশিরের ফুল! নিশাচর পাখির আওয়াজ! বুনোফুলের গন্ধ! পাখ-পাখালির পালকের ঘ্রাণ! এ সব ঘ্রাণ গায়ে মেখে, বৃক্ষের ঘন ছায়া বুকে নিয়ে সবুজ বনের ভেতর দিয়ে নীরবে চলে যাওয়া একটি নির্জন পথ! মন চায় এই পথ দিয়ে পদ্মগন্ধার হাত ধরে হাঁটি! পদ্মগন্ধা, ‘এই পথ যদি শেষ না হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলত?’ আর ‘যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়...’ যদি অনন্তকাল তার হাত ধরে হাঁটা যেত!

একটি কোকিল আমগাছের ঘন পাতার আড়ালে অনবরত ডাকছেÑ কুউ কুউ কুউ...কখনো সে মানুষের চোখের সামনে আসে না আড়ালে-আবডালে লুকিয়ে লুকিয়ে ডাকে কেউ তাকে দেখে ফেললে উড়ে গিয়ে বসে অন্য ডালে, কিংবা অন্য গাছে নিজেকে সব সময় কেন সে আড়ালে রাখতে চায়? পদ্মগন্ধাও কি লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে তাকে সংগোপনে ডাকে! বুনো ঝোপের ভেতর অনেকক্ষণ ধরে একটি ডাহুকী ডেকে ডেকে গলা ফাটাচ্ছে! থামছে না ঘরে আমার মন টিকছে না এই গড়জরিপায় আমার আর থাকতে ইচ্ছে করছে না অনেকদিন তো হলো, অভিমান করে আমি দর্শা গ্রামে যাই না কানুনগো পাড়ায় যাই না কেমন আছে পদ্মগন্ধা? আমার মন বলছে ওই ডাহুকীর মতো মনে মনে সে আমাকে ডাকছে গোপনে ডেকে ডেকে গলায় রক্তক্ষরণ করছেÑ এসো গাজী তোমার ঘোড়ার খুরের শব্দের অপেক্ষায় কান পেতে আছি আমাকে ভালোবেসে কেন দূরে সরে থাকো আমার আত্মার অনিঃশেষ আর্তনাদ কি তুমি শুনতে পাও না?

হামজার পিঠে সওয়ার হন শের আলী গাজী তুফানের বেগে ছুটে চলেন দর্শা গ্রামের সড়ক থেকে মৃগী নদীর পাড় পর্যন্ত এক বার চক্কর দেন, দুই বার চক্কর দেন, তিন বার চক্কর দেন...সাতবার চক্কর দেন, প্রতিবার বসন্তরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির সামনে এসে ঘোড়ার গতি শ্লথ করে দিয়ে তাকিয়ে থাকেন বাড়িটির দিকে না, কাউকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন না তাহলে পদ্মগন্ধা কি এখানে নেই! রমাবল্লভ নন্দী এসে তাকে নিয়ে গেছে কানুনগো পাড়ায়? কানুনগো অফিসের দিকে তিনি ছুটে চলেন, খা খা রোদ গায়ে মেখে গরমে ঘেমে উঠছেন তিনি কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই তিনি ঘোড়া হাঁকিয়ে ছুটছেন তো ছুটছেনই কানুনগো পাড়ায় পদ্মগন্ধার বাড়ির সামনে না যাওয়া পর্যন্ত তার বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই, মনে শান্তিও নেই

কানুনগো অফিসে তিনি ঢোকেন না পদ্মগন্ধার বাড়ির সামনে ঘোড়ার গতি কমিয়ে তাকান জানালার দিকে জানালাটা বন্ধ ঘরে কি নেই পদ্মগন্ধা? নাকি ঘোড়ার খুরের শব্দ সে শুনতে পায়নি? তিনি ঘোড়ার খুরে খুরে থকথক আওয়াজ তুলে, ধূলো উড়িয়ে যান তাড়াই নদীর দিকে সেখান থেকে আবার ফিরে আসেন কানুনগো পাড়ায় একবার, দুবার, তিনবার, চারপার... জানালাটা বন্ধ পদ্মগন্ধা কি এখনো শুনতে পায়নি আমার ঘোড়ার খুরের আওয়াজ! নাকি শুনতে পেয়েছে ঠিকই কিন্তু সে জানালা খুলবে না, পাচিলের দরোজার কাছে আসবে না তাড়াই নদীর ঘাট থেকে পঞ্চমবার এসে দেখেন জানালাটা খোলা, তবে পদ্মগন্ধা নেই পাচিলের দরোজার কাছেও কেউ নেই ষষ্ঠবার এসে দেখেন একই অবস্থা জানালা খোলা কিন্তু পদ্মগন্ধা নেই সে কি অন্য কোথাও দাঁড়িয়ে আছে? পণ করেছে আমাকে আর দেখবে না! সপ্তমবার তাড়াই নদীর ঘাট থেকে ফিরে আসার সময় তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন, এবার যদি তাকে না দেখি, তাহলে পাচিলের দরোজায় করাঘাত করবো! পদ্মগন্ধাকে আসতেই হবে কিন্তু সপ্তমবার তার বাড়ির সামনে এসে দেখেন খোলা জানালার ও-পাশে দাঁড়িয়ে পদ্মগন্ধা চুল আঁচড়িয়ে খোঁপা করেছে খোঁপার ওপর আঁচলের শেষ প্রান্ত টানা হাতে শাখা তার দিকে ডাগর ডাগর করুণ চোখে তাকিয়ে কপালে রক্তরাঙা সিঁদুর ‘বন্ধুয়া সিন্দুর হইলে লাগাইতাম পোড়া কপালে...’ পদ্মগন্ধা কি কাঁদছে তার চিবুকে জলের রেখা কি চিকচিক করছে না! কিন্তু তা বেশিক্ষণ দেখার সুযোগ পেলেন না শের আলী গাজী জানালা থেকে আড়ালে চলে গেল পদ্মগন্ধা!

ফাতেমার কথা

নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না ফাতেমা শের আলী গাজী একটি হিন্দু ব্রাহ্মণ মেয়েকে ভালোবাসেন! মেয়েটির নাম পদ্মগন্ধা তাদেরই কানুনগো রামনাথ নন্দীর স্ত্রী! সম্প্রতি পদ্মগন্ধার একটি পুত্র সন্তান হয়েছে!

সংসার ও জমিদারির দিকে অনেকদিন ধরেই মন নেই শের আলী গাজীর ফাতেমা ভেবেছিলেন, তিনি কবি হতে চান বিখ্যাত কবিদের শায়েরে ডুবে থাকেন সংসার ও জমিদারির দিকে মন নেই তার কিছুটা পাগলাটে স্বভাব কবিতার মোহ কেটে গেলে, কবি হওয়ার বাসনাও তার মরে যাবে তাই নায়েবকে গোপনে ডেকে বলেছিলেন, বুদ্ধিমত্তার সাথে জমিদারির সবকিছু মোকাবিলা করতে নায়েব তার পারঙ্গমতা দেখিয়েছে বেশ ভালোই মাঝে মাঝে তিনিও হঠাৎ তার কাছে হিসাবনিকাশ চেয়ে যাচাইবাছাই করে দেখেছেন, সব ঠিক আছে ফাতেমা ভেবেছিলেন, শের আলী গাজী খুব তাড়াতাড়িই সংসার ও জমিদারির দিকে চোখ ফেরাবেন কিন্তু তিনি যে কবিতাচর্চার আড়ালে হিন্দু রমণীর প্রেমে মশগুল হয়ে পড়েছেন, তা কল্পনাও করতে পারেননি তার কানে বাড়ির চাকরবাকরদের থেকে দুএক কথা ভেসে আসতেই বিষণ্ন হয়ে পড়েন নায়েবকে ডেকে এনে পর্দার অন্তরাল থেকে বলেন, ‘গাজী সাহেব, মাঝে মাঝেই কোথায় যায়, কেন যায়, কী করেন, তাড়াতাড়ি আমাকে জানাবেন তবে খবরদার কাকপক্ষীও যেন একথা জানতে না পারে

শের আলী গাজীর বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও জমিদারি রক্ষার স্বার্থে, এ পরিবারের মানসম্মান রক্ষার স্বার্থে খুব গোপনে তার তিনজন বিশ্বাসভাজন, বুদ্ধিমান লোককে গুপ্তচর নিয়োগ করেন তিনদিনের মধ্যেই তারা পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য সরবরাহ করে হ্যাঁ, ঘটনা ঠিকই শের আলী গাজী, কানুনগোর স্ত্রী পদ্মগন্ধাকে ভালোবাসেন কয়েকদিন পর পর দশ কাহনিয়ার কানুনগো পাড়ায় তিনি ছুটে যান, মূলত পদ্মগন্ধাকে একনজর দেখার জন্যই পদ্মগন্ধা তাকে ভালোবাসে কি না, তা একেবারেই অস্পষ্ট তবে তিনি যে তাকে পাওয়ার জন্য অস্থির, তা শতভাগ সত্য এ কারণেই তিনি এত উদাসীন তার মনে সুখ নেই, শান্তি নেই জমিদারির দিকে খেয়াল নেই এখন উপায়? এখনই যদি তাকে ফেরানো না যায় তাহলে তো এ জমিদারি উচ্ছন্নে যাবে নায়েব সাহেব চুপ করে থাকেন ফাতেমা বুঝতে পারেন, নায়েবের পক্ষে গাজীকে ফেরানো সম্ভব নয় কীভাবে ফেরাবে সে? এখন পর্দার অন্তরালে থেকে তাকেই সবকিছু করতে হবে নায়েবকে তিনি চলে যাওয়ার ইঙ্গিত দেন তবে কর্মচারীরা যাতে মুখ বন্ধ রাখে এ ব্যাপারে সাবধান করে দেন কিন্তু পরক্ষণেই বোঝেন, তাতে কোনো লাভ হবে না এদের মুখ না হয় ভয় দেখিয়ে বন্ধ করবেন, কিন্তু প্রজাদের? তারা তো বাড়িতে, পথে-ঘাটে, হাটে-মাঠে গাজীর বিরুদ্ধে সমালোচনা করবেই ইশ্ প্রজাদের মধ্যে কী সুন্দর ভাবমূর্তি ছিল শের আলী গাজীর! এখন ধূলোয় সব মিশে যাচ্ছে আর তিনি প্রেমে এতই দেওয়ানা হয়ে গেছেন, এতই নির্লজ্জ হয়ে গেছেন যে এদিকে তার দৃষ্টিই নেই ইশ! ব্যাপারটা তো তারই আগে বোঝা উচিত ছিল কতদিন শের আলী গাজী তার দিকে চোখ ফেরান না তিনিও ব্যস্ত থেকেছেন নামাজ-কালাম নিয়েÑ আল্লাহপাকের বন্দেগীতে শের আলী গাজীর দিকে মনোযোগ ছিল না মাঝে মাঝে যদিও বা তার দিকে চোখ ফেরাতেন, দেখতেন গাজী ব্যস্ত আছেন শায়ের নিয়ে পড়তে পড়তে কোথায় যেন ডুবে যাচ্ছেন মাঝে মাঝে কলম নিয়ে বসছেন শায়ের লেখার জন্য কিন্তু তিনি যে ওই নারীর মধ্যে এভাবে হারিয়ে গেছেন, বুঝতে পারেননি পুরুষের এ মতিগতি বুঝবেনই-বা কীভাবে? তারই পাশে শুয়ে, তারই সাথে রতিক্রিয়া করে তিনি ডুবে আছেন অন্য নারীতে এটা কীভাবে সম্ভব? কবে থেকে এত অধঃপতন হলো গাজীর? এখন তিনি তাকে ফেরাবেন কীভাবে? যদি তিনি ওই হিন্দু রমণীকে বিয়ে করে ঘরে তোলেন! তাহলে সতীনকে তিনি সহ্য করবেন কীভাবে? তবে আশার কথা এই যে পদ্মগন্ধা বিবাহিত তার একটি পুত্র সন্তান রয়েছে তাছাড়া হিন্দু ব্রাহ্মণের মেয়ে সমাজ ও ধর্মের ডরে সে হয়তো নীরব রয়েছে কিন্তু শের আলী গাজী যদি সব সময় তার পেছনে আঠার মতো লেগে থাকেন, তাহলে সে আর কদিনই বা নিজেকে ধরে রাখতে পারবে এতদিনে শের আলী গাজীর প্রতি সে যে দুর্বল হয়ে পড়েনি, তারইবা কোনো নিশ্চয়তা আছে নাকি? তার কোনোরকম আশ্রয়প্রশ্রয় না পেলে গাজী কি অযথাই তার পেছনে এত ঘুরঘুর করেন? যতদূর জেনেছেন, সে তাদেরই এক সাধারণ প্রজার কন্যা তাহলে কীসের মোহে, কীসের ঘোরে গাজী তার প্রতি এত মজে গেলেন? সে কি তার চেয়েও অধিক রূপবতী? গুণবতী? যদি তিনি সত্যি তাকে বিয়ে করে ফেলেন, তাহলে আজ যেটুকু ভালোবাসা আমার প্রতি তার রয়েছে, এটুকুও থাকবে না তারই চোখের সামনে আরেক নারীকে নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াবেন, তার সাথে হাসি-তামাশা, রঙ্গ করবেন, তা ফাতেমা বিবি কীভাবে সহ্য করবেন? এর চেয়ে মরে যাওয়াই তো ভালো কিন্তু আল্লাহপাকের কাছে মৃত্যু প্রার্থনা করাও তো পাপ! তিনি তাকে এ কোন পরীক্ষায় ফেললেন? ফাতেমা বিবির বুক ফেটে কান্না আসে হু হু করে ওঠেন তিনি মনে মনে বলেন, হে আল্লাহ! তুমি রক্ষা কর, রক্ষা কর আমাকে, এই বিপদ থেকে সবরকম বালামুছিবত থেকে শের আলী গাজীকে তুমি ফিরিয়ে দাও, আগের মতো, আমার কাছে পৃথিবীর আর কোনো নারী যেন তাকে কেড়ে নিতে না পারে

আজও শের আলী গাজী বাড়িতে নেই সাত সকালেই হামজাকে নিয়ে বেরিয়ে গেছেন নিশ্চয় ওই কানুনগো পাড়ায়? হে আল্লাহ! পদ্মগন্ধার মন তুমি পাথর করে দাও সে যেন কোনোভাবেই গাজীর দিকে ঝুঁকে না পড়ে আজ আসুক গাজী তার দিকে কড়া নজর দিতে হবে যে কোনোভাবেই হোক, তাকে ফেরাতে হবে এ পথ থেকে

কয়েক বছর হলো তাদের বিয়ে হয়েছে এখনো কোনো ছেলেপুলে হয়নি শের আলী গাজী ব্যস্ত থাকেন জমিদারি আর শায়ের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো তার নেশা ফাতেমা বিবি পড়ে থাকেন আল্লাহর আরাধনায় সংসারে সন্তান আসুক, এ কথা তাদের কখনো মনেই হয়নি এখন ফাতেমার মনে হয়, সংসারে সন্তানের দরকার আছে অনেকগুলো শেকড়বাকড় না থাকলে বৃক্ষ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না সামান্য ঝড়েই ভেঙে পড়ে সংসারে সন্তান থাকলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনেকগুলো শেকড়ের জন্ম হয়, তখন ঝড়ঝাপ্টা এলেও সংসার ভেঙে যায় না সন্তান থাকলেই তো সংসারের প্রতি পুরুষের ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ জন্মায় তাছাড়া সে হয়ে পড়ে হালহীন নৌকা স্রোতে যেকোনো দিকে ভেসে যেতে পারে স্রোতের বিরুদ্ধে কখনো রুখে দাঁড়াতে পারে না ফাতেমা বিবি মনে মনে প্রার্থনা করেন, হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে একটি সুপুত্র প্রার্থনা করি আর কিছু চাই না সাথে সাথে যেন গায়েবী আওয়াজ আসে, তোমার বাসনা পূর্ণ হবে

সন্ধ্যার পর ফিরে আসেন শের আলী গাজী সারাদিন তিনি কোথায় ছিলেন, কী করেছেন, ফিরতে কেন এত দেরি হলো কিছুই জিজ্ঞেস করেন না ফাতেমা তীক্ষè চোখে তাকিয়ে দেখেন তাকে- ক্লান্ত, বিষণ্ন নিশ্চয় পদ্মগন্ধার বিরহানলে তিনি জ¦লেপুড়ে যাচ্ছেন আমি তোমার পোড়া দেহ, মন-প্রাণ জুড়িয়ে দেবো, ভালাবাসা দিয়ে, মমতা দিয়ে ভালোবাসার মায়াবী বন্ধনে তোমাকে জড়িয়ে ফেলবো গাজী রূপ-যৌবন আমার কি কম আছে? এবার চোখ মেলে দেখো আমাকে ফাতেমা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন নিশ্চয় খুব পেরেশানি যাচ্ছে আপনার হাতমুখ ধুয়ে আসুন খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিন

শের আলী গাজী কিছু বলেন না চোখে-মুখে বিষণ্ন হাসির রেখা, ঝলকে উঠেই আবার মিলিয়ে যায় হ্যাঁ অনেকটা তাই হাত-মুখ ধুতে যান তিনি ফাতেমা দাসিকে খাবার দিতে বলেন গাজী ফিরে এসে খেতে বসেন টেবিলে না, খাবারেও যেন রুচি নেই তার ফাতেমা নিজ হাতে তার প্লেটে তুলে দেন ভাত, শাকসব্জি, মাছ-মাংস, ডাল সবকিছু থেকে তিনি অল্পই মুখে তোলেন তারপর চলে যান শয়নকক্ষে ফাতেমা এশার নামাজ পড়েন, খেয়েদেয়ে আজ বেশি দেরি করেন না শয়নকক্ষে গিয়ে গাজীর পাশে বসে নিজেকে মেলে ধরেন চোখে প্রগাঢ় প্রেম, ঠোঁটে ফুটিয়ে তোলেন কান্তিময় হাসি মনে মনে বলেন, আমাকে দেখো গাজী দেহ থেকে কি ছড়িয়ে পড়ছে না পবিত্র উজ্জ্বল জ্যোতি? কস্তুরীর সুবাস! আমার চোখের দিকে তাকাও, বুকের দিকে তাকাও, রক্তজবা ঠোঁট দেখো, দেখো হাতের আঙুল, কাজল কালো চুলের ঘ্রাণ নাও এই দেহ পদ্মগন্ধার চেয়ে কম কীসে? রাজপ্রাসাদে ফুটন্ত গোলাপ রেখে তুমি কেন দূর দূরান্তে ছুটে যাও বুনোফুলের গন্ধ নিতে বুকে? একটু শুঁকে দেখো, এখানেও জমে আছে তোমার মননের মধু বিশুদ্ধ, পবিত্র ভ্রমরের মতো যত পারো শুষে নাও ভালোবাসার মোম দিয়ে তৈরি কর ঘর, যেখানে অনাগত বংশধরেরা বসবাস করবে এই মনোহর মধুকুঞ্জ রেখে তুমি কেন গিলতে যাও ভাগাড়ের পাশে ফুটে থাকা ধুতরা ফুলের বিষ! আমাকে স্পর্শ করে দেখো, আমিও মেলে দিতে পারি নিজেকে কাম ও মমতায়, খুনসুটি ও ভালোবাসায় রূপের ঐশ্বৈর্যোচ্ছটায় কোথায় তোমার সেই কামনেশাকাতর দুটো চোখ? বাসররাতে প্রথম যেমন দেখেছিলাম কিংবা দেখেছিলাম, তারপর, আরও অনেক অনেক রাতে সে-সব রাতের মতো একটি রাত কি আজ ফিরিয়ে দিতে পারবে? তোমাকে কেন এত নিঃস্ব ও নিঃসঙ্গ দেখাচ্ছে গাজী? আমি তো তোমার পাশে আছি থাকবো পদ্মগন্ধাকে আমি সহ্য করতে পারছি না, আমি জানি তুমি এখনো তার চিন্তায় বুদ হয়ে আছো তবু আমি বুকের সব ক্রন্দন চেপে, দীর্ঘশ্বাস চেপে, হাহাকার চেপে, জেনেশুনেবুঝে একটি খোলসের কাছে এসেছি, প্রাণের স্পর্শে তাকে জাগিয়ে দিতে চাই, সেই আগের মতো আমার মতো আর কে তোমাকে ভালোবাসতে পারবে, গাজী? শের আলী গাজীর বুকে মুখ ঘষে ঠোঁটে কিঞ্চিৎ হাসি ছড়িয়ে পড়ে থাকেন ফাতেমা বিবি যেন চোখের জলের ওপর ফুটে আছে একটি লালপদ্ম এই দেখো, একটি গোলাপ হয়ে ফুটে আছি, কেন তুমি ধুতরা ফুলের কাছে যাও সুবাস নিতে?

শের আলী গাজী তার দিকে তাকিয়ে অবাক হন এভাবে আজ নিজেকে পরিপাটি করে সাজিয়ে কেন এসেছে ফাতেমা? পদ্মগন্ধার কথা ভাবতে ভাবতে সে তো ভুলে গেছে তার শরীরের ঘ্রাণ! কতদিন তাকে চোখ মেলে দেখা হয় না ফাতেমাও কাছে এগিয়ে আসে না আজ কেন এসেছে? ফাতেমা, ভালোবাসতে বাসতে আমি তো শূন্য হয়ে গেছে, নিঃস্ব হয়ে গেছি এখন তোমাকে দেওয়ার মতো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই ভিখিরিও বলতে পারো মনের মধ্যে গোলাপের বিষকাঁটা বিঁধিয়ে মুখে কীভাবে ফুটিয়ে তুলবো হাসি? তবু আমাকে তা পারতেই হবে ভেতরে ভেতরে আমি যতই ক্ষয়ে যাই, নিঃশেষ হয়ে যাই, হারিয়ে যাই, তবু জেগে উঠতে হবে কী অদ্ভুত জীবন আমাদের! ভেতরে দগ্ধ হয়ে বাইরে হাত রাখি জলে! ভেতরে আরেকজনকে সংগোপনে পুষে বাইরে মেতে উঠি আরেকজনকে নিয়ে! পৃথিবীতে মানুষই শুধু পারে- যে ভালোবাসে তাকে ঠেলে দেই দূরে, যে অবহেলা করে তাকে বুকে পেতে অস্থির হয়ে পড়ি, তার জন্যই ঘোরাঘুরি, প্রাণপাত করি শুধু মানুষই পারে এভাবে বাঁচতে অদেখাকে দেখতে, অজানাকে জানতে, অস্পর্শকে স্পর্শ করতে আমরা কতই না কাঙাল! ফাতেমার পিঠে হাত রাখেন শের আলী গাজী আর ভাবেন, ফাতেমার মতো পদ্মগন্ধা কবে নিজেকে মেলে ধরবে তার সামনে! আমি তো সেই দিনটির জন্য শুধুই অপেক্ষায় আছি অপেক্ষার প্রহর কবে শেষ হবে? গরল গিলে মুখে ছড়িয়ে রাখি হাসি নকলে আসল ঢেকে কী সহজে আসল মানুষ হয়ে উঠি!

রমাবল্লভ নন্দী

জমিদার শের আলী গাজী কেন বারবার এদিকে আসেন? আমার বাড়ির সামনে দিয়ে ঘোড়া নিয়ে ছুটে যান তাড়াই নদীর দিকে আবার সেখান থেকে ছুটে আসেন আমার বাড়ির সামনে আবার সেখান থেকে ছুটে যান তাড়াই নদীর দিকে কখনো কিছুক্ষণ বাড়ির সামনে দাঁড়ান আবার কোনো কোনোদিন না দাঁড়িয়ে, ঘোড়া নিয়ে তাড়াই নদী থেকে বাড়ির সামনে, বাড়ির সামনে থেকে তাড়াই নদী পর্যন্ত বারবার ছোটাছুটি করে রওয়ানা হয়ে যান গড়জরিপা পদ্মগন্ধা তো কখনো বাড়ির বাইরে আসে না সব সময় ঘরের মধ্যেই থাকে ছেলেটাকে লালনপালন করতেই তার সময় চলে যায় তাছাড়া ঘরে আছে আমার বৃদ্ধ বাবা-মা তাদের খেদমতও তাকে করতে হয় যদিও একটা অল্প বয়সী কাজের মেয়ে আছে কিন্তু সে তাকে আর কতটুকুই বা সাহায্য করতে পারে? ছেলেটাকে হয়তো সে আগলে রাখে রান্নাবান্না, সংসারের কাজকর্ম আর শ^শুর-শাশুড়ির সেবা তো পদ্মগন্ধাকেই করতে হয় ঘরের বাইরে তো দূরের কথা, জানালার পাশেও তাকে দেখা যায় না তবু লোকে নানা কথা বলে বলবেই তো এ কেমন খেলা খেলছেন শের আলী গাজী! আমার বাড়ির সামনে দিয়েই কেন ঘোড়া নিয়ে তার এতবার ছোটাছুটি! আরও তো কত জায়গা রয়েছে মাঠের পর মাঠ, চকের পর চক, আরও কত সড়ক পড়ে রয়েছে সেসব জায়গায় রাতদিন ঘোড়দৌড় করলেই তো হয় কেউ কিছু বলবে না নাকি বলবে? কী জানি, বলতেও পারে লোকের মুখ তো আটকানো যায় না পাতাঝরা গাছে শকুন বসে থাকলেও আশঙ্কা করে, না জানি কোথায় কী ঘটে! আজেবাজে কথা শুনলে আমার কান ঝা ঝা করে মাথা গরম হয়ে যায় খামাখা আমার বাড়ির সামনেই কেন বারবার মরতে আসেন তিনি? পদ্মগন্ধাকে কি তিনি সত্যি পছন্দ করেন? নাকি এখানে ঘোড়দৌড় করা তার একটা নেশা কত রকম নেশাই তো জমিদারদের থাকেÑ টাকার নেশা, মদের নেশা, নারীর নেশা, বাঈজীর নেশা, প্রজাপীড়ন নেশা তাদের রঙমহলে প্রতি রাতে কত সুন্দরী সুন্দরের রঙ ছড়ায়, বাতাসে মাদকতা ছড়িয়ে মদের আসরে ঘুঙুরের শব্দে আসর মাতায় তা কি আমি জানি না! শের আলী গাজীর হয়তো ঘোড়দৌড়ের নেশা আবার পদ্মগন্ধার ওপরও তার বদনজর পড়তে পারে অস্বাভাবিক কিছু না তার যা রূপচেহারাÑ শের আলী গাজীর মনে ধরতে পারে যদিও তার নামে নারী ও মদের গল্প প্রজাদের মুখে শোনা যায় না সবাই বলে প্রজা হিতৈষী জমিদার এ যুগে এমন মানুষ আর কোথাও চোখে পড়ে না কথা ঠিক তবে নারীর ব্যাপারে তার চিন্তা ভিন্ন কাউকে রমাবল্লভ নন্দী বিশ^াস করে না নারীর রূপে ভগবানও পাগল! শের আলী গাজী কোন ছার! পদ্মগন্ধাকে যদি তিনি ছিনিয়ে নিয়ে যান, তাহলে? আমি কি পারবো তাকে রক্ষা করতে? তার যে ক্ষমতা, প্রভাব, প্রতিপত্তি! তান্ডার সুবাহদারকেই তিনি পাত্তা দেন না, খাজনা দেন না কত বছরের খাজনা বাকি! তার প্রতি প্রজাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা সম্পর্কেও শাসকরা ওয়াকিবহাল তাই তাকে তারা বেশি ঘাটায় না যদি তার প্রজারা শাসকদের বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠে, আর সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে, তাহলে তো গদি রক্ষা করাই কঠিন হবে তার চেয়ে থাক না সে যেমন আছে! দুচার জন জমিদার খাজনা না দিলে রাষ্ট্রের কী-ই বা এমন ক্ষতি হবে? অযথা বিপদ ডেকে এনে ঘাড়ে বসিয়ে লাভ কী? শাসকদের এমন মনোভাব দেখে রমাবল্লভ নন্দী কিছুটা হতাশই হয়Ñ কী-বা দেশ, কী-বা রীতিÑ জোর যার মুল্লুক তার! যার যেমন ইচ্ছে চলুক আমার কী আসে যায় তাতে?

শের আলী গাজী যতবার ইচ্ছে ঘোড়া নিয়ে ছোটাছুটি করুক পদ্মগন্ধার দিকে চোখ তুলে না তাকালেই তো হলো যদি তাকায়, তাহলে তাকে আমি ছেড়ে দেবো না একটুও শান্তিতে থাকতে দেবো না আমার গায়েও বংশ পরম্পরায় বহমান রাজরক্ত অষ্টম শতকে জন্মগ্রহণ করেন ভৃগুনন্দী ও জগদানন্দীর পুত্র জম্বুর নন্দী তিনি মহারাজাধিরাজ ছিলেন তার বংশধরগণ প্রায় দু’শ বছর ধরে মুর্শিবাদের যাজিগ্রামের হিলরা নামক স্থানে বসবাস করে আসছে এখনো সেখানে রয়েছে বিশাল সরোবর নন্দীর দিঘি জম্বুর নন্দীর আগে সেই পৌরাণিক যুগে শিশুনাগের দোর্দণ্ড প্রতাপে কেঁপে উঠতো মগধরাজ্য বিম্বিসার, আদিশুর, সামন্ত সেন, বিজয় সেন, বল্লাল সেন, লক্ষ্মণ সেন-এর দাপটও কি কম ছিল এই বঙ্গদেশে? তাদের পদাঘাতে কেঁপে উঠতো এদেশের মাটি স্বগৌরবে তারা শাসন করতেন এদেশ মুসলমানদের আগমনের পরই তাদের সেই মহিমা একেবারে ধূলিসাৎ হয়ে গেল নাগবংশের পদবী কতদিকে মোড় নিলো কতজনে কতোদিকে গড়লো বসতি এখনো তাদের বংশগৌরব অন্ধকারে নিভু নিভু প্রদীপের মতো জ্বলছে শিক্ষাদীক্ষাই তাদের বংশীয় গৌরব কিছুটা হলেও টিকিয়ে রেখেছে হিন্দু হলেও বিদ্যাবলে মুঘল দরবার থেকে সে জুটিয়ে নিয়েছে সম্মানজনক এই কানুনগোর চাকরি তার ক্ষমতা কি কম? জমিদার শের আলী গাজীকে তার তোয়াক্কা না করলেও চলে সে তো খোদ মুঘল সরকারের কর্মচারী শের আলী গাজীরই তো তাকে বেশ সমীহ করে চলা উচিত অবশ্য এখন পর্যন্ত সে তাকে কোনো ব্যাপারে বিরক্ত করেনি বিরক্ত করলে সমুচিত জবাব সে দেবে এই দশ কাহনিয়ায় সে কাকে ডরায়? না জমিদার, না কোনো প্রজা না, কাউকে না ওই তো গোয়ালপাড়ার পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র নদের ওই পাড়ে রাঙ্গামাটিয়ায় ভুবনানন্দের পুত্র কানুনগো বাণী বল্লভের কাছারি তিনি তাদেরই নিকট আত্মীয় সুবাহদারের সাথে তার দহরম মহরম সম্পর্ক সম্পর্ক আছে মুঘল রাজদরবারে উচ্চপদস্থ বিভিন্ন রাজকর্মচারীর সাথেও বাণী বল্লভের সহায়তা না পেলে এই কানুনগো পদে চাকরি তার ভাগ্যে জুটতই না দাদা, পরিবার পরিজন নিয়ে ওখানেই বসবাস করেন শের আলী গাজী যদি পদ্মগন্ধাকে নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করে, তাহলে তাকে দিয়ে আমি গাজীর বিরুদ্ধে সুবাহদারের কাছে রিপোর্ট করাবো তাতেও কোনো কাজ না হলে, এই চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় চলে যাবো ব্যবসা-বাণিজ্য ধরবো আর যদি দেখি পদ্মগন্ধা তাকে ভালোবাসে, তার কারণেই শের আলী গাজী এখানে আসেন, তাহলে? তাহলে কী করবো আমি? পদ্মগন্ধাকে খুন করে পালিয়ে যাবো কলকাতায়? আমি কি পারবো তাকে খুন করতে? এর চেয়ে ভালো, তাকে ত্যাগ করা কিন্তু আমার সংসারের কী হবে? আমার ছেলে রামনাথ নন্দীর কী হবে? দুধের শিশু ও পদ্মগন্ধা ওকে কত ভালোবাসে ছেলেকে কোল থেকে একটুও মাটিতে নামায় না, যদি ব্যথা পায়!

‘পিঁপড়ার ভয়ে মাও না থুইলা মাটিত

কোল দিয়া বুক দিয়া জগতে বিদিত

আমি কি পারবো পদ্মগন্ধার মতো ওকে ভালোবাসতে? সারাক্ষণ বুকের সাথে লেপ্টে রাখতে? অফিসে কত কাজ করতে হয় কত জায়গায় ছোটাছুটি করতে হয় আমাকে রামনাথ নন্দীকে কীভাবে আগলে রাখবো? আরেকটা বিয়ে করলেই কি সব চুকেবুকে যাবে? পদ্মগন্ধার শূন্যস্থান কিছুতেই পূরণ করা সম্ভব নয় পৃথিবীতে মায়ের ভালোবাসার বিকল্প হয় না মা তো মা-ই তার সাথে কারও তুলনা চলে? স্ত্রী-পুত্র নিয়ে কী সুন্দর সাজানো গোছানো সংসার আমার! কত সুন্দর বাড়ি! দিনরাত কত ভালোবাসাবাসি! কী শান্তি! কী সুখ! মনে হয় স্বর্গে বাস করছি যদি পদ্মগন্ধা তার অবস্থান থেকে একটু নড়চড় করে, তাহলে, সব তছনছ হয়ে যাবে ছারখার হয়ে যাবে এ সংসার আর সংসার থাকবে না, হবে নরক না না, আমি কেন এত ভেবে ভেবে হয়রান হচ্ছি? পদ্মগন্ধা তো শের আলী গাজীকে পছন্দই করে না সেই কবে একটু জল চেয়েছিল, পদ্মগন্ধা জল দিয়েছিল, এই যা এই নিয়ে এত কানাঘুষা কেন? তিনি দশ কাহনিয়ার জমিদার তৃষ্ণা পেলে যেকোনো বাড়ি গিয়ে একটু জল তো চাইতেই পারেন তখন কেউ কি তাকে জল না দিয়ে পারবে? জল চাইলে, অনেকে তাকে ঘরে নিয়ে বসাবে, তাকে অন্ন দিয়ে ধন্য হবে, তার মন পেতে তাকে আরও সেবা করার জন্য অস্থির হয়ে পড়বে, যারা আজ কানাঘুষা করছে কেউই বাদ যাবে না, তা সে যতবড়ো ব্রাহ্মণই হোক কত দেখলাম, এসব আমার ভালোই জানা আছে আমার বেলায় শুধু কানাঘুষা

একদিন অফিসের কেরানি দুজন ফিসফিস করে কথা বলছিল তাকে দেখেই চুপ রমাবল্লভ নন্দীর খুব রাগ হয়েছিল, কী কথা বলছিলে তোমরা?

আমাগো জমিদারের কথা, বাবু এত জায়গা থাকতে কেনইবা এখানে এসে ঘোড়দৌড় করেন?

শুধু ঘোড়দৌড়ই করেন আর তো কিছু করেন না আমরা কি তাকে বাধা দিতে পারবো?

না, তা পারবো না সেই সাধ্য কি আমাদের আছে?

তাহলে আর কথা কেন? কাজ কর

তারা কাজে ডুবে গিয়েছিল আর কোনোদিন তাদের কানাঘুষা করতে দেখেনি রমাবল্লভ নন্দী কিন্তু সেদিন তার মেজাজ খুব বিগড়ে গিয়েছিল বাড়ি ফিরে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল পদ্মগন্ধার দিকে তাতেই খুব ভয় পেয়েছিল সে, কী হয়েছে? কোনো সমস্যা?

জমিদার সাহেব কেন এখানে এত ঘোড়দৌড় করেন?

তা আমি কী করে বলবো? আপনি জিজ্ঞেস করলেই পারেন

তুমি তো তাকে জল দিয়েছিলে?

কেন? তাতে কি দোষের কিছু হয়েছে? কারো কাছে জল চাইলে সে কি তাকে মানা করতে পারবে?

এত কথা আমি বুঝি না তুমি তাকে আর কোনোদিন জল দেবে না দরোজায় হাতুড়ি পেটালেও খুলবে না

আমি তো আমার ছেলে নিয়েই পড়ে থাকি ওদিকে তাকানোর আমার কি সময় আছে? তৃষ্ণার্তকে জল দিলে এতই যদি দোষ হয়ে থাকে, তাহলে...

তাহলে!

আমাকে, আমাকে ত্যাগ করলেই পারেন

তুমি এমন কথা বলতে পারলে পদ্মগন্ধা?

তাছাড়া আর উপায় কী?

হু হু করে ডুকরে উঠেছিল পদ্মগন্ধা রমাবল্লভ নন্দীর মনটাও খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল অযথা পদ্মগন্ধাকে দোষারোপ করে লাভ কী? নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়েছিল তার রাতে পদ্মগন্ধাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, কিছু মনে করো না বউ লোকে আমাদের নিয়ে কানাঘুষা করে মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল তাই...

তাহলে আমরা অন্য কোথাও চলে যাই

কোথায় যাব?

আমি তার কী জানি! হিলড়া না তান্ডা

না সুবাহদার আমাকে এই কাজের জন্যই এখানে পাঠিয়েছে সরকারের ইচ্ছে হলে হয়তো অন্য কোনো কাছারিতে বদলি করতে পারে কিন্তু সেটা সরকার বাহাদুরের মর্জির ওপর নির্ভর করে আমি বদলির ইচ্ছা প্রকাশ করলে সরকার বাহাদুর চটে যেতে পারে তার ফল খুব ভালো হবে না

তাহলে নদীর ওই পাড়ে তোমাদের এক আত্মীয় থাকে না, কানুনগো কী যেন নাম? সরকার বাহাদুর তাকে এখানে দিক, আর তোমাকে ওখানে নিয়ে যাক, তাহলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়

কত সহজ হিসাবনিকাশ পদ্মগন্ধার! রমাবল্লভ হাসবে না রাগ করবে বউয়ের ওপর, বুঝতে পারে না এই নির্বোধ মেয়ে মানুষের সাথে কথা না বাড়িয়ে চুপ করে থাকাই তো ভালো সে তো আগেই যোগাযোগ করে দেখেছে, এখান থেকে সরকার বাহাদুর তাকে বদলি করবে না তান্ডা সেখানে যেতে চাইলে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে আর চাকরি ছেড়ে দিলে সংসার চালাবে কী দিয়ে? নতুন চাকরি পাওয়া কিংবা কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য দাঁড় করানো কোনোটাই সহজ নয় সবই অনিশ্চিত এমন নিশ্চিত জীবন ছেড়ে অনিশ্চিত অন্ধকারে পা দিয়ে সে কি মরবে? ঘোরাঘুরি করলে তান্ডা কিংবা কোলকাতায় কোনো জমিদার বাড়িতে একটি পোস্ট হয়তো সে জোগাড় করে নিতে পারবে তাও তো সময়ের ব্যাপার তাছাড়া সেই চাকরি কি এর চেয়ে ভালো হবে? কত স্বাধীন এই চাকরি! কত ক্ষমতা তার! জমিদারদের তোয়াক্কা না করলেও চলে বরং জমিদার বাবুরাই তাকে কিছুটা সমীহ করে চলে কানুনগোর কলমের জোর কত তা তারা ভালো করেই জানে এই চাকরি বাদ দিয়ে কি না জমিদারের নায়েব বা খাজাঞ্চিখানার কেরানি! না না, তা সম্ভব নয়

রমাবল্লভ নন্দী ভাবে, যারা আমাদের নিয়ে কুকথা বলে, গুজব ছড়িয়ে সুখ পায়, তাদের মুখে চুনকালি পড়ুক এই সংসার আমার, পদ্মগন্ধা আমার, আমারই থাকবে আমি পদ্মগন্ধাকে ভালোবাসি পদ্মগন্ধা আমাকে ভালোবাসে আমাদের সংসারে কেউ চিড় ধরাতে পারবে না ঘোড়দৌড় করতে আসুক না শের আলী গাজী যদি তিনি বাড়াবাড়ি করেন, তাহলে, আমিও তাকে ছেড়ে কথা কইবো না দাঁতভাঙা জবাব দেবো তারপর যা হবার হবে, আমি তাকে ভয় পাই না তার কারণে লোকে মন্দ বললে, আমার সংসার ধ্বংস হয়ে গেলে, কেন ভয় পাবো তাকে? কেনই বা ছেড়ে কথা কইবো? আমি কি তার চাকরি করি? আমি তো সরকারের লোক আমাকে জ¦ালাতন করলে তার ক্ষতি ছাড়া ভালো হবে না কারণ অনেকদিন যাবৎ তিনি খাজনাও দেন না স্বাধীনভাবে জমিদারি চালাচ্ছেন সরকারকে তোয়াক্কা করছেন না এ জন্য সরকার, তার ওপর খুশি হয়ে নেই তাকে কিছু না বললেও নিশ্চয় নাখোশ হয়ে আছে একদিন তার প্রকাশ ঘটবেই প্রয়োজনে বাণীবল্লভের সাথে আমি যোগাযোগ করবো তাকে খুলে বলবো সব সে তো শের আলী গাজীকে সহ্যই করতে পারে না বলেন, ম্লেচ্ছ আবার জমিদার হয় রে রমাবল্লভ! কিন্তু কী দুর্ভাগ্য সেই ম্লেচ্ছ সরকারের অধীনেই আমরা চাকরি করি তবে আশার কথা এই যে, মহামান্য সম্রাট হিন্দুদের বেশ সম্মান করেন কাজির আইনে হিন্দু-মুসলমান কেউই আলাদা গুরুত্ব পায় না কাজেই বাগে পেলে তাকে আমি ছেড়ে দেবো না

তাড়াই নদী পরিকল্পনা

‘রূপ লাগি আখি ঝুরে গুণে মন ভর

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর

হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে

পাষাণ পিরীতি লাগি থির নাহি বান্ধে’

পদ্মগন্ধার জন্য আর কতকাল তিনি ছোটাছুটি করবেন এভাবে বারবার দশ কানুনগো পাড়ায় গিয়ে পদ্মগন্ধাকে এক নজর দেখে লাভ কী? তার মনের আগুন তো নেভে না পদ্মগন্ধা তাকে ভালোবাসে বটে, কিন্তু তার সন্তান ছেড়ে, সংসার ছেড়ে, স্বামী ছেড়ে কোনোদিন তার কাছে স্বেচ্ছায় আসবে না সে সমাজকে ভয় পায়, ধর্মকে ভয় পায় আবার আমাকেও ভালোবাসে! তাহলে আমি কি তাকে জোর করে তুলে নিয়ে আসবো? না না, ভালোবাসার মানুষের ওপর আমি জোর খাটাতে চাই না তাহলে তো কত আগেই...তাহলে কী করবো আমি? আমৃত্যু শুধু গড়জরিপা থেকে দশ কাহনিয়া কানুনগো পাড়ায় ছোটাছুটি করবো? তারপর একদিন মরে মিশে যাবো মাটিতে, পদ্মগন্ধা মরে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে! বাতাসে সংগোপনে মিশে থাকবে অনন্ত দীর্ঘশ^াস! তা তো হতে পারে না খৈয়াম বলেছেন, ‘দূরের বাদ্য লাভ কী শুনে,/ মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক’ হ্যাঁ, সত্যিই তো যেভাবে চলছে তাতে এ ফাঁক তো কোনোদিনই ঘুচবে না মানুষের মৃত্যু হলে কিছুই থাকে না সব শূন্য, সব ফাঁকা, অর্থহীন ঘোরাঘুরি, অর্থহীন এই ভালোবাসাবাসি শুধু এ কারণে পদ্মগন্ধাকে আমি অনেকবার ভুলে যেতে চেয়েছি মনকে প্রবোধ দিতে চেয়েছি বারবার এই বলে যে, তার বিয়ে হয়েছে, সংসার হয়েছে, সে তার মতো করে বেঁচে থাক আমি কাঁটা হয়ে তার মনে আর বিঁধে থাকতে চাই না কিন্তু এত বছরেও আমি তাকে কিছুতেই ভুলতে পারিনি পদ্মগন্ধার জন্য আমার ভেতরে দিবানিশি দহন, অন্তরে অনন্ত তিয়াসা এই দহন কোনোকালেই থামবে না আমাকে শুধু পোড়াতে থাকবে পুড়িয়ে পুড়িয়ে ছাই করে এই খোলস দেহটাকে একদিন কবরের অন্ধকারে শুইয়ে দেবে এ তিয়াসা আর কোনোকিছু দিয়েই মিটবে না অসহ্য এ তিয়াসা নিয়েই আমাকে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে! আহা! আমি কেন দেখেছিলাম পদ্মগন্ধার ওই রূপ? তার ডাগর ডাগর মায়াবী চোখ, সুন্দর গ্রীবা, মুখ, গোলাপ পাপড়ির মতো ঠোঁট, লম্বা চুল সাপের মতো পেঁচানো চুলের খোপা, হাত-পা, বুক, দুধে-আলতা গায়ের রঙ! ওই রূপের আগুনে পতঙ্গের মতো ঝাপ দিয়ে কেন পোড়াতে গেলাম নিজেকে! তাকে দেখার পর সংসারে আমি মন বসাতে পারিনি, সন্তানের দিকেও আমি চোখ তুলে তাকাতে পারি না আমার আসলে এসব কিছুই ভালো লাগে না সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে কোথাও নিরুদ্দেশ হবো, তাতেইবা লাভ কী? পদ্মগন্ধাকে তো পাবো না অনন্ত তিয়াসা বুকে নিয়ে আমার পথ গেছে অন্তহীন গন্তব্যে মিশে, কিংবা শুধু কবরের অন্ধকারের দিকে এ জীবন আর ভালো লাগে না নির্লজ্জ, বেহায়ার মতো পদ্মগন্ধাকে এক নজর দেখার জন্য আমি আর দশ কাহনিয়ার কানুনগো পাড়ায় যাবো না তার বাড়ির সামনে দিয়ে ঘোড়দৌড় করবো না আমি তাকে চিরকালের জন্য ভুলে থাকতে চাই আমার অন্তরের জ¦ালা আমি জুড়াতে চাই আমি আবার আমার সেই আগের আমিকে ফিরে পেতে চাই দক্ষতার সাথে জমিদারি পরিচালনা, প্রকৃতির রূপ দর্শন, শিকার আর শায়েরে ডুবে যেতে চাই ফাতেমার কাছে ফিরে যেতে চাই এখন ফাতেমার কাছে যেতে আমার সংকোচ হয় সে আমার দিকে তাচ্ছিল্য বা করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার হাসিতে বিষণ্নতা ও পরিহাস মিশে থাকে আবদুল করিমের দিকে আমি তাকাতে পারি না তাকে ঠিক এত আদর করতে পারি না, ভালোবেসে বুকে টেনে নিতে পারি না ছেলেটা আমাকে দেখে কেন যেন ভয় পায় কাছে ডাকলেও সহজে আসতে চায় না আমাকে দেখলেই ওর মায়ের কাছে চলে যায়, কেমন জড়োসড়ো হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে আড়ালে লুকাতে চায় সে নিজেকে খুব অপরাধী লাগে বুকের ভেতর এই ভালোবাসা নিয়ে, না-পাওয়ার দহন নিয়ে কোনোদিন এদের কাছে মনের মানুষ হয়ে উঠতে পারবো না আমি আস্তে আস্তে সব ভুলে যেতে চাই অবহেলা, ভালোবাসা, বিরহজ¦ালা সবকিছু আমার অন্তর থেকে মুছে ফেলতে চাই

দুদিন ধরে আফিম খেয়ে নেশায় বুদ হয়ে আছেন গাজী যতক্ষণ নেশার ঘোরে থাকেন, ততক্ষণই যাতনা থেকে আস্তে আস্তে মুক্তি মন ও শরীর খুব হালকা হয়ে যায় মনে হয় আমি বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছি মেঘের মতো, পাখির মতো কাঞ্চনজংঘার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছি কোথায় যাচ্ছি আমি? মন ও শরীরে এত আনন্দ কেন? এ জন্যই মানুষ আফিম খায়! কাঞ্চনজংঘার ওপর থেকে আমি কেন উড়ে আসছি দশ কাহনিয়ার দিকে আমার সামনে ও কে? পদ্মগন্ধা? হাসি মুখে আমাকে ডাকছে, আসুন, কাছে আসুন আমার হাত ধরুন আমি তাকে ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে দেই সে খিলখিলিয়ে হেসে শূন্যে মিলিয়ে যায় তারপর একটি ছোট্ট সুন্দর পাখি হয়ে গাছের ডালে ডালে নাচতে থাকে কী নাম দেয়া যায় তার? গোল্ডেন বার্ড! ও গোল্ডেন বার্ড তুমি আমার হাতে আসো গোল্ডেন বার্ড বলে, আমি যাবো না পারলে আপনি আমাকে ধরুন, গাজী আমাকে ধরে নিয়ে আপনার খাঁচায় পুষুণ গোল্ডেন বার্ড! তোমার মতো এত সুন্দর পাখি আমি কোনোদিন কোথাও দেখিনি আমি তোমাকে ধরবো নিশ্চয় ধরবো ধরে গড়জরিপায় নিয়ে যাবো গোল্ডেন বার্ডকে ধরার জন্য হাত বাড়াতেই সে পাখা ঝাপটিয়ে উড়াল দেয় আমিও ভেসে যাচ্ছি হাওয়ায়, তার পিছু পিছু কিন্তু গোল্ডেন বার্ডকে কিছুতেই ধরতে পারছি না সে ঝিকিরঝিকির করে ডাকে বলে, আমাকে এখনো ধরতে পারলেন না গাজী! এই যে আমি আপনার খুব কাছে, এবার ধরুন তো আমাকে সোনার খাঁচা আছে তো আপনার?

চাইলে তোমার জন্য একটি খাঁচা আমি বানাতেই পারি কিন্তু আমি বানাবো না আমি চাই, তুমি মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরে বেড়াও গড়জরিপায় সেখানে আকাশে ওড়ো, গাছের ডালে নেচে নেচে গান গাও

শুধু গড়জরিপায়? আর কোথাও না? তার চেয়ে সোনার খাঁচাই তো ভালো!

আমি তোমার জন্য সোনার খাঁচা নয়, মনখাঁচা বানিয়েছি

তাই বুঝি! তাহলে আমাকে পোষতে পারছেন না কেন?

তুমি যে ধরা দিচ্ছো না

কী যে বলেন! এই যে নিন, আমাকে ধরুন কত কাছে আপনার একেবারে হাতের নাগালে তবু আপনি আমাকে ধরতে পারছেন না কেন? আপনি না শিকারে যান? শুধু বাঘ-হরিণই শিকার করেছেন? কোনোদিন পাখি শিকার করেননি বুঝি! জানেন না কীভাবে শিকার করতে হয় পাখি? নিন এই যে ধরুন আপনার হাতের মুঠোয় পুরে নিন আমাকে

শের আলী গাজী প্রাণপণ চেষ্টা করেন তাকে ধরতে কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছেন না হাতের নাগালের মধ্যে এসেও বারবার ফসকে যাচ্ছে কিন্তু এই ধরাধরি খেলা খেলতে খেলতে পাখিটি তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? দশ কাহনিয়ায়? কানুনগো পাড়ায়? না, পাখিটি আমাকে ধরতেই হবে যে কোনোভাবে পাখিটি এবার খিলখিলিয়ে হাসে, কই আমাকে তো ধরতে পারলেন না গাজী নিন, শেষ বার চেষ্টা করুন ধরুন, আমাকে এই যে আমি

ফুড়ুৎ করে উড়াল দিয়ে পাখিটি খোলা দরোজা দিয়ে ঢুকে গেল রমাবল্লভ নন্দীর ঘরে সাথে সাথে দরোজা বন্ধ হয়ে গেল ভেতর থেকে ভেসে এল পদ্মগন্ধার কান্নাভেজা কণ্ঠস্বর, আপনি আমাকে ধরতে পারলেন না গাজী! হয়তো আর কোনোদিনই পারবেন না তাহলে ঘোড়া হাঁকিয়ে কেন আসেন, আমাকে দেখার জন্য?

শের আলীর ঘুম ভেঙে গেল নেশা কেটে গেছে তার এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি স্বপ্নেও পদ্মগন্ধা! আমি তোমাকে কোনোদিনই কি ধরতে পারবো না কাছে পাবো না? চিরকাল অধরাই থেকে যাবে? ভেতরে কষ্ট মোচড় দিয়ে উঠছে কেঁচোর মতো

দস্তগীর! দস্তগীর!

জি¦ হুজুর

একটু আফিম দাও

কাল থেকে অনেক খেয়েছেন তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছেন

যেতে দাও এ জীবন আর ভালো লাগে না আফিম খেলে ভালো থাকা যায়

দস্তগীরের চোখে জল টলমল করে, কিন্তু এভাবে আপনি তো বেশিদিন বাঁচবেন না হুজুর

দরকার নেই আমার বেশিদিন বাঁচার তোমাকে আফিম দিতে বলেছি, আফিম দাও

দস্তগীরের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে

দস্তগীর! তুমি কাঁদছো? কেঁদো না বাছা একমাত্র তুমিই আমাকে ভালোবাসো আর কেউ না

দস্তগীর চোখ মুছে বলে, হুজুর, কাঁটা আছে বলে পথে হাঁটবেন না? পথ থেকে কাঁটা তুলে ফেললেই তো হয় পথে যখন হাঁটতেই হবে, তখন বসে থেকে লাভ কী? আপনি চাইলে...

শের আলী গাজী কিছুটা রেগে গিয়ে বলেন, তোমাদের যা খুশি কর আমাকে শুধু আফিম দাও, দস্তগীর শুধু আফিম

নিরুপায় হয়ে তার হাতে আরেক পুরিয়া আফিম তুলে দেয় দস্তগীর তারপর মনে মনে বলে, আপনাকে আমি এভাবে মরে যেতে দিতে পারি না হুজুর যেকোনোভাবেই হোক, গোপনে আমাকে আপনার পথের কাঁটা তুলে ফেলতেই হবে কেউ জানবে না কাকপক্ষিও টের পাবে না অতীব গোপনে কাজটি সেরে ফেলবো আমি সঙ্গে বিশ^স্ত আরও কয়েকজনকে নেবো তারাও তাই চায় আপনার এই কষ্ট আমরা সহ্য করতে পারছি না আর

তাড়াই নদী

তাড়াই নদীর জলে গো

ঢেউ খেলে গো ঢেউ খেলে,

বধুয়ার রূপের জ্যোতি,

ঢেউয়ের চূড়ায় গজমতি

সকরুণ কার মিনতি

ভেঙে ভেঙে পড়ে লো ভেঙে ভেঙে পড়ে

আহা! তাড়াই নদীর জলে গো

ওই তাড়াই নদীর জলে

এমনি এ নদী শান্তই থাকে সহজে ক্ষেপে যায় না জেলেরা দিনরাত মাছ ধরে আইড়, মহাশোল, বোয়াল, চিতল, রুই, কাতল আরও কত রকম মাছ জাল ফেললেই উঠে আসে মাছ আস্তে আস্তে নৌকার খোল ভরে যায় মাছে জেলেরা খুশি মনে সেই মাছ বিক্রি করে আড়তে কিংবা হাটবাজারে

দিনরাত পাল তুলে, দাঁড় টেনে আসা-যাওয়া করে পসরা সাজিয়ে কারবারি নাও নাইওয়ের নাও আরও কতশত কাজের নাও জলের কলকল স্রোতের সাথে মাঝিমাল্লাদের গল্প, গান-বাজনা, হাসি-তামাশা, আনন্দ-বেদনা, স্বপ্ন ও জীবনগাথা ভেসে যায় কচুরিপানার মতো ঢেউয়ের চূড়ার সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকে কখনো নিঃশেষ হয় না জীবন এখানে কখনোই থেমে থাকে না নদীর সাথে আত্মিক বন্ধনে জড়িয়ে থাকে তারা আশা-নিরাশায়, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিতে

তাড়াইয়ের দু পাড়ে সবুজ ফসলের ক্ষেত কত স্বপ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে দিনরাত আনন্দে বাতাসে দোল খায় নদীর সর্বনাশকে তারা ভয় পায় না আপন মহিমা নিয়ে জেগে থাকে

দূরে ধু ধু গ্রাম ধীরে ধীরে দিগন্তে মিলিয়ে গেছে ওই দূর গাঁও থেকে ছেলে-মেয়ে, বউ-ঝিরা তাড়াইয়ে আসে গোসল করতে, কলসি ভরে জল নিতে গামছায় সেঁকে ছোটো মাছ ধরে ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরা তারপর জলে সাঁতার কেটে, হোল ডু ডু খেলা খেলে বাড়ি ফিরে যায় এ তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম

মাঝে মাঝে এ নদী ভাঙেও দু পাড়, ভরা ফসলের ক্ষেত, ঘরবড়ি নিশ্চিহ্ন করে দেয় কারও দোহাই মানে না বাও বাতাস পেলেই ঢেউ ওঠে এ নদীর রূপ তখন চেনা বড়ো দায় এ পাড় থেকে ওপাড়ে যাওয়া যায় না ছোটো বড়ো নাও তখন চোখে পড়ে না বললেই চলে আবার শান্ত হলে সবকিছু স্বাভাবিক, আগের মতোই চলে কোনো দুঃখের রেখা ফুটে ওঠে না জলে আনন্দ-বেদনা সংগোপনে মিশে থাকে জলের কল্লোলে, জোয়ার-ভাটায়, স্রোতে তখন তাড়াইয়ের বুকে শুধু ছোটো ছোটো ঢেউ ভাঙে গাঙচিল ভেসে থাকে উপরে উড়ে বেড়ায় চিল রাতের অন্ধকারে বাতাসে মিশে থাকে দীর্ঘশ^াস! জলে ঝিকিমিকি করে রূপোলি জোছনা কী যে সুন্দর দেখায় তাড়াইকে!

আজ তাড়াইয়ের বুকে স্রোতের কল্লোল উজান থেকে ভেসে আসছে অল্পস্বল্প কচুরিপানা কখনো কখনো দু একটি কলাগাছ, আমগাছ, জামগাছ, বাঁশঝাড়, মরাপাতাও চোখে পড়ে উজানে ভাঙন লাগলে এমনটি হয়

চারদিক ঝিম মেরে আছে কোথাও যেন বাতাস নেই নৌকার পালগুলো অযথাই মাস্তুলে বাঁধা দাঁড় টেনে, বৈঠা ঠেলে তাড়াইয়ের বুকে আসাযাওয়া করছে নাও সকাল থেকে রোদের তেজও যাচ্ছে বেড়ে ঘাটে ঘাটে নৌকা বাঁধা তার একপাশে গাঁয়ের বউঝিরা স্নান করে কলসিতে জল ভরে চলে যায় ছোটো বড়ো ছেলে-মেয়েরা জলে সাঁতার কাটে কেউ কেউ গরুবাছুরকে গোসল করিয়ে উঠে যায় ঘাটের ওপর উদর পূর্তির জন্য সবুজ বিচালি ঘাসে ছেড়ে দিচ্ছে গোরুগুলো

যারা নদীতে নৌকা নিয়ে আসা-যাওয়া করছে উজান-ভাটি এবং যারা ঘাটে আসে যায়, তাদের অনেকেই দেখছে স্রোতের সাথে ভেসে আসছে একটি লাশ ফুলে ঢোল হয়েছে গায়ে কোনো পোশাক নেই তবে মাথার চুল দেখে বোঝা যায় পুরুষ কার লাশ গো! কীভাবে মরলো! কার মায়ের বুক খালি হলো? কার সিঁথির সিঁদুর গেল? কেউ কেউ বলে, হয়তো উজানে কোথাও নৌকাডুবি হয়েছে অথবা কোনো বাণিজ্যের নায় ডাকাতি হয়েছে বাধা দিতে গিয়েই দস্যুদের হাতে মারা পড়েছে লোকটি অথবা লোকটি সাঁতার জানতো না নদীর ঘাটে গোসল করতে এসে জলে ডুবে গেছে অথবা মৃগী রোগ ছিল লোকটির জলের কাছে আসতেই শরীরে জানান দেয় রোগ লোকটি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে তারপর পড়ে যায় জলে এমন নানারকম কাল্পনিক কথা চলতে থাকে এসব উপেক্ষা করে লাশটি আস্তে আস্তে ঢেউয়ের ধাক্কায় কিনারে আসতে থাকে তারপর ভাসতে ভাসতে নদীর কিনারে চরায় আটকে যায় স্রোত ঠেলেও তাকে সেখান থেকে একটুও ভাটির দিকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে না যারা কাছে আসছে তারা দেখছে, শরীর পচে গেছে মাছে খেয়ে ফেলছে শরীরের অনেক জায়গার মাংস মৃদু বাতাসে চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে তবু লাশের কাছে উৎসুক মানুষের ভিড় নাকে-মুখে গামছা বেঁধে তারা লাশটি নিরীক্ষণ করার চেষ্টা করছে চেহারা বিকৃত হলেও মাথার ঘন কালো চুল, নাকের নিচে ঘন মোচ আর শারীরিক গঠন দেখে বোঝা যায় লোকটির বয়স খুব বেশি না বড়ো জোর ত্রিশ পঁয়ত্রিশ

কয়েকজনে ধরে লাশটি নদীর চরা থেকে পাড়ে তোলে লাশ যারই হোক, সৎকার তো করতে হবে কিন্তু কীভাবে করবে সৎকার? লাশের নুনু যে অর্ধেক নেই হিন্দু না মুসলমান বুঝবে কীভাবে? আহা! কত হতভাগ্য মায়ের পুতগো মুসলমান হলে পেল না কবর আর হিন্দু হলে পেল না চিতা এ লাশ যে শেয়াল-শকুনে খাবে কাক আর পোকামাকড়ে খাবে শুধু কয়খান হাড়গোড় পড়ে থাকবে এখানে কার লাশ? কত দূর থেকে ভেসে এসেছে এখানে কে জানে!

মুসলমানরা বলে, মনে হয় লোকটি মুসলমান দাফনকাফন দেওয়া উচিত

হিন্দুরা বলে, কীভাবে বুঝলেন মুসলমান ছিল লোকটি? আমাদের তো মনে হয় লোকটি হিন্দু ছিল তার জন্য শ্মশানে চিতা সাজানোই উত্তম

দু দলের মধ্যে তর্কবিতর্ক বেধে যায় প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থানে অটল এখান থেকে লাশ তারা কেউ কোথাও নিয়ে যেতে দেবে না প্রয়োজনে রক্তারক্তি হবে যে কারও লাশ পড়বে লাশটিকে কেন্দ্র করে শোরগোল বাড়তে থাকে খবর পেয়ে গ্রাম থেকে ছুটে আসে মাদবর গোছের কয়েকজন মুরুব্বি তাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলাম উভয় আছে তারা এসে সবাইকে জোরে ধমক দেয়, থামো তোমরা কার না কার লাশ তা নিয়ে তোমরা এত শোরগোল করছো কেন? একটি অজানা, অচেনা লাশের জন্য কি আরও লাশ ফেলে দেবে তোমরা? আগে আমাদের ভালো মতো দেখতে দাও যদি আমরা কেউ চিনে উঠতে না পারি, এ লাশ হিন্দু না মুসলমানের, তাহলে এ লাশ এখানেই পড়ে থাকবে শেয়াল-শকুনে খাক, তবু কেউ ছুঁয়েও দেখবে না জাতই যদি চিনতে না পারো, তাহলে সৎকার করবে কীভাবে? তা করেইবা কী লাভ তোমাদের? মহা পাপের ভাগী হবে ধরো লোকটি মুসলমান ছিল, কিন্তু তোমরা তাকে জোর করে নিয়ে চিতায় পোড়ালে, পরে সত্য উদঘাটিত হলে কী করবে তোমরা? কিংবা ধরো, লোকটি হিন্দু ছিল, তোমরা তাকে দাফনকাফন করে কবরে রাখলে, পরে যদি জানা যায় সে হিন্দু ছিল, তখন কী করবে তোমরা? ভালো কাজ করতে গিয়ে মহাপাপী হবে না? তার চেয়ে ভালো তোমরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা কর আমাদের ভালোভাবে দেখতে দাও দেখি লাশটিকে আমরা চিনতে পারি কি না

ঠিক আছে তাহলে তাই করেন আগে

কেউ কোনো কথা বলে না আর মুরুব্বিরা ভালো মতো পর্যবেক্ষণ করতে থাকে লাশটিকে চোখ-কান, নাক-মুখ, হাত-পা, শরীর গায়ের রঙ বয়স কিছুক্ষণ পার হয়ে যায় নীরবতার মধ্যে তারপর গ্রামের জোতদার শ্রেণির একজন ব্রাহ্মণ দৃষ্টি ফেলে আরেকজন জোতদার শেখের ওপর

ও শেখ সাব লাশটি তো চেনা চেনা লাগছে

আমারও কোথায় যেন দেখেছি তাকে

ব্রাহ্মণ লোকটি বলে, কানুনগো রমাবল্লভ নন্দী না তো?

শেখ সাহেব বলে, হঁ, বাবু আমারও তাই মনে হয় সেই রকমই চেহারা হাত-পা, চোখ-মুখ সবই মিলে যায়

কেউ কেউ বলে, আমরা এসব বুঝি না এ লাশ যদি কানুনগো রমাবল্লভ নন্দীরই হয়, তাহলে, কোনো কথাই নেই আমরা কাঁধে করে লাশ সেখানে পৌঁছে দিয়ে আসবো কিন্তু এ লাশ যদি তার না হয়!

ব্রাহ্মণ ও শেখ একে অপরের দিকে চোখে চোখ রাখে কথা তো ঠিকই একই মানুষের মতো আরও মানুষ থাকতে পারে না শেখ সাব তখন কয়, বাবু, এতে কোনো সমাধান নাই তার চেয়ে ভালো, আমাদের মধ্যে থেকে দুজন এবং আপনাদের মধ্যে থেকে দুজন বিশ^স্ত লোক পাঠিয়ে দেই কানুনগো পাড়ায় তারা গিয়ে আগে জেনে আসুক, রমাবল্লভ নন্দী বাড়ি আছে কি না না থাকলে কোথায় গেছে, কবে ফিরবে সে আদৌ বেঁচে আছে কি না সত্যটা তারা জেনে এসে আমাদের জানাক তারপর ব্যবস্থা নেওয়া যাবে একটি অজানা, অচেনা লাশকে কেন্দ্র করে আমরা কেউই অযথা গ্যাঞ্জাম করতে চাই না ঝগড়াবিবাদ চাই না শান্তি চাই

লোকজনের মধ্যে থেকে কথা ওঠে, এটাই উত্তম প্রস্তাব আর দেরি করবেন না কে কে যাবে, এখনই বাছাই করুন এখনই পাঠিয়ে দিন গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে ফিরে আসতেও তো বেশ খানিকটা সময় লাগবে বিকাল বা সন্ধ্যা হয়ে যাবে যাক, তবু ভালো

চারজন লোককে বাছাই করে তারা বৃদ্ধ নয়, আবার একেবারে তরুণও না সত্যবাদী, বিশ^স্ত শক্তিশালী এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই তারা ছোটে দ্রুত পায়ে কানুনগো পাড়ার দিকে

পদ্মগন্ধার পলায়ন

গতকাল দুপুরে বাড়িতে খেতে আসেনি রমাবল্লভ নন্দী পদ্মগন্ধা ভেবেছিল, অফিসে কাজের চাপ কাজ শেষ করে বিকালে ফিরবে কিন্তু সন্ধ্যায় কিংবা রাতেও বাড়ি ফিরে আসেনি রমাবল্লভ নন্দী এমন তো কখনো ঘটেনি না বলে কোথাও যায় না সে আজ কোথায় গেল? তার শ^শুর-শাশুড়ি ছেলের চিন্তায় খুব অস্থির হয়ে পড়েছে শাশুড়ি তো মাঝে মাঝেই ডুকরে উঠছে ও রমা, রমা কোথায় গেলি রে বাপ আজ দুদিন হয়ে গেল তোর কোনো খোঁজ নেই

পদ্মগন্ধাও বুঝে উঠতে পারে না হঠাৎ মানুষটা কই গেল রাতে ঘুম আসে না তার সারারাত বিছানায় এ-পাশ ও-পাশ করে ভোর হতে না হতে কুসুমকে অফিসে পাঠায় অফিস বন্ধ তখন তার খেয়াল হয়, এত সকালে তো অফিস খোলে না কোনোদিন বেলা আরেকটু বেড়ে গেলে সে কুসুমকে আবার অফিসে পাঠায় এবার সে খবর আনে, গতকাল দুপুরের আগেই জমিদারের একজন লোক আসে রমাবল্লভের কামরায় তার সাথে স্বল্পকাল কথা হয় তারপর সে হাসতে হাসতে তার সাথে বেরিয়ে যায় তারা ভেবেছিল, কিছুক্ষণ পরই অফিসে ফিরে আসবে রমাবল্লভ নন্দী কিন্তু সারাদিনে সে অফিসে ফিরে আসেনি তারা ভেবেছিল, জমিদারের কাছারিতে গেছে বাবু আজ আর ফিরবে না সন্ধ্যার আগ দিয়ে অফিস বন্ধ করে তারা বাড়ি ফিরে যায় কিন্তু রাতেও রমাবল্লভ নন্দী বাড়ি ফিরেনি শুনে তারা বেশ অবাকই হয় এমন তো কখনো হয় না কোথায় গেল বাবু? তাহলে কি সে জমিদারের কাছারিতে যায়নি? নাকি দেরি হয়ে গিয়েছিল বলে সেখানেই থেকে গেছে বাবু আজ ফিরে আসবে কুসুমকে তারা বলে, বউদিকে দুশ্চিন্তা করতে না কর হয়তো দুপুরে, না হয় বিকালে ফিরে আসবে বাবু কিন্তু তাতেও পদ্মগন্ধার মন মানে না অস্থির লাগে বেলা যত বাড়তে থাকে, অস্থিরতা ততই বাড়তে থাকে রমাবল্লভ নন্দীকে কোনোদিন সে ভালোবেসেছে কি না মনে পড়ে না আসলে পাশাপাশি থাকলে সম্পর্কটা বোঝা যায় না নিত্য-নৈমিত্তিক কর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে কিন্তু মানুষটা কাছে না থাকলে কিংবা দূরে গেলে সম্পর্কের সুতোয় টান পড়ে মনের মধ্যে শূন্যতা তৈরি হয় হাহাকার করে ওঠে পদ্মগন্ধা কান পেতে থাকে মানুষটার পদধ্বনি শোনা যায় কি না কিংবা খিড়কিতে করাঘাত কিন্তু বেলার দিকে তাকিয়ে সে হতাশই হয়, না বলে কোথায় গেল মানুষটা! জমিদারের কাছারিতে গেলেও তো বাড়ি এসে বলে যেতে পারতো কতক্ষণই বা লাগতো নাকি জমিদারের লোক সঙ্গে ছিল বলে আসেনি ওখান থেকেই সরাসরি চলে গেছে কাছারিতে কাছারিতেই বা এমন কী কাজ যে রাতে থাকতে হবে বাড়ি ফিরে আসা যাবে না দুপুর গড়িয়ে বিকাল হবার দশা এখনো ফিরে আসছে না রমাবল্লভ নন্দী!

শ^শুর-শাশুড়িকে সে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করে, চিন্তা করবেন না আপনারা হয়তো জরুরি প্রয়োজনে কোথাও গেছে ফিরে আসবে তাড়াতাড়ি

শাশুড়ি বিষণ্ন ও করুণ কণ্ঠে বলে, তাই যেন আসে, বৌমা কোথায় বা যাবে আমার রমা এখানে তার যাওয়ার জায়গা কই?

দুপুরে শ^শুর মহাশয় বেরিয়েছে ছেলের খোঁজখবর নিতে এখনো ফিরে আসেনি বৃদ্ধ মানুষ, এই তাপদাহের মধ্যে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, কে জানে! তবু রমাবল্লভের খোঁজ পেলে ভালো হয়

এ সময় পাচিলের দরোজায় করাঘাত ওই বুঝি এলো সে! কুসুমকে সে দরোজা খুলতে পাঠিয়ে দেয় কুসুম একদৌড়ে যায়, আবার একদৌড়ে ফিরে এসে বলে, মাসি মা, মেসো মশায় নয় চারজন লোক তারা মেসো মশাইয়ের খোঁজ করে বাড়িতে আছে কি না জানতে চায়

জানিয়ে দে, সে বাড়িতে নেই

কুসুম আবার দৌড়ে যায়, আবার ফিরে আসে দৌড়ে বলে, লোকগুলো আপনার সাথে কথা বলতে চায় আপনি গিয়ে কথা বলেন

পদ্মগন্ধা এগিয়ে যায় পাচিলের দরোজার কাছে একপাশে দাঁড়িয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে বলে, কে আপনারা? কোথা থেকে এসেছেন? কী জানতে চান, বলুন

তারা বলে, আমাদের চিনবেন না আমরা ভিন গাঁয়ের লোক তাড়াই নদীর পাশেই আমাদের গ্রাম অফিসে গিয়েছিলাম রমাবল্লভ নন্দীর খোঁজে পেলাম না ভাবলাম বাড়িতে আছে কি না দেখে যাই

না, বাড়িতে নেই

কোথায় গেছে জানেন?

না শুনেছি জমিদারের কাছারিতে

লোকগুলো একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে পদ্মগন্ধা বলে, কেন তার খোঁজ করছেন, বলুন তো

লোকগুলো ইতস্তত করে, না, মানে কী বলবো আপনাকে বলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না

না না সমস্যা নেই কী বলবেন বলে ফেলুন

না, ঠিক আছে এখন আমরা যাই পরে না হয় আসবো ভালো মতো খোঁজখবর নিয়ে

তারা আর দেরি করে না চলে যায় পদ্মগন্ধা অবাক কিছু বলতে গিয়েও লোক দুটো থেমে গেল কেন রমাবল্লভের কোনো খারাপ সংবাদ নেই তো?

এ সময় ফিরে আসে তার শ^শুর তাকে বেশ হতাশ, ক্লান্ত ও বিষণ্ন দেখায়

বউ মা!

তার কণ্ঠ যেন একেবারে ভেঙেচুরে ম্লান হয়ে আসে

কী হয়েছে, বাবা! আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?

রমার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না গাজীর সাথে তার কী হয়েছে জানি না লোকজন বলাবলি করছে, ঝগড়া হয়েছে গাজী নাকি রমাকে খুন করেছে তার লোকজন নাকি এদিকে আসবে, আমাদের ধরে নেওয়ার জন্য সেখানে নিয়ে গেলে কি আমাদের আস্ত রাখবে? ম্লেচ্ছ জমিদার মানসম্মান তো যাবেই বাপ-দাদার ধর্মও আর থাকবে না সব জলাঞ্জলি দিতে হবে

এ সব কী বলছেন বাবা?

যা বলছি, ঠিকই বলছি তাড়াতাড়ি সবকিছু গোছগাছ কর শকট আসছে

কোথায় যাবো আমরা

আপাতত নদীর ঘাটে ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিমপাড়ে গোয়ালপাড়ার অন্তর্গত রাঙ্গামাটিয়ায় বাণীবল্লভের কাছারি পাশেই তার বাড়ি তার কাছেই যাব সে-ই একটা কিছু করতে পারবে তাছাড়া যাওয়ার আর কোনো জায়গা দেখছি না

ওখানেই যাবেন?

হ্যাঁ ওর বাবা ভূবনানন্দ নাগ চন্দ্রদ্বীপের অধীন কড়াপুর নিবাসী আমার জ্ঞাাতি ভাই

তার শাশুড়ি এগিয়ে এসেছিল পাচিলের কাছে সবকিছু শুনে সে কাঁদতে থাকে, ও রমা রমা রে বাপ আমার তোর সাথে কার এত শত্রুতা? আমার ছেলের কিছু হলে গাজীর বংশ যেন নির্বংশ হয়

শ^শুর বলে, চুপ করো চুপ করো কান্দনের সময় এখন না এর জন্য অনেক সময় পাইবা আগে নিজেদের জীবন বাঁচাও ধর্ম বাঁচাও ওই পাড়ে চলো বাণীবল্লভের কাছে

তুমি তো বাপ না, পাষাণ একটা এই ম্লেচ্ছদেশে আমার পোলার কী হইলো, তা না জাইনা আমরা কীভাবে যাই

শকট এসে থামে, বাড়ির খিড়কির কাছে চালকের বয়স বেশি না বিশ বাইশ বছর চেহারা খানিক লম্বা বেশ শক্তপোক্ত শরীর মাথায় একটা গামছা বাঁধা সে বলে, বেশি দেরি করা যাইব না কাকা শুনছি গাজীর লোকজন রওয়ানা দিছে তাদের আসার আগেই ঘাটে গিয়া নদী পার হইতে হইব তা না অইলে শুধু আপনারা না, আমিও ঘোর বিপদে পইড়া যাব কই, তাড়াতাড়ি করুন আপনারা তা না অইলে আমি এক্ষণি ফিইরা যামু বাড়ি

পদ্মগন্ধার সম্বিৎ ফিরে আসে তার শাশুড়িরও অবস্থা যখন এতই বিপদাপন্ন, নিজের বাঁচামরা প্রশ্ন, তখন আর অন্য কিছু চিন্তা করার সময় কই! তারা দ্রুত ঘরে ফিরে যায় কাপড়চোপড়, গয়নাগাটি, টাকাপয়সা একটি বাক্সে ভরে ছেলেকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে পদ্মগন্ধা তার শাশুড়িও

শ^শুরের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার বাবার বাড়ি গেলে হয় না?

ওটা কোনো নিরাপদ জায়গা নয়, বৌমা এখানে আমাদের না পেলে গাজীর লোকজন নিশ্চয় তোমাদের ওখানে গিয়ে খোঁজ করবে

শ^শুর মহাশয়ের কথায় যুক্তি আছে পদ্মগন্ধা আর কিছু বলে না তারা শকটে উঠে বসতে না বসতেই শকট ছেড়ে দিলো চালক কুসুম এসে দাঁড়িয়ে ছিল সামনে তার দৃষ্টি করুণ আমাকে সঙ্গে নিবে না মাসি? কী বলবে পদ্মগন্ধা? তাদের নিজেদেরই এখন থাকার জায়গা নেই, বাঁচে না মরে, ঠিক ঠিকানা নেই, কুসুমকে রাখবে কোথায়? শুধু পেছন দিকে খানিক ঘুরে পদ্মগন্ধা বলল, বাড়ি ফিরে যা কুসুম যদি পারি পরে তোর খোঁজখবর নিবো

কুসুম কিছুই বলল না বড়ো অবাক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল খুব অভিমান কুসুমের এত বড়ো শকটেও তার জায়গা হবে না! চোখ টলমল করে জলে কিন্তু সে কাঁদলো না পাথরদৃষ্টিতে শুধু তাদের দিকে তাকিয়ে রইল কুসুমের জন্য খুব মন খারাপ হলো পদ্মগন্ধার কিন্তু কোনো উপায় নেই হয়তো তার সাথে এ জীবনে আর দেখাই হবে না সংসারের কত কাজ করে দিয়েছে ওই ছোট্ট মেয়েটা রামনাথ নন্দী ছিল ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছলছল চোখে সে তাকিয়ে ছিল রামনাথ নন্দীর দিকে রামনাথ নন্দীও মন খারাপ করে তাকিয়ে ছিল কুসুমের দিকে শকট কিছুদূর আসার পর দুতিন বার সে জিজ্ঞেসও করেছে, মা, কোথায় যাচ্ছি আমরা? নানাবাড়ি? কুসুম বুবু যাবে না? পদ্মগন্ধা কোনো জবাব দিতে পারেনি রামনাথ নন্দীও আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি তার চোখেমুখেও যেন একরাশ ভয়, আতঙ্ক

ভয়ে তার শ^শুর-শাশুড়ির চোখ-মুখও পাণ্ডুর তারা কেউ কিছু বলছে না শকটচালক টাট্টু ঘোড়ার পিঠে চাবুক কষে জোরে চালাচ্ছে শকট কিছুদূর যাওয়ার পর তার শাশুড়ি চাপাস্বরে ডুকরে উঠল, আগেই কইছিলাম, এই ম্লেচ্ছদেশে আসার দরকার নেই তা বাপ-বেটা শুনলোই না আমার কথা আমার বেটার এখন কী হইল রে, ভগবান

শের আলী গাজীর মুখ মনে পড়ল পদ্মগন্ধার মনে পড়ল রমাবল্লভের মুখ ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে কণ্ঠে আসতে চায় কান্না আঁচলে মুখ লুকায় পদ্মগন্ধা এ আপনি কী করলেন গাজী! আমাকে পাওয়ার জন্য একজন নিরপরাধ মানুষকে কি আপনি সত্যিই খুন করেছেন? যদিও তা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না কিন্তু রমাবল্লভের তো কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না সে তো না বলে বাইরে থাকার লোক না তাহলে, সত্যিই আপনি তাকে খুন করেছেন? ছিঃ ছিঃ! এর চেয়ে ভালো হতো না যদি আপনি আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে যেতেন গড়জরিপায়? যদি ভালোবাসতেন তাহলে তাই করতেন এই নিষ্ঠুর পথ কেন বেছে নিলেন? এ বড়ো লজ্জার, এই বড়ো ঘৃণার আপনাকে ক্ষমা করা যায় গাজী

গাজীর জন্য এতদিন তার মনে যে ভালোবাসা তিলে তিলে গড়ে উঠেছিল, আজ মুহূর্তে তা যেন উবে গেল, যেভাবে জল বাষ্পীভূত হয়ে শূন্যে অদৃশ্য হয়ে যায় এখন তার দিলে আছে শুধুই ঘৃণা মনে মনে সে গাজীকে অভিশাপ দেয়, আপনি আমাকে স্বামীহারা ও সংসার হারা করে, অকূল পাথারে ঠেলে দিয়েছেন, আপনার ভালো হবে না গাজী আপনিও একদিন আমার মতোই অকূল পাথারেই পড়বেন আমাকে আপনি কোনোদিনই পাবেন না না মনে, না শরীরে যদি সে রকম কোনো সুযোগ আপনার আসে, আমি আত্মহত্যা করবো তবু যাবো না আপনার কাছে এরকম একজন খুনিকে আমি কিছুতেই ভালোবাসতে পারি না পারবোও না কোনোদিন

টাট্টু ঘোড়া দুটি খুরে আওয়াজ তুলে দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে মাঝে মাঝে খুব ঝাকি লাগছে টাল সামলাতে কষ্ট হচ্ছে পদ্মগন্ধার ছইয়ের সামনে ঝালর টানা তারই ফাঁকফোকর দিয়ে দেখা যাচ্ছে সড়কের দু পাশে ফেলে যাওয়া গাছপালা, বাড়িঘর মানুষজন সবকিছু কত স্বাভাবিক আছে অথচ এরই মধ্যে তার জীবনে নেমে এসেছে ভয়াল বাঘের থাবা কেউ জানতে পারলো না, বুঝতে পারলো না, এই বহমান স্বভাবিক জীবনধারার মধ্যে দিয়ে অনিশ্চয়তা ও ব্যথার একটি পাথর বুকে চেপে নীরবে পদ্মগন্ধা চলে যাচ্ছে চেনাজানা চৌহদ্দি ছাড়িয়ে, দূরে এই গাঁয়ে আর কি তার কোনোদিন ফিরে আসা হবে? তার বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে খুব কান্না পাচ্ছে কিন্তু কাঁদা যাবে না ছেলেটা শকটে উঠেই কুসুমের জন্য মন খারাপ করে তার বুকে মুখ লুকিয়ে এখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে এখন সেও যদি কাঁদে, তাহলে, রামনাথ চিৎকার করে উঠবে, তার শাশুড়িকেও সামাল দেওয়া যাবে না আশপাশের লোকজন জেনে যাবে ঘটনা এর ফল খুব বেশি ভালো হবে না তার চেয়ে এই তো ভালো নিঃশব্দে চোখের অবিরল ধারা বয়ে যাক, সে সংগোপনে আঁচলে মুছে ফেলবে চোখ কেউ দেখবে না, বুঝবে না, কেন কাঁদছে পদ্মগন্ধা ওই তো দেখা যাচ্ছে কল্লোলিনী ব্রহ্মপুত্রের তীর ঘাটে একটা নৌকাও দেখা যাচ্ছে

চক্রান্ত

রাঙ্গামাটিয়ায় বাণী বল্লভের বাড়িটি বেশ বড়োসড়োই একটি কামরা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে পদ্মগন্ধা এবং তার ছেলেকে আরেকটি কামরায় তার শ^শুর-শাশুড়ি শাশুড়ি দিনরাত অভিসম্পাৎ করে শের আলী গাজীকে তার বংশ যেন নির্বংশ হয় নিরাপরাধ ছেলেকে গাজী হত্যা করেছে এ পাপ ভগবান কিছুতেই সইবে না কত ভালো মানুষ ছিল রমা শিক্ষাদীক্ষা, ভালো চাকরি কীসে কম ছিল সে? সবাই কত সম্মান করতো তাকে কিন্তু পোড়া কপালে আমার সুখ সইলো না ওর ওপর শকুনে চোখ পড়লো ম্লেচ্ছ জমিদারের! আহা! ছেলের লাশটাও বাড়িতে এনে সৎকার করা গেল না খবর পেয়ে বসন্তরঞ্জন নাকি ছুটে গিয়েছিল সেই ঘাটপাড়ে ততক্ষণে রমাবল্লভ নন্দীর লাশ চিতায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে পদ্মগন্ধার বাবা-মা এখন কেমন আছে, ভালো না মন্দ, তাড়াতাড়ি কিছুই জানার উপায় নেই

সারাদিন বিষণ্নমনে ঘরে বসে থাকে পদ্মগন্ধা খাবারদাবার, যত্নআত্তির কমতি নেই এখানে কিন্তু কিছুই তার ভালো লাগে না রমাবল্লভ নন্দী বেঁচে নেই এটা তার বিশ^াসই হতে চায় না এমন একজন নিরীহ, নিরাপরাধ মানুষকে কেন হত্যা করলেন শের আলী গাজী? শুধু মাত্র আমাকে পাওয়ার জন্য এমন নিষ্ঠুর কাম তিনি কীভাবে করতে পারলেন? নাকি রমাবল্লভ নন্দীর অন্য কোনো শত্রু ছিল? কিন্তু সেরকম কারো সাথে শত্রুতা থাকলে তো সে তাকে জানাতো সে তো এরকম কথা গোপন করার মতো মানুষ না

আমি তোমাকে তান্ডায় সুবাহদারের দরবারে নিয়ে যেতে চাই আমি জানি, এতে তোমার কোনো আপত্তি থাকার কথা নয় সুবাহদার শাহবাজ খান যদিও মুসলমান, কিন্তু অন্যরকম মানুষÑ ন্যায় বিচারক হিন্দু-মুসলমানকে তিনি একই চোখে দেখেন অন্যায়কারী যে-ই হোক তাকে যথাযথ শাস্তি দেন শের আলী গাজী মুসলমান হলেও পার পাবে না কারণ তারই কানুনগোকে গাজী হত্যা করেছে এই অন্যায় হত্যাকাণ্ডের ন্যায় বিচার তিনি করবেনই তাই তোমাকে তান্ডায় সুবাহদার শাহবাজ খানের কাছে যেতেই হবে তোমাকেই সুবাহদারের দরবারে খুনি শের আলী গাজীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে হবে ভয় পেও না তুমি একা নও এই অঞ্চলের সকল হিন্দু জমিদার তোমার সাথে আছেন আমরাই তোমাকে তান্ডায় গমনাগমন, সেখানে থাকা-খাওয়া এবং সুবাহদারের দরবারে অভিযোগ তোলার ব্যবস্থা করে দেবো তবে কথা একটাই শের আলী গাজীর প্রতি তুমি বিন্দু মাত্র অনুকম্পা দেখাতে পারবে না আজ সে তোমার স্বামীকে হত্যা করেছে সুযোগ পেলে একদিন তোমার ছেলেকেও হত্যা করবে ওই পাষণ্ডের কোনো মায়াদয়া নেই নিজের স্বার্থের জন্য সে সবকিছু করতে পারে কাজেই তুমি তৈরি হয়ে নাও দু একদিনের মধ্যেই আমরা রওয়ানা দেবো তান্ডা অনেক দূরের পথ বটে তবে আমাদের শকটগুলো সেই ভাবেই প্রস্তুত করছি চিন্তা করো না, তুমি একা নও তোমার শ^শুর-শাশুড়িও তোমার সাথে যাবে

হায় তান্ডা!

পদ্মগন্ধা জানতো না, এমন কি কোনোদিন শুনেছে বলেও মনে পড়ে না এখানে আসার পরই জানতে পেরেছে, এখানে তার বাবার এক মামাতো ভাই থাকে সুবাহদারের দরবারে নাকি চাকরিও করে তার নাম সুখরঞ্জন দাশ আসল নিবাস কোলকাতা চাকরির সুবাদে এই তান্ডাতেই আবাস গড়েছে

এখানে আসার দিন কয়েক পরই পদ্মগন্ধার বাবা-মা আসে

বসন্তরঞ্জন মুখোপাধ্যায় তার খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করছে প্রায় প্রতিদিনই সে দু একবার বের হয় তার খোঁজে আশপাশের লোকজনের কাছে তার নাম বলে জানতে চায় তারা তাকে চিনে কি না কিন্তু কেউ কোনো সদুত্তর দিতে পারে না কেউ বলে ঘোড়াশালে থাকে এক সুখরঞ্জন দাশ বাইরে খুব কম বের হয় কেউ বলে, ঘোড়াশালে নয়, সুখরঞ্জন নেজামতে চাকরি করে কালেভদ্রে বের হয় তার পরিবার কলকাতায় থাকে যা-ই হোক, তাকে পেলে খুব ভালো হতো নেজামতের চাকরি তো আর যেমন তেমন চাকরি না অনেক ক্ষমতা অনেক দাপট নিশ্চয় মাঝে মাঝে সুবাহদার শাহবাজ খানের সাথে তার দেখা-সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়! সুখরঞ্জন তাদের জন্য অনেক কিছুই করতে পারতো কিন্তু তাকে পাওয়া যাবে কীভাবে?

নাতিকে সঙ্গে নিয়ে সে কয়েকদিন দূর থেকে রাজপ্রাসাদের আশপাশে ঘোরাঘুরি করেছে সুখরঞ্জনকে খোঁজার চেষ্টা করেছে সুবাহদারের প্রাসাদের প্রধান ফটক দিয়ে মাঝে মাঝে লোকজন ভেতরে ঢোকে, আবার অনেকে বের হয়ে আসে, এদের মধ্যে কেউ যদি সুখরঞ্জন দাশ হয়! সুবাহদারের প্রাসাদে চাকরি পাওয়ার পর সুখরঞ্জনের বেশভূষা ও চেহারা কি পরিবর্তন হয়ে গেল? যতই পরিবর্তন হোক, তাকে এক নজর দেখলেই বসন্তরঞ্জন চিনতে পারবে কিন্তু সেরকম কাউকে এই কদিনে সে দেখতেই পেল না! প্রধান ফটকে তলোয়ার ও বন্দুক হাতে পাহারা দিচ্ছে যে পাহারাদাররা, তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে এই প্রাসাদে সুখরঞ্জন দাশ নামে কেউ চাকরি করে কি না কিন্তু তাদের চেহারায় তেজি ভাব দেখলেই তার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে তাছাড়া এই রাজপ্রাসাদে কত লোক চাকরি করে, সবাইকে কি ওরা চিনতে পারবে? এই প্রাসাদের আশপাশে বেশি ঘোরাঘুরি করাও ঠিক না গুপ্তচররা আবার সন্দেহ করে বসতে পারে শেষে কপালে না জানি কী ঘটে জাকজমক প্রাসাদ দেখে রামনাথ খুব খুশি সুবাহদারের প্রাসাদ এত বড়ো, এত সুন্দর! এমন একটি প্রাসাদ যদি আমাদের থাকতো! বসন্তরঞ্জন মুখ টিপে হেসে বলে, হবে, তোমারও এমন প্রাসাদ হবে, রামনাথ

রাজপ্রাসাদের পাশেই গঙ্গা এখান থেকেই গঙ্গার দুটি শাখা দুদিকে কলকল করে বয়ে গেছে সেখানে উজান-ভাটিতে যাওয়া-আসা করে পালতোলা ছোটো-বড়ো কত রকমের নাও কেউ কেউ গুন টেনে উজানে যায় কেউ কেউ দাঁড় টেনে যায় ভাটিতে নাও থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসে মাঝিদের গানের সুর কোনো কোনোদিন তাদের গানে বসন্তরঞ্জন ভেসে যায় অজানায়, বহুদূর

মাঝে মাঝেই নানা-নাতি চলে আসে গঙ্গার পাড়ে রামনাথ গানটান বোঝে না সে তাকিয়ে থাকে ঘাটে বাঁধা বড়ো বড়ো রাজকীয় নৌকার দিকে এত সুন্দর নৌকা আগে সে কোনোদিন দেখেনি নানাকে সে প্রশ্ন করে, ওইটা কী নাও? এইটা কী নাও? এই নায়ে কারা কোথায় যায়? সুরের মগ্নতায় ছেদ পড়ে বসন্তরঞ্জনের সে নাতির প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে প্রায় ক্লান্ত হয়

না, নাওগুলো আসলেই খুব সুন্দর এটা হয়তো রাজঘাট তবে এখানেও ছোটো ছোটো নাও আছে অনেকগুলো একটি নাও তো অনেক বড়ো অবিকল যেন জলে ভাসা ময়ূর নাতিকে সে বলে, এই যে, এই নাওয়ে চরেই সুবাহদার শাহবাজ খান নৌবিহার করেন ও ঘাটে নৌকায় বসে মাঝি-মাল্লারা গল্পস্বল্প, হাসিঠাট্টা করছে ভাটিতে, আরেকটি ঘাট সেখানে নৌকা এসে ভিড়ছে, ছেড়ে যাচ্ছে উজানে-ভাটিতে মালপত্র উঠা-নামা করছে লোকজন আসছে-যাচ্ছে সবাই খুব ব্যস্ত তারা হেঁটে হেঁটে সেখানে যায় লোকজনের ব্যস্ততা দেখে দুপুর গড়িয়ে বিকালের হলে তারা ঘরে ফেরে কমলা দেবী বলে, সুখরঞ্জনের সাথে দেখা হলো?

না

কেমন মানুষ তুমি, এতদিনেও লোকটার কোনো খোঁজ করতে পারলে না?

বসন্তরঞ্জ চুপ করে থাকে তার সাথে তর্ক করা বৃথা কমলা দেবী বলে, তার খোঁজ পাওয়া গেলে কত উপকার হতো

বসন্তরঞ্জন ভাবে, তা তো ঠিকই কিন্তু তার খোঁজই তো পাওয়া যাচ্ছে না চেষ্টা তো আর কম হচ্ছে না এই এলাকায়, লোকে সুখরঞ্জন নামে যাকে চেনেজানে, সে সুবাহদারের ঘোড়াশালে চাকরি করে ঠিকই, তার বাড়ি গিয়েও দেখে এসেছে বসন্তরঞ্জন, কিন্তু সে তাদের কেউ না দ্বিতীয় আরেকজন সুখরঞ্জনের খোঁজ কেউ দিতে পারছে না এমনও হতে পারে, সুখরঞ্জন নামে আর কেউ হয়তো এখানে চাকরিই করে না কলকাতায় গিয়ে বাড়ি থেকে জেনে আসা দরকার সুখরঞ্জন আসলে কোথায় চাকরি করে রাজ দরবারে নাকি সরকারের অন্য কোনো কাছারিতে এমনও তো হতে পারে, এখানে সে চাকরিই করে না চাকরি করে এই তান্ডাতেই কোনো জমিদারের কাছারিতে লোকের মুখে তারা যা শুনেছে, ভুল শুনেছে

কমলা দেবী বলে, বাণীবল্লভ বাবুও চুপ করে বসে আছে ভালো-মন্দ কোনো সংবাদই দিচ্ছে না হায়! ভাগবান কী হবে কে জানে! এত সুন্দর সুখের সংসার মেয়ের, জ¦লেপুড়ে ছারখার হয়ে গেল

চিন্তা কর না বাণীবল্লভ তো চেষ্টা করছে সময় হলেই ডাক পড়বে রাজদরবারে

পরদিন বিকালে বাণীবল্লভ এসে বলল, সুখবর আছে আগামী কাল রাজ দরবারে যাওয়ার ব্যবস্থা প্রায় পাকাপাকি শের আলী গাজীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দাঁড় করানো হয়েছে নিশ্চিত বিচারে তার কঠিন শাস্তি হবে তাই তোমাকে আরও শক্ত হতে হবে ধৈর্য ধরতে হবে, বৌদি আমরা তোমাকে যেভাবে শিখিয়ে পড়িয়ে দিচ্ছি, সেভাবেই সুবাহদার শাহবাজ খানকে বলতে হবে, অবশ্য যদি তিনি কোনো প্রশ্ন করেন, তাহলে তাছাড়া কিছু বলার প্রয়োজন নেই

বিচার

একটি কালো ঝালরের ওপাশে দাঁড়িয়ে পদ্মগন্ধা এ পাশে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে শের আলী গাজী ঝালরের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় তার মুখের আভা তাকে দেখলে কেন তিনি ভেতরে ভেতরে এত অস্থির হয়ে পড়েন? আড়চোখে তার দিকে আরেকবার তাকালেন শের আলী গাজী এই তো সামান্য একটু জায়গা, কানুনগো পাড়ার বাড়ির খোলা জানালার চেয়েও কত কাছে, কালো ঝালর সরিয়ে ফেললেই দেখা যাবে পদ্মগন্ধার মুখ, তবু তার মনে হয় মাঝখানের এই দূরত্বটুকু কোনোদিন ঘুচবে না জনম জনমের পথ ‘বঁধু, তোমার আমার এই বিরহ এক জনমের নহে’ জনম জনম ধরে এই বিরহ, এই না-পাওয়ার হাহাকার কি শুধু থেকেই যাবে? কোনোদিন কি ছুঁয়ে দেখতে পারবো না তোমার মুখ? আজ তুমি যে কারণে দাঁড়িয়েছো রাজ দরবারে, আমি সেই অপরাধে মোটেও অপরাধী নই তোমার স্বামীকে আমি হত্যা করিনি পদ্মগন্ধা তবু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, আমার গায়েই লেগে আছে খুনের কালিমা ভালোবাসা নয়, হয়তো তোমার প্রচণ্ড ঘৃণা ও ক্রোধানল আমাকে দগ্ধ করে ফেলছে যতক্ষণ আমি নিঃস্ব না হই, নিঃশেষ না নই, ততক্ষণ তুমি শান্তি পাবে না, এই তো? তুমি কী চাও পদ্মগন্ধা? আজ তুমি যা চাইবে, আমি তাই দিতে প্রস্তুত তোমাকে দেখার পর ভেতরে যে পীড়ন সৃষ্টি হয়, তা থেকে আমি মুক্তি পেতে চাই আদৌ কি মুক্তি পাবো কোনোদিন? নাকি তোমাকে না-পাওয়ার আগুন আমাকে আমৃত্যু পোড়াবে? আড়চোখে পদ্মগন্ধার দিকে আবারও তাকালেন শের আলী গাজী

পদ্মগন্ধাও তাকিয়ে শের আলী গাজীর দিকে সে ভাবছে, কী সুন্দর মুখ! নিষ্পাপ চোখ এখনো আমার জন্য দুচোখে জমে আছে গাঢ় মায়া, প্রেম দু চোখে কী তৃষ্ণা! এ জন্যই সে বারবার দেখছে আমাকে! এই মানুষ কীভাবে হত্যাকারী হয়? আমার তো বিশ্বাস হয় না তবু তোমার বিরুদ্ধেই তো উঠেছে রমাবল্লভ নন্দীকে হত্যার অভিযোগ কেন হত্যা করেছ তাকে? শুধু আমাকে পাওয়ার জন্য? যাকে একটু জোর করলেই পেতে পারতে, তার জন্য তোমার হাতে কেন খুনের কালিমা লাগালে, গাজী? নাকি তুমি আদৌ খুন করোনি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছ? তাহলে রমাবল্লভ নন্দীকে হত্যা করলো কে? কেনই-বা তাকে হত্যা করলো? তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে তুমি মানুষ হত্যা করতে পারো না কেননা তোমার চোখে জমে আছে প্রেম অনন্ত তৃষ্ণা তুমি শুধু ভালোবাসতেই পারো, জোর করে কিছু আদায় করে নিতে জানো না তা না হলে, এত বছর গেল, আমার বাড়ির দোর ভেঙে তুমি ভেতরে প্রবেশ করতে পারলে না তুমি খুনি বা প্রেমিক যা-ই হও না কেন, তবু আমি তোমাকে ভালোবাসি তোমার মুখের দিকে তাকালে আমার সব রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা ধুয়েমুছে যায় তোমাকে শুধু ভালোবাসা যায় গাজী, ঘৃণা করা যায় না তোমাকে শুধু কাছে পাওয়ার সাধ জাগে, দূরে ঠেলে দিতে ইচ্ছে করে না তুমি হয়তো কোনোদিনই জানবে না, তোমার জন্য তিলে তিলে আমি পুড়ি গোপনে যদিও আজ এই রাজ দরবারে দাঁড়িয়েছি তোমার বিরুদ্ধে, কিন্তু বিশ^াস কর, আমি তা কোনোদিনই চাইনি তবু আমাকে দাঁড়াতে হয়েছে সময়ই আজ আমাকে তোমার বিরুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে জানি না, তোমার কী শাস্তি হবে ভগবানের কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছি, তুমি যেন রেহাই পাও সুবাহদারের ক্ষোভানল থেকে

সুবাহদার শাহবাজ খান তাকালেন শের আলী গাজীর দিকে তার ওপর তার খুব গোস্যা সামান্য একজন জমিদার হয়ে কীভাবে তিনি এত বছর খাজনা না দিয়ে পারলেন? বছরের পর বছর রাজকোষাগারে তার থেকে একটি কানাকড়িও পড়েনি কেন? সে কি বাংলার এই সুবাহদারকে মোটেও তোয়াক্কা করে না? সুবাহদারের চেয়েও স্বাধীনভাবে সে জমিদারি চালাতে চায়? কী দুঃসাহস! সামান্য একটি ইঁদুর হয়ে লড়াই করতে চায় হাতির সাথে! পাহলোয়ান গাজী আর ফজল গাজীর বংশধর বলে এতদিন তিনি তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি কিন্তু সে হত্যা করেছে তারই নিযুক্ত কানুনগো রমাবল্লভ নন্দীকে তার শিশু সন্তানকে এতিম করেছে এই শিশু সন্তান নিয়ে এই বিধবা ভদ্র মহিলা এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কীভাবে বাঁচবে? এই অন্যায় তো কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না ক্রদ্ধ দৃষ্টিতে তিনি তাকালেন শের আলী গাজীর দিকে

আপনিই তো শের আলী গাজী, দশকাহনিয়ার জমিদার, তাই না?

জি¦ হুজুর

বহু বছর যাবৎ আপনি রাজকোষাগারে প্রাপ্য খাজনা তো দূরের কথা, একটি কানা কড়িও জমা দেননি স্বাধীনভাবে জমিদারি পরিচালনা করছেন আমার কানুনগো রমাবল্লভ নন্দী আপনাকে বারবার খাজনা পরিশোধ করার জন্য অনুরোধ করেছিল আপনি তার কথায় কোনো কান দেননি প্রতি বছরই আপনার খাজনা না দেওয়ার অভিযোগ আমাদের দপ্তরে জমা পড়েছে আপনি তা ভালো করেই জানতেন তারপরও খাজনা পরিশোধ তো করেনইনি উল্টো, ক্ষিপ্ত হয়ে রমাবল্লভ নন্দীকে তাড়াই নদীতে নিয়ে হত্যা করেছেন তার স্ত্রীকে বিধবা করেছেন, নাবালক সন্তানকে এতিম করেছেন এসব অভিযোগের বিরুদ্ধে আপনার কি কিছু বলার আছে?

শের আলী গাজী বিস্মিত হলেন, তাহলে পদ্মগন্ধার সাথে তার সম্পর্কের বিষয়টি এখানে গোপনই রয়েছে কিন্তু সুবাহদারের প্রশ্নের জবাব তিনি কীভাবে দেবেন? নিজেরই পাতা জালের ফাঁদে আটকা পড়েছেন তিনি এখান থেকে বের হয়ে আসার কোনো উপায় নেই যদি প্রতি বছর খাজনা পরিশোধ করে আসতেন, তাহলে হয়তো কিছুটা রেহাই পেতেন খাজনা পরিশোধ না করা তো সুবাহদারের বশ্যতা অস্বীকার করা এবং তারই নিযুক্ত কর্মচারীকে হত্যা করা তো প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রদ্রোহিতারই সামিল সুবাহদার শাহবাজ খান তা সহ্য করবেন কীভাবে? তাছাড়া রমাবল্লভ নন্দী অভিজাত ব্রাহ্মণঘরের সন্তান মানসিংহের সাথে তার কোনো সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে কারণ সে চাকরি নিয়েছে মুঘল রাজদরবার থেকে এজন্যই শের আলী গাজী ভাবলেন, রমাবল্লভ নন্দীর জন্য তো তার গোপন একটা টান থাকতেই পারে সুবাহদার শাহবাজ খান তার ওপর যে পরিমাণ গোস্যা, তাতে এই বিচারে ভালো কিছু আশা করা যায় না হয়তো, তার গুরু দণ্ডই হবে যা-ই হোক তার স্বাধীনচেতা মাথা তিনি নত করতে পারবেন না এই রাজসভায় শাহবাজ খান আবারও তার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন

এখনো চুপ করে আছেন কেন গাজী? কী ভাবছেন? কিছু বলার থাকলে বলুন আমি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিচ্ছি ইসলাম এই শিক্ষাই আমাকে দিয়েছে

শের আলী গাজী বললেন, না, আমার কিছু বলার নেই এই কারণে যে রমাবল্লভ নন্দী আমার পরগণাতেই খুন হয়েছে খুন যে-ই করুক, শাসক হিসাবে তার দায়ভার তো শেষপর্যন্ত আমার ওপরই বর্তায় আর খাজনার কথা বলেছেন, তা আমি প্রজাদের কল্যাণের জন্যই ব্যয় করে ফেলি তবে মহামান্য সুবাহদার যদি আমাকে সময় দেন, তাহলে ভবিষ্যতে আমি তা পরিশোধ করার চেষ্টা করবো

ভষ্যিতের কথা এখন হচ্ছে না অতীতে আপনি যথেষ্ট দুঃসাহস দেখিয়েছেন তাছাড়া রমাবল্লভ নন্দীকে হত্যার সব দায় আপনি প্রত্যক্ষভাবে স্বীকার করতে না চাইলেও সাক্ষী আছে এই দরবারে সাক্ষীদের হাজির করা হোক

তিনজন মাঝবয়সী লোককে নিয়ে আসা হয় দরবারে তারা সবাই তার পরগণার অধিবাসী তাদের মধ্যে দুজন দর্শার কানুনগো অফিসের কর্মচারী আরেকজনের বাড়ি তাড়াই নদীর তীরে গাজীকে এত কাছে দেখে তারা যেন খানিকটা ভয়ই পায় তার দিকে চোখ তুলে তাকাতে কেউই সাহস করে না

পদ্মগন্ধা অবাক হলো, সুদূর দশকাহনিয়া থেকে তাদের নিয়ে আসা হয়েছে! অথচ এ কথা আমি জানতামই না কেউ তো বলেইনি এজন্যই কি বিচারের এত বিলম্বের কারণ? না, পদ্মগন্ধাকে কিছুই বলতে হয় না প্রথমেই কর্মচারী দুজন বলে, রমাবল্লভ আমাদের একদিন বলেছিল, গাজী মহাশয় রমাবল্লভকে নৌবিহারে নিতে চায় এর চেয়ে বেশি কিছু আমরা জানি না তৃতীয় সাক্ষী কথা বলতে গিয়ে তোতলানো শুরু করে, আ আ আমি দে দে দেখেছিলাম গাজী মহাশয়ের নায়ে র র রমাবল্লভকে উঠে যেতে এটুকু বলেই সে থেমে যায় সুবাহদার বলেন, আর তারপরই রমাবল্লভ নন্দীর লাশ পাওয়া যায় তাড়াই নদীর তীরে এতে কী প্রমাণিত হয় গাজী? আপনি তার হত্যাকারী নন?

মহামান্য সুবাহদার যা ভালো মনে করেন

কাজেই আমার সিদ্ধান্ত হচ্ছে এই যে, রাষ্ট্রের খাজনা বছরের পর বছর পরিশোধ না করে আপনি যে স্পর্ধা প্রদর্শন করেছেন, তা আসলে রাষ্ট্রদ্রোহিতাই শুধু মাত্র এই অপরাধে আপনার জমিদারি বাতিল ঘোষণা করা যায় দয়াপরবশ হয়ে এই আদালত যদি তা নাও করে, তারপরও আপনি রেহাই পাবেন না কারণ অত্যন্ত প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে আপনি সুবাহদারের নিযুক্ত রাজকর্মচারী রমাবল্লভ নন্দীকে হত্যা করে রাষ্ট্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছেন ইসলামে অন্যায়ভাবে হত্যার বদলে হত্যা জায়েজ, বাদি ভিন্ন ধর্মের হলেও বিবাদি রক্ষা পায় না কাজেই রমাবল্লভ নন্দীকে হত্যার অভিযোগে আপনাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো আর যেহেতু রমাবল্লভ নন্দীকে হত্যা করার কারণে তার নাবালক সন্তান রামনাথ নন্দী ও বিধবা স্ত্রী পদ্মগন্ধার অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে যা কোনোভাবেই আর পূরণ করা সম্ভব নয় তাই তাদের জীবনধারণ ও ভরণপোষণের নিশ্চয়তার জন্য দশকাহনিয়ার জমিদারির ভার তার পুত্র রামনাথ নন্দীর ওপর অর্পণ করা হলো তবে শর্ত থাকে যে, রামনাথ নন্দী প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগ পর্যন্ত উক্ত জমিদারি দেখাশোনা করবেন তারই মাতা পদ্মগন্ধা দশকাহনিয়া থেকে আদায়কৃত খাজনা নিয়মিত রাজকোষাগারে জমা দিতে হবে

শের আলী গাজী পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন আড়চোখে কালো ঝালরের ফাঁকফোকর দিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন পদ্মগন্ধাকে মনে মনে বললেন, এই তো চেয়েছিলে তুমি! এবার খুশি হয়েছ পদ্মগন্ধা? আমার জীবন নিপাত যাক, দুঃখ নেই তুমি সুখি হও শান্তিতে থাকো ম্লান হাসির দীপ্তি ছড়িয়ে পড়লো তার চোখে-মুখে

শের আলী গাজীর দণ্ড যে এত ভয়াবহ হবে, তা পদ্মগন্ধা কল্পনাও করতে পারেনি রমাবল্লভ নন্দী হত্যার শাস্তি জমিদারিচ্যূত করাই তো কম কথা নয়, তার ওপর গাজীর মৃত্যুদণ্ড না, তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না বিচারে এমন দণ্ড আমি কখনো আশা করিনি বড়োজোর আশা ছিল আর্থিক জরিমানা তাও কখনো চেয়েছি বলে তো মনে পড়ে না আহা আমি কেন এসেছিলাম সুবাহদারের কাছে স্বামী হত্যার অভিযোগ করতে? আমি তো তোমাকে ভালোবাসি গাজী রমাবল্লভ নন্দীর চেয়েও বেশি ভালোবাসি তুমিই আমার ভালোবাসার প্রথম পুরুষ, স্বপ্নের পুরুষ আমার ভালোবাসা ও স্বপ্নের শেষ মানুষটিও তুমিই কিন্তু আমি মহা শানশওকতে দিন গুজার করবো, আর স্বপ্নের মানুষটি থাকবে না, তা কী করে সইবো আমি? এ যন্ত্রণা এতই গোপন যে কারও কাছে কোনোদিন প্রকাশ করা যাবে না তার চোখ হতে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো নিচে কেউ তা দেখল না হাতের তালুতে তা মুছে ফেলে বলল, মহামান্য সুবাহদারের কাছে আমার একটি আরজ আছে শের আলী গাজীর প্রাণদণ্ড মওকুফ করে দেওয়া হোক

শাহবাজ খান চমকে উঠলেন, তুমি যা বলেছ, ভেবে চিন্তে বলেছ তো?

জি¦ হুজুর ভেবে চিন্তেই বলেছি

ইসলামে বিধান আছে যদি অভিযোগকারী অপরাধীর দণ্ড মওকুফ করে দেয়, তাহলে সে মুক্তি পেতে পারে তাই বাদির অনুরোধে শের আলী গাজীর প্রাণদণ্ড মওকুফ করে দেওয়া হলো তবে আজই দশকাহনিয়ার জমিদারির নতুন ফরমান জারি করা হবে

পদ্মগন্ধা বুকের ভেতর একটু শান্তি অনুভব করলেন যাক, অন্তত প্রাণ বাঁচানো গেল শের আলী গাজীর এখন মানুষটা যেভাবেই বেঁচে থাকুক, সে যে বেঁচে আছে এটুকু জেনেই তার ভালো লাগবে মনে আনন্দ হবে ঝালরের ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো সে শের আলী গাজীকে

শের আলী গাজী মনে মনে বললেন, আমার কাছে এখন বাঁচামরা দুইই সমান বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই তো শ্রেয় কেন আমাকে বাঁচাতে গেলে পদ্মগন্ধা? শুধু ভালোবাসো বলেই কি? না কি এটুকু তোমার অনুকম্পা? হায় ভালোবাসা! ‘ভালোবাসা মোরে ভিখিরি করেছে, তোমাকে করেছে রানি’ ভালো থেকো পদ্মগন্ধা ভালো থেকো

অলংকরণ : রেজাউল হোসেন

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :