উপজেলা ভোটের মাঠে বিএনপির তৃণমূল নেতারা

উপজেলা নির্বাচনে তৃণমূল নেতাদের ঠেকাতে পারছে না বিএনপি। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ভোটের মাঠে দলটির তৃণমূল নেতারা। কড়া সতর্কবার্তা দেওয়ার পরও অনেকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার না করে ভোটের মাঠে রয়েছেন। বিএনপি এখন তাদেরকে বহিষ্কার করছে। সবশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ইতিমধ্যে পাঁচ প্রার্থীকে কেন্দ্র থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
গতকাল বুধবার নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী নেতাদের শোকজ করা হয়েছে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সন্তোষজনক জবাব না পেলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে দলটি। আগামী ২৭ এপ্রিলের মধ্যে তাদের বহিষ্কার করা হবে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। তবে বহিষ্কারের তালিকা কমবেশিও হতে পারে।
বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা ঢাকা টাইমসকে জানান, আসন্ন উপজেলা নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়ে সারাদেশে লিফলেট বিতরণ করবে দলটি। যেমনটি ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে করা হয়েছিল। এছাড়াও প্রতিটি উপজেলায় তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করবে স্থানীয় বিএনপি নেতারা। উদ্দেশ্য ভোটারদের নির্বাচন কেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত করা।
দলের তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীদের আরও সক্রিয় করতে, তাদেরকে রাজপথে আনতে এবং উপজেলা নির্বাচনে ভোট বর্জনের আহ্বানে কর্মিসভা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। গতকাল বুধবার থেকে নারায়ণগঞ্জ মহানগর দিয়ে কর্মিসভা শুরু হয়েছে। ধাপে ধাপে অন্যান্য মহানগর, জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে কর্মিসভা করবে বিএনপি। এদিকে দলটির সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির সভায় আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে অংশগ্রহণকারী পদধারী নেতাদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
সাংগঠনিকভাবে সর্বোচ্চ শাস্তির বার্তা দিয়েও উপজেলা নির্বাচনে ভোটমুখী নেতাকর্মীদের ঠেকাতে পারছে না বিএনপি। কেন্দ্রীয় নেতাদের ব্যক্তিগত যোগাযোগসহ দলীয় নানা উদ্যোগও অনেককে প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারছে না। সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে শুধু চেয়ারম্যান পদেই ভোটের মাঠে রয়ে গেছেন বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের ৩৮ নেতা। এ ছাড়া দ্বিতীয় ধাপে ভোট করার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন কমপক্ষে ৩৫ জন। এর পাশাপাশি বিভিন্ন উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদেও লড়ছেন বিএনপি সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ঢাকা টাইমসকে বলেন, আমরা পরবর্তী পদক্ষেপের অপেক্ষায় আছি। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ভোটের পক্ষে না। কিন্তু কিছু ভোটপাগল নেতাকর্মী আছেন, তাদেরই এখানে আগ্রহ আছে। তবে তাদের বুঝিয়ে ফিরিয়ে আনাও আমাদের দায়িত্ব। আমরা সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। কিন্তু একবার দলীয় প্রতীক, আরেকবার দলীয় প্রতীকবিহীন। এগুলো সরকার অসৎ উদ্দেশ্যে করছে। এগুলো করে প্রার্থী বাড়িয়ে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে চায়। কিন্তু প্রার্থী বাড়ালেই ভোটার বাড়ানো যায় না, যা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে।
মঙ্গলবার বিএনপির পক্ষ থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মুন্সীগঞ্জ জেলার টংগীবাড়ী উপজেলার আড়িয়ল ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মঞ্জু শেখ ফারুখকে বিএনপির প্রাথমিক সদস্য পদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
এর আগে গত ২১ এপ্রিল পটুয়াখালী জেলার সদর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনির রহমান এবং কক্সবাজার জেলার ঈদগাহ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলমগীর তাজ জনিকে প্রাথমিক সদস্য পদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। বিএনপির কুমিল্লা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ সেলিম ভুঁইয়া ঢাকা টাইমসকে বলেন, বিএনপি উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রত্যাহারের দিন পর্যন্ত আমরা প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছি। ইতোমধ্যে কুমিল্লা বিভাগের ৫ জন প্রত্যাহার করেছেন। আর যারা প্রত্যাহার করেননি তাদের শোকজ করা হয়েছে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে শোকজের সন্তোষজনক জবাব না দিলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত সোমবার রাতে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। নমনীয়তা দেখাতে নারাজ হাইকমান্ড। পরবর্তী ধাপেও যারা অংশ নেবেন তাদের বিরুদ্ধে একই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিএনপি মনে করে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। নির্বাচনে গেলে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা আরও বৃদ্ধি পাবে। এদিকে স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, আবারো নতুন কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নামতে চাচ্ছে বিএনপিসহ সমমনা দল এবং জোটগুলো। এরই অংশ হিসেবে খুব শিগগিরই সমমনা দল ও জোটগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করবে বিএনপি। বৈঠকগুলোতে আগামীদিনে কর্মসূচির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি উপজেলা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও প্রথম ধাপে দলের পদধারী, সাবেক ও সমর্থক মিলিয়ে ৩৮ জন নেতা অংশ নিয়েছেন। এদের মধ্যে থানা-উপজেলার বিএনপির পদধারী ২০ জন, বিভিন্ন সময়ে বহিষ্কৃত বা অব্যাহতিপ্রাপ্ত ১১ জন এবং সমর্থক বা নেতাদের আত্মীয়স্বজন ৯ জন রয়েছেন।
বিএনপির একটি সূত্র জানায়, উপজেলা নির্বাচনে যাতে নেতারা অংশ না নেয় এবং মনোনয়ন প্রত্যাহারের জন্য বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের দলীয় প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব দিলেও অনেকেই এতে কর্ণপাত করেননি। দফায় দফায় বৈঠক ও যোগাযোগ করেও তাদের বাগে আনতে পারেননি বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। শেষ পর্যন্ত ৮ থেকে ১০ জন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করলেও ভোটের মাঠে রয়ে গেছেন অধিকাংশ নেতা। এর মধ্যে আবার দ্বিতীয় ধাপে ১৬১ উপজেলা নির্বাচনের জন্য চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বিএনপিসংশ্লিষ্ট অন্তত ৩০ জন। তাদের অনেকে অবশ্য বিভিন্ন কারণে আগেই দল থেকে বহিষ্কৃত।
উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী ও তাদের অনুসারীরা জানান, বিএনপির কেন্দ্র তার তৃণমূলকে বুঝতে ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। বছরের পর বছর জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে মাঠের কর্মীদের অংশ নিতে না দেওয়ার কারণে দল হিসেবে দুর্বল হয়ে উঠছে বিএনপি। তৃণমূল মনে করে, নির্বাচন করা ছাড়া স্থানীয় রাজনীতিতে টিকে থাকা যায় না।
তারা বলছেন, এমনিতেই টানা প্রায় দেড় যুগের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এত লম্বা সময় কখনোই ক্ষমতাহীন থাকেনি দলটি। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা ও নির্বাচনের বাইরে থাকলেও স্থানীয়ভাবে বিএনপির অনেক নেতা প্রভাবশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। অনেকের পূর্বপুরুষ কিংবা পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘকাল নিজ এলাকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পারিবারিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে তারা নির্বাচন করছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী ও উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক বাবর আলী বিশ্বাস বলেন, এলাকার জনগণ ও তৃণমূল নেতাকর্মীদের চাপেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। বিজয়ী হয়ে তাদের আশা পূরণ করব।
তিনি বলেন, স্থানীয় নির্বাচনে অংশ না নিলে নেতাকর্মীরা দলছাড়া হয়ে পড়ে। আশা করি, দল পরিস্থিতি বুঝে আমাদের বিষয়টি সঠিকভাবে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ঢাকা টাইমসকে বলেন, দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। যারা অংশ নিচ্ছেন তাদের অধিকাংশই দলে পদ নেই। তারপরও অংশ নিলে তাদের প্রাথমিক সদস্য পদও বাতিল করা হবে। ইতোমধ্যে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার না করায় সকল প্রার্থীকে শোকজ করা হয়েছে। ২৭ এপ্রিলের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিএনপির দপ্তর সূত্র থেকে জানা যায়, প্রথম ধাপের নির্বাচনে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলায় বিএনপির সাবেক সহসভাপতি শামসুর রশিদ, ফুলপুর পৌরসভার সাবেক সাধারণ সম্পাদক এমরান হাসান, হালুয়াঘাটে ময়মনসিংহ উত্তর জেলার সদস্য আবদুল হামিদ, পিরোজপুরের ইন্দুরকানি উপজেলার সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফায়জুল কবির তালুকদার, ফরিদপুর সদরের সাবেক সভাপতি রউফ উন নবী ও যুবদলের সাবেক নেতা কে এম নাজমুল ইসলাম, সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার সভাপতি নগেন্দ্র চন্দ্র সরকার, নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন, রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে জেলা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান খান, শেরপুরের ঝিনাইগাতীর সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মো. আমিনুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জে জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নাজমুল আলম, কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার আহ্বায়ক রমিজ উদ্দিন, নাঙ্গলকোট উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মাজহারুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের সাবেক নেতা আশরাফ হোসেন ও ভোলাহাটের আহ্বায়ক বাবর আলী বিশ্বাস, সিলেটের বিশ্বনাথের সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ সুহেল আহমদ চৌধুরী, সাবেক সাধারণ সম্পাদক গৌছ খান, যুক্তরাজ্য বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক মো. সেবুল মিয়া, যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতা সফিক উদ্দিন, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার সহসভাপতি সারওয়ার হোসেন, নাটোরের নলডাঙ্গার সাবেক সদস্য সরদার আফজাল হোসেন, নাটোর সদরে জেলার সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম সারোয়ার, ফরিদপুরের চরভদ্রাসনে উপজেলা যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হোসেন মৃধা, নওগাঁর ধামইরহাটে আয়েন উদ্দিন, মহাদেবপুরে দলের সহসভাপতি আবদুস সাত্তার, সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন, ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে উপজেলা যুবদলের সাবেক সহসভাপতি হানিফ আহমেদ এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে জেলা জিয়া পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শামীমা আক্তার নির্বাচন করছেন। এছাড়া মুলাদীতে উপজেলা নির্বাচনে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মো. তরিকুল ইসলাম দিপু মোল্লার স্ত্রী মোসা. নাদিরা।
(ঢাকাটাইমস/২৫এপ্রিল/জেবি/কেএ)

মন্তব্য করুন