পর্দা বেপর্দা লজ্জাহীনতা: প্রসঙ্গ বাঙালির পোশাক-কথকতা
মানুষ লজ্জা নিবারণের জন্য পোশাক পরিধান করে। পোশাক তাকে আবৃত রাখে। পোশাকহীন অনাবৃত মানুষ দেখতে কদাকার, কুৎসিত লাগে। পোশাক মানুষকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে। সেই সাথে রোদ, তাপ, শৈত্য থেকেও মানুষকে সুরক্ষা দেয়।
পৃথিবীতে প্রথম সৃষ্ট মানব মানবী আদম হাওয়া। মহান স্রষ্টার নির্দেশে তারা জান্নাতের বাগানে বসবাস করতে থাকেন। কিন্তু স্রষ্টার আদেশ অবমাননার শাস্তি হিসেবে তাদেরকে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়। নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণের সাথে সাথে তাদের শরীর থেকে বেহেশতি পোশাক খসে পড়ে। তাদের লজ্জাস্থান তাদের সামনে দৃশ্যমান হয়। তারা দ্রুত বৃক্ষের পাতা দিয়ে লজ্জাস্থান আবৃত করতে সচেষ্ট হন। আসলে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণের আগেও তাদের দেহে কোনো পোশাক ছিল না। ফল খাওয়ার পরই তারা বুঝতে পারেন তাদের দেহে কোনো পোশাক নাই। তাদেরকে কেউ লজ্জাস্থান চিনিয়ে দেয়নি। সহজাতভাবেই তারা এ সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন।
অতএব লজ্জা মানুষের সহজাত একটা বিষয়। উদ্দেশ্য একই হলেও নারী পুরুষের পোশাকে পার্থক্য রয়েছে। স্থানভেদে রয়েছে তার বৈচিত্র্য। মানুষের পরিধেয় বস্ত্রের প্যাটার্ন চেঞ্জ হয়েছে যুগে যুগে। পোশাক একটি জাতি, গোষ্ঠীর বা সম্প্রদায়ের প্রচলিত সংস্কৃতির অংশ। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংস্কৃতির অংশ হিসেবে পোশাকের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে।
বঙ্গ রমণীর সাধারণ পোশাক ছিল শাড়ি। সেই শাড়ি থেকে এলো সালোয়ার কামিজ। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে বা মফস্বলে বয়স্ক কিছু মহিলা ছাড়া কেউ আর শাড়ি পড়েন না। শাড়ি এখন প্রায় আনুষ্ঠানিক পোশাক হয়ে গেছে। আর মুসলিম নারীদের বাইরে যাওয়ার পোশাকের মধ্যে বোরকার জনপ্রিয়তা বেশি। মুসলিম নারীদের জন্য পর্দা করা ফরজ। পর্দা ফার্সি শব্দ। এর অর্থ আবরণ, আড়াল। বোরকা আরবি শব্দ। বোরকা এক ধরনের পোশাক। কিন্তু বাঙালি মুসলমানের কাছে পর্দা এবং বোরকা সমার্থক। সুতরাং পর্দা করা মানেই বোরকা পরিধান। আর বোরকা পরিধান মানেই পর্দা। আজ থেকে ১৫/২০ বছর আগেও বোরকার প্রচলন এতটা ছিল না। ইউনিভার্সিটিতে দেখেছি আমাদের সাথে ৬০/৭০ জন মেয়ের মধ্যে ৫/৬ জন যারা নিয়মিত বোরকা পরতো। তারমধ্যে ২/১ জন বোরকার সাথে নেকাব নিত। সারা ইউনিভার্সিটি জুড়ে খুব কম সংখ্যক মেয়েই বোরকা পরতো।
৩০/৩৫ বছর আগের চিত্র আরও ভিন্ন ছিল। সে সময় প্রৌঢ়া নারীরাই বোরকা পড়তেন। কোথাও যাওয়ার সময় তাদের পরনে থাকত কালো ঢিলা বোরকা আর মাথা থেকে বুক পর্যন্ত ঝুলে থাকত কালো পাতলা হিজাব। হাতে থাকতো একটা ছাতা। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় পুরুষ মানুষ চোখে পড়লে তারা রাস্তার এক পাশে ছাতা আড়াল করে দাঁড়িয়ে পথিককে পথ করে দিতেন। সে সময় তরুণী যুবতীরা বোরকা পরতো না। বোরকা যেন বৃদ্ধাদের জন্যই বরাদ্দ ছিল। গ্রামের মহিলারা শাড়ির সাথে ব্লাউজও পরত না। পর্দা সম্পর্কে মুসলিম নারী পুরুষের জ্ঞান সামান্যই ছিল। তারা মনে করতো চুল ঢাকাটাই পর্দা। অতএব ব্লাউজ পেটিকোট না পরলেও শাড়ির আঁচল দিয়ে তারা চুল ঢেকে রাখত। অল্প বয়সী মেয়েরা মাথায় কাপড় না দিলে মুরুব্বিরা রাগারাগি করতো। কারণ পর পুরুষকে চুল দেখানো পাপ এটাই তারা জানতো।
আমি যখন কলেজে পড়তে ঢাকাতে গেলাম তখনও সেখানে যুবতী, বয়স্কাদের বোরকা পরতে দেখি নাই এবং আমার কলেজের মেয়েদেরকেও কাউকে বোরকা পরতে দেখি নাই। তবে শহর অঞ্চলের মেয়েরা চুল ঢাকার জন্য মাথায় স্কার্ফ ব্যবহার করত। স্কুল অথবা কলেজ ইউনিফর্মের সাথে অথবা সালোয়ার কামিজের সাথে মাথায় স্কার্ফ বাঁধতো অনেক মেয়ে। আর আজ কিশোরী থেকে বৃদ্ধা সকলেই বোরকা, হিজাব পরতে অভ্যস্ত। পর্দা মানেই যে বোরকা নয় সে সম্পর্কে বহু তর্ক বিতর্ক হয়, হচ্ছে। কারণ কোরআন হাদিসে পর্দা করতে বলা হয়েছে; সেটা যে বোরকাই তা কিন্তু নয়। পবিত্র কুরআন শরীফে নারীদের মাথা, গলা, বুক আলাদা বস্ত্র দিয়ে আবৃত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
যাহোক এই শতকের প্রথম দশকে বাংলাদেশের মফস্বল শহরে, গ্রামাঞ্চলে, এমনকি সীমিতভাবে শহর অঞ্চলেও নারীদেরকে ইসলামি দ্বীনি শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে নারীদের দ্বারাই তালিম বৈঠকের রেওয়াজ শুরু হয়। এখানে নারীদেরকে দ্বীনি জীবনযাপনের শিক্ষা দান করা হয়। নারীদের সমস্ত শরীয়ত বিধানের মধ্যে প্রধান বিধান পর্দা; সাধারণ নারীরা সেই শিক্ষা এখান থেকেই লাভ করে। পর্দা নারীর জন্য ফরজ এবং পর্দা না মানলে নারীদের সমস্ত ইবাদত ব্যর্থ। এই শিক্ষা গ্রহণের পর থেকেই গ্রামাঞ্চলে নারীদের সুন্নতী হিজাব এবং বোরকা পরার প্রবণতা বাড়তে থাকে। সে সময় ইভ টিজিংয়ের মাত্রাও বেড়ে গিয়েছিল। ২০০৬/২০০৭ সালে ইভ টিজিং একটা সামাজিক সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছিল। পত্র পত্রিকায় লেখালিখি, সভা সেমিনার, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি সব মিলিয়ে ইভ টিজিং-বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। ইভ টিজিং ঠেকাতে তখন বোরকা হয়েছিল একটা প্রতিরোধক। বোরকা পরলে যৌন হয়রানি থেকে অনেকখানি রক্ষা পাওয়া যায়। এই ভাবনা থেকেই হাইস্কুল, কলেজ পড়ুয়া অনেক মেয়ে বোরকা, নেকাব পড়া শুরু করলো। আরেকটা ব্যাপার হলো সে সময় মফস্বলের কলেজগুলোতে নির্ধারিত ইউনিফর্ম ছিল না। ফলে শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে মেয়েদের পোশাক পরিচ্ছদে তাদের পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থার পার্থক্যটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠতো। বোরকার প্রচলনে সেই পার্থক্যটা ঘুচে যায়। এতে শুধু ধনী দরিদ্রের সীমারেখাই ঘুচলোনা বেশি কাপড় চোপড় তৈরির খরচও কমলো এবং আজও অধিকাংশ মেয়ে দারিদ্র্য লুকানোর জন্য বোরকা পরে এটা মানতে হবে। বোরকা পরলে বাইরে যাওয়ার সময় চটপট রেডি হওয়ার সুবিধা, এতে সময়ও বাঁচে। অনেক চাকুরীজীবী নারী এই সুযোগটা নিলো।
এরপর এলো ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন। বাংলাদেশের মুসলমানকে ধর্মীয় জ্ঞান যতখানি না কুরআন-হাদিস পির-দরবেশ, আলেম-ওলামাগণ প্রত্যক্ষভাবে দিয়েছে তার চেয়ে অধিক জ্ঞান দিয়েছে ইউটিউব, ফেসবুক ইত্যাদি। অনেক ইসলামিক পণ্ডিত আছেন যাদের ওয়াজ মাহফিলে সবাই সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারে না। ইউটিউবে তাদের ওয়াজের ভিডিও দেখে সাধারণ মানুষ এই পণ্ডিতদের থেকে অনেক ধর্মীয় জ্ঞান লাভ করেছেন। ফেসবুকও কুরআন হাদিস প্রচারের একটা মাধ্যম হয়েছে। আবার অনেক নারী আছে যারা পিতা-মাতা, ভাই অথবা স্বামীর চাপে পড়ে পর্দা পালন করে তথা বোরকা পরিধান করে। কিছু কিছু মুসলমান সন্তানের নামকরা আলেমদের ওয়াজ শুনে ধর্মীয় চেতনা এমনভাবে জাগ্রত হয়- মনে হয় তারা যেন নও মুসলিম এবং নয়া মুসলমান হয়ে তারা প্রথমেই যে ফরজ কাজটি করে তা হলো বাড়ির মহিলাদের চলাফেরার স্বাধীনতা, শিক্ষা গ্রহণের স্বাধীনতার ওপর অবরোধ আরোপ করা এবং তাদের ওপর বোরকা চাপিয়ে দেওয়া- তাদের ইচ্ছা থাকুক বা না থাকুক।
যাহোক বোরকা পরিধানের পেছনে রয়েছে বিভিন্নমুখী উদ্দেশ্য। সর্বোপরি বোরকার রয়েছে সম্মান। বোরকা আবৃত থাকলে মানুষ পর্দানশীন ভেবে সম্মান করে। রাস্তা ঘাটে, বাসে ট্রেনে পুরুষের লোভী আর ঘৃণিত হাত থেকে, ইভ টিজিং থেকে আত্মরক্ষা করা যায়।রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অপেক্ষাকৃত উন্নত শহরগুলোতে বোরকার ব্যবহার কম। যারা পর্দা করে তাদের পর্দা বেশ ফ্যাশনেবল। সালোয়ার কামিজের সাথে অথবা শাড়ির সাথে হিজাব পরে। মাথার চুল ঢাকা থাকে, হিজাবের এক অংশ বুকের এক পাশে, কামিজের ওপর বুকের আরেক পাশটায় ওড়না ঝোলানো থাকে। ওটাও এক ধরনের ফ্যাশন এবং প্রকারান্তরে শরীর প্রদর্শন।
বোরকারও রয়েছে নানান ফ্যাশনেবল স্টাইলিশ ডিজাইন। আমার শহরে রাস্তায়, মার্কেটে বোরকা বা হিজাব ছাড়া কোন মুসলিম নারীকে দেখা যায় না। আমি একজন কলেজ শিক্ষক হওয়ার সুবাদে আমার কলেজের মেয়েদেরকে দেখি; এছাড়াও এ শহরের অন্যান্য কলেজ থেকে আসা মেয়েদেরকে দেখি যারা বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা দিতে আসে। তাদের মধ্যে বোরকা অথবা হিজাব ছাড়া দেখলেই বোঝা যায় ওরা মুসলিম নয়। কত রকম ডিজাইনের বোরকা- ঢিলা, টাইট, প্রিন্ট, এক কালার ইত্যাদি ইত্যাদি। হিজাবও নানান ডিজাইনের। বোরকার এত সৌন্দর্য যে বোরকা পরিহিতার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। এই যে বোরকা তৈরি, ডিজাইন তো পুরুষরাই করে। হরেক রকম বোরকা দ্বারা তারা নারীসমাজকে প্রলুব্ধ করছে তাতে তাদের ব্যবসা লাভজনক হচ্ছে কিন্তু নারীদের পর্দা পালন কতটা হচ্ছে তা ভাববার বিষয়।
পরীক্ষার হলে যে সকল মেয়ে বোরকা, নেকাব, হাত মোজা, পা মোজা পরে আসে দেখা যায় ওরাই বেশি অসদুপায় অবলম্বনের চেষ্টা করে। করোনাকালীন মাস্কের ব্যবহারও পর্দার অংশ হয়ে গেছে। অনেক মেয়ে মাস্ককে নেকাব হিসেবে ব্যবহার করে এবং পরীক্ষার হলে এই নেকাব ও মাস্ক পরে কথা বললে বোঝা যায় না কে কথা বলছে। আবার বোরকার ভিতরে অবাঞ্ছিত কাগজপত্র বহন করাও সহজ। পর্দার এই সুবিধা নিতে তারা পিছুপা হয় না। এসব মিলিয়ে এরা হলের পরিবেশকে অস্থির করে তোলে। এখানে কি তাদের নৈতিকতার স্খলন হয় না? অনেক সময় পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য মুখ দেখতে চাইলে তখন তাদের প্রবল আপত্তি। তারা যুক্তি তোলে যে তারা সহী পর্দা পালন করে। অথচ এরা যখন সামনে পেছনে বসা ছেলেদের সাথে অহেতুক কথা বলে, গল্প করে তখন তাদের পর্দা লঙ্ঘন হয় না। আসলে তারা মনে করে পর্দা পালন করছে মানেই তাদের জান্নাতে প্রবেশের টিকেট কনফার্ম হয়ে গেছে। নীতি-নৈতিকতার, আদর্শের কোনো দরকার নেই।
একটা পোশাক, একটা আচ্ছাদন মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে পবিত্র, সম্মানের হতে পারে কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে তা শুধু পরিধেয় বস্ত্র ব্যতীত অন্য কিছু নাও হতে পারে। তাই আজ নারীরা বোরকাকে আবরণ বানিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অন্য দিকে মুসলিম মেয়েরা যারা পর্দা করে না তাদের বেশভূষা আরও উগ্র ও দৃষ্টিকটু হয়েছে। যে সময় মেয়ে সালোয়ার কামিজ পরে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেত তখন ছেলেদের সাথে আলাপচারিতা, হাসি ঠাট্টা এবং দৈহিক মুভমেন্ট সবকিছুর মধ্যেই একটা আড়ষ্টতা জড়িয়ে থাকতো। তার মধ্যে শালীনতা ছিল। লজ্জা যে নারীর ভূষণ তখন বোঝা যেত। আজকে কোন স্তরেই নারীদের মধ্যে সেই জড়িমা নেই। হাতে মোজা, পায়ে মোজা, মুখে নেকাব, পরনে বোরকা তারা ছেলে বন্ধুদের সাথে গল্প-গুজবে মেতে উঠছে। 'আমরা ফ্রি মাইন্ডে কথা বলি' এই অজুহাতে তারা অশ্লীল কথাবার্তা বলছে, হাসি ঠাট্টা-তামাশায় আড্ডা জমিয়ে তুলছে। মেয়েদের রিনিঝিনি হাসি, মিষ্টি সুরে কথা ছেলেদের যৌন উদ্দীপনা জোগায় না? না কি জোগায়? তারা একসাথে ঘুরতে যাচ্ছে, আনন্দ-ফুর্তি-হইচই করছে। মহিলারাও চাকরিক্ষেত্রে সহকর্মী, গায়েরে মাহরাম আত্মীয় স্বজন, নিজের বন্ধু-বান্ধব, স্বামীর বন্ধু-বান্ধব সকলের সাথে অন্তরঙ্গভাবে, ফ্রি মাইন্ডে গল্প করছে। আর মহিলাদের সবচেয়ে বড়ো বিচরণক্ষেত্র শপিং সেন্টারগুলো। সেখানে সাধারণত মহিলারাই ক্রেত্রী। সেখানে কোনো নিয়ম নীতি নেই। বিক্রেতা জিনিস বিক্রির জন্য মহিলাদেরকে নানান রকম তোষণ করছে আবার ক্রেত্রী সাশ্রয়ে কেনার জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত অবাঞ্ছিত কথাবার্তা বলছে। শপিং সেন্টারের ভিড়ের মধ্যে অনেক নারী যৌন নিপীড়নের শিকারও হচ্ছে। আবার বোরকার আড়ালেই মেয়েরা অনেক সময় অনৈতিক সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়ছে। বোরকা অনেক সময় লোকচক্ষু থেকে আত্মরক্ষায় তাকে সাপোর্ট দিচ্ছে। কিন্তু পরিণামে নিজের জীবনে ডেকে আনছে ভয়াবহ সব বিপদ।
আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনুগ্রহে আমাদের অন্দর-বাহিরের সীমারেখা মুছে যাচ্ছে ক্রমশ। সকাল বেলা যে মেয়েকে দেখবেন বোরকা পরে ঘুরছে বিকালেই দেখা যাবে ফেসবুকে সে বোরকা হিজাব ছাড়া নানান লুকে, নানান স্টাইলে সুসজ্জিত আকর্ষণীয় সব ছবি, রিলস আপলোড দিয়েছে। যা কি না তার ফেসবুকীয় বন্ধুদেরকে যৌনতায় তাড়িত করে। এখন প্রশ্ন হতে পারে শুধু ছবি দেখেই? হ্যাঁ অবশ্যই। কেননা তেঁতুলের গন্ধ নাকে এলেও তো জিহ্বায় পানি আসে। কারো যদি জিহ্বায় পানি না আসে তাহলে তার জিহ্বার স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে। এই পর্দানশীন মেয়েরাই আবার মেসেঞ্জারে, হোয়াটসঅ্যাপে বন্ধুদের সাথে ঘনিষ্ঠ ভিডিয়ো চ্যাটিং করে সময় কাটায়।
পর্দা শুধু নারীর জন্য নয় পুরুষের পর্দা পালনও ফরজ। আজ নারীরা অধিকাংশই পর্দা করছে তবুও নারী পুরুষ উভয়ের নৈতিক পদস্খলন ঘটছে। পবিত্র কুরআন মজিদে আল্লাহ তায়ালা নারী পুরুষ উভয়কেই তার যৌনাঙ্গ হেফাজত করতে বলেছেন। উভয়ের দৃষ্টিকে সংযত করতে বলেছেন এবং পুরুষকে নারীর সামনে চোখ নিচে নামাতে বলেছেন। বিনা প্রয়োজনে পুরুষ কোনো নারীর সাথে কথা বলতে পারবে না, অতীব গুরুত্বপূর্ণ কোনো কারণে কথা বললেও হয় সে পর্দার আড়ালে থেকে কথা বলবে আর যদি সামনে বলতে হয় তবে মাথা নিচু করে তার সাথে কথা বলবে। এটাই পুরুষের জন্য ফরজ। পুরুষ সমাজের কাছে মাহরাম, গায়েরে মাহরাম এবং পরনারী বলে কিছু নাই। আমাদের পুরুষ সমাজকে কোনো আলেম ওলামা তাদের পর্দা মেনে চলার ব্যাপারে জোর দিয়ে কথা বলেন না। বেশির ভাগ পুরুষ জানেনই না তাদের জন্যও পর্দার বিধান রয়েছে। আলেমগণই তাদেরকে জানান না। তারা শুধু নারীর আব্রুর কথাই বলেন। ব্যাপারটা এরকম; চোরকে বলো চুরি করো, গৃহস্থকে বলো সাবধানে থাকো।
ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তি স্বাধীনতা এই ভাবধারা মানুষকে নির্লজ্জ করেও তুলেছে। উঠতি বয়সী কিশোর-কিশোরীদের কাছে মানব মানবীর যৌন জীবন রহস্যময়। আজকে স্মার্ট ফোনের উপকারিতায় তাদের কাছে সেই রহস্যের পর্দা উন্মোচিত হয়ে গেছে। তারা সহজেই তাদের কৌতুহল মেটাতে পারে। এক সময় পিতা মাতা তাদের সন্তানদের সামনে পাশাপাশি ঘনিষ্ঠ হয়ে বসত না এবং এভাবে ছবি পর্যন্ত তুলতো না। আজ তারা সন্তানের সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক গড়ে তোলার অজুহাতে তাদের সামনেই ঘনিষ্ঠভাবে বসছে, ছবি তুলছে। শিশু মনের হাজার প্রশ্নের উত্তর বাবা মায়ের সম্পর্কের মধ্যেই খুঁজে তারা। স্বামী স্ত্রী একে অপরকে বুকে জাপটে, স্বামী স্ত্রীকে কাঁধে তুলে বিভিন্ন পোজে বিভিন্ন লুকে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে। এগুলো কিশোর কিশোরীদের নিকট যৌন জীবনকে যেমন আকর্ষণীয় করে তুলছে তেমনি অবিবাহিত যুবক যুবতীদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বেকার, অবিবাহিতদের হতাশা ও হীনম্মন্যতা আরও বাড়িয়ে তুলছে। আত্মীয়, বন্ধু বান্ধবীর এমন যুগল ছবি আবার ওদিকে ফেসবুকে বান্ধবীদের নজর কাড়া উপস্থাপন যুবক তরুণদের চোখের লালসা বৃদ্ধি করে এবং লৈঙ্গিক ভোগের আকাক্সক্ষা জাগায়। আজকের তরুণ এবং যুবকেরা অনেকেই গুপ্ত, অশ্লীল যৌনাচারে লিপ্ত। এসব পুরুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় ঘটায় এবং সামাজিক অনাচার বৃদ্ধি করে।
নির্লজ্জতা নারী পুরুষ উভয়কেই গ্রাস করে ফেলেছে। আসলে আমাদের জীবন চালানোর স্টিয়ারিংটা আমাদের হাতে নেই। বিশ্বায়ন, মুক্ত বাজার অর্থনীতি আমাদের যাপিত জীবনকে কুক্ষিগত করে ফেলেছে। নারীকে উপভোগের বস্তু করে তুলেছে। ভোগবাদী সমাজ নারীর জন্য যে রাস্তা তৈরি করবে সেই রাস্তায়ই সে হাঁটবে যতদিন না নারী নিজে সচেতন হবে, যতদিন না সে নিজেকে সম্মান করতে শিখবে। এ এক অদৃশ্য শৃঙ্খল যা থেকে আমরা বের হতে পারবো না। তবে আত্মসম্মান এবং আত্মসচেতনতাই আমাদেরকে খানিকটা হলেও রক্ষা করতে পারবে।নীলুফার ইয়াসমিন: লেখক ও সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, সরকারি মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ, টাঙ্গাইল