পর্দাপোশাক ও পোশাকসংস্কৃতি

পর্দাপোশাকের সাথে একটি ধর্মীয় মূল্যবোধ জড়িয়ে আছে। যদিও নারী-পুরুষের পর্দার শুধু ধর্মীয় নয়, সামাজিক গুরুত্বও আছে। তবে সামাজিক গুরুত্বের দিকটি সব সময় গৌণ থাকে এবং ধর্মীয় গুরুত্বকেই মুখ্য হিসেবে বিবেচনা করেন সাধারণ মানুষ। অথচ ধর্ম না থাকলেও মানুষকে পর্দা রক্ষা করে চলতে হয় সামাজিক কারণে। ধর্মে অবিশ্বাসী মানুষও পর্দা মেনে চলেন। বেপর্দায় থাকাটা কোনো সভ্য সমাজ মেনে নেয় না। তাই পর্দার সামাজিক গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়। আদিম মানুষ পোশাকের অভাবে গাছের পাতা ও বাঁকল দিয়ে শরীরকে আবৃত করে রাখার চেষ্টা করতো। সেটাও ছিল এক ধরনের পর্দা বা লজ্জা নিবারণের প্রচেষ্টা। লজ্জা নিবারণের এই প্রচেষ্টা মানুষকে ক্রমশ সভ্যতার দিকে এগিয়ে নিয়েছে। তখন পর্দার ধর্মীয় গুরুত্বের চেয়ে সামাজিক গুরুত্ব ছিল বেশি। পরবর্তী সময়ে মানুষ যখন বিভিন্ন ধর্ম ও সামাজিক প্রথার অধীনে আসে তখন পর্দা বা লজ্জা নিবারণের বিষয়টি ধর্মীয় গুরুত্ব লাভ করে। যুগে যুগে ধর্ম ও সমাজ মানুষের দ্বারাই বিকশিত ও পরিবর্তিত হয়েছে। ফলে এক অঞ্চলের সমাজব্যবস্থার সাথে অন্য অঞ্চলের সমাজব্যবস্থার বিস্তর পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ধর্মাচারের ক্ষেত্রেও এই পার্থক্য লক্ষ করা যায়। সমাজ-ধর্মের এই ভিন্নতার ফলে পর্দা বিষয়ে সৃষ্টি হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মনোভাব।
বর্তমান প্রসঙ্গে মুসলিম নারী-পুরুষের পর্দাভাবনা ও পর্দাপোশাকের বিবর্তন ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান বাস্তবতা তুলে ধরার প্রচেষ্টা থাকবে। এটা কোন ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনা নয়। ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সামাজিক মূল্যবোধ যুক্ত হওয়ার ফলে পর্দাপ্রথার যে পরিবর্তিত রূপটি প্রচলিত হয়েছে তার বিরূপ প্রভাব তুলে ধরাই বর্তমান প্রসঙ্গের মূললক্ষ্য।
নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার কারণে আদিমাতা হাওয়ার শরীর থেকে স্বর্গীয় পোশাক খুলে গিয়েছিল এবং বিকল্প উপায়ে আদি মাতা লজ্জা নিবারণের চেষ্টা করেছিলেন- এমন একটি ধর্মীয় ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। একই অপরাধে আদি পিতা আদম ও আদি মাতা হাওয়াকে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল। স্বর্গীয় পোশাক খুলে গিয়েছিল বলে পৃথিবীতে এসে তাদেরকে বিকল্প পোশাকের সন্ধান করতে হয়েছিল। পোশাক মানেই পর্দা। পর্দা রক্ষার জন্য তাই পোশাক পরিধান করা অপরিহার্য। পর্দা বা ছতর ঢাকার ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নির্দেশনা। এই নির্দেশনা শুধু ধর্মীয় নয়, সামাজিকভাবেও অনুমোদিত। এ ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের শারীরিক গঠন বিবেচনা করা হতে পারে। যেখানে ধর্মীয় ও সামাজিক শাসন অতটা প্রবল নয় এবং ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নেই খুব একটা সেখানে নারী ও পুরুষের একই পোশাক পরতেও দেখা যায়।
মানুষের শারীরিক গঠন অপরিবর্তিত থাকলেও যুগে যুগে পোশাকের পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমান যুগের ফ্যাশন বলতে গেলে পুরোটাই পোশাকনির্ভর। অতীতের ফ্যাশনও অনেকটা পোশাকনির্ভরই ছিল। এখন ফ্যাশন সচেতন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানমাত্রই পোশাকে পরিবর্তন আনার ব্যাপারে সদা সচেষ্ট। পর্দা রক্ষা করে বা ছতর ঢেকে পোশাক পরিধান করলে ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ অক্ষুণ্ন থাকে। যে পোশাকে ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ খর্ব হয় সে পোশাক পরিধান করা স্বাভাবিকভাবেই আপত্তিকর। আবার পোশাকের মর্যাদা বলেও একটা কথা আছে। ধর্মীয় দৃষ্টিতে মর্যাদাপূর্ণ পোশাক পরে কেউ যদি অধর্মের কাজ করে তবে তাকে ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করে অধর্মের কাজ করার দায়ে অভিযুক্ত করা যায়। ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করে যারা সামাজিক মর্যাদা হাসিল করতে চান তাদের কাজটিও নৈতিক বিচারে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ এখানে প্রকৃত অবস্থা কৌশলগতভাবে গোপন করা হয়। বিশেষ পোশাকের বিশেষ মর্যাদা প্রসঙ্গে কথাটি বলা হলো। পুলিশের পোশাক পরে চুরি করা আর সাধারণ পোশাক পরে চুরি করার মধ্যে একটি পার্থক্য আছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের কাজটি বেশি গর্হিত বলে প্রতিপন্ন হয়। কারণ পুলিশ চুরি করা নয়; চুরি প্রতিরোধের জন্যই বিশেষভাবে নিয়োজিত।
যদিও বিধিবদ্ধভাবে ধর্মীয় পোশাক বলতে কিছু নেই, তবু সামাজিকভাবে কিছু পোশাককে ধর্মীয় পোশাকের মর্যাদা দেওয়া হয়। ইসলাম ধর্মে পুরুষের জন্য সাদা বা হালকা রঙের ঢিলা পায়জামা-পাঞ্জাবি ও টুপি এবং নারীদের জন্য বোরখা ও হিজাবকে পর্দাপোশাক হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং ধর্মীয় মর্র্যাদা দেওয়া হয়। ফলে এসব পোশাক যারা পরিধান করেন তারা ধর্মীয় মর্যাদাও রক্ষা করে চলবেন- এমন প্রত্যাশা করেন সকলেই। ব্যতিক্রম হলেই বিরূপ মন্তব্যের শিকার হন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। পোশাকের মাধ্যমে পর্দা রক্ষার বিষয়ে ইসলামি অনুশাসন বেশ কড়া। এই অনুশাসন পুরুষের চেয়ে নারীদের ক্ষেত্রে আরও বেশি কড়া। মুসলিম নারীদের পর্দা রক্ষার বিষয়ে তাই পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসন চলে আসছে ইসলাম ধর্মের শুরু থেকেই। ভারতীয় মুসলিম নারীরা এক সময় কঠোরভাবে পর্দা মানতেন। সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনের ফলে পর্দাপ্রথা মেনে চলতে বাধ্য হতেন। শুধু পর্দা নয়, গৃহে অবরুদ্ধ থাকতে হতো অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীদের। বেগম রোকেয়ার (১৮৮০-১৯৩২ খ্রি.) রচনাবলি থেকে আমরা সেই কঠোর পর্দাপ্রথা আর অবরোধবাসিনীদের বিষয়ে জানতে পারি। বেগম রোকেয়া অবরোধ ও পর্দাপ্রথার অর্থহীন বাড়াবাড়িকে সমর্থন করেননি। নিজে কোনোদিন বোরখা বা হিজাব পরেননি। কিন্ত তিনি ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষা করে চলেছেন আমৃত্যু। পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদা ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখার জন্য পর্দার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। তবে পর্দার ব্যাপারে অযৌক্তিক বাড়াবাড়ির মাধ্যমে নারী যেন তার মানবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত না হয় কিংবা পর্দা যেন শুধু কৌশলগত না হয়ে ওঠে সেদিকেও নজর দেওয়া জরুরি। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য নারীরা ঘরের বাইরে বের হয়ে এসেছে অনেক আগেই। পুরুষতন্ত্রের পক্ষে ধর্ম ও সামাজিক বিধি-বিধানের দোহাই দিয়ে নারীর বাইরে চলাচলের পথ বন্ধ করে রাখা সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতেও আর সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। নারীর শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে হচ্ছে সময়ের প্রয়োজনে। অবশ্য এটা সুযোগ নয়, এটা নারীর অধিকারের মধ্যেই পড়ে। নারীকে শিক্ষা ও কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত রাখা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল। যদিও এখন নারীর শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে কোনো বাধা নেই, তবে ধর্ম, সমাজ ও পুরুষতন্ত্র মিলে নারীর বাইরে চলাচলের জন্য বিশেষ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। এ নির্দেশনাগুলোর অন্যতম হলো পর্দা এবং পর্দা নিশ্চিত করার জন্য যে পোশাকটি এই ভারতবর্ষে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ছিল এবং এখনো আছে সে পোশাকটি হলো বোরখা।
পর্দাপোশাক হিসেবে বোরখার একটি ধর্মীয় মর্যাদা ছিল। এখনো আছে, তবে তা সীমিত আকারে। বোরখা পরিধানকারীর আচরণগত পরিবর্তন ও বোরখার রঙ, কারুকাজ ও আকর্ষণীয় বাহারি ডিজাইনের কারণেই এর ধর্মীয় মর্যাদা কমেছে বলে মনে করা হয়। তাই যারা বোরখা পরিধান করবেন তাদেরকে এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। বোরখা পরিধান করে একজন নারী আপাদমস্তক নিজেকে আবৃত করে রাখতে পারে। আবৃত অবস্থায় তার আত্মপরিচয়ও গোপন হয়ে যায়। এই গোপনীয়তার সুযোগ নিয়ে নারী-পুরুষ উভয়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে নারীদের কেউ কেউ নানা প্রকার অপরাধেও জড়িয়ে যাচ্ছে। এ বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। পর্দারক্ষার মাধ্যমে নারীর ধর্মীয় ও সামাজিক মর্যাদা অনেকাংশেই বেড়ে যায়। আবার পর্দার ছদ্মবেশ ধারণ করে কোনো নারী যদি অনৈতিক ও অধর্মের কাজ করে তাতে পর্দাপোশাকের মর্যাদা যেমন খর্ব হয় তেমনি ধর্মীয় মূল্যবোধেও আঘাত লাগে। অতীতে যারা বোরখা পরতেন তারা বোরখার ধর্মীয় মর্যাদা রক্ষা করে চলতেন- এ কথা নানাভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
এখন যারা বোরখা পরেন তাদের বেশিরভাগই বোরখার ধর্মীয় মর্যাদা রক্ষা করে চলেন না- এ কথাও নানাভাবে প্রমাণিত হচ্ছে। মূল সমস্যা এখানেই। কাউকে ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষার জন্য কথিত পর্দাপোশাক পরিধান করে চলতে বাধ্য করা যায় না। কারণ যারা বাধ্য হন তারা ভেতর থেকে ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষা করে চলেন না। আর যারা পর্দাপোশাকের সুযোগটাকে ব্যবহার করেন তাদের কাছে ধর্মীয় মূল্যবোধের কোনো গুরুত্বই নেই। ধর্ম ব্যক্তিগতভাবে পালনীয় বিষয়। ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করাটা ধর্মও অনুমোদন করে না। তাহলে সমাধান কোন পথে? যদিও সমাধান খুঁজে বের করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়, এ লেখা শুধু বাস্তবতার স্বরূপ উন্মোচন করতে চায়। বাস্তবতার নিরিখেই এক্ষেত্রে আরও কিছু কথা বলা জরুরি মনে করছি।
কৌশলক্রিয়া কোনো ধর্মসম্মত কাজ নয়। একই সাথে ছদ্মবেশ ধারণ করা কোনো ধর্ম সমর্থন করে না। পরিচয় গোপন হয়ে যায় বা চিনে নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে এমন বেশ ধারণ করাকেই ছদ্মবেশ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। এই ছদ্মবেশ কিছু সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করে। মানুষকে সঠিক পরিচয়ে চিনে নেওয়ার একমাত্র উপায় হলো তার মুখদর্শন করা। পেছন থেকে দেখে আমরা সব সময় সবাইকে সঠিকভাবে চিনতে পারি না। প্রায়ই ভুল হয় এবং ভুলের কারণে বিব্রতকর অবস্থায়ও পড়তে হয়। মুখমণ্ডল আবৃত থাকলে অনেক সময় সামনে থেকে দেখেও অনেক মানুষকেই সঠিকভাবে চিনে নেওয়া যায় না। নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও কম নয়। দুই দশকের অধিককাল অধ্যাপনার সাথে জড়িত থেকে আমি তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। অনেক ক্ষেত্রেই রীতিমত বিব্রতবোধ করেছি। আগে আমার কলেজের মেয়েরা যে হারে বোরখা পরতো এখন তার চেয়ে অধিক হারে বোরখা পরা শুরু করেছে। এই বোরখা পরা মেয়েদের বেশিরভাগই আবার মুখ ঢেকে রাখে। আমার এমন কোনো অলৌকিক শক্তি নেই, যে অলৌকিক শক্তির মাধ্যমে আমি মুখ ঢেকে রাখা অবস্থায় আমার মেয়েদের সব সময় সঠিক পরিচয়ে চিনতে পারি। ফলে বারবার ভুল করে বসি। চিনতে পারি না। চিনতে ভুল করি বলে মেয়েরা অবাক হয়। কেউ কেউ হয়তো আমার স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা দেখে বিস্মিত হয়। কিন্তু আবৃত মুখের মেয়েগুলো বেশিরভাগই আমার কাছে অচেনাই থেকে যায়। অনুমানশক্তি ব্যবহার করে হয়তো কোনো মেয়েকে বলি- ‘তুমি প্রথম বর্ষে না?’ মেয়েটি অবাক হয়ে বলে ‘আমাকে চিনতে পারলেন না স্যার, আমি তো ডিগ্রি সেকেন্ড ইয়ার’ কিংবা বলে ‘আমি অনার্স প্রথম বর্ষ।’ চিনতে না পারার এই অপারগতায় আমি বার বার বিব্রত হই।
আমার অধ্যাপনার দুই দশকে আমি যাদের পড়িয়েছে তাদের বেশিরভাগই এখন আমার কাছে অচেনা। কারণ শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সময় আমি তাদের আবৃত মুখ দেখেছি। এখন পথে-ঘাটে, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখা হলে আমার সেই সাবেক ছাত্রীরা যখন আমাকে আদাব-সালাম দেয়, কুশল জিজ্ঞাসা করে তখন মুচকি হেসে আন্তরিকভাবে ওদের সাথে কথা বলি। মেয়েটি মনে করে আমি তাকে চিনেছি। কিন্তু আমি পুরোটাই চেনার ভান করি। নিরুপায় হয়ে আমাকে এই অভিনয়টা করে যেতে হয়। বর্তমানে অনেক শিক্ষক আমার মতো একই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন নিশ্চয়ই।
এই মেয়েরা বোরখা পরে নিজেকে আবৃত করে রাখে। অথচ এদের বেশিভাগই ধর্মকর্ম করে না। এই মেয়েরা যদি অন্তত মুখটুকু খোলা রাখতো তাহলে ক্লাসে পাঠদান আরও বেশি ফলপ্রসূ হতো। ক্লাসের বাইরে এরা অন্যের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনৈতিক ও অন্যায় কাজ করতে পারতো না খুব একটা। অথচ এরা মুখ ঢেকে নিজেকে আড়াল করে রাস্তাঘাটে, বাজারে, শপিং মলে, পার্ক বা বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে অবাধে চলাচল করছে। আমি অবাধে চলাচলের বিরোধিতা করছি না। আমি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ^াস করি। তবে সর্বদাই মুখ ঢেকে নিজেকে আড়াল করে রাখা সমর্থন করি না। কারণ এটা এক ধরনের ছদ্মবেশ। প্রায়ই শোনা যায় মুখ ঢেকে রাখা বোরখা পরা মহিলারা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ইত্যাদি অপকর্ম করে ইদানীংকালে। শুধু শোনা যায় না, প্রমাণিতও হয়েছে অনেকবার। মুখ ঢাকা থাকার কারণে এদের চিহ্নিত করা মুশকিল হয়ে পড়ে। এটা সবাই না, কেউ কেউ। বোরখা পরে মুখ ঢেকে রাখা বা ঢেকে না রাখার ধর্মীয় ব্যাখা দেওয়ার এখতিয়ার ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের। কিন্তু বর্তমানে মুখ ঢেকে সামাজিক অপরাধ করা এবং অন্যকে বিভ্রান্ত করার কাজটি পর্দাপোশাককেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। পর্দাপোশাকের ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়েও সময়বাস্তবতার নিরিখে এই আলোচনার গুরুত্ব অস্বীকার করা বোধ হয় সম্ভব নয়।
নারীদের পর্দাভাবনা, পর্দাপোশাকের বিবর্তন ও সামাজিক মনোভাব নিয়ে মত ও ভিন্নমতের কমতি নেই। এ বিষয়ে ধর্মীয় পরিমণ্ডলে যে আলোচনা হয় তার সঙ্গে সাধারণ আলোচনার মিল নেই খুব একটা। পর্দাপোশাকের বিবর্তনের ফলে বর্তমানে পর্দাপোশাক যে রূপে পরিবর্তিত হয়েছে তাতে ধর্মীয় মূল্যবোধের বালাই নেই। বোরখা ও হিজাবে যে পরিমাণ কারুকাজ করা হচ্ছে, কাপড়ের রঙ ও প্রিন্টে যে পরিমাণ বৈচিত্র্য আনা হচ্ছে এবং যেভাবে আকর্ষণীয় ডিজাইন করা হচ্ছে তাতে অনেক ক্ষেত্রেই পর্দাপোশাকের আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। কিন্তু এই পরিবর্তনটা গ্রহণ করে নিয়েছে নতুন প্রজন্মের নারীরা। বোরখা ও হিজাব পরিধান করেও কীভাবে অন্যের কাছে আকর্ষণীয় হওয়া যায় এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নারীসমাজের একটি বড়ো অংশ। এটা ধর্মসম্মত কি না- সে ব্যাখ্যা প্রদান করবে ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ। তবে পর্দাপোশাক ব্যবহার করে মুখ ঢেকে রাখার মাধ্যমে নিজের পরিচয় গোপন করে সামাজিক ও নৈতিক অপরাধকারী নারীরা কোনো ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ^াসী নয়। এক সময় স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের মেয়েরা মুখমণ্ডল আবৃত করে বোরখা পরা তো দূরের কথা, বোরখাই পরিধান করতো না। কিন্তু তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ যেমন ছিল প্রবল, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধও ছিল অত্যন্ত প্রখর। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তখন যৌনঅপরাধ ছিল না বললেই চলে। আচার-আচরণে, কথাবার্তায় মেয়েরা ছিল অতিশয় শালীন। মেয়েদের সাথে কথা বলা ছিল অত্যন্ত সাহসের কাজ। বর্তমানে মেয়েরা প্রায় সবাই মুখ ঢেকে বোরখা পরে থাকে। কিন্তু শুধু ধর্মীয় মূল্যবোধ নয়; সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধকেও তারা তোয়াক্কা করে না। তারা অসময়ে অবাধে আপত্তিকর জায়গায় ঘোরাঘুরি করে। অনেকে যৌন অপরাধের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ে। যারা স্বেচ্ছায় এসব করে তাদের পক্ষে এসব কাজ করা অনেকটাই সহজ ও সম্ভব হয় মুখঢাকা বোরখা পরার কারণে। অনেকেই ভিন্ন মত প্রকাশ করে বলতে পারেন, সবাই এক রকম নয়। আমিও বিশ^াস করি সবাই এক রকম নয়। কিন্তু পর্দাপোশাক পরিধান করে অবাধে চলাচলকারী অসংখ্য নারী থেকে একটি অংশ যদি বিপথগামী হয় কিংবা পর্দাপোশাকের সুযোগ নিয়ে প্রতারণা করে বেড়ায় সেখানে প্রকৃত ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ^াসীদের আলাদা করে চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
পোশাকের সাথে ধর্মীয় মূল্যবোধ যুক্ত করা উচিত কি না- এ ব্যাপারে একমত হওয়া কঠিন। মত ও ভিন্নমত থাকলেও একটি বিষয় অস্বীকার করা যায় না যে, ধর্মীয় মূল্যবোধ যুক্ত থাকার কারণেই কিছু মানুষ প্রকৃত ধার্মিক না হয়েও ধর্মীয় মর্যাদা লুফে নিতে পারে। ধর্মীয় মূল্যবোধ যুক্ত থাকার কারণেই কিছু মানুষ প্রতারণার আশ্রয় নিতে পারে। বিশেষ পোশাকের ধর্মীয় মূল্যবোধ ব্যবহার করে অনেকেই সামাজিক সম্মান পেয়ে থাকে। কিন্তু পোশাকের সাথে ধর্মীয় মূল্যবোধ যুক্ত না থাকলে এ ধরনের কৌশলের আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ থাকে না। সঠিক নিয়মে পরিধান করলে সকল পোশাকেই পর্দা রক্ষা হয়। ফলে বিশেষ পোশাককে পর্দাপোশাক হিসেবে বিবেচনা করে সেই পোশাকের সাথে ধর্মীয় মূল্যবোধ যুক্ত করার প্রয়োজন পড়ে না। সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে পোশাকের পরিবর্তন আসবেই। পোশাকের রঙ, কারুকাজ ও ডিজাইনের বৈচিত্র্যকে মানুষ গ্রহণ করবেই। কিন্তু পোশাকে কোনো মূল্যবোধ আরোপ করা হলে সেই মূল্যবোধের অবমাননা ঠেকিয়ে রাখা কঠিন। পাঞ্জাবি, পায়জামা, টুপি কিংবা বোরখা-হিজাবের ধর্মীয় মর্যাদার সুযোগ নিয়ে অধর্মের কাজ সম্ভব বলেই পোশাকের সাথে ধর্মীয় মূল্যবোধ যুক্ত না থাকাই নিরাপদ। ধর্ম মনোজাগতিক বিষয় আর পোশাক প্রদর্শনের বিষয়। পোশাকে ধর্মীয় মূল্যবোধ যুক্ত করা হলে ধর্মও প্রদর্শনের বিষয় হয়ে ওঠে।আলী রেজা: কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন