ইট পাথরের শহরে বেঁচে থাকার এক নির্বাক জীবন

আচমকা ডাক শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম। আশপাশে তাকিয়ে দেখলাম কেউ নেই। অপরিচিত সব মুখ।
কিন্তু 'চাচা' ডাক যে কন্ঠের সেটা খুব পরিচিত মনে হলো। পেছনে ফিরে দেখি কালু। আমাদের গ্রামের ছেলে। ওর বাবার নাম ভাদ্রু। চৌকিদার ছিল ভাদ্রু ভাই। তাকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম এবারের যুগান্তর ঈদ সংখ্যায়। গল্পটার নাম 'সোনা-রুপা'।
আমি হাঁটছিলাম গুলশান-২ হয়ে কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের দিকে। যখন দেখা হলো তখন হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। কালু বৃষ্টিতে ভিজছিল। ওর ডাক শুনে থমকে দাঁড়ালাম। কতদিন পর দেখা ওর সাথে আমার? দশ-বারো কিংবা পনের বছরেরও বেশী হতে পারে। এর মধ্যে কত পরিবর্তন হয়েছে কালুর। সেই দুরন্ত-দূর্বার কালু এখন পুরোদস্তুর যুবক। আমাকে দেখেই বলে উঠে- চাচা, আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি ভাদ্রু চৌকিদারের ছেলে কালু। সারা শরীর ঘামে ভেজা উস্কোখুস্কো চুলের কালুকে চিনতে দেরী হলোনা এক মুহুর্ত।
কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই কালু দু'হাত দিয়ে জড়িলে ধরলো আমাকে। আনন্দের ঝিলিক তখন ওর চোখ-মুখে। কালুর ঘাম থেকে আমার গ্রামের গন্ধ পেলাম। গন্ধে পেলাম সোঁদা মাটির। গন্ধ পেলাম ভাঁটফুলের, কদম, কৃষ্ণচূড়া, জবা আর বামুনিয়া মোড়ে থাকা অসংখ্য শিমুল আর পলাশ ফুলের।
আমাকে অনেকক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখলো কালু আর আমার বামুনিয়া গ্রাম।
তালগাছের মতো লিকলিকে লম্বা হয়েছে কালু। বাবা ভাদ্রুর মতো পুরো অবয়ব ওর শরীরজুড়ে। গুলশান-বনানীর অলগলিতে রিক্সা চালায় । দরদর করে ঘাম ঝরে ওর শরীর থেকে। রিক্সাচালিয়ে মাসে প্রায় কুড়ি হাজার টাকা কামায়। এখান থেকে টাকা পাঠায় ওর ছোটভাই হুমায়ুনকে। 'হুমায়ুন ছাড়া তো আমার আর কেউ নেই চাচা, আব্বা আমার হাতেই ওকে তুলে দিয়ে গেছে ''। কণ্ঠে তার অনুভব বিহ্বলতা।
আলাপেই জানলাম- কালু বিয়ে করেছিল একবার। লোহাগাড়া হাটের এক মেয়েকে। শ্যামলা গড়ন সেই মেয়েটিকে ভীষণ ভালোবেসেছিল ও। বছরখানেক টিকে ছিল মাত্র । ওর ছোটভাই হুমায়ুনকে তার বউ একদিন বেধড়ক মাইর দেওয়ায় সেদিনই বিয়ের পাট চুকিয়ে ফেলে কালু। তখন থেকে আজ অবধি বিয়ে করেনি। কিছুটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছোটভাই হুমায়ুনকে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে এখন ব্যস্ত সে।
এর মধ্যেই কালুর ফোন বেজে উঠে। দু'ভাই আলাপ শুরু করে। কথা বলতে গিয়ে আমার কথা বলাতেই হুমায়ুন আমার সাথেও কথা বলে। অস্পষ্ট উচ্চারণে বলে - ইয়েল চাচা কেমন ছি (আছো)? কুরবানি ঈদোত বাড়ি ওসপোনি ( আসবেনা)। আমি বললাম - যাবো। ওপাশ থেকে হাসির শব্দ শুনতে পেলাম।
নাস্তা-পানি খাইয়ে বিদায় দেওয়ার সময় ভীষণ হাসিমাখা মুখ নিয়ে কালু জানাল- সে এবার চার শতক জমি কিনেছে। এই ঈদে ওখানে নতুন বাড়ি করবে। টিনের চাল দিবে তাতে। একটা ছোট রান্নাঘর আর একটা কলপাড় করবে।
কালু রিক্সা চালিয়ে চলে যাচ্ছে বনানীর ১১/ ০৭ বি রোডে। তখন বৃষ্টি সামান্য বেড়েছে । খানিকদূরে গিয়ে হাত উঁচিয়ে আবার তাকায় কালু। সে তাকানোয় মন কেমন করা এক মায়া। এক অজানা ঘোর। আমি সেই ঘোর নিয়েই গাড়িতে উঠি।
লেখক: পুলিশ কর্মকর্তা

মন্তব্য করুন