বাজেট ও শিক্ষকদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রসঙ্গ

মহান জাতীয় সংসদে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বেড়েছে ৬ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। এতে শিক্ষকদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রত্যাশা থাকলেও তা কতটা হবে সেটা দেখার জন্য বাজেট বাস্তবায়ন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা হলেও বর্তমানে বাংলাদেশে মেধাবীরা এ পেশায় যুক্ত হওয়ার আগ্রহ ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে। এর অনেকগুলো কারণ আছে। প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় বেতন-ভাতা ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে শিক্ষকতা পেশা সবচেয়ে পিছিয়ে।
একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের পদোন্নতির বিষয়টি সন্তোষজনক বলা যায়। উচ্চতর ডিগ্রি ও গবেষণাকর্ম থাকলে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অতি অল্প সময়ের মধ্যেই পদোন্নতির সর্বশেষ সোপান ‘অধ্যাপক’ পদ লাভ করতে পারেন। কিন্তু এই অধ্যাপকগণ যথাযোগ্য সামাজিক মর্যাদা পান না। রাষ্ট্রীয় মর্যাদা তথা ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স’ অনুসারেও একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের যে অবস্থান সেটিও সন্তোষজনক নয়। হাতে গোনা কিছু অধ্যাপক জাতীয় পর্যায়ে মর্যাদার আসন পেলেও বিপুল সংখ্যক অধ্যাপক প্রাপ্য সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করতে পারেন না। তবু মেধারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আসতে চান। কিন্তু নিয়োগের ক্ষেত্রে সুনীতির অভাবে অনেক মেধাবী মুখ সে সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হন। এতো গেল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বাস্তবতা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় থেকে যদি কলেজ পর্যায়ে আসা হয় সেখানেও শিক্ষকতাকে একটি অবহেলিত পেশা হিসেবেই দেখতে পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে শিক্ষা ক্যাডার নামে একটি ক্যাডার আছে যেটি অন্যান্য ক্যাডারের তুলনায় অনেক বেশি বৈষম্যের শিকার। শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি এতটাই ধীরগতিতে হয় যে, বেশিরভাগ ক্যাডার সদস্য পুরো চাকরি জীবনেও অধ্যাপক হতে পারেন না। শুধু পদোন্নতি নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁদের সুযোগ-সুবিধা খুব সামান্যই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের পার্সোনাল রুম নেই। গণরুমেই অনেকের চাকরি জীবন শেষ হয়। অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের মতো তাঁরা সরকারি গাড়ি-বাড়ির কথা চিন্তাও করতে পারেন না। একই বিসিএসে যোগদান করে অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাগণ যে সময়ের মধ্যে একাধিক প্রমোশন পেয়ে যান সে সময়ে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাগণ প্রথম প্রমোশনের জন্য অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকেন। এসব বৈষম্য নিয়ে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের আন্দোলন করতেও দেখা যায়। কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের মধ্যে যারা এমপিওভুক্ত তাঁদের অবস্থা আরো করুণ।
বর্তমান বিধি অনুযায়ী পুরো চাকরি জীবনে তাঁরা একটি মাত্র প্রমোশন পেয়ে থাকেন। এখানে দক্ষতা, যোগ্যতা এবং উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার কোনো মূল্যই দেওয়া হয় না। পদোন্নতির ক্ষেত্রে নেই কোনো বিভাগীয় পরীক্ষা বা দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রদর্শনের সুযোগ। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার বিষয়গুলো এখানে কোনো বিবেচনায় আনা হয় না। অনেক এমপিওভুক্ত শিক্ষক এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে সরকারি কলেজের শিক্ষকগণের মতো তিনটি ইনক্রিমেন্টও পান না। বিভাগীয় পরীক্ষা ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক যোগ্যতা বিবেচনায় এনে পদোন্নতি প্রদান করা হলে নিঃসন্দেহে শিক্ষকগণ উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় মনোনিবেশ করতেন এবং মেধাবীরাও শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী হতেন।
এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনকাঠামো একেবারেই অসম্মানজনক। এঁদের পদোন্নতি বলতে কিছু নেই। নেই কোনো বদলি ব্যবস্থা। স্থানীয় প্রভাবশালী ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডির অনৈতিক চাপ ও প্রভাব সহ্য করেই এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের চাকরি করতে হয় বছরের পর বছর। বেশ কিছুদিন যাবৎ শিক্ষকদের বেতন বিষয়ে পরিচালিত একটি জরিপের ফলাফল গণমাধ্যম সূত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হতে দেখা যাচ্ছে। উক্ত জরিপ থেকে জানা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকগণের বেতন সর্বনিম্ন। কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে জরিপ করলেও একই ফলাফল আসবে। শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো নিয়ে বিভিন্ন সময় আলোচনা হলেও তা বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেই। এই বাস্তবতায় বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ ‘এনটিআরসিএ’ প্রায় এক লক্ষ শিক্ষক নিয়োগের গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বয়স ও নিবন্ধনের মেয়াদ সংক্রান্ত নানা জটিলতার কারণে উক্ত গণবিজ্ঞপ্তিতে মোট চাহিদার এক তৃতীয়াংশ আবেদন জমা পড়ে। লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকারের এই দেশে বিষয়টিকে একটি বিরল ব্যতিক্রম হিসেবে মনে করা যায়। এতে এটাও প্রমাণিত হয় যে, বিদ্যমান বেতনকাঠামোতে এমপিওভুক্ত শিক্ষকতায় মেধাবীরা তো নয়-ই; অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরাও আসতে আগ্রহী নয়।সরকার শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে চায়। সেজন্য শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে বেশ কয়েক বছর যাবৎ নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে হলে সর্বাগ্রে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষক প্রয়োজন। শিক্ষকতাকে একটি আকর্ষণীয় পেশায় পরিণত করার জন্য শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও চাকরিবিধিকে যুগোপযোগী করতে হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় মেধাবীরা যে শিক্ষকতাকে মানসিকভাবে বর্জন করেছে এনটিআরসিএ-র সর্বশেষ গণবিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থী স্বল্পতা থেকে তা পরিষ্কার বোঝা গেছে। বর্তমান সমাজে যথাযোগ্য সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অর্থের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
পুঁজিবাদের প্রভাব বর্তমান সমাজকে এতটাই বদলে দিয়েছে যে, এখন যার হাতে অর্থ বা পুঁজি আছে সে সহজেই সমাজের চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে। পেশা পছন্দের ক্ষেত্রে এখন আদর্শিক দিকের চেয়ে অর্থের দিকটিকেই প্রাধান্য দিতে দেখা যায়। যে বিষয়ে পড়লে বেশি অর্থ উপার্জনের সম্ভাবনা সে বিষয়ের দিকেই ঝুঁকে পড়ছে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা। ফলে সাহিত্য, শিল্পকলা ও মানবিকবিদ্যার বিষয়গুলো এখন মেধাবীদের পছন্দক্রমে স্থান পায় না কিংবা পছন্দক্রমের সর্বনিম্নে থাকে। এ বাস্তবতায় শিক্ষকতা পেশায় নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে হলে শিক্ষকতা একটি মহান পেশা বা সম্মানজনক পেশা- শুধু এ জাতীয় আদর্শিক কথা বললে চলবে না, বেতনকাঠামোকেও আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। বর্তমান সময়ে শিক্ষকতা পেশাকে পছন্দ না করার একটি প্রধান কারণ হলো বেতনের স্বল্পতা। যুক্তি দেখানো যেতে পারে যে, পূর্বে শিক্ষকদের বেতন আরো কম ছিল। এখন অনেক বেড়েছে। কিন্তু এই অনেক বৃদ্ধিও অন্যান্য পেশার সমান্তরালে বৃদ্ধি নয়। এই বিষয়টি এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে। পেশা বা চাকরি পছন্দের ক্ষেত্রে এখন সবাই বেতনকাঠামো পর্যালোচনা করে। জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির ফলে এখন চাকরি নেওয়ার ক্ষেত্রে বেতনের বিষয়টি সবার আগে বিবেচনায় আনতে হয়। আর এ বিবেচনা থেকেই মেধাবীদের পছন্দক্রমে শিক্ষকতা পেশা সর্বনিম্নেই অবস্থান করছে। তারা আদর্শিক দিক বিবেচনায় এক পা আগালেও বেতনকাঠামো বিবেচনা করে দুই পা পিছিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বায়নের এই যুগে নতুন প্রজন্মের দেশের প্রতি আবেগ নেই বললেই চলে। ‘দেশে থেকে কিছু হবে না। সুযোগ পেলে দেশের বাইরে চলে যাব’- তাদের মুখ থেকে এ ধরনের কথা প্রায়ই শোনা যায়। বড়োরাও বলে ‘সুযোগ থাকলে বাইরে চলে যাও।’ এই বিদেশ যাওয়ার প্রবণতাও কিন্তু তৈরি হয়েছে যথাযোগ্য মূল্যায়ন না হওয়ার কারণে। মেধা অনুযায়ী চাকরি হলে হয়তো বিদেশগমনের এ প্রবণতা থাকতো না। বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে গিয়ে আর ফিরে আসছে না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অনেক শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে শুধু আর একটু ভালো থাকার জন্য। দেশের ভেতরেও অন্য ক্যাডারে সুযোগ পেলে শিক্ষা ক্যাডার ছেড়ে দিচ্ছে বেশিরভাগ কর্মকর্তা। শিক্ষকতা ছেড়ে অন্য চাকরিতে যোগ দেওয়ার হার যত বেশি অন্য চাকরি ছেড়ে শিক্ষকতায় আসার হার সে তুলনায় অনেক কম।
মেধাবীরা বিমুখ হওয়ার ফলে কম মেধাবীরা শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু বিশ্বমানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে মেধাবীদের শিক্ষকতায় নিয়ে আসার পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষকদের বেতনবৃদ্ধির প্রসঙ্গ আসলেই আর্থিক সক্ষমতার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক সক্ষমতা পূর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। অনেকগুলো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয়েছে। এখানে সদিচ্ছা একটি বড়ো বিষয়। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ মাত্র ২৫% উৎসভাতা পেয়ে আসছেন। প্রতি বাজেটে ৫% করে বৃদ্ধি করলে পনেরো বছরেই শিক্ষকদের শতভাগ উৎসব ভাতা নিশ্চিত করা যেত। প্রতি বাজেটে ২% বৃদ্ধি করা হলে ২০ বছরেই বাড়িভাড়ার সমস্যা সমাধান হয়ে যেত। এর জন্য বাজেটে আলাদা বরাদ্দের প্রয়োজন পড়ে না। থোক বরাদ্দ থেকেই শিক্ষকদের এসব দাবি মেটানো সম্ভব। শিক্ষকদের বদলির দাবি পূরণ করতে কোনো অর্থই লাগে না। অথচ এসব বিষয় নিয়ে শিক্ষকগণ বছরের পর বছর আন্দোলন করে আসছেন। এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী করে তুলতে হলে অবশ্যই সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বিশ্বমানের শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এর কোনো বিকল্প নেই।আলী রেজা: কলাম লেখক, শিক্ষক ও পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন