বাজেট তুমি কাদের? গৃহহীনরা এত গৃহ পায় কোথা থেকে?

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
  প্রকাশিত : ১৩ জুন ২০২৪, ১১:৫০
অ- অ+

প্রতিবছর বাজেট ঘোষিত হওয়ার পর সরকারি দল এটিকে গণমুখী বাজেট বলে আখ্যায়িত করে, বিরোধীরা গণবিরোধী, দুর্নীতি ও লুটপাটতন্ত্র কায়েমের বাজেট বলে এটিকে দাবি করে থাকে। একসময় অর্থমন্ত্রী সংসদে বাজেট পড়া শেষ করতে না করতেই বিরোধীরা বাজেটের কপি জাতীয় প্রেসক্লাবের সম্মুখে মিছিল সহকারে পুড়িয়ে উৎসব করতে দেখা যেত। এখন বাজেট নিয়ে বহ্নি উৎসব করতে আর দেখা যায় না। তবে গরিব মারা লুটপাটতন্ত্রের বাজেট বলে গণমাধ্যমে প্রচারের জন্য সাংবাদিক সম্মেলন করে বাজেট প্রত্যাখান করতে বিরোধীরা সব আয়োজনই আগে করে থাকতো, এখনো করে। দেশে এখন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কোনো অভাব নেই। সংখ্যায় এটি এখন ৪০-এর কাছাকাছি রয়েছে। অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়ার তো সংখ্যা কারোই জানা নেই। যদিও করোনাকাল থেকে প্রিন্ট মিডিয়া বলতে গেলে হারিয়েই যাচ্ছে।

সোশ্যাল মিডিয়া নামক আরেকটি মিডিয়া এখন এতই সক্রিয় এবং উত্তেজনা ছড়াতে পারদর্শী যে, সেখানে কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক তা জানতে ও বুঝতে অনেক মানুষেরই বেশিরভাগ সময় তালগোল পাকিয়ে যায়। বাজেট নিয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো বেশ আগে থেকেই, কেমন হতে যাচ্ছে এবারের বাজেট- এমন প্রশ্ন করেই দুই-তিন সপ্তাহ শ্রোতাদর্শকদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। সঙ্গে সঙ্গে বাজার কেমন অস্থির হবে সেটিও বুঝতে নানা ধরনের প্রশ্ন অতিথিদের দিকে ছুড়ে দিতে থাকে। অতিথিরা নানা বর্ণ ও গোত্রের তাই তাদেরও ভাষ্য রঙবেরঙের শোনা যায়। কয়েকদিন কেউ কেউ হয়তো আগ্রহ ভরে শোনেন কিন্তু কতদিন কতজন তাদের ধৈর্য ধরে রাখতে পারেন সেটা বলা মুশকিল। এরপর বাজেট পেশ হওয়ার পর তো কথাই নেই। টকশোর নামে তখন বাজেট বিশেষজ্ঞরা যে যার মতো বাজেটকে নিয়ে টানাটানি করতে থাকেন। একেকটি ইলেকট্রনিক মিডিয়া যেন বাজেট নিয়ে আলোচনার একেকটি মিনি সংসদ হয়ে ওঠে। অথচ তখনো সংসদে বাজেট নিয়ে এ দল ও দল কোনো দলের সদস্যরাই আলোচনা বলতে গেলে সূত্রপাতই করেনি। মিডিয়াকে কোনো দোষ দিচ্ছি না। বাজেটগুলো নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের চেষ্টা তারা করবেনই। মিডিয়ার দায়িত্ববোধ থেকেই তারা তা করেন।

এখন বাজেট নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার সংগঠনেরও অভাব নেই। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো গণমাধ্যম কিংবা বাজেট নিয়ে আলোচনা করার নামে গড়ে ওঠা সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে যা বলা হয় তাতে খুব বেশি নতুনত্ব বা ভিন্নতা থাকে বলে মনে হয় না। যেমন, এবারের প্রায় সবকটি সংস্থাই বাজেটে কালোটাকা সাদা করার যে সমালোচনা করেছে, সেটি সবকটি টিভি চ্যানেল, তাদের নিজ নিজ সংবাদ, টকশো এবং বিশেষ বিশেষ আলোচনায় বলতে বলতে একেবারেই শ্রোতাদের মুখস্ত করে দেওয়ার কাজটি করেছেন। মূল্যস্ফীতি কমবে না, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের পক্ষে কতটা সম্ভব হবে এবং দেশের মানুষের ওপর যে মূল্যস্ফীতির চাপ রয়েছে তা আদৌ কমবে কি না সেই ধরনের সন্দেহমূলক বার্তা প্রায় সকলেই ছুড়ে দিয়েছে। এই কথাগুলো হয়তো বেশিরভাগ শ্রোতা দর্শকই শুনতে শুনতে প্রায় মুখস্তই করে ফেলেছেন। কিন্তু এর চাইতে জটিল কোনো আলোচনা বোঝার অবস্থা কতজনের রয়েছে বলা মুশকিল। আমজনতা বলতে যাদের বোঝানো হয়ে থাকে তাদেরকে পরদিন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা বাজারে বাজেট নিয়ে প্রশ্ন করলে, অনেকেরই উত্তর হচ্ছে দ্রব্যমূল্য তো কমলো না, সাধারণ মানুষ বাজারে এসে হতাশ হচ্ছে, তাই বাজেট-টাজেট বুঝি না জিনিসপত্রের দাম কমালেই আমরা খুশি।

আবার অন্যদিকে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা নানা টিভি টকশোর অনুষ্ঠানে কর বৃদ্ধির নানা অভিযোগ উত্থাপন করেন। এনবিআরের বিরুদ্ধেও কেউ কেউ তাদের ক্ষোভ ঝাড়েন। সরাসরি সরকারের সমালোচনা না করেই তারা কোথায় কোন শুল্ক, ভ্যাট বেশি বেশি চাপানো হচ্ছে, তাতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি তাদের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেলে বাজারদরও চড়া থাকবে এমন শর্তযুক্ত কথাও যথেষ্ট শক্তভাবে উচ্চারণ করে থাকেন। বাজেট নিয়ে এইসব আলোচনা-সমালোচনা-পর্যালোচনা প্রতিবারই একইরকমই কথা বার্তায় শুনতে হয়, বুঝতে হয়। কে কতটা বোঝেন সেটি অবশ্য ভিন্ন বিষয়। তবে এক বছরের জন্য অর্থমন্ত্রীর উত্থাপিত বাজেট দেশের উন্নয়ন কতটা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে, তার কতটাই বা বাস্তবায়ন করা সম্ভব সেটি বিশেষজ্ঞরা বোঝেন না- তা কেউ বলবে না। কিন্তু বিরোধীদলের পক্ষ থেকে যখন বলা হয়ে থাকে যে- দেশের অর্থনীতি একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। সরকার দেশকে কিছুই দিতে পারেনি- দেশটাকে ধ্বংস করা ছাড়া। তখন বাজেট সত্যিই কী কিংবা কাদের জন্য সেটি বুঝতে কিছু কষ্ট হওয়ার কথা। আমজনতা বাজেট নিয়ে যেমন মাথা ঘামায় না, তারা বাজারে স্থিতিশীল দ্রব্যমূল্য দেখতে চায়। সেটি হলেই তারা খুশি থাকে।

এখন অবশ্য বাজেট ঘোষণার পর বাজারে নতুন করে এখন কোনোকিছুর দাম বৃদ্ধি পেতে শোনা যায় না, বাজারে মূল্য অস্থিতিশীলতার জন্য সবাই দুষ্টচক্র, সিন্ডিকেট, মধ্যস্বত্বভোগী, দালাল, ফড়িয়াদের কারসাজি হিসেবেই দেখে থাকে। বাজেট বাজারের আশপাশেও ঢোকে না। করোনা পরবর্তী সময় থেকে এই দুষ্টচক্র হেন কোনো জিনিস নেই যা থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ কামাই করতে মোটেও তোয়াক্কা করেছে। পৃথিবীর তাবৎ পণ্যসামগ্রীও যদি বাংলাদেশের বাজারে বিনে পয়সায় এনে দেওয়া হয় তারপরও মজুতদার, ফড়িয়াবাজ, মধ্যস্বত্বভোগী আর লুটপাটকারী দুষ্টচক্ররা সেইসব পণ্য থেকে অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নিতে মোটেও কসুর করবে না। বাংলাদেশের বাজার সম্পর্কে সাধারণ ভোক্তার এখন এমনই ধারণা জন্ম নিয়েছে। ভ্যাট-ট্যাক্স শূন্যের কোটায় নিয়ে আসলেও তাতে কোনো ব্যত্যয় ঘটবে বলে মনে হয় না। এনবিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পেরে ওঠাও অনেকের পক্ষে খুব সহজ কাজ হবে না। কেউ যদি সৎভাবে ব্যবসা কিংবা আমদানি-রপ্তানি করতে চায় তাহলেও লাল বাতি জ্বালিয়ে দেওয়ার অনেক দুষ্টচক্রের অভাব হবে না। সুতরাং কে কাকে দুষে সাধু সাজতে চায় সেটিই এখন ভাববার বিষয়। তবে দেশটা যে ২০০৯ সাল থেকে ধ্বংস হয়ে যায়নি সেটি বেশিরভাগ মানুষই অবিশ্বাস করতে পারছে না। অবিশ্বাস করলে নিজেদের অস্তিত্বই যা থাকে না তা সহজেই অনুমেয়। ওসব কথার কথা বাস্তবে গত ১৫ বছরে অনেক কিছু হয়েছে যা এদেশ কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। আবার দুর্নীতিও যে সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে সেটিও যদি সকল মহল কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা না করে, কেবলই দোষারোপের রাজনীতি করে তাহলে এর রাশ টেনে ধরা কারো পক্ষেই সম্ভব হবে না।

এত অভাব, অভিযোগ আর সমালোচনার পরও দেশে গৃহহীন মানুষের অবস্থার যে পরিবর্তন শেখ হাসিনা সরকারপ্রধান হিসেবে করে যাচ্ছেন তাঁর উৎসটা কী? বিদেশ থেকে তিনি তো কোনো লোন এনে এসব করছেন না, ব্যাংক থেকেও ধারদেনা করে করছেন বলে শুনিনি। তিনি কোনো ম্যাজিশিয়ানও নন যে তার ম্যাজিকে আমরা ঘর দিচ্ছি, যেগুলো আবার নাই হয়ে যাবে। আমরা শেখ হাসিনাকে কোনো জাদুকর হিসেবে দেখতে চাই না, তিনি যা তাই তাকে অভিহিত করা সংগত হবে। তিনি জাদুকর নন, রাজনীতিবিদ। তবে অন্য রাজনীতিবিদদের সাথে তার পার্থক্য হলো তিনি বাংলাদেশের জন্য অতি আশ্চর্যজনক বেশ কিছু উন্নয়নের উদ্ভাবন ঘটিয়েছেন যা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। তিনি নিজেই সেই পারার কারণটি বলে থাকেন যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ তিনি করে যাচ্ছেন। দেশপ্রেম এবং জনগণের প্রতি ভালোবাসা এবং আস্থাই তার মূলশক্তি- যা বলতেন বঙ্গবন্ধুও।

মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে শেখ হাসিনা আশ্রয়হীন, ভূমিহীন, গৃহহীন মানুষকে একটি আধাপাকা বাড়ি দানের উদ্যোগ নেন। এটি তিনি বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া চিন্তা থেকেই কুড়িয়ে নেন। এ পর্যন্ত বহু সংখ্যক ঘর তিনি এইসব ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন। গত ১১ই জুন তিনি সর্বশেষ ১৮ হাজার ৫৬৬টি ঘর বিতরণ করেছেন। আগের দেওয়া ঘরের সঙ্গে সর্বশেষ ২৬ জেলা ও ৭০ উপজেলার গৃহহীন, আশ্রয়হীন ও ভূমিহীন পরিবারগুলোকে ভূমিহীন-গৃহহীন মুক্ত করেছেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর পরিসংখ্যানটি হলো- ১৯৯৭ সালের পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত ৫৮টি জেলায় ৪৬৪টি উপজেলায় এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আগে-পরের বিভিন্ন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনাকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোট ৮ লাখ ৬৭ হাজার ৯০৪টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ের ঠিকানা করে দিলেন। এর মধ্য দিয়ে এই বিপুলসংখ্যক পরিবার ভূমিহীন-গৃহহীন মুক্ত হলো। প্রতিটি পরিবারের পাঁচজন সদস্য ধরা হলে ভূমিহীন-গৃহহীন মুক্ত হয়েছেন মোট ২৯ লাখ ১০ হাজার ২৬৫ জন আশ্রহীন মানুষ। এটা কি ভাবা যায় যে কী অসাধ্য সাধন করে চলেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।

এই প্রকল্পের বিস্ময়কর দিকটি হচ্ছে হতদরিদ্র মানুষগুলোকে ঘর দেওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি শুধু মাথা গোঁজার ঠাঁই-ই করে দেননি, তাদেরকে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা ও নিজেদের পায়ের ওপর দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করাসহ তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার পরিবেশও সৃষ্টি করে দিয়েছেন- যা একেবারেই আমাদের মতো দেশের জন্য বিরল ঘটনা। পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোনো দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনের হাজারও চেষ্টা অনেক দেশে করা হয়েছে। কিন্তু সেটি ঘটেছে সমাজের ওপর থেকে নিচের দিকে তেল চুইয়ে পড়ার মতো। কিন্তু শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্পের চরিত্রটি হচ্ছে নিচের থেকে ওপরের দিকে ওঠার সিঁড়ি তৈরি করা। দারিদ্র্য বিমোচন এভাবেই কেবল হলে সেটি টেকসই হতে পারে, হতদরিদ্র মানুষদের নিম্ন মধ্যবিত্তে উত্তরণের পথ সৃষ্টি করে দেওয়া একটি মাত্র প্রজন্মই এর মাধ্যমে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হয়ে আসার সুযোগ পেতে পারে। তিন বছর আগে যারা ঘর পেয়েছে তারা এখন মর্যাদার জায়গায় আসার দাবি করছে। ১১ তারিখ যারা পেলেন তাদেরও অবস্থান সেভাবেই তৈরি হবে। উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা ঘূর্ণিঝড় রেমালের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াবেন বলে তাদেরকে আশ্বস্ত করেছেন। তাহলে বুঝে নিতে হবে বাজেটই সব নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যে নেতৃত্বে আছেন তিনি যে বাজেটের বাইরে অনেককিছু করতে পারেন তার উদাহরণ কি আর খুব বেশি দেওয়া প্রয়োজন রয়েছে?

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: ইতিহাসবিদ, কলাম লেখক ও সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
এবার চিন্ময়ের জামিন স্থগিতের আদেশ প্রত্যাহার, শুনানি রবিবার
গুলশানে নসরুল হামিদের ২০০ কোটি টাকা মূল্যের জমি ক্রোক
খুলনায় ট্যাংক লরি উল্টে দুই নারী নিহত
আন্তঃজেলা বাসে ডিএনসির অভিযান, সাড়ে ১৫ হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার ২
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা