দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে

আলী রেজা
  প্রকাশিত : ০৬ জুলাই ২০২৪, ১৩:১৮
অ- অ+

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের ক্যাডার চয়েজের একটি বিষয় আছে। তাদের একটি পছন্দক্রমের ফরম পূরণ করতে হয়। এই পূরণকৃত ফরম অনুসারেই চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়। এই ফরমে বেশিরভাগ প্রার্থী প্রশাসন কিংবা পুলিশ ক্যাডারকে প্রথম পছন্দ এবং শিক্ষা ক্যাডারকে শেষ পছন্দ হিসেবে দেখিয়ে থাকেন। বিসিএস পরীক্ষার্থীদের এই প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। তার মানে হলো আমরা দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষাকে পছন্দক্রমের সর্বশেষে রাখছি। অন্য কোনো ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত না হলে আমরা বাধ্য হয়ে শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করি। আবার শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করার পরেও ক্যাডার পরিবর্তনের জন্য অনেকে বারবার বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। শুধু বিসিএসের ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য চাকরির ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। অন্য কোনো নিম্নপদের সরকারি চাকরি কিংবা কোনো কোম্পানির চাকরি পেয়ে গেলে অনেকেই খুব সহজে শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দেন। যে দেশে শিক্ষা ক্যাডার কিংবা শিক্ষকতার চাকরি চাকরিপ্রার্থীদের শেষ পছন্দের বিষয় হয় সে দেশে শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়া বড়োই কঠিন কাজ। এখন প্রশ্ন হলো শিক্ষার প্রতি কেন এই অনাগ্রহ কিংবা পুলিশ ও প্রশাসনের প্রতি কেন খুব বেশি আগ্রহ? বিষয়টি সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

শিক্ষকতা পেশায় কোনো বাড়তি আয় নেই। বিশেষ কিছু বিষয়ের শিক্ষকগণ প্রাইভেট টিউশনির সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাড়তি আয়ের সুযোগ পান। যদিও বর্তমানে শিক্ষকগণের প্রাইভেট পড়ানোর ওপর নানা সরকারি নিষেধাজ্ঞা বিদ্যমান আছে। ‘জ্ঞানার্জন ধনার্জনের চেয়ে মহত্তর’- এ নীতিকথাটি মুখে বলা হলেও বর্তমান সমাজে ধনার্জনের প্রতিই সবাই ঝুঁকে পড়েছে। শিক্ষার আদর্শিক দিকের চেয়ে আয়-উপার্জনের দিকেই সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ। ফলে যে বিষয় পড়লে বেশি আয় করা সম্ভব সে বিষয়গুলোই এখন শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ। আবার চাকরির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা বিদ্যমান। বেতন যাই হোক- বাড়তি আয়ের বিষয়টি এখন প্রধান্য পায়। কিছুদিন আগে সর্বোচ্চ মর্যাদার ক্যাডার সার্ভিসের চাকরি ছেড়ে নন-ক্যাডার সাব-রেজিস্ট্রার হয়েছেন একজন কর্মকর্তা।

বেশি বেতন ও বেশি মর্যাদার চাকরি ছেড়ে কম বেতন ও কম মর্যাদার চাকরিতে যোগদানের বিষয়টি কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। বেতন বহির্ভূত মোটা অঙ্কের টাকা উপার্জনের জন্য বাংলাদেশে সাব-রেজিস্ট্রারের চাকরির তুলনা নেই। কাস্টমসসহ আরো কিছু চাকরিতেও আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার সুযোগ আছে। কোনো ইঞ্জিনিয়ার সরকারি চাকরিতে ঢুকতে পারলে টাকার পাহাড় গড়ে তোলা যায়। পুলিশের চাকরির ক্ষেত্রেও বাড়তি আয়ের সুযোগ অবারিত। কিন্তু বাড়তি আয় মানেই দুর্নীতি। যারা বেতনের বেশি খরচ করে তারা কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত।

বর্তমান সমাজে দেখা যায়, অনেক চাকরিজীবী আছেন যারা তাদের বেতনের সমপরিমাণ টাকায় বাসা ভাড়া করে থাকেন। সন্তানের লেখাপড়ার পেছনে যে টাকা খচর করেন তার পরিমাণও প্রায় বেতনের সমান। এরা কীভাবে সারা মাসের সংসার খরচ চালান? একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশে এমন অনেক চাকরি আছে যেখানে বেতনের টাকায় হাত দিতে হয় না। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিজীবীদেরও হাজার কোটি টাকার সম্পদের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হতে দেখা যায়। সদ্য অবসরে যাওয়া পুলিশ বিভাগের এক শীর্ষ কর্মকর্তার বিপুল পরিমাণ ভুসম্পত্তি ও গাড়ি-বাড়ি ও ব্যাংক ব্যালেন্সের সন্ধান পাওয়া গেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে আরো বেশ কয়েকজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তার বিপুল পরিমাণ সম্পদের খবর জানা গেছে। সমাজে এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাগণ যথাযোগ্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল। চাকরি জীবনের এদের অনেকেই শুদ্ধাচার পুরস্কার পেয়েছেন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দান করেছেন অকাতরে। হজ-ওমরা পালন করেছেন। ফলে সামাজিক মর্যাদা পেয়েছেন প্রত্যাশার চেয়েও বেশি।

বর্তমান সমাজ এতটাই ধনতন্ত্রের কবলে পড়ে গেছে যে, অর্থ-বিত্ত থাকলে সামাজিক মর্যাদার অভাব হয় না। এখন সমাজপতি বা জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য অন্যন্য যোগ্যতা থাকুক আর নাই থাকুকÑ টাকা থাকতেই হবে। সে টাকা সাদা কিংবা কালোÑ যাই হোক। সমাজও বদলে গেছে। নীতি-আদর্শের প্রতি মানুষের ভক্তি এখন শুধু মুখে মুখে। মুখে নীতিকথা বলে কাজের বেলায় দুর্নীতিতে যুক্ত থাকা মানুষের সংখ্যা এখন দিন দিন বেড়েই চলেছে। সারা দেশে ব্যাপকভাবে গজিয়ে ওঠা ধর্মশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষকে ধার্মিক করে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করে বেশিরভাগ মানুষ ধার্মিক না হয়ে ধর্মব্যবসায়ী হয়ে উঠছে। সাধারণ শিক্ষায় এখন ধনার্জনের প্রতিই অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফলে মানবিক শিক্ষা এখন সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। সবচেয়ে দুর্বল শিক্ষার্থীরাই এখন মানবিক শাখায় পড়ালেখা করছে। আর মানবিক ও সামাজিক শিক্ষাবঞ্চিত নতুন প্রজন্মের মেধাবী শিক্ষার্থীরা অতি সহজেই নীতিবিসর্জন দিতে পারছে। ফলে দেশে রাস্তা নির্মাণে রডের বদলে বাঁশ ব্যবহারের ঘটনা ঘটছে। অপারেশনের রোগীর পেটে কাঁচি ও গজ রেখে সেলাই করার ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে। এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলেও এর মাধ্যমে পেশাগত দায়িত্বহীনতা ও অনৈতিকতার একটি অশুভ বার্তা পাওয়া যায়।

এসব কিছুর পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে দুর্নীতির সামাজিক স্বীকৃতির বিষয়। বর্তমান সমাজে দুর্নীতিবাজরা বিভিন্নভাবে সামাজিক মর্যাদা পেয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আর্থিক সহায়তা দিয়ে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে সক্ষম হচ্ছে। সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন ও ব্যাপক অবক্ষয় ঘটেছে। টাকার পেছনে ছুটেও যারা আশানুরূপ টাকা উপার্জন করতে পারছে না তারা টাকাওয়ালার পেছনে ছুটছে। সম্পদ উপার্জনের এক ধরনের মোহ সবাইকে অন্ধ করে দিয়েছে। কারণ, যেকোনো উপায়ে টাকার পাহাড় গড়ে তুলতে পারলে টাকার মাধ্যমেই অন্য সবকিছু অর্জন করা সম্ভব হয়- এ ধারণা এখন অনেকের মনেই বদ্ধমূল হয়ে গেছে। আমাদের ঔপনিবেশিক শিক্ষাই আসলে দুর্নীতিকে প্রমোট করার শিক্ষা।

শৈশবেই আমাদের শেখানো হয় ‘লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়ায় চড়ে সে’। ফলে গাড়ি-বাড়ি না করতে পারলে আমাদের শিক্ষা মূল্যহীন হিসেবে চিহ্নিত হয়। লেখাপড়া শিখে যেভাবেই হোক গাড়ি-বাড়ি করতেই হবে। তা না হলে অর্জিত শিক্ষা মূল্যহীন হয়ে যাবে। অনৈতিকতাও আমাদের শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের সন্তানদের দুধের সঙ্গে পানি মেশানোর অঙ্ক শেখানো হতো। এ ধরনের অনৈতিকতা আমাদের শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত বলে নৈতিক, মানবিক ও মনুষ্যত্বের শিক্ষা থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি। সুশিক্ষা আমাদের কাছে আজো অধরা। আমরা বই পড়ি, পরীক্ষায় পাস করি, বড়ো বড়ো ডিগ্রি অর্জন করি কিন্তু মনুষ্যত্ব অর্জন করতে পারি না। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত একবার পে স্কেলের মাধ্যমে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন দ্বিগুণ করেছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে, এতে দুর্নীতি কমে আসবে। কিন্তু হিতে বিপরীত হতে দেখা গেল। ঘুষ-দুর্নীতিও নাকি পে স্কেলের মতো দ্বিগুণ হারেই বেড়েছিল। বর্তমান অবস্থা আরো ভয়াবহ। দুর্নীতিবাজদের সামাজিক স্বীকৃতি এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী। দুর্নীতিবাজদের আর্থিক সহায়তা গ্রহণ করার জন্য সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন মুখিয়ে থাকে।

সভা-সমিতি কিংবা কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে দুর্নীতিবাজদের মধ্যমণি করা হয়। চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদেরও এখন আদাব-সালামের অভাব হয় না। সমাজে সৎ ও দায়িত্বশীলদের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। কারণ তারা অগাধ টাকা উপার্জনে ব্যর্থ। এভাবে সমাজমানস দুর্নীতিকে প্রমোট করছে। দুর্নীতিবাজরা আরো উৎসাহী হচ্ছে। তারা সাধারণ মানুষের নিকট থেকে নানা কৌশলে কিংবা বাধ্য করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সেই টাকা থেকে একটি ছোটো অংশ সামাজিক ও ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাও পেয়ে যাচ্ছে। এই সামাজিক স্বীকৃতি না পেলে তাদের অনেকেই দুর্নীতির পথ থেকে ফিরে আসতো। সুতরাং দুর্নীতির সামাজিক স্বীকৃতি একটি ভয়াবহ বিষয়। আজকাল দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো সামাজিক আন্দোলন হতে দেখা যায় না। কে করবে এ আন্দোলন? যুবসমাজ এখন ন্যায্য অধিকার আদায়ের বদলে দুর্নীতিবাজদের লেজুড়বৃত্তি করতে ব্যস্ত। ছাত্রসমাজ এখন মেরুদণ্ডহীন। দুর্নীতিবাজদের তল্পীবাহক ও ঠিকাদারি-চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে গেছে ছাত্রনেতৃত্ব। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতের সমাজ একটি মনুষ্যত্বহীন সমাজে পরিণত হয়ে যাবে। মানুষের মানবিক মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে যাবে। জাতির উন্নতির জন্য শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়ন যথেষ্ট নয়। নৈতিক ও মানবিক উন্নয়ন ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল ভোগ করা যায় না। তাই শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের পেছনে হাঁটলে চলবে না। দুর্নীতি প্রতিরোধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে না পারলে দুর্নীতি নির্মূল করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

আলী রেজা: কলাম লেখক, কলেজ শিক্ষক ও পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
এবার চিন্ময়ের জামিন স্থগিতের আদেশ প্রত্যাহার, শুনানি রবিবার
গুলশানে নসরুল হামিদের ২০০ কোটি টাকা মূল্যের জমি ক্রোক
খুলনায় ট্যাংক লরি উল্টে দুই নারী নিহত
আন্তঃজেলা বাসে ডিএনসির অভিযান, সাড়ে ১৫ হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার ২
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা