জনসংখ্যার ভারে আমাদের পৃথিবী: ২০৫০ সালে জনসংখ্যা হবে ৯৭০ কোটি

পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যা যেকোন দেশের জন্য বোঝাস্বরূপ। কারণ প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অতিরিক্ত জনসংখ্যা সরাসরি প্রভাব ফেলে। কোন দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে ভূমির উপর। কারণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খাদ্য ও বাসস্থানের চাহিদা বৃদ্ধি পায়৷ খাদ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হয়।
মানুষের অধিকার, সম্মান ও নিরাপত্তা বাড়াতে প্রতিবছর পালন করা হয় বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। ১৯৯০ সালের ১১ জুলাই প্রথম বারের মতো ৯০টি দেশে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস উদযাপিত হয়। বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের ২০২৪ সালের প্রতিপাদ্য–‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উপাত্ত ব্যবহার করি, সাম্যতার ভিত্তিতে টেকসই ও সহনশীল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলি’। বহু মানুষ তাদের লিঙ্গ, জাতি, শ্রেণী, ধর্ম, যৌন অভিমুখ, অক্ষমতা এবং নাগরিকত্বের উপর ভিত্তি করে বৈষম্য, হয়রানি এবং হিংসার সম্মুখীন হন। অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে বহু জায়গাতেই মানবাধিকারও খর্ব হয়। এই বিষয়টি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতেই দিনটি পালন করা হয়।
আধুনিক মানুষ হোমো সেপিয়েন্সের যাত্রা শুরু প্রায় দুই লাখ বছর আগে। খ্রিষ্টপূর্ব ১,৯০,০০০ সালে আফ্রিকায় যাত্রা শুরু মানবজাতির। পৃথিবীর জনসংখ্যা ৮০০ কোটির মাইলফলক ছাড়িয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীতে প্রতি বছর জনসংখ্যা বাড়ছে প্রায় সাত কোটি। আর চিরনিদ্রায় শায়িত হন আরও প্রায় সাত কোটি। গবেষণায় দেখা গেছে, দুজন থেকে যাত্রা শুরু হয়ে প্রথম ৫০ হাজার বছর শেষে মানবজাতির সংখ্যা স্পর্শ করে ২০ লাখ। ৪২ হাজার বছরের ব্যবধানে ৮০০০ খ্রিষ্টপূর্বে জনসংখ্যা ৫০ লাখের (৫ মিলিয়ন) মাইলফলক স্পর্শ করে। বলা হয় প্রায় দুই হাজার বছর আগে যিশুখ্রিষ্টের জন্মের সময় পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ৩০ কোটি।
পৃথিবীতে জন্ম নেয়া মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬ দশমিক ৫ শতাংশ বা ৮ বিলিয়ন এখন জীবিত রয়েছে। পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে ১০ হাজার কোটি (১০০ বিলিয়ন) মানুষ। জাতিসংঘের ধারণা অনুযায়ী, পৃথিবীর জনসংখ্যা ১০৪০ কোটিতে পৌঁছানোর পর এ সংখ্যাটি মোটামুটি দুই দশক স্থির থাকবে। এরপর জনসংখ্যা ক্রমশ আবার কমতে থাকবে।
সারাবিশ্বে ২০৫০ সালে জনসংখ্যা হবে ৯৭০ কোটি। জাতিসংঘের তথ্য বলছে, এই শতকেই মানুষের সংখ্যা স্পর্শ করবে হাজার কোটির ঘর। তবে কয়েকটি দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমায় আছে উদ্বেগও। জাতিসংঘ বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ অন্তত ৬১টি দেশে জনসংখ্যা কমে যাবে। এর মধ্যে, ২৬ দেশে অন্তত ১০ শতাংশ মানুষ হ্রাস পাবে।
বিশ্বে জনসংখ্যা আটশো’ কোটির ঘর ছুঁয়েছিল ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর। বর্তমানে এ সংখ্যা আটশো’ ১২ কোটির বেশি। ২০১১ সালে সাতশো কোটি স্পর্শ করে মানুষের সংখ্যা। বিশ্বের জনসংখ্যা প্রথম শতকোটি ছুঁয়েছিল ১৮০৪ সালে। এরপর দু’শো বছরের মধ্যেই তা’ সাতগুণ বেড়ে যায়। আর সবশেষ ১০০ কোটি বেড়েছে মাত্র ১১ বছরে।
চীন ও ভারত সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দুই দেশ। দেশ দু’টিতে ১৪০ কোটি করে মানুষ বাস। তবে, ভারতে জন্মসংখ্যা বৃদ্ধির হার ঊর্ধ্মুখী হলেও চীনের ক্ষেত্রে চিত্রটা বিপরীত। দেশটিতে সন্তান জন্মদানে ব্যাপক অনিহার কারণে কমছে মানুষের সংখ্যা। এই শতকের শেষ নাগাদ, চীনের জনসংখ্যা নেমে যেতে পারে ১০০ কোটির নিচে।
জাতিসংঘের মতে, গত দুই শতকে লাফিয়ে লাগিয়ে বাড়ছিলো যে জনসংখ্যা, আগামী কয়েক দশকে তাতে লাগাম পড়বে। মানুষের সংখ্যা ৯ শ কোটি ছুঁতে লাগবে ১৫ বছর। ২০৫০ সালে দাঁড়াবে ৯৭০ কোটি। আর ২ হাজার ১০০ সালে জনসংখ্যা হবে ১ হাজার ৯০ কোটি।
২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের অন্তত ৬১টি দেশে কমবে জনসংখ্যা। এরমধ্যে, ২৬টি দেশ কমপক্ষে ১০ শতাংশ বাসিন্দা হারাবে। জাপান, ক্রোয়েশিয়া, লাটভিয়া, সার্বিয়া, মলদোভা, হাঙ্গেরি ও ইউক্রেনে কমতে পারে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত। বেশকয়েকটি দেশের সরকার প্রনোদনা দেয়াসহ নানা উদ্যোগ নিয়েও সন্তান জন্মদানে মানুষের আগ্রহ বাড়াতে পারছে না।
অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে বৈশ্বিক পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। অনেক পরিবেশবাদীই মনে করেন, বর্তমানে আমরা যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হচ্ছি এগুলো অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে নয়, বরং মানুষের মাত্রাতিরিক্ত হারে ভোগের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে ঘটছে।
অতিরিক্ত জনসংখ্যার ফলে বাসস্থান চাহিদা মেটানোর জন্য গাছ কেটে যথেচ্ছা দালানকোঠা নির্মাণ আমাদের পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। গাছপালা কেটে ভূমি উন্মুক্তের ফলে মাটির ক্ষয় বৃদ্ধি পায়৷ অধিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বন উজাড় করে স্কুল, কলেজ, রাস্তাঘাট, শিল্প-কারখানা নির্মাণ পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করে৷
জনসংখ্যা বৃদ্ধি মানে পানির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়া। কারখানার বর্জ্য পানিতে নিক্ষেপ মানে জলজ উদ্ভিদ, কচুরিপানা, প্ল্যাংটন, শেওলা প্রভৃতি জন্মতে না পারা। এতে জলে বসবাসকারী মাছসহ অনেক জলজ প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে, জলজ সম্পদ দিন দিন কমতে থাকে।
মানুষের সংখ্যা যত বেশি হবে, তারা তত সেবা ও পণ্য তৈরি করতে পারবে এবং বেশি ভোগ করতে পারবে- তাই অর্থনীতির সর্বোত্তম বন্ধু হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি। তবে একটি দেশে মোট কতজন মানুষ আছে তা দেশটির অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নয়। বরং জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও হ্রাস পাওয়ার হারটিই কোনো দেশের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তবে যতই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার চেষ্টা করা হোক না কেন, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আমাদের পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা কেবল বাড়তেই থাকবে। এ প্রবৃদ্ধি থামানো সম্ভব হবে না। গবেষণায় দেখা গেছে কোনো বৈশ্বিক দুর্ঘটনা, মহামারি, ভয়ংকর বিশ্বযুদ্ধ, এমনকি পৃথিবীর প্রতিটি দেশে এক-সন্তান নীতি গ্রহণ করা হলেও আগামী ২১০০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা ১০০০ কোটিতে পৌঁছাবে।
ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে সবার সঙ্গে মিলেমিশে বাস করা ও পরিবেশ রক্ষা করার কোনো টেকসই উপায় খুঁজে পাওয়াটাই মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। সকলের উচিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি সম্পর্কে নিজে সচেতন হওয়া ও সচেতনতা তৈরি করা।
(ঢাকাটাইমস/১১ জুলাই/আরজেড)

মন্তব্য করুন