সিদ্ধিরগঞ্জের বিভীষিকায় যত মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি 

মো. আকাশ, সিদ্ধিরগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ)
  প্রকাশিত : ২৪ জুলাই ২০২৪, ১৭:০৩
অ- অ+

সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের যত সংঘর্ষ হয়েছে, এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পরিস্থিতি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের অবিরাম সংঘর্ষে প্রাণহানি হয়েছে অনেক মানুষের। বিভিন্ন হাসপাতালের তথ্যমতে বিভীষিকাময় এ কদিনে সিদ্ধিরগঞ্জ অংশে নিহত হন ২৫ জন। আরও অনেকে মারা গেছেন বলে অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে। এই আন্দোলনে সারা দেশে পৌনে দুই শ মানুষের মৃত্যুর খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ ও পুলিশ সদস্য। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার।

গত ১ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে নামেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দু-তিন দিনের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। গত ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় যেন বিস্ফোরণ ঘটে আন্দোলনে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন অন্য শিক্ষার্থীরা। এর ঢেউ লাগে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জেও।

সময় যত গড়ায় আন্দোলন তত বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘অ্যাকশন’ সশস্ত্র হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে পুঁজি করে ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও সহিংসতায় অংশ নেয় বহিরাগত দুর্বৃত্তরা। ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার থেকে তাদের সঙ্গে সিদ্ধিরগঞ্জ অংশে কয়েক দফায় সংঘর্ষ হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। এখানকার বহু কারখানা কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, হামলা ও লুট করে দূর্বৃত্তরা।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জ অংশে হামলা-সংঘর্ষে মৃত্যু ও অগ্নিসংযোগের কিছু ঘটনা ঢাকাটাইমস পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন আমাদের সিদ্ধিরগঞ্জ প্রতিনিধি।

চার দিনে যত মৃত্যু আন্দোলনকারী আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যকার দফায় দফায় সংঘর্ষে সিদ্ধিরগঞ্জ অংশে মারা গেছেন ২৫ জন। এ ছাড়া আরও অনেকের মৃত্যুর কথা জানা গেলেও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাদের অনেকের নাম-পরিচয় জানা যায়নি।

শুক্রবার ১৯ জুলাই সাতজনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেন প্রো-অ্যাক্টিভ মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। তবে, নাম-পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।

২০ জুলাই সংঘর্ষে আটজন মারা যান। তারা হলেন: হৃদয় (২৫), সজল (২২), মেহেদী (২০), শাহিন (২৩), মিনারুল (২৫), সড়ক পারাপারকালে মৃত্যু হয় সিদ্ধিরগঞ্জ পুলস্থ মাছ বাজারের মিলন নামের এক মাছ ব্যবসায়ীর। তার গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলায়, মতলব উত্তরের সিদ্দিকুর রহমান সরদারের ছেলে আলাউদ্দিন (৩৫) নিমাইকাশারী এলাকায় বেড়াতে এসেছিলেন। চিটাগাং রোডস্থ আহসান উল্লাহ মার্কেটের বিক্রমপুর হার্ডওয়্যার দোকানের কর্মচারী সজীব (১৭)। নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী এলাকার আকরাম হোসেনের ছেলে মো. আকাশ। তিনি ফল দোকানের কর্মচারী ছিলেন।

২১ জুলাই রবিবার মহাসড়কে দফায় দফায় সংঘর্ষে মোট সাতজন নিহত হন। এর মধ্যে দুজনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন: রাব্বি (১৯)। তিনি নাসিক তিন নং ওয়ার্ড এলাকার বাসিন্দা এবং একটি হার্ডওয়ারের দোকানের কর্মচারী ছিলেন এবং নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী এলাকার আকরাম হোসেনের ছেলে মো. আকাশ। সে ফল দোকানি ছিলো। বাকিদের নাম ঠিকানা পাওয়া যায়নি।

২২ জুলাই সোমবার শনিবার আগুনে পুড়ে যাওয়া ডাচ্ বাংলা ব্যাংক ভবনের ভেতর থেকে সোমবার দুপুরে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আরেক ব্যক্তি হাসপাতালে চিকিৎসাধনি অবস্থায় মারা যান। তারা হলেন: কুষ্টিয়া জেলার চর জগন্নাথপুর এলাকার ওমর মন্ডলের ছেলে সেলিম মন্ডল (২৯), একই এলাকার মৃত সাবের বিশ্বাসের ছেলে আব্দুল সালাম (২২), সিলেটের বিয়ানীবাজারের মোখলেসুর রহমান কাবুরার ছেলে সোহেল আহমেদ (২২)। শনিবারের সংঘর্ষে গুলিতে আহত হওয়া রাজু নামের এক দারোয়ানের মৃত্যু হয় সোমবার।

ভাঙচুর-আগুন-হামলা শুক্রবার (১৯ জুলাই) দুপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইল মোড়স্থ সৌদি বাংলা নামের একটি শপিং মলে ছাত্রলীগ নেতাদের উপস্থিতি রয়েছে এমন খবরে সেখানে ব্যাপক ভাঙচুর করে বহিরাগতরা। এতে মার্কেটটির বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। সেদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মহাসড়কে যানচলাচল বন্ধ থাকলেও কিছুসংখ্যক মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেল সিদ্ধিরগঞ্জ অংশে এলে সেগুলো হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়।

পরদিন শনিবার দুপুরে মহাসড়কের শিমরাইল মোড়ের ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ভবনটিতে আগুন দেওয়া হয়। এতে ওই ভবনের ব্যবসায়ীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয় সাধারণ মানুষের। ভবনটি ভাড়া নিয়ে সেখানে বসবাসরত হাইওয়ে পুলিশের সদস্যরা আগুনে আটকা পড়লে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, র‌্যাব-১১ এর সদস্যসহ যৌথ বাহিনীর চেষ্টায় শতাধিক মানুষকে উদ্ধার করা হয়। তবে, বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়ানোর কারণে ওই দিন আগুন নেভাতে ব্যর্থ হয় প্রশাসন। পরদিন ফায়ার সার্ভিস সেই আগুন পুরোপুরি নেভায়।

ওই দিন ভবনটির পাশের জঙ্গল নামের একটি রেস্তোরাঁয়ও হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। দিনব্যাপী মহাসড়কে বেশ কয়েকটি যানবাহনে ভাঙচুর চালায় তারা। পরে রাত ১০টার দিকে মহাসড়কের সানারপাড় অংশে ঢাকা-৭ আসনের সাবেক সাংসদ হাজি সেলিমের মালিকানাধীন মদিনা কোল্ড-স্টোরেজে আগুন দিয়ে করে লুটপাট করে। পাশের একটি স-মিল জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। মাহিন গার্মেন্টসে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়, সিঙ্গার কোম্পানির দোকানে লুট করা হয়, এর আশপাশের তিনটি চা দোকানে লুটপাট চালানো এবং নাসিক-এর ২ নং ওয়ার্ডে একটি ফার্নিচারের দোকানে হামলা চালিয়ে মালামাল লুট করা হয়।

একই দিন দুপুরে নাসিক ১ নং ওয়ার্ডের সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির বাসভবনে হামলা, তার বাড়ির সামনের একটি মিনিবাস ভাঙচুর, লোকমান টাওয়ারে ভাঙচুর এবং চান টাওয়ারের ভবনটিতে ভাঙচুর করা হয়। শুধু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানই নয়, ওই রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শিমরাইল হাইওয়ে পুলিশ ক্যাম্পের অফিসে অগ্নিসংযোগ করে তা পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

একই রাতে আদমজী-চাষাঢ়া সড়কের বিদুৎ অফিসে হামলা চালিয়ে ব্যর্থ হলে সড়ক দিয়ে পারাপারকালে একটি তেলবাহী ট্যাংলরিতে আগুন দেওয়া হয়। পরে প্রশাসনের গুলিবর্ষণে নাশকতাকারীরা স্থান ত্যাগ করে।

রবিবার (২১ জুলাই) সকাল থেকেই মহাসড়কে অবস্থান নেন বহিরাগত আন্দোলনকারীরা। তাদের হটাতে সেদিন দুপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী যৌথ বাহিনীর বিপুল গুলিবর্ষণ করতে দেখা যায়। পরে বিকেলে আবার অবস্থান নেয় তারা এবং নাশতার চেষ্টা করে। তখন থেকে রাত পর্যন্ত কয়েক দফার গুলিতে কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়। বিকেলের দিকে ভূমিকাপল্লী অংশে একটি কাভার্ডভ্যানে আগুন জ্বালিয়ে দেন নাশকতাকারীরা।

এ ছাড়াও আরও বেশম কয়েকটি অগ্নিসন্ত্রাস ও হামলার ঘটনা ঘটে সিদ্ধিরগঞ্জে।

এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী তলব ও কারফিউ জারি করার পর গত দুই দিনে জনমনে স্বস্তি ফিরে আসে। ছয় দিন বন্ধ থাকার পর মঙ্গলবার সকাল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ অংশে সীমিত পরিসরে যানবাহন চলাচল করতে দেখা যায়। বুধবার সকাল ১০টা থেকে কারফিউ শিথিল এবং অফিস-আদালত খোলায় যানবাহনের চাপ বাড়ে এই মহাসড়কে। আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষে জড়ানোর অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক। তার ভাষ্যমতে, রবিবার অভিযান চালিয়ে ২২ জন, আর সোমবার রাতের অভিযানে ১৬ জনকে আটক করা হয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/২৪জুলাই/মোআ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
যেসব পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার অকালে চুল পাকা ঠেকায়
ভিসি ও প্রো-ভিসিকে অব্যাহতি, ৫৭ ঘণ্টা পর অনশন ভেঙে কুয়েট শিক্ষার্থীদের আনন্দ মিছিল 
ভেষজ ঔষধি লাল বিট দেহে রক্ত বাড়ায়, ক্যানসার ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে
সুস্থ দেহে সুন্দর মন, জানুন নীরোগ থাকার মন্ত্র
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা