স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন ও আলাদিনের চেরাগ

বাংলাদেশে অসংখ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান আছে। এমন অনেক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে হয়তো আমরা জীবন দশায় কোনোদিনও সেবা নিতে যাবো না। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা এমন একটি খাত যেখানে আমরা সবাই যেতে বাধ্য। বরঞ্চ এভাবে বলা যায় আমাদের জীবন যেখান থেকে শুরু আর যেখানে শেষ সেটি হচ্ছে এই স্বাস্থ্য খাত। এই খাতের চরম অব্যবস্থাপনার স্বীকার আমরা সবাই। এর সংস্কারে গঠিত কমিশনের কাছে আমার কিছু আবদার:
১। রোগীর টেস্ট করিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ডাক্তারদের টাকা নেয়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করুন।
২। প্রেসক্রিপশনে কোন কোম্পানির ওষুধের নাম লেখা বন্ধ করুন। ডাক্তাররা শুধুমাত্র জেনেরিক নাম লিখবে।
৩। সরকারি ডাক্তারদের অফিস নয়টা পাঁচটা করুন। এখন দুইটা পর্যন্ত অফিস করেই প্রাইভেট প্র্যাকটিসে চলে যায়। আর সকাল ৯ টায় হাসপাতালে আসা নিশ্চিত করুন।
৪। সরকারি ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করুন। অন্য কোন বিভাগের সরকারি কর্মকর্তারা কোন প্রকার প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে না যেমন ইঞ্জিনিয়ার। আচ্ছা পুলিশরা কেন ডাক্তারের মতো এই সুযোগটি নিচ্ছে না?!? তারা ডাক্তারের মত অফিস টাইমের পরে চেম্বার খুলে বসে পুলিশি সেবা প্রদান করল!!
৫। সরকারি ডাক্তাররা যদি একান্তই প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে চায় তবে তা অবশ্যই করতে হবে তার নিজস্ব কর্মস্থলে, অফিস টাইমের পরে।
৬। ডাক্তারদের ঔষধ কোম্পানি হতে গ্রহণ করা যাবতীয় সুবিধা বন্ধ করুন। বাসার বাজার, ফ্রিজ, টিভি... বিদেশে ভ্রমণ পর্যন্ত ঔষধ কোম্পানি থেকে নিয়ে থাকে। নীলক্ষেতের পাশের ফুটপাতে দেখে আসুন, ওষুধ কোম্পানি দেয়া গিফট কিভাবে বিক্রি করছে।
৭। দুপুর ২ টার পরে কয়েকজন ডিউটি ডাক্তার ব্যতীত কোন ডাক্তারই সরকারি হাসপাতালে থাকে না। অথচ সেই একই ডাক্তার মধ্যরাত অতিক্রম করে দৈনিক ৮/১০ ঘন্টা প্রাইভেটে রোগী দেখে; অপারেশন করে।
৮। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ডাক্তার আছে প্রায় ৩০০ জন। অথচ দুপুর দুইটার পর সেখানে মৃত্যু পথযাত্রী রোগী আসলেও সেখানে ন্যূনতম কোন চিকিৎসা যেমন এনজিওগ্রাম পর্যন্ত করা হয় না। এরকম পরিস্থিতি প্রতিটি সরকারি হাসপাতালেই বিদ্যমান। অথচ এই সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের মালিকানাধীন প্রাইভেট হাসপাতালে সার্বক্ষণিক যেকোনো ধরনের চিকিৎসা নিশ্চিত ভাবে প্রদান করে।
৯। সরকারি চাকরি করা কোন ডাক্তার কোন প্রাইভেট ক্লিনিকের মালিক বা শেয়ার হোল্ডার হতে পারবে না। তারা সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ব্যক্তিগত হাসপাতালে নিয়ে যায়।
১০। চিকিৎসকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিদেশে ট্রেনিং খুবই কম। অধিক হারে বিদেশে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করুন।
১১। দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীরাই ডাক্তারি পেশায় আসে। অথচ তারা এডমিন ক্যাডার হতে অনেক কম সুযোগ-সুবিধা পায়। তাদের সুযোগ সুবিধা এডমিন ক্যাডারের সমপর্যায়ে করুন।
১২। ডাক্তাররা যেহেতু প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে প্রচুর টাকা ইনকাম করে, তাই তাদের এসব সুযোগ সুবিধা আদায়ে একেবারেই সোচ্চার না। আবার প্রাইভেট প্র্যাকটিস এর পক্ষে যখন কথা বলে তখন এডমিন ক্যাডার হতে সুযোগ সুবিধা কম পাওয়ার যুক্তি দাঁড় করায়!
১৩। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সহ স্বাস্থ্য খাতের অন্যান্য অফিসের দায়িত্ব ডাক্তারদের হাতে তুলে দিন।
১৪। স্বল্প বেতনের জন্য তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্ত জেলা বদলি করা হয় না। এই সুযোগে তারা আজীবন একই হাসপাতালে চাকরি করে মারাত্মক অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়। এদেরকে একই জেলার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে বদলি করুন।
১৫। প্রতিটি সরকারি হাসপাতালের ল্যাব ফেসিলিটিকে পূর্ণাঙ্গ করুন। দ্রুততম সময়ে এ সেবা চালু করতে চুক্তিভিত্তিক ল্যাব টেকনিশিয়ান নিয়োগের বিকল্প নেই। আনসারের মাধ্যমে এ নিয়োগ করুন যেন তাদেরকে পূর্ণমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
১৬। প্রতিটি সরকারি হাসপাতালের অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে শুরু করে সকলের আলাদা করে নির্দিষ্ট পোশাকের ব্যবস্থা করুন, যেন এখানে দালালদের দৌরাত্ম বন্ধ করা যায়।
১৭। আর কারো কাছে আলাদিনের চেরাগ যদি থাকে জানাবেন, যে দৈত্য ডাক্তারদেরকে রাজনীতিমুক্ত করতে পারবে! এ কাজ দৈত্যকে দিলে সে নিশ্চিত হার্ট এটাক করবে, আর ডাক্তাররা দৈত্যকে বিনা চিকিৎসায় মেরে ফেলবে!!!!
পুনশ্চঃ চিকিৎসা ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশন উপরের ১ থেকে ১৬ নং পয়েন্ট গুলোর সমাধান করতে পারবেন না নিশ্চিত। কারণ এতে ইন্ডিয়া তার ৮০% চিকিৎসা ট্যুরিজম হারাবে, সাথে ৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার! এক্ষেত্রে আলাদিনের চেরাগ অবশ্যম্ভাবী। আর এক্ষেত্রে দৈত্যকে দিয়ে ১৭ নং পয়েন্ট এর সমাধান নিশ্চয়ই আগে করাবে!! কারণ এ চেরাগও যে আসবে ইন্ডিয়া থেকে!!!
লেখক: ধ্রুবনীল রোজারিও, গুলশান – ১, ঢাকা

মন্তব্য করুন