ইউনাইটেড বিশ্ববিদ্যালয় কি ইউনাইটেড গ্রুপের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান?

আওয়ামী লীগ সরকারের পতন আন্দোলনে সামনে থেকে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনে আহত একাধিক শিক্ষার্থী হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও তাদের কাছ থেকে সেশন ফি নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এই বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্ক শুরু হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক আবুল কাশেম মিয়াসহ বিভাগীয় প্রধানদের পদত্যাগের দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। পরে তারা পদত্যাগে বাধ্য হন।
শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন— ইউনাইটেড বিশ্ববিদ্যালয় কি ইউনাইটেড গ্রুপের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান? হঠাৎ কেন শিক্ষার্থীরা এতটা ক্ষেপলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকদের বিরুদ্ধে? এর পেছনের কারণ হিসেবে পাওয়া গেছে অমানবিকতার চিত্র।
ইউনাইটেড বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কয়েকদিনের ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনৈতিক ফি আদায়, অদক্ষ শিক্ষক, মানহীন শিক্ষাব্যবস্থা, ডিপার্টমেন্ট অফিসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ, কঠোর পরীক্ষা পদ্ধতি, স্বৈরাচারিদের পুনর্বাসন, ক্যান্টিনে মানহীন খাবার সরবরাহসহ অসংখ্য অভিযোগ আছে এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এসব বিষয়ে তারা বারবার প্রশাসনকে জানালেও কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
সূত্র বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন সমালোচিত ইউনাইটেড গ্রুপের প্রধান উপদেষ্টা হাসান মাহমুদ রাজা। যার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে পাঁচটির মতো মামলা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে ফান্ড থেকে খুব কৌশলে লভ্যাংশ সরিয়ে নিচ্ছে ট্রাস্টি বোর্ড— এমন অভিযোগ বেশ পুরাতন। তাছাড়া যেসব শিক্ষার্থী শেখ হাসিনা সরকার পতন আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তাদেরকে কৌশলে হয়রানি করা হচ্ছে।
অমানবিক ইউনাইটেড!
ইউনাইটেড বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক ছাত্রীর (নিরাপত্তার স্বার্থে তার নাম ব্যবহার করা হলো না) বাবার মৃত্যুসনদ নিয়ে বিভাগীয় প্রধানের হয়রানিমূলক আচরণের অভিযোগ উঠেছে। ওই শিক্ষার্থী জানান— আমার মিড পরীক্ষার ৫ দিন আগে আমার বাবা মারা যায়। আমার মানসিক অবস্থা এতটাই বেশি খারাপ ছিল, যে কারণে আমি প্রথম দিকের মিড পরীক্ষা দিতে পারিনি। এই নোটিশ অনুযায়ী আমি তিন দিনের মধ্যে ক্যাম্পাসে ডিপার্টমেন্ট হেডের সাথে কথা বলি। (উনি এতটাই বেশি ব্যস্ত যে কথাই বলবে না এবং কিছু শুনবেও না। তাও সকাল ৯টা থেকে বিকাল তিনটা পর্যন্ত উনার রুমের আশেপাশে ঘোরার কারণে শেষমেষ কথা বলে)। আমি আমার বাবার মেডিকেল ডেথ সার্টিফিকেট দেখাই। এরপর আমাকে বলা হয়, এটা দিয়ে কাজ হবে না। আমাকে আমার জেলার কমিশনার বা কনসিলার বা জেলা প্রশাসক যেই আছে তার কাছ থেকে সনদপত্র বা স্বাক্ষর ইত্যাদি আনতে হবে। তাহলে আমার ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষার ফি ফ্রি করে দেবে। যেহেতু আমার বাবা মারা গিয়েছেন এবং আমার কোনো ভাই নেই (ছিল সেও মারা গিয়েছে অনেক বছর আগে)। এসব কাগজপত্র জিনিস তেমন একটা বুঝার কথা না আমাদের। তাও অনেক চেষ্টা করে সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে পেপারস ম্যানেজ করার ট্রাই করি। কিন্তু কোনোভাবেই তিন দিনের মধ্যে এসব পেপার্স ম্যানেজ করা পসিবল হয়নি। … তারপর আজকে আমি যাই এই বিষয়ে স্যারের সাথে কথা বলতে। যদি সে একটু শুনে এই আশায়। আমার অন্য একটি কোর্সের ল্যাবের মিড ছিল আজকে, তাই মিড পরীক্ষার পর দুপুর ১টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত ৫ ঘণ্টা ওয়েট করার পরও স্যার আসেনি। (উনি বলেছিলেন আজকে ফ্রি থাকবে)। আমার কথা হচ্ছে একটা মানুষের ডেথ সার্টিফিকেট ও ফেক বানিয়ে আনবে কেউ?’
ওই শিক্ষার্থী আরও জানান, আরও অনেক সিরিয়াস কন্ডিশন নিয়ে স্টুডেন্টরা এসেছিল কথা বলতে। এমনও দেখেছি অ্যাক্সিডেন্ট করে ব্যথা পেয়ে হাত-পা ছিলে গিয়েছে। কিন্তু কোনো হাড় ভাঙেনি। এমন সিরিয়াস কন্ডিশন দেখেও বলে এক্স-রে রিপোর্ট আনতে। অনেকে আইসিইউ মেডিকেল রিপোর্ট নিয়ে গেলেও তাদের বলে এগুলা ফেক বানানো যায়! তার মানে আপনারা টাকা দিয়ে পরীক্ষা দিতে বাধ্য। মনুষত্ব কোথায়? কাকে যেয়ে কমপ্লেইন করব। যাকে গিয়ে করব তারাই এ রকম!’
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে সেপ্টেম্বরের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারের জন্য অনলাইনে ১৯৪০ জন শিক্ষার্থীর ভোটের ভিত্তিতে ১৩ দফা দাবি নিয়ে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তৎকালীন ভিসি প্রফেসর আবুল কাশেম মিয়া শিক্ষার্থীদের জানান, গ্রেডিং সিস্টেম পরিবর্তনের দাবি ব্যতিত ১২ দফা দাবি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মেনে নিয়েছে। উনার এই আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন স্থগিত করে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যান।
কিন্তু দীর্ঘ ৮ মাস অতিবাহিত হলেও ১২ দফা দাবির মধ্যে অধিকাংশ দাবি পূরণে কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে দেখা যায়নি। এমতাবস্থায় ভিসি আবুল কাশেম মিয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন বলেই প্রতীয়মান হয়। দাবিগুলোর মধ্যে একটি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, ইম্প্রুভমেন্ট এক্সাম দিতে মিড টার্মের ক্ষেত্রে পার কোর্সে ২০০০ টাকা ও ফাইনালে ৩০০০ টাকা দিতে হবে। কিন্তু বর্তমানে সেই ফি ৪৫০০ টাকা করায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
এছাড়া প্রশ্নের দৈর্ঘ্য আগের মতোই রেখে পরীক্ষার সময় ১৫ মিনিট কমিয়ে দেওয়া, এক্সাম হলে কোর্স টিচারকে প্রবেশ করতে না দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে শিক্ষার্থীদের মিডটার্ম এক্সামের রেজাল্ট খারাপ করানোর অভিযোগ রয়েছে, যেন শিক্ষার্থীরা পুনরায় ৪৫০০ টাকা করে প্রতি কোর্সে দিয়ে ইম্প্রুভমেন্ট এক্সাম দেয়।
মেডিকেল ইমার্জেন্সির ক্ষেত্রে টাকা ছাড়া মেকাপ এক্সাম দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের যে নিয়ম, সেটি মানতেও বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট থেকে অনীহা প্রকাশ করা হয়। টাকা দিয়ে ইম্প্রুভমেন্ট এক্সাম দেওয়ার জন্য বলা হয়। এমনকি শিক্ষার্থীরা কোর্স উইথড্র দিতে চাইলেও সেটি দিতে দেওয়া হয়নি ইম্প্রুভমেন্ট এক্সাম দেওয়ার কথা বলে। বাবার ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে যাওয়ার পরেও একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে সিএসই ডিপার্টমেন্ট হেড প্রফেসর নুরুল হুদার অমানবিক ব্যবহারের কথা সবারই জানা। এ ধরনের ইম্প্রুভমেন্ট ব্যবসায় শিক্ষার্থীরা ক্ষুদ্ধ।
ভিসি ও সিএসই ডিপার্টমেন্টের প্রধান ছাড়া বাকি ৯ শিক্ষক যারা বিভিন্ন পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন, ওনাদেরকে নিজেদের পদত্যাগপত্র উইথড্র করার জন্য আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে।
দ্রুত নতুন ভিসি নিয়োগ, পূর্বে আশ্বাস দেওয়া ১২ দফা দাবির পূর্ণ বাস্তবায়ন, ইম্প্রুভমেন্ট ফি কমানোসহ বিভিন্ন দাবিতে ২৭ এপ্রিল শিক্ষার্থীরা একাডেমিক কার্যক্রম বয়কট করে আন্দোলন চালিয়ে যায়। এরপরই তড়িঘড়ি করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
(ঢাকাটাইমস/২৮এপ্রিল/এসএস/এজে)

মন্তব্য করুন