দখল-দূষণে ফেনীর ২৪০ খাল: কাগজে-কলমে থাকলেও ৬০ শতাংশের অস্তিত্ব নেই
দখল ও দূষণের কবলে ফেনীর ২৪০টি খাল ও শাখানদী। চলতি বছরের আগস্টের শেষে ভয়াবহ বন্যার সাক্ষী এ জনপদ। ভেসেছে প্রাণ, দুর্ভোগে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। স্থানীয়রা বলছেন বিপর্যয়কর এ বন্যা দীর্ঘায়িত হওয়ার অন্যতম কারণ খাল ও শাখানদী দখল-দূষণ।
ফেনীর সোনাগাজীর ৫৬টি, দাগনভূঞার ৫২টি, সদর উপজেলার ৩৯টি, পরশুরামের চারটি, ছাগলনাইয়ার তিনটি ও ফুলগাজীর সব কটি খালই দখল-দূষণে মৃতপ্রায়। এসব খাল দখল ও দূষণরোধে কার্যকর পদক্ষেপ আশা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
ফেনী শহরের দাউদপুর ও পাগলিছড়া খালের পাশে প্রতিনিয়ত ময়লা-আবর্জনা ফেলে খাল দখল করা হয়েছে। আড়তের ময়লায় শুধু খালের পানি দূষণই হচ্ছে না, বন্ধ হচ্ছে পানির প্রবাহ। শহরের অন্য খালগুলোর দশাও প্রায় একই। সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবে যায় পেট্রোবাংলা, আরামবাগ, পশ্চিম উকিলপাড়া। এবার বন্যায় পেট্রোবাংলা এলাকা প্রায় সাত ফুট পানিতে তলিয়ে যায়।
ছোট ফেনী নদীর সঙ্গে সংযোগ থাকা একাধিক শাখাখাল তাদের নাব্যতা হারানোয় বন্যার পানি দ্রুত নামতে পারে না বলে মনে করেন স্থানীয় অধিবাসীরা। পরিবেশ অধিদপ্তরের এ বিষয়ে ভূমিকা রাখার কথা থাকলেও কার্যকর পদক্ষেপ দেখেননি তারা।
ফেনী শহরের বর্তমান প্রজন্মের কাছে রূপকথা মনে হলেও বাস্তবতা হলো এ খালেই একসময় চলাচল করত মালবাহী বাণিজ্যিক নৌকা। ছোট-বড় নৌকাগুলো ভিড়ত শহরতলির দাউদপুল এলাকায়। সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নানা পণ্যের সমারোহে বসত মাসব্যাপী রাসমেলা। ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম ভরসা ছিল এ খাল।
ফেনী জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ও সুফলা বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলাল উদ্দিন আলাল বলেন, ‘আমরা নিজ চোখে দেখেছি ফেনী শহরের দাউদপুল এলাকার খালে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বাণিজ্যিক নৌকা ভিড় করত, পণ্য ওঠা-নামা করত। সেসব পণ্য যেত জেলার বিভিন্ন এলাকায়। সেই চিত্র এখন ভাবাও মুশকিল।’
সানরাইজ ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা প্রবীণ কবি মু. ইকবাল চৌধুরী বলেন, খালগুলো দিয়ে নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কাঠের তৈরি জিনিসপত্র আসত। খাল পাড়েই প্রায় এক কিলোমিটার জায়গাজুড়ে রাসমেলা বসত। সেই মেলা চলত মাসব্যাপী। এখন সেই খালও নেই, রাসমেলাও নেই।
চলতি বছরের আগস্টের মাঝামাঝিতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ফেনীতে ২৯ জনের প্রাণহানি ঘটে। দুর্ভোগে পড়ে জেলার অন্তত ১৭ লাখ মানুষ। অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় বিপুল পরিমাণ। যে ভয়াবহ বন্যায় এ বিপুল ক্ষয়ক্ষতি, তার মূলে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে ফেনীর ছয় উপজেলার অন্তত ২৪০টি খাল ও শাখানদীর দখল-দূষণ। এসব খালের পানির প্রবাহ ঠিক করা না গেলে বন্যা প্রতিবছর ভাসাতে পারে ভাটির এ জনপদকে- এমন আশঙ্কা ভুক্তভোগীদের।
এফবিএম ফাউন্ডেশন উপদেষ্টা একরামুল হক জানান, গত ৪০ বছর ধারাবাহিকভাবে খালগুলো একটু একটু করে দখল হচ্ছে। অনেক খাল কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে বিলীন। এসব খাল ও পানির প্রবাহ ধ্বংস করার করুণ পরিণতি এবারের বন্যায় মানুষ দেখেছে। বন্যা দীর্ঘায়িত হওয়ার বড় কারণ পানির প্রবাহগুলো নষ্ট হওয়া।
দফায় দফায় উদ্যোগ নিয়েও খাল ও শাখানদীগুলোর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড। নানা কারণে ব্যর্থ হতে হয় তাদের। কাগজে-কলমে থাকলেও ৬০ শতাংশ খালের অস্তিত্ব নেই।
উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পৌর প্রশাসক গোলাম মো. বাতেন জানান, খালগুলো দখল ও দূষণ থেকে রক্ষা করার বিষয়ে তাদের কার্যক্রম চলমান।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পরিবেশ অধিদপ্তরের বড় ভূমিকা রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদ শাহরিয়ারের জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে জানানো হয়েছে। অভিযান চলবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোসাম্মৎ শওকত আরা কলি জানান, বিভিন্ন সময়ে তারা এ বিষয়ে অভিযান পরিচালনা করেছেন। এ বিষয়ে আদালত কোনো রায় দিলে সেটি বাস্তবায়নে কাজ করেন তারা।
(ঢাকাটাইমস/২৯নভেম্বর/মোআ)
মন্তব্য করুন