মেয়ে ফুটবলারদের প্রাপ্য সম্মান দিন

এস এম কায়উম
| আপডেট : ০৯ জানুয়ারি ২০১৭, ১১:১৯ | প্রকাশিত : ০৯ জানুয়ারি ২০১৭, ১১:০৮

ভারতের শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত সাফ ফুটবলের চতুর্থ আসরের ফাইনালে শক্তিশালী ভারতের সাথে পারল না বাংলাদেশের মেয়েরা। কাল ফাইনালে বাংলাদেশকে ৩-১ গোলে হারিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সাফ শিরোপা জিতল ভারত। ইতিহাসের তৈরির খুব কাছাকাছি গেলেও শেষ পর্যন্ত ইতিহাস লেখা হলো না স্বপ্না, সাবিনাদের; যদিও তাঁরা ইতিহাসেরই অংশ হয়ে গেছেন ইতোমধ্যেই। ফুটবলে মেয়েদের নৈপুণ্য বাংলাদেশ ফুটবলের বর্তমান ক্রান্তিকালে একমাত্র সাফল্য।

বাংলাদেশ ফুটবলে পুরুষরা ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিলেও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিম-লে মেয়েরা সফল, তারই ধারাবাহিকতায় সাফ ফুটবলে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন স্বপ্না, সাবিনারা। এবারের ফুটবল আসরে প্রথম ম্যাচে মেয়েরা গ্রুপ পর্বের ৬-০ গোলে আফগানিস্তান এবং শক্তিশালী ভারতের সাথে গোলশূন্য ড্র করে পরে সেমিফাইনালে মালদ্বীপকে ৬-০ গোলে হারিয়ে ইতিহাসের অংশ হলেন বাংলাদেশের মেয়েরা। প্রথমবারের মত সাফ ফুটবলের ফাইনালে খেলল মেয়েরা।

মেয়েদের সাফে গত তিন আসরে দুইবার সেমিফাইনাল পযন্ত উঠেছিল বাংলাদেশ। ছেলেদের সাফেও ২০০৩ সালের পর থেকেই শিরোপা খরা। পুরুষ ও মহিলা মিলিয়ে সেই ২০০৫ সালের পর আবারও সাফের ফাইনালে উঠল বাংলাদেশ। ২০০৫ সালে অবশ্য পুরুষ সাফে ফাইনালে উঠেছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মেয়েরা অবশ্য যোগ্যতর দল হিসেবে ফাইনালে ওঠে কিন্তু গ্রুপ পর্বে ভারতেকে আটকে দিলেও ফাইনালে শেষ রক্ষা হলো না।

ভারত অবশ্য এবারের সুস্পষ্ট আসরে ফেবারিট ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মেয়েরা তাদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চটা দিয়ই চেষ্টা করে প্রথমবারের মতে রানার্স আপ হয়। ম্যাচ শেষে খেলার ত্রটিগুলো সংশোধন করে এই সাফল্যের ধারাবাহিকতা রাখাটা বাংলাদেশ ফুটবলের জন্য এখন খুব দরকার। বাংলাদেশ ফুটবলে মেয়েদের এই অভূতপূর্ব সাফল্য অবশ্য একদিনে আসেনি বরং দীর্ঘদিনের কর্মনিষ্ঠারই ফলাফল স্বরুপ এবং সাম্প্রতিক সময়ে ফুটবলে মেয়েদের ধারাবাহিক সাফল্যও সেটারই প্রতিফলন মাত্র।

যদিও ফুটবলে মেয়েদের অংশ্রগহণের পথক্রমটা খুব মসৃন ছিল না। মেয়েরা খেলাধুলা করবে এই ব্যাপারটাই যেন আমাদের সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা শুরুতে কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি। জেলা পর্যায়ে ফুটবলে মেয়েদের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে অনেকভাবেই তাই বাধা সৃষ্টি করা হয় এমনকি এরূপ চিত্র খুঁজলে হয়ত এখনও পাওয়া যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ লৈঙ্গিক বৈষম্যের বীজ আমরাই আমাদের ভেতরে বুনে রেখেছি। তাই এক শ্রেণির অশিক্ষিত গ্রাম্য মাতব্বরের অসহযোগিতা ও বৈষম্যমূলক আচরণ করে থাকে। যদিও বর্তমানে পরিস্থিতির ক্রমশ উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। আসলে আমাদের সমাজে এখনও নারীদের ক্ষমতায়ন বা নারীদেরকে স্বাবলম্বী হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত নয় অনেক ক্ষেত্রেই। তাদের চাওয়াটাও আন্তরিক নয়। তাই বাংলাদেশ ফুটবলে মেয়েদের অংশগ্রহণ যেন এই মানসিকতার বিরুদ্ধে এক ধরনের নীরব বিপ্লব।

বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নারীর ক্ষমতায়নের উপর প্রগাঢ়ভাবেই গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং তাঁর আন্তরিকতা, তার মনোভাব আমরা দেখেছি কলসিন্দুরের মেয়েদের ফুটবলারদের উপর সামাজিক লাঞ্ঝনার পরিপ্রেক্ষিতে। বর্তমানে বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে ফুটবলে মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে এবং বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের জেলা পর্যায়ে বয়সভিত্তিক, সিনিয়রসহ বিভাগওয়ারী নানা কর্মকা- পরিচালনার মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে অনেক ভালো ভালো খেলোয়াড় আমরা পেয়েছি।

এক্ষেত্রে বাফুফের কর্ম পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন প্রশংসনীয়। জেএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে আমরা পেয়েছি ময়মনসিংহের কলসিন্দুরের একঝাঁক মেধাবী নারী ফুটবলার। যারা এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আন্তর্জাতিক চ্যাম্পিয়নশিপে অসাধারণ নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখে ফাইনালে উঠে। যদিও নেপালের সঙ্গে সে ফাইনাল ম্যাচটি ভয়াবহ ভূমিকম্পের দরুণ অনুষ্ঠিত হয়নি।

পরিসংখ্যান বলে ২০০৩ সালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ চ্যাম্পিয়নশিপের বাংলাদেশের মেয়েরা তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিল যেখানে ভারত, ইরান, তাজিকিস্তান, ভুটান এবং শ্রীলংকা খেলেছিল। শুধু কলসিন্দুরই নয় সাতক্ষীরা, মাগুরা, রাঙামাটি, বান্দরবান, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে নারী ফুটবলাররা বাংলাদেশ ফুটবলে জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করছে যেটা আমরা জাতীয় দলের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি।

এছাড়াও ২০১৬ এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের বাংলাদেশ ফুটবলের মেয়েরা অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিল। ফুটবলে মেয়েদের এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ফুটবলে মেয়েদের অংশগ্রহণ আগের তুলনায় বেড়েছে। যদিও এক্ষেত্রে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে আরও বেশি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। মেয়ে ফুটবলাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে থেকে আর্থিকভাবে মূল্যায়ন দরকার। বাংলাদেশের মেয়েরা অদম্য মনোবলে ফুটবলের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতায় সে সততার পরিচয় তারা সাফ ফুটবলে রেখেছে এজন্য আমরা সত্যিই গর্বিত।

ফুটবলে বাংলাদেশের মেয়েরা এক জোয়ার তৈরি করেছে এক এক অনন্য সাধারণ অর্জন বাংলাদেশের। তাই বাংলাদেশ ফুটবলে মেয়েদের অংশগ্রহণ আরও বৃদ্ধি করা এবং মেধাসম্পন্ন ভালো ফুটবলার খুঁজে বের করার জন্য বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের জেলা ও শহর পর্যায়ে বয়সভিত্তিক স্পল্প ও দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন কর্ম পরিকল্পনা নেওয়া দরকার। একইসঙ্গে ফুটবলে মেয়েদের বিভিন্ন অর্জনের যথাযথ মূল্যায়ন একান্তকাম্য।

লেখক: ফ্রিল্যান্স লেখক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :