‘রাজাকারে’র নামে সৌধ গুঁড়িয়ে দিল প্রশাসন
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার খর্নিয়া ইউনিয়নের মেছাঘোনা গ্রামের তালিকাভুক্ত ‘রাজাকার’ শেখ আব্দুল মজিদের নামে নির্মিত সেই শহীদ স্মৃতিসৌধটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে প্রশাসন। তাদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে ডুমুরিয়ার স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ।
রবিবার দুপুর খুলনা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সজিব খানের নেতৃত্বে একদল পুলিশ অভিযান চালিয়ে নিহত সেই ‘রাজাকারে’র বাড়ির আঙ্গিনা থেকে স্মৃতিসৌধটি ভেঙে দেন এবং আলামত হিসেবে স্মৃতিসৌধে লাগানো রাজাকারের নামের ফলকটি জব্দ করেন। ঘটনাস্থলে আব্দুল মজিদের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও কেউ কোনো মন্তব্য করেননি।
ডুমুরিয়ার মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলী জানান, রাজাকারের নামে শহীদ হিসেবে স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা জঘন্য অপরাধ। কিন্তু সংবাদ মাধ্যম কর্মীদের লেখনিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই স্মৃতিসৌধটি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এ কারণে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সম্মানিত করা হয়েছে। ফলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে সাংবাদিকসহ স্থানীয় প্রশাসনকে তিনি ধন্যবাদ জানান।
তিনি আরও জানান, ডুমুরিয়া উপজেলা মেছাঘোনা জেহের শেখ ও খর্নিয়া রানাই মোল্লা, মৃত ফজর আলী মোল্লার বাড়িসহ বেশ কয়েকটি স্থানে ১৯৭১ সালে রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। অথচ ওই সকল পরিবারের সদস্যরা শোনা যাচ্ছে কেউ কেউ রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছে। এসব বিষয় খোঁজ-খবর নিয়ে তাদেরও বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান তিনি।
ডুমুরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি, তদন্ত) মো. আব্দুল খালেক জানান, খুলনা জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে রবিবার সকালে ওই স্মৃতিসৌধটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহম্মাদ আশেক হাসান জানান, রাজাকারের নামে শহীদ স্মৃতিসৌধটি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং আলামত হিসেবে ফলকটি রেখে দেয়া হয়েছে।
১৯৭১ সালে ডুমুরিয়া হাট থেকে পার্শ্ববর্তী শোভনা মৌলপাড়া নিবাসী কাওছার শেখকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে ধরে নিয়ে বাড়ির উঠানে বিকেলে জনসম্মুখে নির্যাতন চালান মজিদ শেখ। সন্ধ্যার দিকে মজিদ শেখের বাড়ির দক্ষিণে শ পাঁচেক গজ দূরে পার্শ্ববর্তী ওয়াপদার রাস্তার পাশে নিয়ে নদীর তীরে গুলি করে ফেলে রাখে। পরদিন সকালে কাওছার শেখের লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যান তার বাহাদুরপুর গ্রামের আত্মীয় মহাতাব শেখসহ কয়েকজন। ওই গ্রামেই তাদের বাড়ির কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
কাওছার শেখের ছেলে লুৎফর শেখ এখন ডুমুরিয়ার শোভনা ইউনিয়নের সামনে চা বিক্রেতা। তারা তখন ছোট তাই কিছুই করতে পারেননি। এর বিচারও হয়নি। এলাকার লোকজনের অভিযোগ, এ হত্যাকা-সহ মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পার্শ্ববর্তী কার্তিকডাঙ্গা, থুকড়া, রংপুর গ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে হিন্দুসম্প্রদায়ের ঘরবাড়িতে লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের নেতৃত্ব দেন শেখ আব্দুল মজিদ। গোনালী গ্রামের দুঃখে ঠাকুরকে (দুলাল চক্রবর্তী) অমানবিকভাবে নির্যাতন চালিয়ে জোর করে জমি লিখে দিতে বাধ্য করা হয়। পরে তার হাত-পা ভেঙে দিলে ক্ষোভে-দুঃখে তিনি আত্মহত্যা করেন। তার ছেলে গোনালী গ্রামের কার্তিক ঠাকুর বলেন, ‘আমি তখন ছোট ছিলাম। তবে আমার বাবার ওপর নির্যাতনের কথা লোকমুখে শুনেছি।’ একই গ্রামের ব্যস্তু জেলেকেও নির্যাতন করেন আব্দুল মজিদ। এমন অসংখ্য নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
১৬ ডিসেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের পর বীর মুক্তিযোদ্ধারা ডিসেম্বরের শেষ দিকে পার্শ্ববর্তী গোলনা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করেন। সেখানে ধরে এনে তাৎক্ষণিক শাস্তি হিসেবে তাকে প্রচ- লাঠিপেটা করে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর পরাজিত শক্তি আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে মজিদ শেখ আবার অত্যাচারী হয়ে ওঠেন।
মজিদ শেখের পরিবার দীর্ঘ ৭০-৮০ বছর ধরে এলাকায় প্রভাবশালী ছিল বলে তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি। তার বাবা জেহের আলী শেখ লাঠিয়াল বাহিনীর প্রধান হিসেবে বিভিন্ন স্থানে ভাড়ায় মারামারি করতে যেতেন বলে প্রচলিত আছে। তাদের জীবদ্দশায় কেউ তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গেলে নেমে আসত নির্যাতন। মুক্তিযুদ্ধের আগে ও মুক্তিযুদ্ধকালে অবৈধভাবে বিত্তবৈভব গড়ে তোলে পরিবারটি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থানায় একাধিক মামলা হয় মজিদ শেখের নামে। এলাকায় অনেক গরিব মানুষের নামে খাসজমি বেনামি করে তা দখল করার অভিযোগ আছে। ১৯৮২ সালে নিজ বাড়িতে সেটেলমেন্ট মাঠজরিপের ক্যাম্প বসিয়ে ওই সব জমি নিজ নামে রেকর্ড করে নেন। ১৯৯০ সালের দিকে মজিদ শেখ দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এ নিয়ে পারিবারিক কলহ সৃষ্টি হয়। ২০০৩ সালের ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বাড়ির সামনে অজ্ঞাতপরিচয় বন্দুকধারীদের গুলিতে মজিদ শেখ নিহত হন।
গত কয়েক বছর আগে নিহতের ছেলে লাচ্চু শেখ তার পিতা কুখ্যাত রাজাকার আব্দুল মজিদ শেখের নামে গ্রামের সড়কের পাশে শহীদ স্মৃতিসৌধ তৈরি করেন।লোকচক্ষুর অগোচরে রাখতে বেশ কিছুদিন সেটি বেড়া দিয়ে রাখা হয়। সম্প্রতি সেটা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। সেখানে নাম ফলক স্থাপন করা হয়েছে ‘শহীদ স্মৃতিসৌধ’ হিসেবে।
রবিবার সকালে মেছাঘোনা গ্রামের ওই বিতর্কিত শহীদ স্মৃতিসৌধ স্থাপন নিয়ে এলাকায় যে জল্পনা-কল্পনা ছিল তার অবসান ঘটেছে।
ঢাকাটাইমস/৮মে/এএইচ/এমআর