আমার ব্যান্ড চাইম

আশিকুজ্জামান টুলু
| আপডেট : ২৮ মে ২০১৭, ১৮:১১ | প্রকাশিত : ২৮ মে ২০১৭, ১৫:০২

আল্লাহ্‌ যা করেন, তার পিছনে লুকানো একটা কারন থাকে যেটা আমরা ঐ মুহূর্তে বুঝতে পারিনা, কিন্তু পরে আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে আল্লাহ্‌ যা করেছেন, খুব ভালোর জন্য করেছেন । আমি এই কথাটায় ১০০০% বিশ্বাস করি ।

১৯৮৩ সালে অনেক আদর করে তৈরি করেছিলাম ব্যান্ড “চাইম” । কতো ভালবাসা, কতো আশা, কতো কষ্ট, কতো বলিদানের ফল ছিল আমার চাইম । জীবনের প্রথম ভালবাসা । প্রথম প্রেমকে যেভাবে মানুষ আগলে রাখে, তুলে তুলে রাখে, আমিও চাইমকে ঠিক সেভাবেই মনের মণিকোঠায় তুলে রেখেছিলাম । তখন আমি ছোট্ট নতুন মিউজিশিয়ান, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই, পকেটে থাকেনা চারআনা পয়সা, তবু মিউজিকের জন্য এক আকাশ ভালবাসা, সমুদ্রের মতো বিশাল স্বপ্ন - একদিন এই বিরাট আকাশটায় উড়বে আমার স্বপ্নের ঘুড়ি । চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতে থাকি ব্যান্ড ফর্ম করার জন্য । ব্যান্ড করতে চাই ভালবাশার জন্য, মোটেই টাকার জন্য না, পপুলারিটির জন্য না, হিট হওয়ার জন্য না । কেউ পাত্তাও দেয়না, কারোর নাই একমিনিট সময় আমার কথা শোনার । কোন মিউজিশিয়ানই রাজী না আমার মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো পিচ্চি পোলার সাথে ব্যান্ড করতে । পারিনা বাজাইতে কিছু, গোটা চারেক কর্ড জানি, এ মাইনর, জী, এফ আর ই সেভেন, ব্যাস এই কয়টা কর্ড । এই দিয়া কি আর ব্যান্ড হয়? এ বি সি ডি জেড পর্যন্ত মুখস্থ কিন্তু কর্ড জানি মাত্র এই চারটা ।

সেলিম হায়দার ভাইয়ের কর্ড এর ঠেলায় ডরে সামনে ভিড়িনা, বুঝি যে উনি দুইটা জ্যাজ মিস্রিত বিদেশি কর্ড বাজাইলে আমার স্পাইনাল কর্ড খুইলা মাটিতে পইড়া যাইবো । মনে মনে ভাবী ওরা এতো কর্ড কই পায়?? ওরা কি স্বপ্নে কর্ড পায়?? শেষে বুঝতে পারলাম যে আমার একটাই উপায়, একেবারে আনকোরা নতুন ছেলেদের নিয়ে ব্যান্ড করতে হবে । আমার বন্ধুদের নিয়ে শুরু কোরলাম । একজনকে নিলাম লিড বাজানোর জন্য যার কোন অভিজ্ঞতাই নাই গিটার বাজানোর – ওকে শিখালাম গিটার বাজানো । আরেক বন্ধুকে নিলাম গান গাইতে, ও বাফায় গান শিখতো । ড্রামে নিলাম পেশাদার এক ড্রামারকে । উনি আবার প্রোগ্রামে বাজানোর আগে মদ না খাইলে বাজাতে পারেনা। এই শালারে নিয়া পড়লাম বিপদে – উনি আবার ফকির আলমগিরের সাথেও বাজায় তাই ওনার পার্টটা একটু বেশী ।

উনি কথা কম বলেন, ফকির আলমগিরের শো থেইকা দেরী কইরা আমাগো শোতে আইসা, আমাগো ফাঁসাইয়া দিয়া, ইশারায় শিষ দিয়া উনি আমাদের ইশারা দেন বেবিট্যাক্সি ভাড়াটা দিয়া দিতে । আমি মনে মনে কই, একদিন আমি তোর কলিজা খায়া ফালামু শুধু ব্যান্ডটারে হিট হইতে দে, বেজ ড্রামটা ...য়া দিয়া দিমু শালার । আমারে শালায় টুলু ভাইও ডাকতো না, আপনিও কইতো না আবার তুমিও কইতো না, একটা কেয়ারলেস ভাব আর কি । আমি শুধু ওর দিকে তাকায়া ভাবতাম – তোরে আমি একদিন খামুই, তুই দেহিস কেমনে তোর drum stick কান দিয়া ঢুকাইয়া মগজ নাড়াই । পরবর্তীতে এই হালারেই সব চাইতে বেশী ভালবাসছিলাম । শালাও আমারে ছাড়া কিচ্ছু বুঝতো না । ওর পাড়ার এক অসম্ভব সুইট মাইয়ারে নিয়া যখন ভাইগা গেলো বিয়া করনের লেইগা, তখন আমি সব চাইতে আগাইয়া গিয়া নালায়েকরে হেল্প করসিলাম । খুব ভালো লাগতো হালার পোরে । পরে এতো অনুগত ও হইসিলো যে জীবনের যেকোনো ডিসিশন নেয়ার আগে আমারে জিগাইতো – “টুলু ভাই, এহন কন কি করুম” । ব্যান্ড যখন হিট কইরা গেলো ওর মদ খাওয়াও বন্ধ হইয়া গেলো । খুব সিরিয়াস হইয়া গেলো ও ।

চাইম করাকালীন আমি এলাউড ছিলাম না অন্য কোন সোলো ক্যাসেটে বা কারো এলবামে কাজ করতে, ইভেন সিনেমার রেকর্ডিং এ বাজাতেও এলাউড ছিলাম না, যার কারনে চাইমে থাকাকালিন আমার কোন এলবাম প্রোডাকশন ছিলোনা । অর্থাৎ ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত আমার কোন সোলো প্রডাকশন ছিলোনা । ইভেন আমি ১৯৮৩ তে আজম খানের দ্বিতীয় ক্যাসেট এলবামের মিউজিক ডিরেক্টর ছিলাম কিন্তু সেখানেও আমার নিজের নাম ব্যাবহার করতে পারি নাই, চাইমের নাম দিতে হয়েছে মিউজিক ডিরেক্টর হিসাবে । অর্থাৎ অনেক স্যাক্রিফাইস আমাকে করতে হয়েছে ।

একদিন বিনামেঘে বজ্রপাত হলো, আমি ব্যান্ড ছেড়ে দিলাম । প্লিজ জিজ্ঞাসা করেন না “কেন” । কারন “কেন”র উত্তর দিতে গেলে অনেক বড় গল্প লিখতে হবে, যেটা কমেন্টে সম্ভব না । মনে মনে একেবারে ভেঙ্গে পড়লাম । কেউ আর ডাকেনা রেকর্ডিংএ বাজাতে কারন ব্যান্ড থাকাকালিন সবাইকে বাহাদুরি করে না করে দিয়েছি । ওরা ব্যান্ডের শো করে বেড়ায় আর আমার কষ্টে বুকটা ফেটে যায় । নিজের প্রেমিকা যখন অন্য কারো সাথে ঘুরে বেড়ায় তখন যে অনুভূতিটা হয়, নিজের ব্যান্ড যখন ব্যান্ড লিডারকে বাদ দিয়ে প্রোগ্রাম করে বেড়ায়, তখনও ব্যান্ড লিডারের ঠিক সেই একই অনুভুতি হয় । আমার একটা এস পি টু সাউণ্ড সিস্টেম ছিল, ওইটা নিয়েই বিভিন্ন প্রোগ্রামে সাউণ্ড করি আর মনের ক্ষুধা মিটাই ।

আমিতো নেশা ছেড়ে দিয়েছি কিন্তু নেশাতো আমাকে ছাড়েনা । মন কেন যেন শুধু আকু পাকু করে, উদাস হয়ে যায়, মনে লয় আবার বন্দুকটা হাতে লই । অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলাম না - আবার ইচ্ছা করলো ব্যান্ড করতে, ব্যাস আর যায় কই, আবার শুরু হয়ে গেলো সংগ্রাম । মনের কোনায় কোথা থেকে যেন আবার রঙ্গিন স্বপ্ন এসে ভিড় জমায় । জেগে জেগে স্বপ্ন দেখি, হাজার লোকের ভিড়ে থাকলেও মনের গভীরে চলতে থাকে স্বপ্ন বোনার কারখানা । প্রথম প্রেমকে হারিয়ে ক্ষত শুখাতে না শুখাতেই দ্বিতীয় প্রেমের প্রতি মনটা ঝুকে পড়লো । অতি সমর্পণে, গোপনে, মনের গহীনে তৈরি হয়ে গেলো “আর্ক” । আমার দ্বিতীয় প্রেম । আমার আজন্ম ভালোলাগা । এবার প্রেম কোরলাম একটা ছোট মেয়ের সাথে অর্থাৎ ব্যান্ড মেম্বারগুলো বয়সে ছোট । এইজন্নে আমার মতে প্রথম প্রেম চলে গেলে মন খারাপ না করে, দ্বিতীয়বারের জন্য প্রস্তুতি নেয়া ভালো । খামোখা প্রথম প্রেমের স্মৃতি নিয়া বৈরাগী হওয়ার কোন মানেই হয়না । প্রথম প্রেম হোলো ছবির টাইটেল বা গানের প্রিলিউডের মতো । টাইটেল বা প্রিলিউডে কতোটুকুই বা মজা থাকে, মেইন মজা তো শুরু হয় গান বা ছবির মাঝামাঝি । অ্যাপেটাইজারের সাথেও তুলনা করা যেতে পারে প্রথম প্রেমকে । তবে সাবধান, এসব তুলনা শুধু তখনি you are করতে allowed, যদি প্রথম প্রেম কাকড়াইলে চইলা যায় অর্থাৎ ছ্যাক খাইয়া যান । প্রথম প্রেম যদি বউ হইয়া থাকে, খবরদার আমার এই লেখা ওনারে দেখায়েন না, কারন উনি আপনারে এবং আমারেও, দুজনরেই অনেক মারবে এবং সাথে থাকবে সম্পূর্ণ ঘরোয়া পরিবেশে কান ধরে ওঠাবসার ব্যাবস্থা ।

এবার ব্যান্ড করার সময় আগেই বলে নিলাম যে আমরা সবাই যে যার মতো অন্য প্রফেশনাল(মিউজিকাল) কাজও করতে পারবো, কোন বাধা থাকবে না । সবাই যে যার মতো অন্য মিউজিকের কাজও করি, পাশাপাশি ব্যান্ডও চলছে । করে ফেল্লাম বাংলাদেশের প্রথম মিক্সড এলবাম “স্টারস”,“স্টারস টু”, প্রথম ডুয়েট এলবাম “শুধু তোমার জন্য”, কপিয়ার এক ও দুই, আমাদের ভালবাসা, একই বৃন্তে । আরও বেশ কিছু কাজ করলাম ব্যান্ডের পাশাপাশি । ১৯৯১ এ আর্ক করার পর প্রথম এলবাম “মুক্তিযুদ্ধ” কোরলাম, ১৯৯৬ এ তাজমহল এবং এরপরে আরও কিছু এলবাম আসলো একের পর এক । তবে ইন্টারেস্টিং বিষয় হোলো আমার সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রোডাকশনের কাজের স্প্যান ছিল ১৯৯১ থেকে ১৯৯৭ । অর্থাৎ আমি মোট সাত বছর সময় পেয়েছিলাম আমার যতো মিক্স আর সোলো কাজ করার জন্য ।

এর পরেই চলে আসি ক্যানাডা সব কিছুকে পিছে ফেলে রেখে । যখন ক্যানাডা আসি, আমার নিজস্ব কাজের বাজার ভীষণ ভাবে সরগরম অর্থাৎ আমার হাতে প্রচুর কাজ ছিল । কয়েকটা এলবামের কাজ আসার আগে আমি সম্পূর্ণ করে আসতে পারি নাই, অন্যকে দায়িত্ব দিয়ে আসতে হয়েছিলো । ক্যানাডা এসে আবার আমি পথচারী হয়ে গেলাম, মানে আবার শুরু হোলো আরেক সংগ্রাম, সারভাইভালের সংগ্রাম । কতরকমের মানুষ, কতরকমের অবহেলা, কতরকমের মেনে নেয়া, আরও কতো কি । সংগ্রাম আর শেষ হয় না । শুধু ছোটবেলা মনে পড়ে যখন ছিলোনা কোন সংগ্রামের বালাই ।

কোনদিন সপ্নেও ভাবী নাই যে রেস্ট অফ দা লাইফ ইজ অল আবাউট সংগ্রাম এন্ড সংগ্রাম । এখানে এসে প্রথম একটা প্রোগ্রামে কিবোর্ড বাজানোর সুযোগ পেলাম তবে তার জন্য আমাকে রীতিমতো ইন্টার্ভিউ দিতে হোলো বাঙ্গালী ভাবিদের কাছে কারন ওনারা ছিলেন অনুষ্ঠানের হর্তাকর্তা ও মুল গায়িকা । সা থেকে নী পর্যন্ত, একটা নোটও ওনাদের সুরে লাগে না, কোয়াটার নোট নিচে থাকে । মেলোডাইন বা অটোটিউন এই কারনেই ঐ সময় তৈরি হয় নাই, কারন মেলোডাইন বা অটোটিউন ওনাদের গলায় লাগাইলে, সফটঅয়্যার নিজেই জইলা যাইতো, কোম্পানিকে সব সফটঅয়্যার রিকল করতে হইতো । তারমইদ্ধে ওনারা আবার ব্যান্ডের গান শোনেন নাই সুতরাং আমারে তো চিনার প্রশ্নই ওঠেনা । আমি রোল্যাণ্ডের ডি ফিফটি নিয়া গেসিলাম, ওনারা দেইখা বল্লেনঃ নাহ, এই কিবোর্ড টা ভালো না, আপনি স্পিকার ওয়ালা কিবোর্ড নিয়া আসবেন ।

আমি চিন্তায় পইড়া গেলাম, কই পাই সেই দুই পাশে দুই স্পিকার ওয়ালা কিবোর্ড । খ্যাপতো ছুইটা যাওয়ার অবস্থা । বহু কষ্টে ওনাদের শেষ পর্যন্ত রাজী করাইতে পারসিলাম ডি ফিফটির ব্যাপারে ।

এতো কথা বলার একটাই কারন । যদি চাইম সে সময় ভেঙ্গে না যেতো তাহলে পরবর্তীতে মিক্স ক্যাসেট, ডুয়েট ক্যাসেট, কপিয়ার, নিলয়ের এলবাম বিবাগি রাতে, ব্যান্ড আর্ক, মুক্তিযুদ্ধ, তাজমহল, জন্মভুমি, স্বাধীনতা আরও অনেক কিছুরই হয়তো জন্ম হতোনা । আমি হয়তোবা হতে পারতাম না আপনাদের ভাললাগার বা ভালবাসার পাত্র । তাই এখন বুঝি – “আল্লাহ্‌ যা করেন ভালোর জন্য করেন, যখন তিনি করেন তখন হয়তো বোঝা যায় না, তবে পরে এর সুফলটা পরিষ্কার পাওয়া যায় ।“ - ২৭ মে ২০১৭।

আশিকুজ্জামান টুলু: ব্যান্ড সঙ্গীতের পুরোধা ব্যাক্তিত্ব।

ঢাকাটাইমস/২৮মে/এমইউ

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিনোদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :