রসনা

ঢাকাইয়া ঈদে খানাপিনা

আনিস আহামেদ
 | প্রকাশিত : ২৫ জুন ২০১৭, ০৯:৪৪

বঙ্গ জনপদে ঢাকা সবচেয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত শহর। একাধারে ৪০০ বছরের নগরীর ইতিহাস এ এলাকায় আরেকটি নেই। ঢাকায় মোগলরা আসার আগে আফগান তথা পাঠানরা এসেছিল। পাঠানদের সঙ্গে অনেক তুর্কিও ছিল। মোগলদের সঙ্গে এসেছিল পশ্চিম ভারতীয় এলাকার তথা দিল্লি-আগ্রার জনগণ। সঙ্গে ছিল ফার্সিভাষী পারস্য এলাকার মানুষ। মোগলদের শেষ যুগ ও ইংরেজ আমলে ঢাকায় এসেছে গ্রিক, পর্তুগিজ, দিনেমার, ফরাসি ও ইংরেজরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা ও আফ্রিকান নিগ্রো সেনাসদস্যরা ঢাকা এসেছিল। ভারতের পূর্বাঞ্চলের গোর্খা রেজিমেন্টও অনেক দিন ঢাকায় ছিল। ঢাকায় যেসব ইসলামি সুফি-সাধক এসেছেন তারা এবং তাদের অনেক সঙ্গী-সাথি ছিল বোগদাদ, বসরা, ইয়েমেন ও তুরানের [(উজবেকস্তান, কাজাখস্তান (বোখরা)] ও আরব্য অঞ্চলের অধিবাসী। পাকিস্তান হওয়ার পর এখানকার অধিবাসীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেÑ বিহার, কানপুর, নাগপুর, হায়দরাবাদ, বারেলি, ইস্পাহানী, মারাঠা ও মাদ্রাজি জনগোষ্ঠী। পশ্চিম বাংলার মুসলমানরাও এখানে আবাসন গড়েছে। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী আর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার অধিবাসীদের বাস ঢাকায়। এ ছাড়া ব্রিটিশ আমলে অনেক পেশাজীবী চীনারা ঢাকায় বংশপরম্পরায় বসবাস করেছে। তা ছাড়া পাকিস্তান আমলে পাঞ্জাব, সিন্ধুদের কিছু অধিবাসী ঢাকায় বসবাস করেছে। পেশা, ব্যবসা, যোদ্ধা, রাজকর্মচারী, রিফিউজি, ভবঘুরে। সময়ের প্রয়োজনে একদল এসেছে, একদল চলে গেছে আবার অনেকে থেকে গেছে। সমাজ সভ্যতার স্তরে স্তরে আন্তসামাজিক সম্বন্ধ গড়ে উঠেছে। মূলত ঢাকা শহর শত শত বছরের অনেক বর্ণের, ভাষার, সংস্কৃতিকে যুগে যুগে আতস্থ করে একটি নিজস্ব মহিমা সৃষ্টি করেছে। ফলে ঢাকাইয়াদের জনজীবনে ভোজনবিলাসিতায় আশরাফ-আতরাফদের সংমিশ্রণ হয়েছে। আবার ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ, উপাদান ও স্বাদমিশ্রিত তালিকা প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হচ্ছে। ঢাকার মুসলমানদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতর নিয়ে রয়েছে ঢাকাইয়াদের বাহারি খাবারের আয়োজন। এর আগে এক মাস ধরে চলে ভোজনরসিক ঢাকাইয়াদের ইফতারি পর্ব।

পোলাও পিটার-এর মতানুসারে সংমিশ্রিত কাবাব ও পোলাও পৃথিবীর প্রতিটি জায়গার মুসলমানদের স্বাদরুচির অংশ। পোলাও দুভাবে রান্না করা হয়। পাশানো পোলাও রান্না করা সহজসাধ্য ছিল যেহেতু প্রথমে চালকে গলানো হতো। যখন একটু কন্বি বা অর্ধেক কন্বি থেকে যেত তখন প্রয়োজনীয় উপকরণ ঢেলে দম দেওয়া হতো। এ পদ্ধতি সমগ্র হিন্দুস্তানে কমবেশি প্রচলিত আছে। দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো যাতে নৈপুণ্যতার দরকার পড়ে, যাকে এখানে লাপেটা বলা হয়। অর্থাৎ পোলাও আপন স্বকীয়তার প্রকৃতিতে পোলাও হয়ে যায়। ঢাকাইয়ারা পাশানো খানা পছন্দ করত না। যা হোক, ঢাকার বিশেষ পোলাও হলো খাস্বা যার মধ্যে মোরগ দেওয়া হয় ও সম্পূর্ণ মোরগ রাখা হয়। তার বিবরণ হলো এই যে গোস্ত আর চাল এলোমেলো মেশানো হতো, গোস্ত খাশতা হতো, চাল আর গোস্ত একসঙ্গে মেলানো সত্ত্বেও আলাদা আলাদা দেখা যেত, চালে তৈলাক্ততা এমনভাবে প্রবিষ্ট হতো যে চাল থেকে তৈলাক্ত রস বের হতো না বরং প্রতিটা চালের পেট পরিপূর্ণ থাকত। এ রকম মোরগ পোলাও ঢাকা ছাড়া আর কোথাও রান্না করা হতো না এবং ঢাকাইয়ারা ছাড়া অন্য কেউ এটা রান্না করত না। অন্য শহরে যাকে মোরগ পোলাও বলা হয়ে থাকে, তার সঙ্গে এর তুলনা হয় না।

খাস্বা যাকে এখন মোরগ পোলাও বলা হয়ে থাকে, তা এখানকার বিশিষ্ট জিনিস কিন্তু এটা ছাড়াও ঢাকাইয়ারা নিজের ঘরে এবং ছোট আর মাঝারি দাওয়াতের সাধারণত বুন্দিয়া পোলাও, মাহি পোলাও ও বায়দা পোলাও। বুন্দিয়া পোলওতে এ নতুনত্ব পাওয়া যায় যে ছিমির দানার মতো গোসের কোফতা কিছু নোনতা আর কিছু টকমিষ্টি তা দম দেওয়ার সময় ঢালা হয় যাতে প্রতিটা লোকমায় কিছু কোফতা এসে পড়ে। কিন্তু অধিকাংশই নোনতা হয়ে থাকে; আর এখন তার মধ্যে সবুজ ছিমির সম্পূর্ণ দানা ঢালা হয়, যা দেখতে ভালো দেখায় তা যোগ করা হলো। এ পোলায়ের বর্ণনা এই যে কোফতা যেন শক্ত না হয় বরং খাশতাও নরম হয়। মাহি পোলাও সাধারণত রুই ও ইলিশ মাছ দিয়ে রান্না করা হয়। রুই মাছের পোলাও অনেক সুস্বাদু হয়ে থাকে আর এটি রান্না করার সময় অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। ইলিশ পোলাও রান্না করতে বিশেষ নৈপুণ্যতার প্রয়োজন হয়। দম ইলিশ পোলাও ও নারকেল দুধের ইলিশ পোলাও দুভাবে রান্না করা হয়।

তেহারি ঢাকাইয়ারা তেহারি খুবই পছন্দ করেন। তেহারি প্রাচীন পোলাও, কেননা মসলা মিশ্রিত গোস ও চাল একসঙ্গে দম দেওয়া হয়। এভাবে বায়দা পোলাও যাকে প্রথমে খাসি পোলাও কিংবা সাদা পোলাও বলা হতো, তা ঘরোয়া জিনিস কিন্তু বেশি রান্না করা হয়। এখানে সেই পোলাও, যাকে হোগলা পোলাও কিংবা সাদা পোলাও বলা হয়, আর যা প্রত্যেক ছোট-বড় দাওয়াতের আবশ্যকীয় উপাদান বা পদ, এটা শুধু কাঁচা মসলার সাদা এয়াখনী দিয়ে রান্না হয় আর কোথাও কোথাও কিছু গোস্ত এয়াখনীতে ঢালা হয়।

খিচুড়ি ঈদের দিন অনেক বাসায় খিচুড়ি রান্না করা হয়। ঢাকাইয়া ঢলঢলে খিচুড়ি পছন্দ করে। ঢাকাইয়ারা বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি বড়ই শখ করে খায়। ভুনা মুগের খিচুড়ি যেভাবে সব জায়গায় রান্না হয় এখানেও সেভাবে রান্না হয়। কিন্তু এখানে সিদ্ধ ডিম যা ঘি দিয়ে ভাজা হয়, খিচুড়িতে অবশ্যই তা ঢালা হয় এবং সাধারণত খিচুড়ির সঙ্গে মোরগ বা খাসির দোপেঁয়াজাও ব্যবহার করা হয় কিন্তু কোনো পরিবারে ভুনা মুগের খিচুড়িতে কিমাও ঢালা হয়। হ্যাঁ, খিচুড়িতে পনির দেওয়া, যা ঢাকাইয়াদেরই উদ্ভাবন। কিন্তু বুটের ও মসুরের ডালের খিচুড়ি পোলাওয়ের মতো দম করে রান্না হয়, আর কাঁচা ঘি ও রসুন ও মরিচের চাটনি ও আমের আচারের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়। খোসাসহ মাসডালের খিচুড়ি রান্না হয়।

কাবাব ঢাকার বিখ্যাত কাবাব হলো পারসান্দে শিককাবাব, যা ১০-১৫ সের গোসের এক এক শিক তো সাধারণ ব্যাপার, এমনকি তার চেয়েও বেশি ভারী বা ওজনের রান্না হয়। এ কাবাবের বিবিরণ এই যে, গোস্তের কোমলতা কিন্তু খাশতা ও খুশকির মতো এত নরম ও ভিজা হওয়া উচিত নয়, যা ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে যেন গুঁড়া গুঁড়া না হয়ে যায় এবং সম্পূর্ণ চাক যাতে না বের করা যায়। এতে গোস্ত ছাড়া বেসনজাতীয় কোনো জিনিস কখনও মেশানো হতো না। শিকের ভারী কাবাব কিমার সঙ্গে সুতা লেপটিয়ে পেঁচিয়ে বানানো হয়। এসব কাবাব বিশেষ কাবাব বানানেওয়ালারা বানিয়ে থাকেন যদিও তৈরি হয়। আর বকরি ঈদের সময় তো গরিব ঘরে পর্যন্ত শিক বানানো হয়। মোসাল্লাম বা সম্পূর্ণ মোরগ কাবাব এখানে সাধারণত দু’রকমের তৈরি হয়। আর দ্বিতীয় কাবাব যাকে মাসমান বলা হয় এবং তাকে হান্ডি কাবাবও বলা হয়ে থাকে। উভয়ই স্বীয় অবস্থানে উৎকৃষ্টতম কাবাব ও ঢাকার সঙ্গে সম্পৃক্ত। মোরগা মোসাল্লাম অন্য জায়গায়ও রান্না হয় কিন্তু যত সুন্দরভাবে ও যত মজাদার এখানে রান্না হয় আর কোথাও এ রকম প্রাচুর্যসহকারে রান্না হয় না। বঁটিকাবাব, শিককাবাবের মতো আরও রয়েছে নার্গিসী কাবাব।

কোফতা ঢাকায় যেভাবে কোফতা তৈরি হয় তা অন্য কোথাও খুব কম দেখা গেছে। কাঁচা গোসের কোফতা, সিদি গোসের কোফতা এবং কাঁচা ও সিদি গোসের মিশ্রিত কোফতা, খাশতা কোফতা, কোফতার কালিয়া ও কোফতার কোরমা তার মধ্যে বুনিয়া অর্থাৎ মটর সমান থেকে দুই সের পর্যন্ত কোফতা তৈরি হয়। বেরেজি কোফতা যার মধ্যে পনির আর ফলফলারি ভরা হয়। গোস্ত ছাড়া মাছের কোফতাও অনেক সুস্বাদু হয়ে থাকে।

কোরমা ‘কোরমা’ তুর্কি আভিধানিক শব্দ। প্রকাশ থাকে যে মুসলমানদের সঙ্গে এর আগমন। তুর্করা আজ পর্যন্ত লালমরিচ ব্যবহার করেন না। আমাদের এখানে কোরমার বিশেষ মসলা আছে যেখানে লালমরিচ অন্তর্ভুক্ত নয়। কোরমাতে এখানে যে নতুনত্ব করা হয়েছে তাতে সবুজ মরিচের বীজ ফেলে দিয়ে ও তা আবার দুধ মিশিয়ে ঢালা হয়। এ কোরমাকে রেজালাহ বলা হয়। তাতে মালাইয়ের যথোপযুক্ত পরিমাণ বিশেষ পদ্ধতিতে ঢালা এবং দমে রান্না হয়।

রেজালাহ মূলত মোরগ দিয়েই তৈরি করা হতো। এখন লোকেরা খাসির মাংস দিয়েও রান্না করতে আরম্ভ করেছে। প্রত্যেক কোরমা বাসি হয়ে বেশি মজাদার হয়ে যায়। মালাইয়ের কোরমা সেই কোরমা যেখানে গোসের রং টকটকে গোলাপের মতো বরং হাড্ডির রংও গোলাপের মতো হয় এবং ঝোল সাদা দুধের মতো হয়, যা বিশেষ ধরনের কোরমা।

কালিয়া কালিয়া শব্দটি আরবি, যার অর্থ ভাজা। আগে কালিয়া সচরাচর সরিষার তেল দিয়ে রান্না করা হতো। এখন ঘি দিয়ে রান্না করা হয়। কালিয়ার মধ্যে কিছু কালিয়া শুধু ঘি দিয়ে রান্না করা হয়। হোসেনি কালিয়া (সাসলিক) যার আকৃতি এরূপÑ মাংসের ছোট ছোট টুকরাগুলো এক বিল্লাস মাপের বাঁশের শিকের ওপর এ নিয়মে গাঁথা হয় যে এক বঁটি গোস আবার একটি পিঁয়াজ আবার এক টুকরা আদা আবার এক বঁটি গোস এ অনুক্রমে এবং এভাবে কয়েকটি শিক তৈরি করে, যা দোপেঁয়াজার মসলার সঙ্গে কড়াইতে রান্না করা হয়।

বাখরখানি বাখরখানি মোগল আমলের খাবার। আগা মুহম্মদ বাকেরের নামে তৈরি বাখরখানি ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রুটি। এ রুটি পরতযুক্ত। বাখরখানি দু’প্রকার- গোলা ও গাওজোবান বাখরখানি। গাও-জোবান ফারসি শব্দ। গাও অর্থ গরু আর জোবান অর্থ জিহ্বা। গরুর জিহ্বা আকৃতির বাখরখানিই গাওজোবান বাখারখানি। বাখরখানি ছিল সকালবেলার নাশতা। লোকে ভোরে বাড়ি থেকে খাঁটি ঘি, ময়দা ও পনির নিয়ে বাখরখানি তৈরির দোকানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে চাহিদা মোতাবেক তৈরি করে নিয়ে আসত। এ বাখরখানি কোরমা, গরুর শিককাবাব তেক্কা বা মিষ্টি দিয়ে খাওয়া হয়।

ঢাকাই পনির ঢাকাই পনির কিন্তু ঢাকায় তৈরি হয় না, তৈরি হয় কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে, তবে এর বাজার হলো ঢাকা। তাই এ পনির ঢাকাই পনির বলে পরিচিতি। এ পনির খাঁটি কাঁচা গরুর দুধে, গরুর পাকস্থলীর একটি বিশেষ অংশ দিয়ে জমানো হয়।

তেক্কা তেক্কা খাসি বা গরুর রানের বড় বড় চাকা কাঁটা চামচ দিয়ে কেটে নিয়ে সব ধরনের মসলা মিশিয়ে তন্দুরে বেক করা হতো এবং সøাইস করে তা পরিবেশন করা হতো।

নেহারি ও পায়চা নেহারি ফারসি শব্দ, অর্থ সকাল। খাসির পায়চা বা পা কিছু মাংসসহ একটি হাঁড়ির আটা দিয়ে মুখ বন্ধ করে কাঠের চুলোয় টিমে আঁচে সারা রাত বসিয়ে রাখা হয়। গরুর পা দিয়ে তৈরি হয় পায়চা। সকালে এ নেহারি ও পায়চা তন্দুর বা রুমালি রুটি দিয়ে খাওয়া হতো।

মোরগ বিরিয়ানি ঢাকার উচ্চ ও অভিজাত শ্রেণির দাওয়াতি মেহমানদের জন্য মোরগ বিরিয়ানি প্রচলিত রয়েছে। এক সের পেশোয়ারি চালে ৪টি মোরগের ১৬ টুকরার হালকা কোরমা মিশিয়ে মোরগ বিরিয়ানি রান্না করা হতো। এ মোরগ বিরিয়ানিতে কিশমিশ, আলুবোখারা, খাঁটি দুধের মালাই, পেস্তা-বাদাম, খাঁটি গরুর ঘি, জাফরান ইত্যাদি দিয়ে স্বাদ বৃদ্ধি করা হয়।

গ্লাসি ঢাকার এক সের খাসির মাংসের ৮টি টুকরার সঙ্গে বড় আস্ত পেঁয়াজ মিশিয়ে বিশেষ কোরমার মতো করে গ্লাসি রান্না করা হয়। এ গ্লাসি পোলাওয়ের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়।

মুতানজান হালকা মিষ্টি জরদার সঙ্গে কোরমা মিশিয়ে মুতানজান তৈরি করা হয়।

বোরহানি খাঁটি ঘোলে জিরা ভাজা, শুকনো মরিচের গুঁড়া, গোলমরিচ, বিট লবণ, সরষে বাটা এবং পুদিনা পাতা দিয়ে বোরহানি বানানো হয়। এ বোরহানি গ্লাসে করে পোলাওয়ের সঙ্গে পরিবেশন করা হয় খাবার মুখরোচক ও পরিপাক হওয়ার জন্য।

মিষ্টি খাদ্য মিষ্টি খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে চালের জর্দা ও ফিরনির (ঢাকাই ভাষায় সেরেবেরন) প্রচলন আছে। মাকুতি নামক এক ধরনের মিষ্টি অভিজাত পরিবারের মধ্যে প্রচলিত ছিল। খুব ভালো, নেশাস্তা চিনি ও জাফরান দিয়ে এ মিষ্টি তৈরি হতো। ঢাকার খাবারের মধ্যে বিশেষ এক ধরনের ক্ষীরের নাম করা যায়। বাখরখানি রুটি টুকরো করে ঘন দুধের মধ্যে চিনি এবং গোলাপজল মিশিয়ে এই ক্ষীর রান্না করা হয়।

চাপড়ি পিঠা আধা সের আতপ চালের সঙ্গে এক পোয়া মসুরির ডাল মিশিয়ে রাতে ভিজিয়ে রাখা হয়। পরদিন সকালে ভিজানো চাল ডাল শিলপাটায় একটু মোটা করে পিষে নিয়ে পেঁজায়, কাঁচা আদা, ধনেপাতা ইত্যাদি মিশিয়ে লোহার শুকনো তাওয়ায় পাতলা করে লেপে দিয়ে মচমচে করে ভাজলেই চাপড়ি হয়ে যায়। এর সঙ্গে কচুশাক দিয়ে পরিবেশন করা হয়। ২০ রমজানে ঢাকাইয়ারা বিশেষ করে এটা খেয়ে থাকে। প্রচলিত ধারণা, ২০ রমজানে মা ফাতিমার ঘরে অন্য খাবার ছিল না, তাই এটা রান্না করেছিলেন।

কিমা গরু, খাসি ও মুরগির সলিড মাংস দিয়ে কিমা তৈরি করা হয়। কসাইরা যেভাবে মাংস মিহি করে কেটে থাকে। পানিতে ধোয়ার পর মাংসের স্বাদ অবশিষ্ট থাকে না। ব্লেন্ডারের কিমাও একই অবস্থা। ঘরকন্নারা ছোট করে মাংস খ- করে পাটায় ছেঁচে মসলা মাখিয়ে কিমা রান্না করলে অনেক সুস্বাদু হয়ে থাকে।

চাপ গরু ও খাসির মাংসের চাপ হয়। গরুর চাপ দুই রকম। ১. রানের খ- মাংস পাটায় ছেঁচে মসলা দিয়ে মাখিয়ে রাখা হয়। এরপর রেজালার মতো রান্না করা হয়। ২. সিনার বঁটি মসলা ও টক দই দিয়ে মাখিয়ে ঘি অথবা তেলে তাওয়ায় ভাজা হয়। খাসির চাপ শুধু সিনার বঁটি দিয়ে তাওয়ায় ভেজে পরিবেশন করা হয়।

রোস্ট আস্ত মোরগ চার পিস করে ঝাল রোস্ট অথবা কাঁচামরিচের ঝাল দিয়ে পরিবেশন করা হয় সাদা রোস্ট।

কাচ্চি কাচ্চি তৈরিতে বিশেষ মুন্সিয়ানার প্রয়োজন হয়। পরিমাণমতো তেল/ঘি, পোলাও বা বাসমতি চাল, মাখানো খাসি, গরু অথবা মুরগির মাংস পরতে পরতে সাজিয়ে ডেকচির মুখ ময়দা দিয়ে বন্ধ করে নির্ধারিত আঁচের পর নামাতে হয়। আগুনের আঁচ কম হয়ে রান্না কাঁচা ও বিস্বাদ হয়ে যায়। আঁচ বেশি হলে রান্না পুড়ে যায়।

সেমাই ও জর্দা ঢাকাইয়ারা নানা পদের সেমাই ও জর্দা রান্না করে থাকে। ঈদের দিন সকালে প্রথম পরিবেশনই থাকে জর্দা ও সেমাই। পাশানো সেমাই ও জর্দা, সিদ্ধ সেমাইয়ে দুধ চিনি ঢেলে দেওয়া সেমাই, হাত মেশিনের সেমাই, চুটকি সেমাই, লাচ্ছা সেমাইসহ ভিন্ন ভিন্ন পদের সেমাই জর্দা পরিবেশন হয়। দুধ, জাফরান, পেস্তা, বাদাম, খোরমা টুকরায় হালকা সেমাই দিয়ে রান্না করা হয় ঢলঢলে সির। খোরমা চাঁদরাতে বিচি বের করে দুধে ভিজিয়ে রাখা হয়। এটা ঈদ প্রভাতের প্রথম মুখে দেওয়া হয়।

ঈদের দিন মিষ্টি ও পোলাও মাংসের আধিক্য থাকার কারণে এক ধরনের অরুচি তৈরি হয়। এ অরুচি এড়াতে তৈরি করা হয় কিছু নোনতা ও হজমবর্ধক রান্না।

দই বড়া : মাষকলাই ডাল বেটে তেলে ভেজে বড়া তৈরি করে টক দইয়ে ভিজিয়ে রাখা হয়। নানা মসলা দিয়ে পরিবেশন করা হয়।

দই বুন্দিয়া : টক দইয়ে মসলার মিশ্রণ করে রাখা হয়। এর মধ্যে ঢালা হয় বেসনে তেলে ভাজা বুন্দি। দই ফুলকি : মসুর বা মটরের ডাল পেঁয়াজকুচি দিয়ে পিসে, তেলে ভেজে ফুলকি তৈরি করে টক দই ও মিশ্রণ মসলায় ভিজিয়ে পরিবেশন করা হয়। অধুনা নুডলস্, চটপটি, ফুচকাও পরিবেশিত হয়।

আনিস আহামেদ : ঢাকাইয়া গবেষক, সাংবাদিক ও কবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :