জামালপুরে পুলিশের ওপর হামলায় পুরুষ শূন্য চারিয়া

জামালপুর প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৫:০৯

জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার দুরমুঠ ইউনিয়নের চারিয়া পাড়া গ্রামে পুলিশের ওপর হামলার মামলায় পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে পুরো গ্রাম। গ্রেপ্তার ভয়ে বাড়ি ছাড়ছেন নারীও। পুলিশি আতঙ্কে মসজিদের ঈমাম ও শারদীয় দূর্গাপূজার প্রতিমা তৈরির কারিগররাও গ্রাম ছেড়ে যাওয়ায় ভুতুরে পরিবেশ বিরাজ করছে গ্রামটিতে।

এই সুযোগে দুষ্কৃতিকারী এক রাতেই চুরি করে নিয়ে গেছে কয়েকটি বাড়ির মালামাল।

৩ সেপ্টেম্বর একই ইউনিয়নের কলাবাঁধা গ্রামের মৃণাল তার স্ত্রী মিনার বেগমের বস্তাবন্দি লাশ বাড়ির অদূরে একটি পুকুর থেকে উদ্ধার করে। এই হত্যার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে শ্বশুর বাড়ির লোকজন লাশ উদ্ধারের আগের দিন থেকে মৃণালকে বাড়িতে আটক করে রাখে। লাশ উদ্ধারের খবরে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে গ্রামবাসী।

লাশ উদ্ধারের পর মেলান্দহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাদা পোশাকে এক কনস্টেবল ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে নিয়ে মৃণালকে আটক করতে যান। এসময় বিক্ষুদ্ধ জনতা ওসি ও ইউপি চেয়ারম্যানের ওপর চওড়া হয়ে মারধর করে।

এই ঘটনায় মেলান্দহ থানার এসআই নীল কমল বাদী হয়ে ২৭ জনের নামসহ অজ্ঞাত পরিচয়ের শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা মামলা করেন।

মামলার পর পুলিশি গ্রেপ্তারের ভয়ে পুরো গ্রাম পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে। নারীরাও বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে। গ্রামের সিংহভাগ বাড়ির ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে। গোয়াল ঘরও খালি। গৃহপালিত গরু-বাছুরসহ পরিবার-পরিজন নিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে চারিয়ার গ্রামের বাসিন্দারা। এলাকার দোকানপাট, হোটেলসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ।

মসজিদের ঈমামও গ্রাম ছেড়েছে। ভেস্তে যেতে বসেছে শারদীয় দুর্গোৎসবের আয়োজন। ভয় আর আতঙ্কে পূজারীরা বাড়ি ছাড়ায় প্রতিমা তৈরির কাজ ফেলে চলে গেছেন কারিগররা।

হিন্দু গ্রামজুড়ে বিরাজ করছে উৎকন্ঠা। এই সুযোগে গ্রামের তোতা মিয়া মেম্বারের নেতৃত্বে একটি টাউট চক্র গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে মহিলাদেরও করছে বাড়ি ছাড়া। বাড়িঘরে কেউ না থাকায় সোমবার রাতে কয়েকটি বাড়িতে চুরির ঘটনা ঘটেছে।

মঙ্গলবার সরেজমিনে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে।

চারিয়া গ্রামের ৫৫ বছর বয়সী বৃদ্ধা রোকেয়া বেগম বলেন, আমার পুলা (ছেলে) ঢাকায় কাজ করে। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে আইছে। কোথায় গেছে জানি না বাবা। আমি নিজেও রাইতে বাড়িতে থাকবার পাইতাছি না। সবাই বলাবলি করতাছে, মহিলা পুলিশ আইসা ধইরা নিয়া যাব।

একই গ্রামে পাতানি বেগমের (৫০) স্বামী বাচ্চু শেখ এবং দুই ছেলে আব্দসু ছাত্তার ও জাকিরুল ইসলামকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।

তোতা মেম্বার গ্রামের লোকজন জানায়, ট্রাক ভইরা মহিলা পুলিশ আইতাছে। মহিলাগরেও ধইরা নিয়া যাবো। এই খবর শুইনা কি আত্মায় পানি থাকে। আমিও রাইতে বাড়িত ছিলাম না। হেই সুযোগে ঘরের টিন খুইলা চুরেরা আমার সবকিছু নিয়া গেছে বলে অঝরে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

চারিয়া গ্রামে মসজিদ পার হয়ে মেঠো পথে হাটতেই দেখি, এই গ্রামের তোরা অন্যায় করছস আবার কথা কইতাছস নিরিহ দুই পথচারীর হাত ধরে মেম্বার তোতার ভাই জাহাঙ্গীর আলম চাঁন থানায় ফোন দিচ্ছে। আমরা সাংবাদিকরা সেই দৃশ্য দেখে গ্রামের মানুষকে ভয় দেখাচ্ছেন কেন বলতেই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলছেন আপনারা কে? কথা বলছেন কেন, বলেই ক্ষিপ্ত হয়ে তেড়ে আসে। মুহূর্তেই মেলান্দহ থানার এসআই সোলায়মান এসে হাজির। পুলিশ দেখেই ওই দুই যুবক চাঁনের হাত ছুটে দৌড়ে পালিয়ে যায়। এসআই সোলায়মান এসেও ভয়ভীতি দেখাতে শুরু গ্রামের নারীদের। পাশেই মেম্বার তোতা দাঁড়িয়ে ছিলেন। সাংবাদিকরা যেন সঠিক সংবাদ সংগ্রহ করতে না পারে- সে জন্য চক্রটি শুরু করে নানা তৎপরতা। পাশেই গলিপথ দিয়ে এগিয়ে যেতেই দেখা যায়, বাড়িঘর জনশূন্য। ঘরে ঘরে ঝুলছে তালা। গোয়াল ঘরে গুরু বাছুর নেই। গরু বাছুর পরিবার পরিজন নিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। এই বাড়ির দুই ছেলে বাহার আলী ও ছাবেদ আলীকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। পাশের বাড়িতে ভাঙা ঘর থেকে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ময়না বেগম বলেন, আমার নাতি ছেড়াডা নির্দোশ। ঘটনার সময় রিপন (১৭) হোটেলে কাজ করতাছিল। রাইতে পুলিশ দরজা ভাইঙ্গা ঘুম থাইকা টাইনা তুইলা মারতে মারতে নিয়া গেছে। আমিও হোটেলে থালি বাসন ধোয়ার কাজ করি। আমার ট্যাহা পয়সা নাই। কিবাই কি করমো বলে কাঁদতে থাকেন।

গ্রামবাসীরা বলেন, একদিকে পুলিশের ভয়- অন্যদিকে চোরের উৎপাতে কয়েকদিন ধরে ভয়াঙ্কর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এলাকায়। পুলিশের ভয় কাটিয়ে যেসব নারী বাড়িতে বাস করছে তারা। সন্ধ্যা হলেই আলো নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে থাকছে সম্ভ্রম হারানোর শংকায়। তারা বলেন, সবাইতো দোষ করে নাই। নিরীহ মানুষকে মারধর করে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ায় সকল পুরুষ মানুষ বাড়ি ছেড়েছে। কেউ কেউ দিনের বেলায় বাড়িতে খোঁজখবর নিতে আসলেই পুলিশ গ্রামের ঢোকার খবর পেয়েই দৌড়ে পালিয়ে যায়। অজ্ঞাত দেড়শ গ্রামবাসীকে আসামি করে মামলা হওয়ায় চারিয়া গ্রামে গ্রেপ্তার আতংকে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে গ্রামবাসীদের মাঝে।

মেলান্দহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাজহারুল করিম ঢাকাটাইমসকে বলেন, নির্দোষ কাউকে গ্রেপ্তার ও নারীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ আমি দেইনি। তবে দু-একজন মহিলা ঘটনার সাথে জড়িত হতে আমি দেখেছি। কোন টাউট বাটপার আমাদের নাম ভাঙ্গিয়ে যদি ফয়দা লুটার চেষ্টা করে, তাকে ছাড় দেয়া হবে না।

পুরুষ শুন্য গ্রামটিতে, ভয়ে নারীরা বাড়ি ছাড়ছে, চুরি যাচ্ছে বাড়ির মালামাল এ বিয়য়ে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা? এমন প্রশ্নে জবাবে ওসি বলেন, আমি কি বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলব- আপনাদের গ্রেফতার করা হবে না? তবে বাড়িঘরে যাতে চুরি না যায় সে বিষয়টি দেখবেন বলে জানান তিনি।

(ঢাকাটাইমস/৬আগস্ট/প্রতিনিধি/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :