রোহিঙ্গাদের ভয়ের দিন কবে ফুরাবে

মোহাম্মদ জমির
 | প্রকাশিত : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৭:১১

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী নতুন করে রোহিঙ্গা নিধনে নেমেছে। এই জনগোষ্ঠীর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পুরুষদের হত্যা করা হচ্ছে। নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে। নিপীড়ন থেকে বাদ পড়ছে না ছেলেবুড়ো কেউই। তাই নিজভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বাংলাদেশমুখী হচ্ছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। তবে সবাই যে আসতে পারছে তা নয়। কারণ কেউ কেউ নৌ-দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে। তাই তো পানিতে, তীরে ভেসে উঠছে নিষ্পাপ শিশুর লাশ। যা দেখে বিবেকবান কেউ চোখের জল আটকে রাখতে পারছেন না।

সবকিছু মিলিয়ে রাখাইন রাজ্যে নৈরাজ্য কায়েম করেছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। তাদের আবার সমর্থন দিচ্ছে সেখানকার সরকার-প্রশাসন আর ধর্মীয় দিক দিয়ে সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতারা। তারা সবাই মিলে যেন একটি জাতির, একটি জনগোষ্ঠীর নাম-নিশানা পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার আগ্রাসনে নেমেছে। তাদের আক্রমণে হাজারো রোহিঙ্গা মারা পড়েছে। অসহায় মানুষ যাতে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছোটাছুটি করতে না পারে, এবার তার জন্যও পেতে রেখেছে মৃত্যুফাঁদ। তাই বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে বর্মীদের পোঁতা ভূমি-মাইনের খবর আমরা পাচ্ছি। যাতে বেশকিছু প্রাণহানিও ঘটেছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় এ ধরনের মাইন বাংলাদেশের জন্যও বিপজ্জনক। তাই এর বিরুদ্ধে আমাদের সংশ্লিষ্ট প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে আকাশসীমা লঙ্ঘন করে মিয়ানমারের বিমান, ড্রোন বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকেছে। এ ধরনের ঘটনায় অবশ্য জোরালো প্রতিবাদ করেছে ঢাকা।

চলতি সহিংসতার সূত্রপাত গত ২৫ আগস্ট। সেদিন রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) রাখাইনে ৩০টি তল্লাশি চৌকিতে অতর্কিত হামলা চালায়। তারা একটি সেনাক্যাম্পেও হামলা করে বলে দাবি করেছে মিয়ানমারের প্রশাসন। যা হোক সেই হামলায় ১২ জন পুলিশ নিহত হয়। এর পরই সহিংস অভিযানে নামে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। সেনাবাহিনীর নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে ইতিমধ্যে চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। রোহিঙ্গারা বাদেও ওই এলাকার আরও প্রায় ৩০ হাজার মানুষ মিয়ানমারের অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা অভিযোগ করছে রাখাইনে নির্বিচারে নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। অবশ্য মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একপাক্ষিক অস্ত্রবিরতি ঘোষণা করেছে রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। সংগঠনটি ১০ সেপ্টেম্বর থেকে মাসব্যাপী অস্ত্রবিরতি মেনে চলছে। মিয়ানমারের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানে সৃষ্ট মানবিক সংকট উত্তরণে ত্রাণ সংস্থাগুলোকে কাজ করার সুযোগ করে দিতে অস্ত্রবিরতিতে যাচ্ছে আরসা। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রতিও অস্ত্রবিরতির আহ্বান জানিয়েছে তারা। অস্ত্রবিরতির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘অস্ত্রবিরতি চলাকালে মানবিক সংকটে থাকা ধর্ম ও জাতিগত পরিচয় নির্বিশেষে সবার জন্য মানবিক ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম চালাতে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে আরসা।’ তবে আরসার এই একপাক্ষিক অস্ত্রবিরতির ঘোষণা সেভাবে কার্যকর নয়। বিশেষত বিদ্রোহী সংগঠনটি সেনা দমন অভিযানের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি। গত তিন সপ্তায় রাখাইন রাজ্যে হাজারো ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশ অভিমুখে হাজারো উদ্বাস্তুর স্রোত অব্যাহত রয়েছে।

রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের পুরো চিত্র অবশ্য বিশ্ববাসী দেখতে পাচ্ছে না। কারণ সেখানে বিদেশি সাংবাদিক প্রবেশে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে মিয়ানমার সরকার। এমনকি মানবাধিকারকর্মী, ত্রাণকর্মীরা পর্যন্ত যেতে পারছে না সেখানকার সরকারের বাধায়। তাই তো জাতিসংঘের বিশ্বখাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সেখানে ঢুকতে পারে না। তাদের খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম না থাকায় অন্তত আড়াই লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বিপদে পড়েছে। মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছে আরো অনেক মানুষ। যাদের সংখ্যা অন্তত এক লাখ ২০ হাজার। যাদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা মুসলিম। যারা ২০১২ সালের সহিংসতার পর থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাস করে আসছিল।

এদিকে একটি জাতিকে নির্মূল করার মতো মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ সামনে এনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর অবরোধ ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। ১৭ সেপ্টেম্বর সংস্থাটির পক্ষ থেকে এই আহ্বান জানানো হয়। ‘জাতিগত নিধন’ সংক্রান্ত কার্যক্রম যেন বন্ধ করা যায় সেজন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল এবং এই ইস্যুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে মিয়ানমারের ওপর কঠোর অবরোধ ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত বলে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এইচআরডব্লিউর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংস আচরণের কারণে দেশটির সেনাবাহিনী বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হচ্ছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর এমন কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ প্রয়োজন, যেন কোনোভাবেই মিয়ানমারের জেনারেলরা তা উপেক্ষা করতে না পারে। তাদের বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে বিশ্বনেতারা এই মুহূর্তে নিউইয়র্কে জড়ো হচ্ছেন। তাদের উচিত হবে মিয়ানমারে উদ্ভূত সংকট নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আলোচনা করা এবং সেখানে চলতে থাকা হত্যাযজ্ঞ ও মানবিক সহায়তা প্রদানে বাধার নিন্দা করা।’

মিয়ানমানের যেসব ব্যক্তি হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত তাদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি ও সম্পদ জব্দ করতে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে বিবৃতিতে বলা হয়। এর আগে রাখাইন রাজ্যে মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকা রোহিঙ্গা মুসলিমদের কাছে জরুরি ভিত্তিতে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার সুবিধা দিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর জাতিসংঘ, বহুজাতিক সংগঠন ও বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশকে তীব্র চাপ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সহায়তা বৃদ্ধি করার জন্যও জাতিসংঘসহ দাতাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সেই সঙ্গে এ ইস্যুতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে জরুরি ভিত্তিতে বৈঠক ডাকার আহ্বান জানায় সংস্থাটি। এর আগে রোহিঙ্গাদের ওপর এমন বর্বর নির্যাতনের ঘটনায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। পার্লামেন্টে এ সম্পর্কিত একটি রেজ্যুলেশনও গৃহীত হয়েছে।

রোহিঙ্গা সংকট উপ-আঞ্চলিক সংকটেরও একটি স্বরূপ বহন করে। এ কারণে বাংলাদেশকেও উদ্বিগ্ন হতে হয়। কারণ কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রায় ৩০ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থী বাস করছে আগে থেকেই। এটা সবার জানা যে, গত দুই দশকে আরো চার লাখের মতো রোহিঙ্গা স্থানীয় জনতার একটি অংশের সহায়তায় ভিন্ন পথে, বিভিন্ন উপায়ে এদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। তাদের মধ্যে অন্তত ১০ হাজার বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ায় গেছে। এখন আবার নতুন করে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। তাদের খাদ্য, বাসস্থান, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের সরকারের জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ। আশার কথা হচ্ছে, তাদের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি, সংস্থা, দেশ, দেশি-বিদেশি সংগঠন ত্রাণ ও অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। এক্ষেত্রে সব কার্যক্রম স্বচ্ছতার সঙ্গে করতে হবে। যে বিষয়ে জোর দিয়েছেন এবং একই সঙ্গে জাতীয় সংসদে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম না করতেও সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

ডানপন্থি হিসেবে পরিচিত এবং আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠী রোহিঙ্গা সংকট কাজে লাগিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়। সম্প্রতি এর অনেক নমুনা দেখা গেছে। তারা এই সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চাইছে। প্রথমে তারা অভিযোগ এনেছে, সরকার রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। তারপর যখন তাদের আশ্রয় দেওয়া হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে ছুটে গিয়ে আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, বুকে টেনে নিয়েছেন, তখন বলা হলো সরকার রোহিঙ্গাদের সহায়তা দিতে দেরি করে ফেলেছে। এটা সহজেই আঁচ করা যায় যে, এবারকার মতো জোরালো কোনো প্রয়োজন ছাড়া বাংলাদেশ আর কোনো রোহিঙ্গা মুসলিমকে ঠাঁই দিতে চাইছে না। কারণ ১৯৭৮ সাল থেকে এ বিষয়ে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে এখন পর্যন্ত মাত্র কয়েক হাজার রোহিঙ্গা ফেরত পাঠানো গেছে। অথচ এ দেশে লাখ লাখ রোহিঙ্গা থেকে গেছে। এবার তার সঙ্গে যুক্ত হলো আরো চার লাখের বেশি। এই সংখ্যা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তার কোনো কূল-কিনারা মিলছে না।

এবারের সহিংসতা শুরুর কারণ হিসেবে আমরা আরো একটি বিষয় সামনে আনতে পারি। ২৫ আগস্ট শুরু হয় তা। তার এক দিন আগে তথা ২৪ আগস্ট প্রকাশিত হয় রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আনান কমিশনের প্রতিবেদন। রাখাইন রাজ্যে জঙ্গিবাদের ঝুঁকি এড়িয়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ অবশ্যই তুলে নিতে বলেছে এই কমিশন। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন এটাও বলছে, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব যাচাইয়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট কৌশল ও সময়সীমা ঠিক করতে হবে, যা হবে স্বচ্ছ ও বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত রাখাইন রাজ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিশনের (যা সংক্ষেপে আনান কমিশন নামে পরিচিত) চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এই সুপারিশ করা হয়েছে। ‘রাখাইনের জনগোষ্ঠীর জন্য একটি শান্তিপূর্ণ, ন্যায্য ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে’ শীর্ষক ৬৩ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদন গত ২৪ আগস্ট কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। কমিশনের ওই প্রতিবেদন নিয়ে কফি আনান ইয়াঙ্গুনে গণমাধ্যমের সঙ্গেও কথা বলেন। এর আগে তিনি কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সুচির কাছে তুলে দেন। এর আগের দিন প্রতিবেদনের একটি কপি দেন মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট তিন কিউর হাতে। আনান কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ৮৮টি সুপারিশ করা হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে রাখাইনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মানবিক সহায়তা, লোকজনের অবাধ চলাচল ও নাগরিকত্ব আইনের বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। ধর্ম, বর্ণ কিংবা নাগরিকত্ব নির্বিশেষে রাখাইন রাজ্যের সব জনগোষ্ঠীকে অবাধে চলাচলের সুযোগ নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। গত মার্চে আনান কমিশন তাদের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন দিয়েছিল মিয়ানমার সরকারকে। প্রতিবেদন প্রকাশের পর কফি আনান তার টুইটে রাখাইনের পরিস্থিতি আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন। আনান কমিশনের প্রতিবেদনে নাগরিকত্ব প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, নাগরিকত্বের বিষয়টি রাখাইনে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে বড় বাধা। প্রসঙ্গটি বিতর্কিত হলেও এটি এড়িয়ে চলার সুযোগ নেই। বিষয়টির সুরাহা না হলে নাগরিকদের মানবিক সংকট ও নিরাপত্তাহীনতা যেমন অব্যাহত থাকবে, তেমনি তা সামগ্রিকভাবে রাজ্যের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথ আটকে দেবে। স্বল্প মেয়াদে সমস্যার সমাধান করতে হলে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুসারে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের প্রক্রিয়ায় গতি আনতে হবে। তবে ওই আইন পর্যালোচনারও সময় এসেছে।

তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কোনো দাবি-দাওয়া মানতে নারাজ মিয়ানমার। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে যেমন নারাজ, তেমনি তিনিও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের জাতিসত্তার পরিচয় অস্বীকার করে তাদের ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ হিসেবে পরিচয় করাতে চাইছেন। সুচির সরকার রোহিঙ্গা নিপীড়ন করছে বলে সারা বিশ্ব থেকেই আজকে তার নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এমনকি তা ফিরিয়ে নেওয়ার দাবিও তোলা হচ্ছে। তবে মিয়ানমারের সুচির নেতৃত্বে বেসামরিক সরকার থাকলেও রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে রোহিঙ্গা ইস্যু- সবকিছুতেই আসলে কলকাঠি নাড়ছে সেখানকার সামরিক বাহিনী। বৈশ্বিক চাপে পড়ে সুচি যাতে কোনোভাবেই বর্তমান অবস্থান থেকে সরে এসে রোহিঙ্গাদের প্রতি নরম না হন, তার জন্য অন্তরালে চাপ দিচ্ছে সেখানকার সেনাবাহিনী, যা এখন প্রকাশ্যেও আঁচ করা যাচ্ছে। তাই মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়াং বলেছেন, ‘তারা রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি দাবি করছে অথচ তারা কখনো মিয়ানমারের নৃগোষ্ঠী ছিল না। এটি বাঙালি ইস্যু। আর এই সত্য প্রতিষ্ঠায় আমাদের একতাবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের সরকারি পেজে গত শনিবার ১৬ সেপ্টেম্বর দেওয়া এক পোস্টে তিনি এ কথা বলেন। বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে ১৭ সেপ্টেম্বর বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রধান দেশটির উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত সংখ্যালঘু ইস্যুতে দেশের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। সেনাবাহিনী বলছে, রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী যে ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালিয়েছে, তার মূল লক্ষ্য ছিল গত ২৫ আগস্ট পুলিশ ফাঁড়ি ও তল্লাশিচৌকিতে সন্ত্রাসী হামলার মূল হোতাদের উৎখাত করা। অন্যদিকে দেশটির স্টেট কাউন্সিলরের পদে থাকা নোবেলজয়ী অং সান সুচি জাতিগত সহিংসতার যেকোনো অভিযোগই এককথায় নাকচ করে দিচ্ছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবার রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানই নিয়েছে।

মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা নির্যাতিত হয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা ভ‚রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই স্বার্থের কারণে ভারত, চায়না, রাশিয়া মিয়ানমারের পদক্ষেপের পক্ষেই কথা বলছে। চুপ করে আছে জাপানের মতো শান্তিকামী দেশ। এমনকি ওআইসিও প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করেনি। আমি মনে করি রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ফেরত দিতে হবে। তাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখতে হবে। নয়তো এই যে মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে চলেছে রাখাইনে, তা থামবে না। তাই সংকটের শেষ দেখতে হলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। পশ্চিমা পরাশক্তিসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, তাদের নাগরিক সমাজ (যারা মানবাধিকারকর্মী), জাতিসংঘ, আইসিআরসি এবং ওআইসি এ বিষয়ে সক্রিয় হবে। তারা আরো শক্ত অবস্থান নেবে বলে আমরা আশা করছি। আমরা চাই তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করুক। এ বিষয়ে এবার অবশ্য বিশ্বজুড়েই এক ধরনের জনমত তৈরি হয়েছে। কিন্তু সমাধানদাতারা আসলে কতটা এগিয়ে আসবে?

মোহাম্মদ জমির: সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং প্রধান তথ্য কমিশনার

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :