আমার কোনো প্রিয় শিক্ষক নেই

খালিদ মারুফ
| আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০১৭, ১৭:১৮ | প্রকাশিত : ১৬ অক্টোবর ২০১৭, ১৭:১৬

কার্যত আমার কোনো প্রিয় শিক্ষক নেই। দুই-একজনের নাম বলতে পারব, যাদের আমি শ্রদ্ধা করি। শুরুতে তাদের একজনের কথা বলে নেওয়া যেতে পারে, কেননা বাকিদের ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা নেহায়েত তিক্ত। তাঁর নাম ইছাবুর রহমান, মাধ্যমিকে বাংলা পড়াতেন, পরে শিক্ষকতা করেননি। বেশ কয়েক বছর আগে জেনেছিলাম, তিনি কোনো এক রাষ্ট্রয়াত্ব ব্যাংকে মধ্যপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত আছেন। ইছাবুর রহমান অষ্টম শ্রেণিতে আমাদের বাংলা পড়াতেন। জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতার শেষে ‘উড়ুক উড়ুক তারা শব্দহীন জোৎস্নার ভেতর’ এমন একটি লাইন আছে; সেই কবিতাটি (আমাদের পাঠ্য ছিল) পড়াতে গিয়ে তিনি আমাদের ওই কবি বিষয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। বলতে বলতে আপ্লুত হয়ে প্রায় কেঁদে ফেলেছিলেন, উনার প্রতি ‘বিশেষ শ্রদ্ধা’ আমার হয়তো আমৃত্যু থেকে যাবে।

প্রাইমারি স্কুলে সিদ্দিক সাহেব নামক জনৈক হেড মাস্টার ছিলেন। তিনি আমাকে বলতেন, ‘তোর বাপেরা (মুক্তিযোদ্ধারা) যুদ্ধের সময় খুলনায় বিহারিদের গুলি করে মেরেছে।’ বাপের নামে এমন অভিযোগ শুনে কান্নায় আমার গলা আটকে যেত। আমার পিতা তখন বাড়িতে অনিয়মিত ছিলেন, জীবিকার প্রয়োজনে নানা জায়গায় ঘুরতেন। আমি তার ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকতাম। সেবার ফেরার পর আমি তাকে বলেছিলাম হেড মাস্টারের কথা। পিতা আমাকে ভাবলেশহীনভাবে বলেছিলেন, ‘ছিদ্দিক সাহেব রাজাকার ছিল, ওর কথায় কান দিয়ে কাজ নেই।’

মাধ্যমিকেই, সম্ভবত ১৯৯৮ সালের বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একটা মেয়ে (আমাদের জুনিয়র) রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতাটি আবৃত্তি (মুখস্ত পাঠ) করছিল। কবিতাটি পাঠের মাঝ পর্যায়ে স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক (নামটা বলছি না) চিৎকার দিয়ে মেয়েটিকে থামাল, জিজ্ঞেস করল, ‘এই কবিতা তুই কোথায় পাইছিস?’ মেয়েটা কাঁদো-কাঁদো গলায় জানাল, ‘ভাইয়া দিসে’ ওর ভাইয়া বলতে একজনকে আমরা চিনতাম, যে একদা রাজনীতি করত। গ্রামে তাকে দু’একবার দেখেছি, ভীষণ হ্যন্ডসাম, খুঁড়িয়ে হাঁটত। শুনেছিলাম হল দখলের লড়াইয়ে প্রতিক্রিয়াশীল মিলিট্যান্ট ছাত্র-সন্ত্রাসীরা তার একটি পা কেটে নিয়েছিল। তো-সহকারী প্রধান শিক্ষক মেয়েটার হাত থেকে মাইক্রোফোন ছিনিয়ে নিয়ে অপমান করে মঞ্চ থেকে তাড়িয়ে দেন।

আজ কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র জন্মদিন। মূলত কবি ফরিদ কবিরের স্ট্যাটাস দেখে ভেবেছিলাম, রুদ্র’র প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছু একটা লিখব, শেষ পর্যন্ত এই লিখলাম। রুদ্র’র সেই সর্বজন পঠিত কবিতাটির কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করছি- ‘বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে, মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ। এই রক্তমাখা মাটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো, জীর্ন জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আঁধার। আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়। ...

.... এ-চোখে ঘুম আসে না। সারারাত আমার ঘুম আসে না_ তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার, নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ, মুণ্ডুহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বীভৎস শরীর ভেসে উঠে চোখের ভেতরে_আমি ঘুমুতে পারি না, আমি ঘুমুতে পারি না...’

লেখক: কথাসাহিত্যিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :