রাত (সন্ধ্যা) ৮টায় বন্ধ হয়ে যাবে টিএসসি!

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ২১ অক্টোবর ২০১৭, ২১:৫৫

বিশ্ববিদ্যালয় কেন কলেজ বা স্কুল থেকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভিন্ন প্রকৃতির? শুধুমাত্র উচ্চশিক্ষা কিংবা গবেষণামূলক কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজের বিশেষত্ব অর্জন করেনি। বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ক্লাস-পরীক্ষা কিংবা গবেষণার জায়গা নয়। আগে বলা হত, এক্সট্রা- কারিকুলাম এক্টিভিটি, ইদানিং বলা হয় কো-কারিকুলাম। খেলাধুলা, গান-বাজনা, অভিনয়, বিতর্ক, চলচ্চিত্র চর্চা, রক্তদানসহ নানা জনকল্যাণমূলক কাজ অর্থাৎ স্বেচ্ছাশ্রম ও সেবা ইত্যাদি কর্মসূচিকে এখন একাডেমিক পড়াশুনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই সারা বিশ্বে ধরা হয়। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক্ষেত্রে এক বিরল ইতিহাসের অধিকারী। একটি রাষ্ট্রের জন্ম প্রক্রিয়ায় সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক জ্বালানী সরবরাহ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম বিশেষ স্থান দখল করেছে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এ কৃতিত্বের দাবিকার করতে তাঁর যে অংশটি অন্যতম শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছে সেটি হল ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র তথা টিএসসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশালত্ব পূর্ণরূপে অনুধাবন করতে গেলে টিএসসিকে মনে ও মগজে ধারন করতে হবে। টিএসসি নিয়ে এত কথা বলার দরকার ছিল না। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের সচেতন মানুষ নতুন ইস্যু হিসেবে টিএসসি নিয়ে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়েছে। রাত ৮ টার মধ্যে টিএসসি বন্ধ হয়ে যাবে, এমন একটা নোটিশ নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

একদিকে কর্তৃপক্ষ বলছে, রাত ৮ টার মধ্যে টিএসসি বন্ধ করে দেয়া হবে, অন্যদিকে ছেলে-মেয়েদের একটি অংশ প্রকাশ্যেই দাবি তুলেছে, রাতের পুরো সময় টিএসসি খোলা রাখতে হবে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের আলোকে আমার মনে হয়, দুই পক্ষকে একটা মাঝামাঝি অবস্থানে আসতে হবে। কারণ টিএসসি রাত ৮ টায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার জায়গা নয়, আবার পুরো টিএসসি সারারাত খোলা রাখার জায়গাও নয়।

দু একজন আবেগে ভেসে গিয়ে সারারাত টিএসসিতে আড্ডা মারার স্মৃতিচারণ করছেন বটে। কিন্তু এরা ভুলে যাচ্ছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের হলগুলোতে রাত ১০ টায় প্রবেশ করার একটি নিয়ম আছে এবং এ নিয়মটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা প্রায় শতভাগ মেনে চলে। মেয়েদের হলের গেইট বন্ধ হবে ১০ টায়, আর টিএসসি সারারাত খোলা থাকবে? যাইহোক, সারারাত টিএসসি খোলা রাখার দাবি দুই একটি সংগঠনের ক্ষেত্রে যুক্তিযুক্ত। আমার সাথে যে কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বিনে পয়সায় লাখ লাখ মানুষকে রক্তসেবা দিয়ে মানবসেবার অনন্য নজির স্থাপন করা বাঁধন আর বিশ্ববিদ্যালয় তথা দেশকে অবিরাম তথ্যসেবা দিয়ে যাওয়া সাংবাদিক সমিতি ছাড়া অন্য কোনো সংগঠনের সারারাত টিএসসিতে থাকার কোনো কারণ বা দরকার নেই। বাঁধন মানুষের জীবন নিয়ে কাজ করে। জীবন কখন মৃত্যুর মুখোমুখি হবে, কেউ জানে না। সাংবাদিক সমিতির ক্ষেত্রেও বলা যায়, সাংবাদকিতা একটি চব্বিশ ঘণ্টার প্রফেশন। সময় নির্দিষ্ট করে দিয়ে সাংবাদিকতাকে বেধে রাখা যায় না।

অন্যদিকে, প্রশাসনের উল্লেখিত সময় অর্থাৎ রাত ৮ টাও একেবারেই অযৌক্তিক। ৮ টায় কেবল সন্ধ্যা হয়। ডিবেটিং সোসাইটি, ফিল্ম সোসাইটি কিংবা গান, কবিতা আবৃত্তি এবং নাট্যচর্চার সংগঠনগুলো বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের কর্মকাণ্ড শুরু করে বিকেল থেকে। ছেলে-মেয়েদের কেউ টিউশনি করে, কেউ করে পার্টটাইম জব। তাছাড়া দিনের ক্লাস-পরীক্ষা শেষ করে টিএসসিতে আসতে আসতে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বিকেল হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে একটি নাটক কিংবা গানের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিতে গেলে রাত (সন্ধ্যা) ৮ টা খুবই আর্লি হয়ে যায়। আর টিএসসি শুধুমাত্র যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী বা শিক্ষকদের সেবা দেয় তা নয়। সাবেক ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের জামাই, বউ ও পরিবারবর্গ নিয়ে ঘুরতে আসে।

তাছাড়া জন্মলগ্ন থেকে ঢাকার নিম্ন, নিম্ন মধ্য ও মধ্যবিত্তের সিভিলিয়ানদের জন্য টিএসসি ভবন ও এরিয়া একটি বিশেষ বিনোদন ও শিক্ষামূলক স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এখানে আসলে একটা না একটা গানের বা কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান থাকেই। হয়তো কোনোদিন গণসঙ্গীতের আসর বসে, কোনোদিন হয়ত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা আবৃত্তি হয়। কোনোদিন হয়ত পার্থ বড়ুয়া কিংবা জেমস গান গাইতে আসেন। কোনোদিন হয়ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ বাজে। আমাদের বাচ্চারা সেসব শুনে নিজের সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারনা পায়, নিজেদের স্বকীয় অস্তিত্ব টের পায়। এমনিতে বাসা-বাড়িতে ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলের কার্টুন বা গান-বাজনা শোনে-দেখে সময় কাটে তাদের। টক-শো নির্ভর আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলের দিকে ফিরেও তাকায় না এরা।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি কী সৃষ্টি করতে পারে তাঁর একটি উদাহরণ দিই। হুমায়ুন ফরীদিকে নিশ্চয় সকলে চেনেন। বাংলা টিভি ও মঞ্চ নাটক এবং চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একজন কিংবদন্তী। তিনি কিন্তু নাটকের ছাত্র ছিলেন না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র। অর্থনীতি বিভাগ থেকে নিশ্চয় অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি জন্ম নেননি। অভিনেতা ফরীদিকে জন্ম দিয়েছে ক্যাম্পাস, বিশেষ করে বললে টিএসসি। এভাবেই দেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে শত শত গানের শিল্পী বের হয়েছে। শক্তিশালী অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বের হয়ে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। বড় বড় বিতর্ক শিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, ডকুমেন্টারি মেকার, সাংবাদিক, স্বেচ্ছাসেবক বের হয়েছে টিএসসিসমূহ থেকে। আবার টিএসসিতে শুধুমাত্র যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরাই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করে থাকে তা নয়। বাইরের অনেকে নিজেদের প্রতিভা বিকাশের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে টিএসসিকে বেছে নেয়।

রাত ৮ টার মধ্যে টিএসসি বন্ধ করে দেয়ার যে সিদ্ধান্ত প্রশাসন নিয়েছে সেটি যৌক্তিক নয়। টিএসসি যদি রাত (সন্ধ্যা) ৮ টায় বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্ধকার নেমে আসবে। এই অন্ধকার শুধু রাতের অন্ধকার নয়, সাংস্কৃতিক অন্ধকার। টিএসসিতে আলো নিভে গেলে পুরো দেশের সাংস্কৃতিক আলো নিভে যেতে পারে। বাংলাদেশে যেভাবে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে, যেভাবে মেধাবী ছেলে-মেয়েরা শুধু সরকারি চাকরির দিকে ঝুঁকছে সেখানে এই টিএসসিগুলো হতে পারে জাতির সাংস্কৃতিক বাতিঘর। কিন্তু রাত ৮ টায় বন্ধ হয়ে গেলে, কিংবা কোনোদিন যদি পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ হয়ত কোনোদিনই নির্মাণ করা যাবে না।

উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় রাত ১০ টার মধ্যে সংগঠনগুলো টিএসসির স্ব স্ব অফিস তালা মেরে দিবে, এমন একটি সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে। রাত ১০ টা একেবারে কম নয়। হলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে সকালের ক্লাস-পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে বসতে বসতে রাত ১২ টা বেজে যাওয়ার কথা। ১২ টা বেজে গেলে সকাল হতে আর বাকি থাকে আর কয় ঘণ্টা। এরপরেও কারও গান গাইতে ইচ্ছে করলে, কবিতা আবৃত্তি করতে মন চাইলে, অভিনয়টা একটু প্র্যাকটিস করে নিতে মন চাইলে নিজের রুম, ছাদ, বারান্দা কিংবা হলের ভেতরে লন, বাগানতো আছেই।

আর ছেলেরা যে ক্যাম্পাসে একটু বেশি সুবিধা ভোগ করে সেটি তো বলাই বাহুল্য। সকালে ক্লাস পরীক্ষা আছে জেনেও অনেক ছেলে সারারাত হলের বাইরে থাকে, হলে থাকলেও নিজ কক্ষে নয়, ছাদে থাকে। কখনো বৃষ্টিতে ভেজে, কখনো দল বেঁধে গান গায়, আড্ডা দেয়। আমি নিজেও ছাত্রজীবনে এদের দলে ছিলাম। মেয়েদের হলগুলো অবশ্য এত বড় আর সুন্দর যে, রাস্তায় বের হয়ে বাউল-ফকিরের জীবন যাপন করার দরকার তাদের পড়ে না। তাছাড়া আমাদের মত বাউল স্বভাব মেয়েদের মধ্যে একটু কমই থাকে। জীবন-সংসার নিয়ে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা একটু বেশি সিরিয়াস থাকে বলেই দেখেছি এবং জেনেছি।

তবে টিএসসিসমূহে যে শতভাগ প্রগতিশীল কাজই হয়, সেটি বলার সুযোগ রাখেনি ভেতরের ও বাইরের কিছু বখাটে ছেলে-মেয়ে। সংখ্যায় এরা খুব কম হলেও এদের দেখে বাইরের মানুষ মনে করে সবাই বুঝি এদের মত। কোনো কোনো ছেলে-মেয়ে শরীর নির্ভর ‘প্রেম’, পরকীয়া, মাদকসেবনের জন্য টিএসসিকে বেছে নেয়। এদের ব্যাপারে সবাইকে অবশ্যই কঠোর অবস্থান নিতে হবে। প্রশাসন এদের ব্যাপারে বরং কঠোর হতে পারে। টিএসসিকে মাদক ও বখাটে মুক্ত করতে পারে। মাদকাসক্তকে ধরে পুলিশে দিতে পারে। ধূমপানের জন্য বিশেষ জায়গা নির্ধারণ করতে দিতে পারে। কারণ টিএসসিতে অধূমপায়ীর সংখ্যাই বেশী।

লেখকঃ সাবেক শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :