সরকারি আইন কর্মকর্তা

সাবিহা ইয়াসমিন ইসলাম
 | প্রকাশিত : ২৪ অক্টোবর ২০১৭, ১৪:০০

সুপ্রিম কোর্ট এর ঐক্য নিয়ে এর আগেও আমি আমার একটি মতামত প্রচার করেছি। খুব একটা যোগ্যতার বলে আমি আমার মতামত প্রচার করি এটা বলা যাবে না বরং আমার পেশা, আমার বিচারাঙ্গন, আমার সহযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর মমত্ববোধ থেকে তাড়িত হয়ে মতামত প্রকাশ করি অথবা দুঃসাহস প্রদর্শন করি।

এবার আমার বিচারাঙ্গনের (সুপ্রিম কোর্ট) বহুল আলোচিত বা বিতর্কিত(?) একটি বিষয় নিয়ে মতামত প্রকাশের দুঃসাহসিক কাজটি করতে বিবেকের তাড়না অনুভব করছি।

প্রসঙ্গত, অতি সম্প্রতি কিছু সরকারি আইন কর্মকর্তা নিয়োগ–

প্রথম দিনই আইন কর্মকর্তার নামের তালিকায় কিছু আইনজীবীদের নাম দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়েছি। আমার ধারণা ছিল এই বিস্ময় শুধু হয়তো আমার একার। কারণ আমি স্রোতের বিপরীতে চলা একজন মানুষ। কিন্তু পরের দিন কোর্টে গিয়ে দেখি আনেকেই এই নিয়োগ নিয়ে হতাশ, অসহিষ্ণু, অসন্তুষ্ট এবং বিরূপ বা বিকৃত সমালোচনায় মত্ত। যারা নিয়োজিত হয়েছেন তাদের সঙ্গে আন্তরিক আলাপ করে কথা প্রসঙ্গে জেনেছি- আমাদের আইনাঙ্গনের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন চারজন বিশিষ্ট নেতা, আমাদের মুরুব্বি, আমাদের পথপ্রদর্শক, আমাদের আস্থার একান্ত স্থল– তাঁদেরই একান্ত আস্থাভাজন হয়ে ছয়জন করে মোট ২৪ জন যোগ্যতম আইনবিদ সরকারি আইন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। সরকারি আইন কর্মকর্তাদের নামের তালিকা দেখে মনে যে বিস্ময় ভাব জাগ্রত হয়েছিল এই বক্তব্য শোনার পর নিজেই নিজের কাছে বিভ্রান্ত হই! সেই বিভ্রান্ত মন নিয়েই সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনের মিলনায়তনে একটি বিশেষ সভায় অন্য সব আইনজীবীদের সঙ্গে মিলিত হই। সেখানে মঞ্চে উপবিষ্ট আমাদের পরম শ্রদ্ধেয়, একান্ত নির্ভর আশ্রয়স্থল, আমাদের পথ প্রদর্শক নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে সরকারি আইন কর্মকর্তাদের নিয়োগের বিষয়ে ক্ষোভ, উষ্মা, অসন্তোষ প্রকাশ পায়, তাঁদের মতে এই নিয়োগে অন্তত ছয় থেকে সাতজন বিতর্কিত আইনজীবী নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। অবাক করা কথা। নিয়োগপ্রাপ্তদের মুখে যাঁদের বিজ্ঞতামূলক বিবেচনার ফসল হিসেবে তাঁরা নিয়োজিত হয়েছেন বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে আবার সেই পরম শ্রদ্ধাভাজন তাঁদের কণ্ঠেই বিতর্কিত নিয়োগ নিয়ে উশ্মা প্রকাশ করতে শুনছি! বিভ্রান্তকর বিষয়। কে কোন বিষয়ে বিতর্কিত খুব স্পষ্ট করে প্রকাশ না হওয়াতে বিতর্কের বিষয়টি আমার বোধগম্য হয়নি। নিয়োজিত হয়ে যাওয়ার পর বিতর্কিত নিয়োগের বিষয়টি আবিষ্কৃত হওয়ার বিষয়টিও বোধগম্য নয়।

কিন্তু নিয়োগপ্রাপ্তদের তালিকা দেখে আমার বিস্ময় ছিল অন্য কারণে যে– কিছু কিছু নিয়োগ হয়েছে যোগ্যতার বিচারে একদম নবীন যারা (সুপ্রিম কোর্টের সদস্য পদে সবেমাত্র যাদের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে, সর্বনিম্ন যোগ্যতার মাপকাঠি অন্তত পাঁচ বছর বারের সদস্য পদ ধারন) এরকম কয়েক জনের নাম তালিকাতে দেখে। বিস্ময়ের কারণ- তাঁরা যথেষ্ট কর্মদক্ষ, চৌকস, আধুনিক প্রযুক্তি দক্ষ বলে। তাঁদের দক্ষতা এতো তাড়াতাড়ি কোর্টের কক্ষ বন্দি না করে স্বাধীন ভাবে তাঁদের দক্ষতা প্রকাশের আরও সুযোগ দেয়া যথাযথ ছিল বলে মনে হয়েছে। বার নির্বাচনের নিবেদিত কর্মী হিসেবে, দলীয় অনুষ্ঠানে তাঁদের সক্রিয় অংশ্রহণ বা নির্বাচনে দলীয় চিন্তা চেতনার ও উপরে উঠে বিশেষ বিশেষ প্রার্থীর জন্য একান্ত নিবেদিত হয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাঁরা যে দক্ষতা প্রকাশ করে আসছে তাঁদেরকে সেই দক্ষতা প্রকাশের আরও সুযোগ দেয়া প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয়েছে। দিনে দিনে তাঁদের দক্ষতা পরিপূর্ণ হতো, পরিপক্ক হতো, বিকশিত হতো, গ্রহণীয় হতো। পরিপূর্ণতায় তাঁদের নিয়োগগুলো নিঃসন্দেহে গ্রহণীয় এবং নন্দিত হতো সার্বজনীনভাবে। বয়সে বা পেশায় নবীন যারা তাঁদের এতো তাড়াতাড়ি বিদ্বেষের রোষাণলে ফেলে দিয়ে কর্মক্ষেত্রে যেমন তাঁদের শত্রু সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা হয়েছে অপরদিকে দলীয় কোন্দল উসকিয়ে দিয়ে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বিভাজন তৈরির ও সহায়ক হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। বিস্ময় আমার সেই কারণে।

অন্যদিক বিবেচনায় দলীয় শতশত নিবেদিত জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আছেন যারা আট বছর ধরে অপেক্ষায় আছেন এমনি একটি বিবেচনামূলক নিয়োগের। দক্ষতার বিবেচনাতে উপযুক্ত থাকলেও প্রকাশের আধুনিকতায় পিছিয়ে থাকায় অপ্রকাশিত বা অবিবেচিত হয়ে নিঃশব্দ অভিমানে কর্মদক্ষতা প্রকাশে দিনে দিনে পিছিয়ে পড়ছেন, হতাশ হচ্ছেন, যা দলের জন্য শুভকর কিছু নয় বলে মনে হয়েছে। অনেকের মুখে বলতে শুনেছি ১০/১৫/২০/২৫ বছর এই অঙ্গনে পার করছি, দলের জন্য কাজ করে আসছি, ইলেকশন করেছি, ইলেকশনে বার বার জিতেছি তারপরও কোনো দলীয় মূল্যায়ন হয়নি এখানে।

বিশেষ বিশেষ দক্ষতার বিবেচনাতে অদক্ষ হওয়ায় পারদর্শিতার বিবেচনায় পারদর্শী হয়েও সবার পক্ষে উচ্চতর শিখরে বা নেতৃত্বের সর্ব উচ্চ শিখরে আহরণ সম্ভব হয় না। যেসব দক্ষ, বিজ্ঞ, জ্যেষ্ঠ সৌভাগ্যবান পরম শ্রদ্ধেয়জন সেই সব উচ্চতর শিখরে আসীন আছেন তাঁরা তাদের আসনের তুলনায় নিম্নতর আসনগুলোকে দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আসন হিসেবে বিবেচনা করে যোগ্যতার সঙ্গে সঙ্গে জ্যেষ্ঠতাকে প্রাধান্য দিলে পদটির গুরুত্ব বেড়ে যায়, যে নিবেদিত জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তি সেখানে পদায়িত হবেন তিনি সম্মানিত বোধ করবেন, নিবেদিত বিজ্ঞ কনিষ্ঠজন জ্যেষ্ঠজনদের সম্মান করতে শিখতে বাধ্য হবেন, বড়দের জন্য আত্মত্যাগ করতে শিখতে বাধ্য হবেন। বিজ্ঞ জ্যেষ্ঠরা বিজ্ঞ কনিষ্ঠজনদের স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করে পর্যায়ক্রমে উপরে তুলে ধরতে আন্তরিক সহায়তা করবেন। আবেগ তাড়িত না হয়ে বিবেচনাকে প্রাধান্য দেয়াই দলীয় স্বার্থে একান্ত বিবেচ্য বলে মনে হয়েছে।

কোর্ট প্রাঙ্গণে ব্যক্তি কোন্দল বা দলীয় কোন্দলের নিরসন হয়তো এই পদ্ধতিতেই নিহিত আছে। দলীয়ভাবে সামগ্রিক বা সার্বজনীন বিবেচনাতে ‘বার’গুলোতে সম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার হয়তো সেটাই এখন একমাত্র উপায়।

আবেগ নয় বিবেচনা আর বিবেক আগে।

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, সাবেক প্রেসিডেন্ট, রোটারি ক্লাব, ঢাকা পূর্বাশা

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :