বিরল ব্যতিক্রম সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা কোনটি? অনেকে বলবেন, জনসংখ্যার আধিক্য। আমি মনে করি, এক নম্বর বাধা হলো দুর্নীতি। দুর্নীতি থেকেই সমাজের নানা ক্ষেত্রে, নানা পর্যায়ে অব্যবস্থাপনা ও অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে। তবে অধিক জনসংখ্যার সাথে দুর্নীতির একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। একদিকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, অন্যদিকে সীমিত সম্পদের ফলে দেশের মানুষের মধ্যে সবাইকে পেছনে ফেলে একা একা ‘বড়লোক’ হওয়ার প্রবণতা দুর্নীতির মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। লোভের কাছে, সীমিত সুযোগ-সুবিধার জন্য, নৈতিকতার পরাজয় ঘটছে।
জনগণের করের টাকা চুরি করে ‘বড়লোক’ হচ্ছে একশ্রেণির রাজনীতিবিদ, আমলা, ঠিকাদার, প্রকৌশলী ও ব্যবসায়ী। এই কালো টাকার মালিকদের দালালি করে কাঁচা টাকার মুখ দেখছে সমাজের অন্যান্য পেশা ও শ্রেণির মানুষের একটা অংশও। দুই নম্বর লোকেরা যোগসাজশে তৈরি করেছে দুর্নীতি ও কালো টাকার এক সিন্ডিকেট। ফলে মূলধারার সাধারণ মানুষ দুর্নীতির দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। আবার এটাও সত্যি যে, দুর্নীতি-পরায়ণ সমাজে লোভের লাভাস্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে দেশের অনেক মানুষ দেশপ্রেম ও নিষ্ঠার শান্তি-মশাল জ্বালিয়ে রেখেছেন। এখন পর্যন্ত যে দুটি শ্রেণির সততা ও নিষ্ঠা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনি, তারা হলেন দেশের কৃষক ও শ্রমিক সমাজ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীনের পর নানা ভাষণে বলেছেন, দেশের কৃষক-শ্রমিক দুর্নীতি করে না।
তাহলে দুর্নীতিতে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয় কীভাবে? জাতির পিতা তাঁর একাধিক ভাষণে বলেছেন, রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে থাকা শিক্ষিত মানুষই এদেশে দুর্নীতি করে কালো টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছে। জাতির পিতা শিক্ষিত শ্রেণির ঘুষখোর আর চোরাকারবারিদের ডাকতেন ‘ভুঁড়িওয়ালা’ বলে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা দেখে যেতে পারেননি। আমরাও আমাদের জীবনে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখে যেতে পারব কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। জাতির পিতার হত্যার পর দীর্ঘ সামরিক শাসন বাংলাদেশকে অনেক পিছিয়ে দেয়। তবু বাংলাদেশ থেমে যায়নি। বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। এই অগ্রযাত্রায় সবচেয়ে বেশি অবদান দেশের কৃষক ও শ্রমিক সমাজের। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
একটানা সবচেয়ে বেশি সময় দেশ পরিচালনাকারী নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে দিয়েছেন। একটি দুর্নীতিমুক্ত কল্যাণধর্মী সমাজ গঠনের সংগ্রামে শেখ হাসিনা যে কজন সৎ ও নিষ্ঠাবান সাথী পেয়েছেন তাদের একজন আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। শেখ হাসিনা যেমন জাতির পিতার যোগ্য কন্যা হিসেবে দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন, আশরাফুল ইসলামও মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করা সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে হিসেবে নামের প্রতি সুনাম অক্ষুণ্ন রেখেছেন। শেখ হাসিনার হাতকে বরাবরই শক্ত করেছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওবায়দুল কাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বন্দনায় মেতেছিল দেশবাসী। জনসম্মুখে খুব একটা না এসে তুলনামূলক আড়ালে থেকেও জনমানুষের ভালোবাসা ও আস্থা অর্জন করা যায়, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। খুব সম্প্রতি আশরাফুল ইসলামের স্ত্রী শীলা ইসলামের মৃত্যুতে মানুষ ভালোবেসে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। শীলা ইসলামের পরকালের শান্তি কামনায় প্রার্থনারত দেশবাসীর সামনে একটি বিষয় এসেছে। সদ্যপ্রয়াত স্ত্রী শীলা ইসলামের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিজের বাড়ি (?) বিক্রি করে দিয়েছেন আশরাফুল ইসলাম, এ রকম একটা খবর মানুষ খ্যাত-অখ্যাত অনেক অনলাইন নিউজপেপারে পড়েছে। তবে আশরাফুল ইসলামের খুব কাছের বা নিশ্চিত জানেন বলে দাবি করে কয়েকজন ফেসবুকে লিখেছেন, আশরাফুল ইসলামের বাড়িই ছিল না যে তিনি বিক্রি করবেন!
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করা বাংলাদেশি তরুণ পদার্থবিজ্ঞানী ও ব্লগার মোফাজ্জল হোসেন সুমন ফেসবুকে লিখে জানিয়েছেন, ‘সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একজন বিরলপ্রজাতির মানুষ। তার ব্যক্তিগত কোনোপ প্লট নাই। ফেইসবুকে একটি তথ্য যেভাবে ভাইরাল হয়েছে, এমনকি সংগৃহীত সেই স্ট্যাটাসটি আমি নিজেও পোস্ট করেছি। তাতে মনে হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম-এর বনানীতে একটি বাড়ি ছিলো এবং সেটি তিনি বিক্রি করেছেন। এই তথ্যটি বিভ্রান্তিকর। তাই এই স্ট্যাটাসটির অবতারণা করতে হলো এবং পুরো দায়ভার নিয়েই লেখাটি লিখছি। চারবারের সংসদ সদস্য হিসেবে সরকারী প্লট এবং শুল্কমুক্ত গাড়ি ক্রয়ের সুবিধা আইনগতভাবেই পান তিনি। কিন্তু কোন প্লট নিয়েছেন কিংবা গাড়ি কিনেছেন বলে আমরা জানি না। যদিও প্লট নেয়া কিংবা গাড়ি কেনার বিষয়টি অসততার মধ্যেও পড়ে না। তবুও তিনি এসব সুবিধা গ্রহণ করেননি। আশরাফ ভাইয়ের সম্পত্তি বলতে কিশোরগঞ্জ সদর থানার যশোদল ইউনিয়নের যশোদল গ্রামে ১৫ শতাংশ জমির উপরে একটি পৈতৃক বাড়ি এবং ময়মনসিংহের কলেজ রোডে ৮ শতাংশ জমির উপরে একতলা বাড়ি। আর জাতীয় চার নেতার নামে সরকার ১০ কাঠার প্লট দিয়েছিল গুলশানে। বাড়ি করার সময় সেটা চার ভাই দুই বোনের ভিতরে উনি পেয়েছিলেন দুই শতাংশ জমি। বাড়ি করার জন্য যখন প্রত্যেক ভাই-বোনেরা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দিচ্ছিলেন তখন উনার কোন টাকা না থাকার কারণে দুই কাঠা জমি বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ৮০ লাখ টাকা ঋণ নেন।
‘পরবর্তিতে ভাবির (শীলা ইসলামের) অবস্থা জটিল হলে সেই জমি ভাইদের কাছে বিক্রি করে দিয়ে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেন এবং ভাবির চিকিৎসা বাবদ খরচ করেন। এমনকি পরবর্তিতে লন্ডন থেকে জার্মানি নেওয়ার জন্য ১২ লাখ টাকার প্রয়োজন ছিল, সেই টাকা উনার কাছে ছিলো না। উনি দুবার টিকিটের তারিখ পরিবর্তন করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এটা জানার পর উনার নিজের একাউন্ট থেকে ১২ লাখ টাকা দিতে চান কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানতেন এমনিতে দিলে আশরাফ নিবেন না তাই তিনি বলেন, "টাকাটা আমি তোমাকে বোন হিসেবে ধার দিচ্ছি, তুমি পরে শোধ করে দিও। এই হচ্ছেন আমাদের শ্রদ্ধেয় আশরাফ ভাই, সততা আর ন্যায়ের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।’
মফস্বলের সামান্য কিছু সম্পত্তি ছাড়া আশরাফুল ইসলামের ঢাকায় বা লন্ডনে কোনো বাড়ি নেই? অবিশ্বাস্য! ঢাকায় আওয়ামী লীগ-বিএনপির যারা ওয়ার্ড কমিশনার তাদেরও কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি থাকে। অসৎ রাজনীতিবিদ ও আমলাদের একাধিক বাড়ি-গাড়ি থাকে। নামে-বেনামে একাধিক ব্যাংক একাউন্ট থাকে। দেশে বাড়ি-গাড়ি করার পর শুরু হয় বিদেশে পাচার। লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে এরা। কালো টাকার মালিকরা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়ে শিল্পপতি বনে যায়। সমাজ আবার তাদেরই মাথায় তোলে নাচে। অথচ আশরাফুল ইসলাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, একাধিকবার এমপি ছিলেন, এখনো একটা মহাগুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় সামলাচ্ছেন। বাংলাদেশের দুর্নীতি পরায়ণ শিক্ষিত সমাজের বিপরীতে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যেন সততার এক দেদীপ্যমান বাতিঘর।
রাজনীতি এখন সৎ মানুষের জন্য কঠিন হয়ে গেছে। হাজার কোটি টাকার মালিক না হলে এখন সাধারণ মানুষও কাউকে পাত্তা দিতে চায় না। ব্যবসায়ীরা শত শত কোটি টাকা অনুদান দিয়ে নমিনেশন কিনে নিচ্ছে। অথব রাজনীতিবিদরা কালো টাকার মালিক হয়ে বড় শিল্পপতি (?) বনে যাচ্ছেন। এমন কঠিন সময়ে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আমাদের রাজনীতির অন্যতম ভরসার ব্যক্তিত্ব। সমাজে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস আর অনাস্থার সম্পর্ক। কিছু মানুষ ক্রমাগত সম্পদ লুটে চলেছে। জাতির পিতা সমতার ভিত্তিতে যে সমাজ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, তা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তদুপরি বিলাসের আমলাতন্ত্র যেকোনো সময়ের চাইতে শক্তি অর্জন করেছে। নির্দিষ্ট কয়েকটি শ্রেণির মানুষ ছাড়া সাধারণ মানুষের জন্য রাষ্ট্র গণসুবিধা নিশ্চিত করতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিবছর শিক্ষিত তরুণ-তরুণী উপহার দিচ্ছে। তারাই প্রশাসনে যাচ্ছে, কিন্তু দুর্নীতি কমছে না খুব একটা।
এরপরেও বাংলাদেশ অগ্রসর হচ্ছে। কৃষক-শ্রমিকের শ্রমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়মিতভাবে সাতের কাছাকাছি থাকছে। কিন্তু সবাই যদি যার যার কাজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মতো নির্লোভ, আন্তরিক, সৎ ও কঠোর পরিশ্রমী হতেন, তাহলে বাংলাদেশই হতো বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ ও উন্নত রাষ্ট্র।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক।